Published : 02 Nov 2020, 02:32 PM
মিরসরাইয়ের মাওলানা গোলাম রহমান ছিলেন তখনকার দিনের নামকরা আলেম। ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসা থেকে দাওরায়ে হাদিসসহ ধর্মীয় শিক্ষায় উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। বিলেতি পণ্য বর্জনসহ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তার ছিল উল্লেখযোগ্য অবদান। ছিলেন আবুরহাট মাদ্রাসার তত্ত্বাবধায়ক। সেই মাওলানা গোলাম রহমানের ছেলে আহমেদুর রহমান হাটহাজারী কওমি মাদ্রাসা থেকে সর্বোচ্চ ধর্মীয় শিক্ষা অর্থাৎ কামিল ডিগ্রিধারী হয়েও অবিচল ভূমিকা রেখেছেন ভাষা আন্দোলন, সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী প্রগতিশীল (ন্যাপ-ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি) আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে। সত্তর-আশির দশকে এই আহমেদুর রহমানই খ্যাতিমান হয়েছিলেন সংগ্রামী জননেতা মাওলানা আহমেদুর রহমান আজমী হিসেবে। শৈশবে মাদ্রাসায় পড়ার সময় তিনি সংবাদপত্র বিক্রি তথা হকারিও করেছেন। রাজনীতির কারণে থেকেছেন আত্মগোপনে এবং জেলে। আত্মগোপন থাকাকালীন ছদ্মনাম আজমী পরবর্তী সময়ে মূল নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তার নাম হয় আহমেদুর রহমান আজমী। এছাড়া কখনো মজনু, আবার কখনো মিন্টু নামেও পরিচয় দিতেন তিনি।
আহমেদুর রহমানের জন্ম ১৯২৮ সালের ২ নভেম্বর মিরসরাইয়ের ইছাখালী ইউনিয়নের দেওখালী গ্রামে। পড়ালেখায় হাতেখড়ি হয় স্থানীয় সাহেবদীনগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯৪২ সালে মিঠাছড়া এবি স্কুল থেকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর তার বাবা তাকে আবুরহাট মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেন ধর্মীয় শিক্ষায় তালিম নেওয়ার জন্য। তার বাবা ছিলেন ওই মাদ্রাসার তত্ত্বাবধায়ক। কিন্তু সেখানে পড়ার সময় কিশোর আহমদুর রহমানের বিশেষ করে বাম ধারার রাজনীতির প্রতি ঝোঁক দেখে বিচলিত হন তার বাবা। রাজনীতিমনষ্ক লোকদের কাছ থেকে দূরে রাখার জন্য তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় হাটহাজারী কওমি মাদ্রাসায়। আহমদুর রহমান আজমী বলেন, 'আমি আবুরহাট মাদ্রাসায় ৪৮ সাল পর্যন্ত ছিলাম। সেখানে পড়ার সময় আমার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতি ঝোঁক বুঝতে পেরে বাবা আমাকে একরকম জোর করে ভর্তি করান জেলার সবচেয়ে বড় (কওমি মাদ্রাসা) হাটহাজারী মাদ্রাসায়। সেখান থেকেই সর্বশেষ ধর্মীয় ডিগ্রি অর্থাৎ কামিল ডিগ্রি নিই। তবে রাজনীতি আমি ছাড়িনি।'
মাদ্রাসায় পড়েও রাজনীতির প্রতি ঝুঁকে পড়ার কারণ হিসেবে জনাব আজমী বলেন, 'পড়ালেখা মূলত মাদ্রাসায় হলেও ছোটকাল থেকেই নানাভাবে ব্রিটিশবিরোধী রাজনীতির সঙ্গে পরিচিত হই। বাবা কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় থাকার সময় খেলাফত আন্দোলন, বিলাতি পণ্য বর্জনসহ ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। কলকাতা খেলাফত আন্দোলন শহর কমিটির সহসম্পাদক ছিলেন তিনি। ব্রিটিশ আমলে কলকাতা থেকে দৈনিক আজাদ, প্রত্যহ, বসুমতি, যুগান্তর, সাপ্তাহিক সওগাত, মোহাম্মদীসহ বেশ কিছু বামঘেঁষা পত্র-পত্রিকা বের হতো। পরে ঢাকা থেকে আসত সাপ্তাহিক নতুন বাংলা ও ইত্তেফাক। আমি মাদ্রাসার ছাত্র থাকার সময় সেগুলো নানা উপায়ে সংগ্রহ করে মিরসরাইয়ের বিভিন্ন বাজার এলাকায় বিক্রি করতাম। একই সঙ্গে সময়-সুযোগমতো ওইসব পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদ ও খ্যাতিমান মনীষীদের নিয়ে লেখা প্রবন্ধ-নিবন্ধ মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। পাকিস্তানের করাচি থেকে প্রকাশিত উর্দু পত্রিকা জং, লাহোর থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ইমরোজ এবং পাকিস্তান টাইমস পত্রিকাও পড়তাম নিয়মিত। এর মধ্যে মহাত্মা গান্ধী, মাওলানা আকরাম খাঁ, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, নেতাজী সুভাষ বসু, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, জওহরলাল নেহেরুসহ তখনকার নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতি পড়ে আমার মনে সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চিন্তা দানা বাঁধে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর পাকিস্তানিদের শোষণ-বঞ্চনা, সাম্প্রদায়িক শক্তির আস্ফালন ও বাংলা ভাষার ওপর আঘাত ইত্যাদি আমার মন বিষিয়ে তোলে। এ সময় আমি বাম রাজনীতির ওপর লেখা বিভিন্ন বই-পুস্তক সংগ্রহ ও মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। এভাবে বাম তথা সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার চিন্তা আমার মাথায় ঢোকে। আমার বন্ধু এ টি এম শামসুদ্দিনের বাবা আহমদুর রহমান কলকাতার রাইটারস বিল্ডিংয়ে কেরানির চাকরি করতেন। এলাকায় এসে ব্রিটিশবিরোধী আলাপ-আড্ডায় বক্তব্য দিতেন। তার কাছ থেকেও রাজনৈতিক বইপত্র পড়ার অনুপ্রেরণা পাই। বলতে গেলে তিনি আমার রাজনৈতিক জীবনের প্রথম গুরু। আমি হাটহাজারী কওমি মাদ্রাসার মতো ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র হলেও চিন্তা-চেতনায় ছিলাম অসাম্প্রদায়িক, শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় সংকল্পবদ্ধ। এভাবে জড়িয়ে পড়ি রাজনীতিতে।'
হাটহাজারী মাদ্রাসায় থাকা অবস্থায়ই ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন জনাব আজমী। হাটহাজারী থানা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ৫২-এর ভাষা আন্দোলনের সময় ঢাকায় কী ঘটছে তা জানার জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতাম। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণ ও হতাহতের ঘটনা আমরা জানতে পারি ২২ ফেব্রুয়ারি সংবাদপত্রের মাধ্যমে। ওইদিনই স্থানীয় কিছু প্রগতিশীল চিন্তার ছাত্র এবং হাটহাজারী পার্বতী উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিয়ে বৈঠকের আয়োজন করি। ওই বৈঠকেই আমাকে আহ্বায়ক ও হাটহাজারী উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র সাহাবুদ্দিনকে সচিব করে হাটহাজারী থানা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশের মাধ্যমে বাহান্নের ভাষা আন্দোলন সংঘটিত করি। হাটহাজারী মাদ্রাসায় থাকার সময় আমি কর্তৃপক্ষকে ফাঁকি দিয়ে প্রায় সময় শহরে এসে সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে দেখা করতাম। ২২-২৩ ফেব্রুয়ারি আমার ভূমিকায় সন্তুষ্ট হয়ে ভাষা আন্দোলনের জন্য গঠিত জেলা সংগ্রাম কমিটিতে আমাকে সদস্য করা হয়। এ পর্যায়ে আমার ঘনিষ্ঠতা হয় চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রকাশিত তৎকালীন প্রগতিশীল পত্রিকা সীমান্ত সম্পাদক কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী, তার সঙ্গে যুক্ত বাম নেতা সাংবাদিক এ টি এম শামশুদ্দিন, রুহুল আমিন নিজামী, গোপাল বিশ্বাস প্রমুখের সঙ্গে। ঢাকায় ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে লালদিঘি মাঠে আয়োজিত জনসভায় মাহবুব উল আলম চৌধুরীর 'কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি' আবেগপূর্ণ ভঙ্গিতে পাঠ করেছিলেন চৌধুরী হারুণ অর রশিদ। ওই কবিতা আমাকে মুগ্ধ করে। সীমান্ত কার্যালয়ে প্রগতিশীল ছাত্র-যুবকদের প্রায় সময় আড্ডা বসত। আমি হাটহাজারী থেকে প্রায় সময় এসে যোগ দিতাম ওই আড্ডায়। সেই আড্ডাও আমাকে পুরোদমে প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের দিকে নিয়ে যায়। ষাটের দশকে যৌবনে যাদের সঙ্গে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা ও সহযোগিতার মধ্য দিয়ে আন্দোলন-সংগ্রামে নিয়োজিত থেকেছি তাদের মধ্যে মিরসরাইয়ের ফকির আহমদ, মাস্টার আবুল কালাম, সৈয়দ ফজলুল হক বিএসসি, কবির মিয়া, মফিজুল হক, শামসুল হুদা, আজিজুল হক মিয়া প্রমুখের কথা এখনো মনে পড়ে।'
আন্দোলন-সংগ্রামে যুক্ত থাকার কথিত অপরাধে একাধিকবার জেল-জুলুম নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে আহমদুর রহমান আজমীকে। তাকে প্রথম গ্রেপ্তার ও সাড়ে তিন বছর জেল দেওয়া হয় ১৯৫৯ সালে আইউব খানের সামরিক আইন ভাঙার দায়ে। একই মামলায় পূর্ণেন্দু দস্তিদার, অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদ, কমরেড মনি সিংহ, খোকা রায়, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদসহ ২৯ জন আসামি ছিলেন। রাজনীতিতে চড়াই-উৎরাই এবং জেল খাটার বিষয়ে স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, 'বাম আন্দোলনকারীদের প্রতি পুলিশের বরাবরই কড়া নজরদারি ছিল। বাধ্য হয়ে আমি প্রায় আত্মগোপনে থেকে কাজ করতাম। ১৯৫৯ সালে একদিন আমি ১৫ নম্বর হাইতকান্দি ফকিরহাট এলাকায় রেললাইনের পূর্বদিকে এক কৃষকের বাড়িতে আত্মগোপনে ছিলাম। পুলিশ কোনোভাবে খবর পেয়ে ওই বাড়ি ঘেরাও করে আমাকে গ্রেপ্তার করে। ১৯৬২ সালে জেল থেকে ছাড়া পাই। এরপর এক দফায় ১৮ দিন, এক দফায় ১৫ দিন এবং শেষবার ১৯৬৪ সালে আবার গ্রেপ্তার হয়ে দেড় বছর জেল খাটি।
আমি মাদ্রাসাছাত্র থাকার সময় গোপনে বামপন্থী ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। ১৯৫২ সালের ৩ নভেম্বর জে এম সেন হলে চট্টগ্রাম জেলা ছাত্র ইউনিনের আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হলে আমি এতে যুগ্ম আহ্বায়ক হই। সভাপতি হয়েছিলেন প্রয়াত আবদুল্লাহ আল হারুন চৌধুরী। ডা. ছৈয়দুর রহমানও ছিলেন কমিটিতে। ৫৩ সালের মে মাসের সম্মেলনে হারুণ সাহেব সভাপতি এবং আমি হই সাধারণ সম্পাদক। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সময় আমি বাঁশখালীতে থেকে অধ্যাপক আসহাব উদ্দিনের পক্ষে প্রচারণায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করি। সেই নির্বাচনে মুসলিম লীগের শক্তিশালী প্রার্থী খান বাহাদুর বদিউর রহমান বিপুল ভোটে পরাজিত হয়েছিলেন। এ সময় গোপনে আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দিই আমি। এ পর্যায়ে কিছুদিনের জন্য বাকলিয়া এলাকায় আত্মগোপনে ছিলাম। আত্মগোপন অবস্থায় আমার ছদ্মনাম ছিল কখনো আজমী, কখনো মজনু, আবার কখনো মিন্টু। একদিন সেখান থেকে পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তার করে কয়েক সপ্তাহ পর ছেড়ে দেয়। এ সময় আওয়ামী লীগ নেতা এম এ আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরী আমাকে দলের কার্যালয়ে নিয়ে সংবর্ধনা দেন। সেই থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত প্রায় তিন বছর জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ছিলাম।
১৯৫৭ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা ভাসানীর মধ্যে চীন-মার্কিনের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক নিয়ে মতবিরোধ সৃষ্টি হলে আওয়ামী লীগ ভাগ হয়ে যায়। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সঙ্গে মতের মিল না হওয়ায় অন্য অনেকের সঙ্গে আমিও আওয়ামী লীগ ছেড়ে ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দিই। অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদকে সভাপতি, আমাকে সাধারণ সম্পাদক, ব্যারিস্টার সলিমুল হক খান মিলকীকে সহসভাপতি এবং বজলুস সাত্তারকে শহর সম্পাদক করে ন্যাপের জেলা কমিটি গঠন করা হয়। এ ছাড়া পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে মাওলানা ভাসানী প্রতিষ্ঠিত কৃষক সমিতির সভাপতি, স্বাধীনতার পর অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ সমর্থিত ন্যাপের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক, চৌধুরী হারুন অর রশিদ সমর্থিত ন্যাপের সাংগঠনিক সম্পাদক, গণফোরামের প্রথমে কৃষি সম্পাদক ও পরে প্রেসিডিয়াম সদস্যেব দায়িত্ব পালন করি।'
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ ও সম্পর্কের কথাও স্মরণ করেন জনাব আজমী। বলেন, তাকে প্রথম দেখি ১৯৫০ সালে মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে জে এম সেন হলে এক কর্মী সভায়। সেখানে আমি শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। (সম্ভবত ১৯৪৯ সাল হবে। ১৯৫০ সালে বঙ্গবন্ধু কারাগারে ছিলেন-লেখক) এরপর দেখা হয় ১৯৫৭ সালে, ঢাকায়। তিনি একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক বাঙালি ছিলেন। তার সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে আমরা ভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যস্ত থাকায় মাঝখানে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু একবার চট্টগ্রাম এলে তিনি সার্কিট হাউসে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে উপস্থিত ছিলাম আমিও। বঙ্গবন্ধু আমাকে দেখে কুশল বিনিময়ের পর বললেন, "৫৭ সালের পর তুমি একবারও আমার সঙ্গে দেখা করলে না। এখন থেকে যখনই প্রয়োজন হবে আমার সঙ্গে দেখা করবে।" ৭৫ সালে বাকশাল গঠন করা হলে তিনি আমাকে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা কমিটির সম্পাদক করেছিলেন।'
রাজনীতি করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় দলীয় সংঘাতের মতো তিক্ত অভিজ্ঞতারও সম্মুখীন হন মাওলানা আহমেদুর রহমান আজমী। শারীরিকভাবে লাঞ্ছনারও শিকার হয়েছেন। বললেন মাওলানা ভাসানীর ভুল রাজনীতির কারণে দুঃখ পাওয়ার কথাও। স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলেন, কিছু ঘটনার কথা ভোলা যায় না। ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ থেকে বের হওয়ার পর ঢাকার পল্টন ময়দানে মাওলানা ভাসানীর ডাকা প্রথম সমাবেশে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা আবদুল ওয়ালী খানসহ কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন। শুরুতে আমি কোরান তেলাওয়াত করার পর সভাপতি হিসেবে মাওলানা সাহেবের নাম ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সমাবেশে লাঠি হামলা শুরু হয়। লাঠির আঘাতে আমার পিঠ রক্তাক্ত হয়। হামলা করে আওয়ামী লীগের লোকজন। আবার ষাটের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে ভাসানী ন্যাপ ভেঙে মোজাফফর ন্যাপ হওয়ার পর আমরা আন্দরকিল্লার পার্টি কার্যালয়ে সভা করার সময় সেখানেও হামলা হয়। এবার আমাদের ওপর আক্রমণ চালায় ভাসানী ন্যাপের লোকজন। এ সময়ও আমি আহত হই এবং এক সপ্তাহ শয্যাশায়ী থাকতে হয়। আমার স্ত্রী তখন বলেছিল, "এমন রাজনীতি করে কী লাভ? ছেড়ে দাও।" তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলাম, রাজনীতিতে এরকম মাঝেমধ্যে হয়ে থাকে। সব ঠিক হয়ে যাবে। এভাবে আরও দুবার হামলার শিকার হই। কিন্তু রাজনীতির ধারা থেকে কিছুতেই বিচ্যুত হইনি। এ প্রসঙ্গে রাজনীতিতে নীতি নিয়ে যে নীতিহীন অবস্থা দেখা দেয়, অনেক সময় অবিশ্বাস্য রকম ওলট-পালট ঘটনা ঘটে যায় তার একটা উদাহরণ দিই। ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগ স্বায়ত্বশাসনের দাবি সম্বলিত ছয় দফা ঘোষণা করে আন্দোলন যায়। দেখা গেল মাওলানা ভাসানী সেই ছয় দফার বিরোধিতা করছেন। আইউব খানও বিরোধিতা করছিলেন ছয় দফার। আমরা বিস্মিত হলাম। কারণ স্বায়ত্বশাসনের প্রশ্নে সোহরাওয়ার্দী সাহেবদের সঙ্গে দ্বিমত হওয়ায় ভাসানী আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে ন্যাপ গঠন করেছিলেন। আমরা তাকে সমর্থন করেছিলাম। কিন্তু তিনিই আবার চীন সফর করে এসে ছয় দফার বিরোধিতা করে বললেন, "আইউব সরকারকে ডিস্টার্ব করা যাবে না।" এ প্রসঙ্গে তিনি চীনা নেতা মাও সে তুং এর পরামর্শের কথা উল্লেখ করেন। তার এরকম অবস্থান পরিবর্তনের কারণেই ন্যাপে ভাঙন দেখা দেয়। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বে পুনর্গঠিত হয় ন্যাপ। এটিই মোজাফফর ন্যাপ বা মস্কোপন্থি ন্যাপ হিসেবে পরিচিত হয়। আমরা তখন মোজাফফর সাহেবের পক্ষে অবস্থান নিই। পূর্ণেন্দু দস্তিদার, আবদুস সাত্তার, কালিপদ চক্রবর্তী, সতীশ চন্দ্র, এ এন এম নুরুন্নবী, শফিউল আলম, আবদুল মোমেন ভূঁইয়া, এমদাদুল ইসলাম, এম এম শহীদুল্লাহ, সাইফুদ্দিন খান, ডা. শফিসহ অনেকে শহর ও জেলা ন্যাপের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন সে সময়।'
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধেও ভূমিকা রাখেন আহমদুর রহমান আজমী। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম শহরে। শহরে পাকিস্তানিদের অবস্থান বিস্তৃত হয়ে উঠলে তিনি হাটহাজারী, রাউজান, সীতাকুণ্ডের বিভিন্ন গ্রাম-গলি ঘুরে চার-পাঁচ দিন হেঁটে অনেক কষ্টে বাড়ি পৌঁছেন। সেখানে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য চৌধুরী হারুন অর রশিদের একটি চিঠি পেয়ে অধ্যাপক শামসুল আলম সাঈদসহ ভারতের দিকে রওনা দিয়ে ২৩ এপ্রিল আগরতলা পৌঁছেন। সেখানে মনুবাজারের একটি অভ্যর্থনা ক্যাম্পে রাখা হয় তাদের। আগরতলায় তাদের কাজ ছিল মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে যাওয়া ব্যক্তিদের অভ্যর্থনা জানানো এবং রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ দেওয়া। মনুবাজারে পাকিস্তানিরা একবার বিমান হামলা চলালে তারা গো-কুলনগরে গিয়ে সেখানকার একটি ক্যাম্পে কাজ করেন। যুদ্ধকালীন সে সব কর্মকাণ্ডে মেজবাহ উল আলম, চৌধুরী হারুন অর রশিদ, পংকজ ভট্টাচার্য, শহীদুল্লাহসহ অনেকের ভূমিকার কথা স্মরণ করেন জনাব আজমী। তিনি দেশে ফেরেন পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের পর-২০ ডিসেম্বর।
স্বাধীনতার পর একাধিক রাজনৈতিক ও শান্তি সম্মেলনে অংশ নিতে বিদেশ সফর করেন মাওলানা আজমী। ১৯৭৪ সালে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের নেতৃত্বে ৩২ সদস্যের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্রেমলিন ভবনে অনুষ্ঠিত 'ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস ফর পিস ফোর্সেস' সম্মেলনে যোগ দেন তিনি। মতিয়া চৌধুরী, মহিউদ্দিন আহমদও ছিলেন সেই দলে। ১৯৮১ ও ১৯৯০ সালে গিয়েছেন কাজাকিস্তান ও উজবেকিস্তানে। ১৯৮৭ সালে বুলগেরিয়ার ওয়ার্কার্স পার্টি ও কমিউনিস্ট পার্টির যৌথ সভায় বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রিত প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন আজমী এবং অধ্যাপক আবদুল হাফিজ। এসব সফর সম্পর্কে তিনি বলেন, 'মূলত পার্টির কাজে বিভিন্ন সময় বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্রেমলিন, উজবেকিস্তান, কাজাকিস্তান, বোখারা গিয়েছি একাধিকবার। বুলগেরিয়া এবং পাকিস্তানও সফর করেছি। বিভিন্ন দেশের সমসাময়িক রাজনীতিবিদদের সঙ্গে আলাপ পরিচয়ের মাধ্যমে আমাদের একে অপরকে জানার সুযোগ হয়েছিল। বুলগেরিয়ার পার্টি নেতা বুলগেনিন আমাদের বিশেষভাবে সংবর্ধনা দেন। প্রায় দুসপ্তাহ সেখানে পর্যটক হিসেবে বেড়ানো এবং নানা রকম ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ আমাদের হয়েছে। এসব আনন্দের স্মৃতি মনকে সতেজ করে।'
মাওলানা আজমীর স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায় তার ব্যক্তিগত শখ ও রাজনৈতিক কারণে সংসার জীবনে অনিচ্ছার কথা। এ প্রসঙ্গে জানা যাক তার ভাষায়, 'আমার প্রধান শখ ছিল বিভিন্ন বই ও পত্র-পত্রিকা নিজে পড়া এবং পাড়ার তরুণদের পড়তে উদ্বুদ্ধ করা। পাঠক সৃষ্টির লক্ষ্যে নিজ এলাকা আবুরহাটে প্রগতি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেছি স্বাধীনতার পর। এ ছাড়া রবীন্দ্রসংগীত আমার খুব পছন্দ। মাঝে মধ্যে নিজে নিজে গানও গাই, যদিও বয়সের কারণে সুর তাল ঠিক থাকে না।
আমি বিয়ে করি ১৯৬৬ সালের ২২ মে, ৩৮ বছর বয়সে মিরসরাইয়ের প্রয়াত ছৈয়দুল হক মিয়ার মেয়ে আনোয়ারা বেগম লিলিকে। বাবা অনেক আগে থেকেই বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। কিন্তু পার্টির কাজে প্রয়োজনীয় সময় দিতে পারব না ভেবে আমি বিয়ে করতে রাজি হচ্ছিলাম না। বাবার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি না হওয়ায় তিনি ক্ষুব্ধ হন। ইতিমধ্যে আমি গ্রেপ্তার হওয়ার পর বাবা কান্নাকাটি শুরু করেন, একপর্যায়ে তিনি গুরুতর হৃদরোগে আক্রান্ত হন। সবাই বলাবলি করছিলেন তিনি মারা যাবেন। পার্টিতে আলাপ হলে কেউ কেউ বললেন, "লেলিন, মাও সে তুং বিয়ে করতে পারলে আমি-তুমি বিয়ে করলে ক্ষতি কী!" এ অবস্থায় বিয়ে করতে রাজি হই। অবশ্য কনের সঙ্গে কিছুটা পূর্ব পরিচয় আমার ছিল। আমার শ্বশুরের কাছ থেকেও ছোটকালে রাজনৈতিক দীক্ষা পেয়েছি। সে হিসেবে তিনিও আমার রাজনৈতিক গুরু। তার বাড়িতে নিয়মিত পার্টির বৈঠক হতো। আমি সেখানে যেতাম। তার মেয়ে লিলি মাঝেমধ্যে চা-নাশতা এনে দিত। সে হিসেবে তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হতো মাঝেমধ্যে। পাত্রী হিসেবে তার নাম প্রস্তাব করা হলে আমি রাজি হই। রাজনীতির কারণে পারিবারিক জীবনে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য কিংবা প্রয়োজনীয় সময় দিতে পারিনি। তবুও সে আমাকে বুঝত বলে কখনো কোনো সমস্যা হয়নি। আমার দুই মেয়ে তিন ছেলেকে নিয়ে এখনো আমরা ভালোই আছি। মেয়েদের বিয়ে হয়েছে। ছেলেরা চাকরি করছে (সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময়)।
লেখাটি মিরসরাইয়ের মাতৃকা হাসপাতালে আহমেদুর রহমান আজমীর কাছ থেকে নেওয়া সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তৈরি। তিনি বার্ধক্যজনিত রোগে ২০১১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি রাতে মিরসরাইয়ের নিজ বাড়িতে মারা যান।