Published : 23 Jan 2021, 01:51 AM
লালন-মধুসূদন-রবীন্দ্রযুগেয় লেখাজোকায় একজন শিক্ষকের অবয়ব বর্ণনা জেনে আদর্শ শিক্ষক সম্পর্কে আমার মনে একটা কল্পচিত্র লালন করেছিলাম। সেই কল্পচিত্রের দেখা পাইনি সে অর্থে, গ্রাম থেকে ছিটকে পড়ে থানা সদরে গিয়ে, তার দেখা পাইনি মফস্বল জেলাসদরেও। নিজ জেলা থেকে আরেক জেলায় গিয়েও পাইনি দেখা আমার কল্পনার শিক্ষকের। তার দেখা পেলাম পদ্মা মেঘনা যমুনা এপার ওপার করে দেশের এধার-ওধার হয়ে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পরে। অনেকের সাধারণ ধারণা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ চলে সাহেবদের অনুকরণ ও অনুসরণে, আটসাট সাহেবি পোশাক, গলায় পশ্চিমা ন্যাকড়া আর মুখে বিদেশি ভাষার বুলি আউড়িয়ে। তা বটে কিয়দংশে।
এ প্রসঙ্গে এবার একটি গল্প বলে নেওয়া যায়। একবার এক জাদরেল ইংরেজির অধ্যাপক হুকুম জারি করলেন, মৌখিক পরীক্ষায় সকল ছাত্রকেই টাই পরে আসতে হবে। আমাদের কবি দিলদার হোসেন টাইয়ের বাংলা করেছেন 'পশ্চিমা ন্যাকড়া'। নির্ধারিত সেই মৌখিক পরীক্ষায় 'পশ্চিমা ন্যাকড়া' না পরেই হাজির হয়েছেন এক ছাত্র। শেষতক যা হবার তাই হয়েছিল। ছাত্রটিকে মৌখিক পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেওয়া হল। ছাত্রটি দমে গেল না। প্রকাশ্য বিদ্রোহকে অপ্রকাশ্য বিপ্লবের পরিণতির দিকে নিয়ে গেল। সেই ছাত্র শেষ পর্যন্ত একই বিভাগে শিক্ষক হিসেবেও যোগ দিল ঐ 'পশ্চিমা ন্যাকড়া' না পরেই। তার জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সাদা ধবধবে পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহিত সফেদ নিখাদ নিরেট বাঙালি শিক্ষক অস্তিত্বের বিদ্রোহী প্রতিমূর্তি অক্ষুণ্ণ রেখে গেলেন। এমন বিদ্রোহী শিক্ষক তার সকল শিক্ষার্থীর কাছে প্রিয় সেই বিরল মানুষটি ৭৩ বছর বয়সে চলে গেলেন সকলকে ছেড়ে ২০২১ সালের জানুয়ারির ১৭ তারিখে।
আদতে তিনি তার জীবনকে যাপন করে গেলেন সকলকে ছেড়েই। সকলের মাঝে থেকেও ছিলেন একা। আবার একা থেকেও সকলের কথা, সকলের ব্যথা, সকলের পতন, স্খলন, বিপর্যয় ও বিপদের কথা বলে গেলেন আকারে ঈঙ্গিতে। তার নীরবতা আর নিভৃত জীবন আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতসম অনুভূতির তীব্রতায়।
এ বিরল মানুষটির নাম কাশীনাথ রায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক। তিনি জন্মেছিলেন উত্তরবঙ্গের চলনবিলের ধারে নাটোরে। তিনি একাধারে কবি, গল্পকার এবং নাট্যকার ছিলেন। তিনি গোটা দেশের রূপান্তর এত নিবিড় করে দেখেছিলেন, উপলব্ধি করছিলেন আর একা একা তার সিগারেটের টানে টানে ভাবছিলেন, হায়রে হতভাগা দেশ, হায়রে উজবুক চারপাশের মানুষ, আহারে নগরের নাগরিক!
১৯৪৭- এ কাশীনাথ রায়ের জন্ম। যিনি সরাসরি আমার শিক্ষক। ঘোর অন্ধকারে দাঁড়িয়ে অন্ধকারের সঙ্গে কথা বলে উঠে যদি নিজেকে প্রশ্ন করি, ইংরেজি বিভাগের ছাত্র হয়ে কী পেয়েছিস, কী শিখেছিস! কী পাব? কী পেতে হবে? কী পাবার ছিল? এই বিভাগে কাশীনাথ রায়ের মত একজন শিক্ষক ছিলেন। তার ক্লাশ করেছি, আর কোনও ক্লাশে যাই বা না যাই। আর কী পেতে হবে শুনি? এবার আমার প্রশ্ন ৫৫ হাজার বর্গমাইলের ভূখণ্ডে আর কোথায় এরকম বিরল প্রতিভাবান সম্মোহনী ক্ষমতার অধিকারী আদর্শ শিক্ষক কয়জন আছেন?
অনেকেই বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ আদতে 'বড়লোকদের একটা ক্লাব'। আমারও মত কাছাকাছি। সেই ক্লাবে আমার শিক্ষক চলনবিলের কিনার থেকে এসে শুরুতেই 'পশ্চিমা ন্যাকড়া' নিয়ে হোঁচট খেলেন। এর মাঝে দেশটাও স্বাধীন হল। আবার ঘোর অমানিশা নেমে এল ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে। অপার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কাশীনাথ রায় ঠিক ঠিক বুঝে গেলেন, যা হবার ছিল তা আর নয়। যা পাবার ছিল, তা ভবে নাই। বিদ্রোহ আর বিপ্লবের চূড়ান্ত মেধা, প্রতিভা আর শক্তি থাকা সত্ত্বেও তিনি বড় একা হয়ে গেলেন। স্থিত হয়ে গেলেন বাসা, বিভাগে নিজ কক্ষে, আর শ্রেণিকক্ষে এর বাইরে তাকে কখনো কোথাও কোন উপলক্ষে দেখেছি কিনা মনে পড়ে না। শিক্ষকদের নীল-সাদা-গোলাপির মেলে পা বাড়ালেন না।
তিনি কথা বলতেন নিজের সঙ্গে। তিনি নীরবে নিভৃতে চুপটি মেরে ছিলেন কি? চুপ থাকার মানুষ কি কাশীনাথ রায়? না, তিনি চুপ থাকেননি, নীরবও থাকেননি। আদতে তিনি কথাটা বলবেন কোন পরিবেশে, কার সঙ্গে? দেশে এত এত গণমাধ্যম, এত এত বিশ্ববিদ্যালয়, তাকে কি কেউ ডেকেছে, কোন কথা জিজ্ঞেস করেছে? তার সরাসরি ছাত্রদের অনেকেই আজ অনেক জায়গার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। তারা কি আসলে কাশীনাথ রায়কে চিনতে পেরেছিলেন?
১৮ বছর বয়সে ১৯৬৫ সালে লিখলেন কাব্য নাটক 'ডিভাইন কমেডি'। ধসে পড়া খসে পড়া ভঙ্গুর স্থূল অপার্থিব পর্যস্ত দাম্পত্য রহস্যের এমন খোলনলচে তুলে ধরে বাংলার সৃষ্টিকর্ম আর কোনটি আছে? অথচ গোটা জীবন নিরব থেকে সেই কাব্যনাটক প্রকাশ করলেন ২০০৭ সালে। এখানে উল্লেখ্য যে, পাণ্ডুলিপিটি ১৯৭০-১৯৭১ সালে হারিয়ে যায়। ১৯৯৪ সালে সেটি পুনরুদ্ধার হয়। এরপর প্রকাশ করলেন দুটো কাব্যগ্রন্থ। 'জীবনানন্দ দেখুন' শিরোনামের গ্রন্থে তিনি নিজেকে এভাবে তুলে ধরেছেন-
"জীবনের কোন ক্ষেত্রেই কাশীনাথ রায়ের কোন প্রতিষ্ঠা বা পরিচিতি নেই। কুণ্ঠিত চিত্তে যা তিনি বলতে চান সে তার পিতৃভূমির ভাগ্য-দুর্ভাগ্য নিয়ে নির্বোধ মমতামাখা, উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার কথা। যদি কোন সদয় কাব্যরসিক, কোন সহৃদয় শ্রোতা সে-কথা শুনতে রাজি হন, তাহলে কাশীনাথ রায় কৃতার্থ বোধ করবেন"।
আমাদের শিক্ষক কাশীনাথ রায় মানুষটি এমনই ছিলেন।
তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'আমি যাহা দিতে পারি' প্রকাশিত হয় ২০১১-২০১২ সালে।
পিতৃভূমি নিয়ে তার যে উদ্বেগের গভীরতা তা নিয়ে ১৯৭৫ পরবর্তী রাজনৈতিক স্খলনের যে নহর, সেই নহরের এপারে ওপারে কাশীনাথ স্যার অন্তর্দশনে যা দেখেন, হৃদয়ে যা উপলব্ধি করেন, তা তার উল্লিখিত কাব্যগ্রন্থদুটিতে বলে গেছেন। কাশীনাথ রায়ের যা বলার ছিল তা তিনি বলেছেন, কাব্যনাটকে, কবিতায় আর গল্পে। আমরা কি তা শুনেছি?
কাশীনাথ রায় তা জীবন দিয়ে, জীবনাচার দিয়ে, জীবনের যে সত্য দেখিয়ে গেলেন, আমরা কি তা দেখতে পেরেছি? তিনি নিজের জীবন, পথ ও কর্মকে এমন স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন 'নির্মোহ' যাকে বলে। নির্মোহের এমন স্তর কেবল কচুপাতার সঙ্গে জলের তুলনা করা যায়। তার আশেপাশেই অনেকের পদোন্নতি আর সুযোগ সুবিধা পুরস্কার স্বীকৃতি নিয়ে দেশে বিদেশে শনৈ শনৈ অবস্থা। কাশীনাথ রায় রয়ে গেলেন তথৈবচ। না নিলেন কোন বাড়তি ডিগ্রি। বৃত্তি, আমন্ত্রণ, সেমিনার, সভা, মেলা কোনকিছুই তাকে টানে না। ডুবে থাকলেন নিজের ভাবনায়। আঁকড়ে থাকলেন নিজের সততা আর নীতিতে। নির্ভেজাল শিক্ষক জীবন!
ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হবার আগে বিরল এই মানুষটির নামও শুনিনি। তাকে প্রথম দেখার পর অনেকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। আজও মনে পড়ে। তার চোখে আর মুখে না বলা কী সব কথা! কে তা পড়তে পারে? তিনি কি তার সবটা তার কবিতায় বলে গেছেন?
তার চোখের দিকে তাকিয়ে কেন যেন জীবনানন্দ দাশের কথাই মনে পড়ে। কাশীনাথ রায় আর জীবনানন্দ দাশ কি একই নিভৃতিচারিতা আর অন্তর্দৃষ্টি ধারণ করেছিলেন? কাশীনাথ রায় কি জীবনানন্দের অসমাপ্ত কথাগুলোই বলে গেলেন? তার কবিতা পড়ে কেন আমার তা মনে পড়ে? আহা উজবুক আমি নিজেও কম নই। কাশীনাথ স্যারের জীবদ্দশায় তাকে কেন তা জিজ্ঞেস করলাম না? কাগ্যগ্রন্থের নামটি দেখেও তো আমাদের টনক নড়তে পারত, 'জীবনানন্দ দেখুন'।
কাশীনাথ রায়ের নির্মোহ শিক্ষকজীবনের তাৎপর্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুটি কয়েক শিক্ষকের কথা উল্লেখ করা যায়। তারা হলেন অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, সরদার ফজলুল করিম এবং রাজিয়া খান আমিন। যারা খ্যাতি যশ পদোন্নতি আর পুরস্কারকে তুচ্ছজ্ঞান করে বিরল জায়গায় পৌঁছাতে পেরেছিলেন।
বিরল শিক্ষক কাশীনাথ রায়ের প্রথম ক্লাশে ঢুকেছিলাম ১৯৯০ দশকের শেষার্ধ্বে। কলাভবনের উত্তর পাশে লেকচার থিয়েটারের বিশাল ক্লাসরুমে, কোন এক বিকালে। তার ক্লাশে শিক্ষার্থীরা উপচে পড়তো। তিনি পড়ানোর সময় পাঠ্যপুস্তকের চরিত্রের সঙ্গে নিজেকে একীভূত করে এমনভাবে উপস্থাপন করতেন, যেন চরিত্ররা ক্লাসরুমে জীবন্ত কুশীলব হিসেবে কাশীনাথ স্যারের মাধ্যমে আমাদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিয়েছেন। আমার মনে পড়ে, তিনি আমাদের পড়িয়েছিলেন উনবিংশ শতকের ব্রিটিশ লেখক থমাস হার্ডির উপন্যাস 'টেস অব দ্য ডার্বারভিলস" উপন্যাসটি। আজ মনে হচ্ছে- ইংল্যান্ডের পল্লীপ্রান্তরের টেস নামের মেয়েটির জীবনগল্পের যে কথাশিল্পের বয়ান তা কাশীনাথ স্যার তার নিজের ফেলে আসা চলনবিলের জীবনের সঙ্গে কল্পনায় মেলানোর একটা তাগিদ হয়তো অনুভব করছিলেন কি? অনেক প্রশ্ন আর ব্যক্তিগত নানা প্রসঙ্গ মনের মাঝে উঁকি মারে, কাশীনাথ স্যার চলে যাবার পড়ে।
কাশীনাথ রায়ের কবি হিসেবে আবির্ভাব ১৯৬০ এর দশকে আবুদল্লাহ আবু সায়ীদ সম্পাদিত সাহিত্যের কাগজ 'কণ্ঠস্বর' এর মাধ্যমে। তিনি কালেভদ্রে খোন্দকার আশরাফ হোসেনের ছোটকাগজ 'একবিংশে' নাইম হাসানের কাগজ 'নিরন্তরে; এবং পুলক হাসানের 'খেয়া' পত্রিকায় লিখেছেন। কোন বড় কাগজে কোনদিন লিখেছেন কি না আমার জানা নাই।
স্যারের একটি কবিতার শরণ নিয়ে এ লেখার সমাপ্তি টানতে চাই:
চিঠি দাও
যেখানেই থাক চিঠি দিয়ো
এ-পাড়ায় কাউকে চিনি না
চিনব এমন ভরসাও নাই।
পাশের বাড়ির দরজায় কড়া নাড়লে
ও-পাশ থেকে এগিয়ে আসে না কেউ
যদিও বা আসে
অবিশ্বাসে কুঁচকে থাকে চোখ
আমি তাই আর কারো দরজায় কড়া নাড়ি না
কিংবা পথে নেমে হঠাৎ পড়শির মুখোমুখি হলে
হেসে বলি না সুপ্রভাত
মনে হয় সম্ভাষণ ব্যাপারটা
এ-পাড়ায় পছন্দ করে না কেউ।
কোলাহল যে নাই তা নয়
সকাল কিংবা সন্ধ্যা যে- কোন সময়
কলহের কড়া সুর চিৎকার শাসানি
বাতাসে আছড়ে পড়ে
মনে হয় তারই আঁচে
এ-পাড়ার হাওয়ায় কোন প্রজাপতি উড়তে পারে না
বিশ্বাস করো অনেকদিন আমি
লাফ দিতে গিয়ে ঘাসফড়িংকে
মুখ খুবড়ে পড়তে দেখেছি
হয়তো তাই
রাত গভীর হলে
এ-পাড়ার নিশ্বাসে চেপে বসে আধ-কাটা গোর
আমার খুব ভয় করে
যেখানেই থাক চিঠি দিয়ো।
শহরটাকে বুঝে উঠতে পারিনি এখনও
যতবার বাইরে বেরিয়েছি
গলি থেকে রাজপথ
রাজপথ থেকে গলি
বেসামাল হয়ে ফিরেছি কেবল
হঠাৎ করেই রাস্তার নম্বর পাল্টে যায়
হঠাৎ করেই সোজা পথটা বেঁকে যায় ভীষণ
হঠাৎ করেই একটুকরো খোলা মাঠ
দেখতে না দেখতেই হয়ে যায় বিশাল শপিং কমপ্লেক্স
আমার মাথা ঘুরে ওঠে।
একদিন নির্মল বাতাসের খোঁজে
শহর পেরিয়ে গ্রামে গিয়েছিলাম
ইটভাটার রাক্ষুসে ক্ষুধা
গোটা আকাশটাকে গিলে বসে আছে দেখলাম
বাড়িগুলো ন্যাড়া
ঘাড় কাত করে দাঁড়িয়ে আছে
পাংশুটে ভিখিরির মত
মানুষগুলোর চোখ নেই
তাড়া খেয়ে ফিরে আসি আমি।
খুব একা লাগছে আমার
রাত পোহাতে না পোহাতে তাই তোমাকে লিখছি
যেখানেই থাক চিঠি দাও
তোমার চিঠি পেলে মনে হবে
এই অদ্ভুত পাড়ায়
এই শহরে
ব্যস্ত ইহলোকে
কেউ না কেউ আছে আমার।
[জীবনানন্দ দেখুন, ঢাকা ২০০৮]