সমাজ-ইতিহাস-অর্থনীতি ও দর্শনের নানা প্রশ্ন সারাজীবন অম্লানের মন আলোড়িত করেছে, খুঁজেছে উত্তর। শুভবুদ্ধি যখন বিপন্ন, চারদিকে মানুষ তার ভবিতব্য নিয়ে উদ্বিগ্ন, অম্লান তখন তার বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন একজন নৈতিক সংগ্রামী হিসেবে।
Published : 14 Jan 2024, 04:24 PM
প্রায় এক যুগ আগে ওপার বাংলার এক তরুণীর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়, চিত্রশিল্পী সেই তরুণীটির সঙ্গে ফোনে কথা হতো প্রায়ই। একদিন সে জানালো, আমার কথা শুনে তার দিদিমা খুব কেঁদেছেন। খুব অবাক হই, প্রতিবেশী দেশের ৯০ বছর বয়সী অচেনা দিদিমা আমার জন্য কেন কাঁদবেন? বন্ধু জানালো, আমার জন্মবাড়ি কুমিল্লা— এ কথা শুনেই তিনি স্মৃতিবিধুর হয়েছেন। কুমিল্লার বাগিচাগাঁও নিবাসী দিদিমার পরিবারটি ১৯৪৭ সালে দেশান্তরিত হয়।
সেই দিদিমাই কথায় কথায় জানালেন, কুমিল্লার বাগিচাগাঁওয়ের আরেক দত্ত পরিবারের সন্তান অর্থনীতিবিদ অম্লান দত্তের কথা, থাকতেন সল্টলেকে। থাকতেন? হ্যাঁ, বছর দুই হলো মারা গেছেন। একটা মানুষকে চেনার আগেই তিনি গত হলেন, ব্যাপারটা খুব বিঁধল। তবু ইউরোপীয় আধুনিকতার ছাঁচে তৈরি অর্থনীতির নানা শিক্ষাক্রমের ভেতর বাস করে এমন বাংলাভাষী বিদ্বৎসমাজ বা লারনেড সোসাইটির এক জ্যেষ্ঠ সদস্যের খোঁজ পেয়ে বড় আনন্দ হলো।
তারও কয়েকবছর পরের কথা। বইপত্রের জন্য তখনও আমার যাতায়াত ছিল নীলক্ষেত ইসলামিয়া মার্কেটে পুরনো বইয়ের দোকানগুলোতে। একদিন শাহজাহান বুক শপ কিংবা মোস্তফা বইঘরে পেয়ে গেলাম আনন্দ পাবলিশার্সের প্রথম সংস্করণে অম্লান দত্তের বই ‘বিকল্প সমাজের সন্ধানে’ (১৯৯৪)। প্রথমেই দেখে নিলাম পেছনের ফ্ল্যাপে তার ছবিসহ লেখক পরিচিতি, প্রথমবারের মতো এ কীর্তিমানের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ। হোক না বইয়ের মলাটে, কিন্তু কাঁটাতার পেরিয়ে মানচিত্র বদলে যাওয়ার কথাকৃতিতে আমরা যেন সন্ধান পেলাম সহোদরের। শেকড় ছেঁড়ার ৭৬ বছর পরও ফ্ল্যাপের সাদাকালো ছবিতে পুরু চশমার ভেতর তার দীপ্তিমান চোখ দুটো যেন নিটোল মমত্ববোধে কাছে ডাকে।
তারপর নানা সময়ে তার আরও কিছু বই আমি সংগ্রহ করি, যেমন ‘শান্তির সপক্ষে’, ‘সাম্যবাদের সংকট ও অন্যান্য রচনা’, আরতি সেন ও গৌরকিশোর ঘোষের সম্পাদনায় দুই খণ্ডে তার প্রবন্ধ সংগ্রহ, ‘শতাব্দীর প্রেক্ষিতে ভারতের আর্থিক বিকাশ’ এবং ‘শান্তি স্বরাজ সংস্কৃতি’ ইত্যাদি। অম্লান দত্ত ছিলেন একেধারে অর্থনীতিবিদ, অগ্রণী চিন্তক ও অধ্যাপক। তার জন্মশতবর্ষ চলছে, তাকে প্রণতি জানাই।
অম্লান দত্ত জীবনের শুরুতে পড়াশোনা করেছেন কুমিল্লার ঈশ্বর পাঠশালায়। রামমালা গ্রন্থাগারের পাশাপাশি ১৯১৪ সালে এ স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন লোকহিতৈষী মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য (১৮৫৮—১৯৪৪)। ওপার বাংলার চিত্রশিল্পী বন্ধুর কাছে জেনেছি, অম্লান দত্তের সঙ্গে তার দাদাও এই স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। তারপর ঢাকার কলেজিয়েট স্কুলে পড়াশোনার পর ১৯৪০ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় যান অম্লান। প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিষয়ে পড়েন।
১৯৪৭ সালে আশুতোষ কলেজে অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে কর্মজীবন শুরু। পরের বছর অধ্যাপক হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর নানা বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ানোর পর ১৯৮০ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন। বিভিন্ন সময় তিনি ভারতের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন— কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ বেঙ্গল বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় অর্থাৎ শান্তিনিকেতন। সাহিত্য সমালোচক আবু সয়ীদ আইয়ুবের (১৯০৬—১৯৮২) সঙ্গে ‘কোয়েস্ট’ পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদকও ছিলেন অম্লান।
তার চিন্তা-চেতনাকে প্রভাবিত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধী, কার্ল মার্কস, মানবেন্দ্রনাথ রায় ও বার্ট্রান্ড রাসেল। ‘গান্ধীবাদী’ হিসেবে পরিচিতি পেলেও তার লেখায় বারবার এসেছে রবীন্দ্রনাথের কথা। সমাজ-ইতিহাস-অর্থনীতি ও দর্শনের নানা প্রশ্ন সারাজীবন অম্লানের মন আলোড়িত করেছে, খুঁজেছে উত্তর। শুভবুদ্ধি যখন বিপন্ন, চারদিকে মানুষ তার ভবিতব্য নিয়ে উদ্বিগ্ন, অম্লান তখন তার বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন একজন নৈতিক সংগ্রামী হিসেবে। তিনি চেয়েছেন নতুন সমাজের ভিত্তি হবে রাষ্ট্রশক্তির বিকেন্দ্রীকরণ, পল্লী উন্নয়ন, জাতীয় শিক্ষানীতি, অহিংসা ও পরিবেশ সচেতনতা।
অম্লান বাংলাদেশে এসেছিলেন বেশ কয়েকবার। একবার পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায়, তারপর সত্তরের দশকে বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকায়। পরে ১৯৮৬ সালে রবীন্দ্রনাথের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশে এসেছিলেন, এটাই ছিল তার সবচেয়ে বড় সফর। গিয়েছিলেন জন্মশহর কুমিল্লায়ও। কুমিল্লার পথে পথে যেতে শুনেছেন গান। ঢাকায় যোগ দেন বাংলা একাডেমিতে আয়োজিত সভায়, বক্তৃতা দেন রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শ বিষয়ে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সভায় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও যান। এ নিয়ে তিনি লিখেছেন ‘বাংলাদেশ দেখে এলাম’ নামে প্রবন্ধ।
ওই বছর ৭ মে বাংলাদেশের তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ১৫৩টি আসন পেয়ে জয়ী হন, আওয়ামী লীগ পায় ৭৬টি আসন। নির্বাচনের দুদিন পর অর্থাৎ ৯ মে অম্লান ঢাকায় আসেন। স্বাভাবিকভাবে তার সেই প্রবন্ধে তৎকালীন রাজনীতি, সংস্কৃতি, দুই দেশের সম্পর্ক ও বৈপ্লবিক কর্মপন্থা নিয়ে বিস্তর আলোচনা লেখেন তিনি। জন্মভূমি বাংলাদেশের প্রতি তার আকুতি চোখে পড়ে এখানে, “বিপ্লববাদীরা অপেক্ষা করছেন জনগণের আরেক মুক্তিযুদ্ধের জন্য। তারই ভিতর দিয়ে ঘটবে সামরিক শাসনের অবসান, প্রতিষ্ঠিত হবে জনগণের প্রকৃত মুক্তি। এই দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ কোন পথে আসবে, তার নেতৃত্ব ও সংগঠন কেমন হবে, ঢাকার বুদ্ধিজীবীরা তা জানেন না। তবে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নসন্তান এই দ্বিতীয় বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের কল্পনা বাংলাদেশের বামপন্থী চেতনাকে যেন একটা মুগ্ধতায় গ্রাস করে আছে।”
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে লেখেন, “সাম্প্রদায়িকতা নয়, তবে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের প্রতি বাংলাদেশে একটা সন্দেহের মনোভাব আছে। নেপালেও সম্ভবত ভারতের প্রতি ঐ ধরনের মনোভাব অনুপস্থিত নয়। ফারাক্কার জল আর ভারতের বস্ত্রব্যবসায়ীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে বিরূপ মন্তব্য বাংলাদেশে হামেশাই শোনা যায়। এতেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই। জল নিয়ে কোন্দল আছে পাঞ্জাব আর হরিয়ানার ভিতরও।…বাংলাদেশকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখতে হবে নিজের চেষ্টায়। তবে সেই সঙ্গে ভারতেরও একটা বিশেষ দায়িত্ব আছে কারণ সে অপেক্ষাকৃত শক্তিমান প্রতিবেশী। দুই দেশের ভিতর সহযোগিতার অনেক সুযোগ আছে। সন্দেহের আতিশয্যে সহযোগিতার এই সুযোগগুলি দৃষ্টির বাইরে চলে না গেলেই ভালো। সতর্কভাবে অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন।”
বাংলাদেশের কণামাত্র ধুলোটাকেও অম্লান যেন অনুভব করেন প্রাণের দাবি নিয়ে, দেশভাগের বিভীষিকা তিনি দেখেছেন, তাই চিন্তার বহুত্ব ও গণতান্ত্রিক অংশীদারত্বের সপক্ষে তিনি লেখেন, “বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার প্রাদুর্ভাব আমি দেখিনি। সাম্প্রদায়িক বুদ্ধি থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে মুক্ত সাধারণ মানুষের মন। হিন্দুদের ভিতর ভয়সংশয় যথেষ্টই আছে। কিন্তু মুসলমান সাম্প্রদায়িকতা সেজন্য দায়ী এমন আমার মনে হয়নি। অপরিচিতা এক হিন্দু মহিলা আমাকে নিজের পরিচয় দিলেন। তিনি বললেন, কিছুদিন আগে তাঁর বাড়ীতে ডাকাতি হয়েছে, তিনি বাংলাদেশ ত্যাগ করবার কথা ভাবছেন। পশ্চিমবঙ্গেও কিন্তু ডাকাতি হয়, আমরা সেজন্য দেশত্যাগ করবার কথা ভাবি না।”
অম্লান দত্ত শেষবার বাংলাদেশে আসেন ২০০৯ সালে, আহমদ শরীফ স্মারক বক্তৃতার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাংলাদেশে যে কয়জন মানুষের সঙ্গে অম্লান দত্তের যোগাযোগ বা চিঠি আদান-প্রদান হতো তার মধ্যে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, কবি তসলিমা নাসরিন ও ভাস্কর মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী অন্যতম। একবার বার্লিনে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্ক আলোচনা সভায় যোগ দিতে গিয়েছিলেন আনিসুজ্জামান ও অম্লান দত্ত। আনিসুজ্জামান তার ‘বিপুলা পৃথিবী’ বইয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন, অম্লান সম্পর্কে লিখেছেন, “আমাদের সফরসঙ্গীদের মধ্যে অম্লান দত্তের সঙ্গে আমার পরিচয় দীর্ঘকালের। তিনি যেমন পণ্ডিত, তেমনি সজ্জন।” ২০১০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতার সল্টলেকের বাড়িতে মারা যান চিন্তাবিদ অম্লান দত্ত।
অম্লানকে কেউ একবার প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি কী করেন?’ তিনি উত্তর দেন, ‘আমি চিন্তা করি।’ দোচালা আর পুরু ইটের দেয়ালের কুমিল্লার ঈশ্বর পাঠশালার মূল ভবন এখনও অবিকৃত আছে, সেইদিকে তাকিয়ে ভাবি ঢং ঢং করে ঘণ্টা পড়লো বুঝি! অম্লান এসে ক্লাসে ঢুকল। কিংবা ছুটির ঘণ্টা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুদের সঙ্গে হৈহৈ করতে করতে বাগিচাগাঁও বাসার দিকে ছুটল। মহেশাঙ্গনের সিঁড়িতে বসে ভাবি, পথটা তো আমি পুরোটাই চিনি!