পকেটমার, ‘দ্য বাইসাইকেল থিফ’ ও আমাদের সমাজ

Published : 19 April 2020, 02:36 PM
Updated : 19 April 2020, 02:36 PM

মার্চের শেষ দিনটিতে একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা 'করোনা দিন মজুরকে বানাল পকেটমার' শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ করেছে। সংবাদের বিষয় হলো 'নাটোরের গুরুদাসপুরের চাঁচকৈড় মাছবাজারে ৩০ বছর বয়সী এক যুবক পকেট মারতে গিয়ে জনগণের গণপিটুনির শিকার হয়েছে। ছেলেটির বাড়ি নাটোরের লালপুর উপজেলায়। কিছুদিন আগেও ছেলেটি দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালাতেন। বাড়িতে স্ত্রী, দুই সন্তান ও বৃদ্ধ মা রয়েছেন। করোনা পরিস্থিতির কারণে উপার্জন না থাকায় পরিবারের সদস্যেদের মুখে খাবার তুলে দিতে পারছিলেন না। তাই তিনি চাঁচকৈড় মাছ বাজারে এসে তিন চারজন ক্রেতার পকেটে হাত দেওয়ার পর আলিফ খলিফা নামে একজন ব্যবসায়ীর পকেটে হাত দিয়ে জনগণের কাছে ধরা পড়েন। যদিও পড়ে জনগণ তার সমস্যার কথা শুনে ৩০০ টাকা হাতে তুলে দিয়ে বিদায় দেয়।'

সংবাদটি নি:সন্দেহে বেশিরভাগ পাঠকের কাছে অন্য অনেকদিনের স্বাভাবিক সংবাদের মতো হলেও আমার কাছে সংবাদটির অন্য একটি বিশেষত্ব ও তাৎপর্য আছে। বিষয়টির সাথে হুবুহু মিলে যায় ১৯৪৮ সালে পরিচালক ভিত্তোরিও ডি সিকা নির্মিত 'দ্য বাইসাইকেল থিফ' নামের চলচ্চিত্রটির। সংক্ষেপে গল্পটি এমন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইতালি হেরে যাওয়ার পর সেখানে ব্যাপক বেকারত্ব, অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে মানুষ ক্ষুধা, দারিদ্র্যের মধ্যে দিনাতিপাত করছে। এর মধ্যে একটি 'পোস্টার লাগানোর চাকরি'র পদে একজন নিয়োগের প্রসঙ্গ আসে। এমন কাউকে নিয়োগ দেওয়া হবে  যার নিজের সাইকেল থাকতে হবে। সিনেমার মূল চরিত্র অ্যান্টোনিও রিক্কি দুইপুত্র ও স্ত্রী নিয়ে বেকার হিসেবে হতাশায় নিমজ্জিত। হাজার হাজার বেকারের সময়ে এই অ্যান্টোনিও রিক্কি বিয়েতে উপহার পাওয়া চাদরগুলো বিক্রি করে কাজটি পেলেন। ছেলে ব্রুনোকে নিয়ে কাজে দিয়ে সকাল বেলায় কাজে গেলেন। প্রথমদিনই পোস্টার লাগাতে গেলে সাইকেলটি চুরি হয়। এরপর চোরকে ধরতে বন্ধু এবং ছয়-সাত বছরের ছেলে ব্রুনোকে নিয়ে ইতালির সমগ্র রাস্তা, পুলিশ, সাইকেল মার্কেট, গির্জায় খুুঁজে বেড়ান। পরের দিন কাজে যেতে হবে অথচ সাইকেল পাওয়ার সম্ভাবনা একেবারে নাই জানার পর স্টেডিয়ামের বাইরে থেকে পার্ক করা একটি সাইকেল চুরি করবে বলে মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়। অনেক দোলাচলের পর ছেলেকে বাসে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তের পর রিক্কি একটা সাইকেল চুরি করে পালাতে চেষ্টা করে। রিক্কির চুরি করার দক্ষতা নেই তাই চুরি করে পালাবার সময় জনগণের কাছে ধরা পরে গণপিটুনি খায়। এদিকে বাস ধরতে না পেরে ছেলে ব্রুনো ফিরে এলে দেখে যে চুরির অপরাধে তার বাবাকে মানুষ মারছে। ছেলের 'বাবা, বাবা, বাবা' ডাক শুনে অপমানিত বাবাকে মানুষ ছেড়ে দেয়। অপমানিত, লজ্জাকর ও সংকোচবোধক চেহারা নিয়ে বাবা ছেলে পাশাপাশি হাঁটছে এর মধ্যে দিয়ে সিনেমাটি শেষ হয়।

'বাইসাইকেল থিফ' চলচ্চিত্রটি সমাজবিজ্ঞান ও অপরাধবিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীদের কাছে একটি ক্ল্যাসিক চলচ্চিত্র কারণ এখানে একজন মানুষের দরিদ্রতা ও সংকট কিভাবে সাধারণ মানুষকেও অপরাধীকরণের প্রক্রিয়ার  সাথে যুক্ত করে এবং বিশেষভাবে অপরাধ মনস্তত্ত্বের দিকগুলো কেমন তা বুঝতে অত্যন্ত সহযোগিতা করে।

যাহোক, বাংলাদেশে নাটোরের পকেটমারের দৃশ্যের সাথে 'বাইসাইকেল থিফ' চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাপটের ভিন্নতা থাকলেও একটি জায়গায় মিল আছে তা হলো দুজনই আর্থিক সংকটের কারণে অপরাধ করেছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের কালে বাংলাদেশেও প্রায় ৮ কোটি অতি দরিদ্র, বেকার, খেটে খাওয়া মানুষ রাষ্ট্রীয় নির্দেশে 'লকডাউন' এর মধ্যে কাজহীন, সম্বলহীন অবস্থায় বসবাস করছেন। যে মানুষগুলো রাস্তায় রিক্সা চালান, ফুটপাতে কিছু বিক্রি করেন, হোটেল-রেস্টুরেন্টে কাজ করেন, ফেরি করে জিনিসপত্র বিক্রি করেন তারা হঠাৎ করেই বেকার হয়ে গেলেন, কাজহীন হয়ে গেলেন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এর মহাপরিচালক গাই রাইডার বলছেন, 'বিশ্বজুড়ে অন্তত আড়াই কোটি মানুষ বেকার হয়ে যাবেন। কর্মীদের আয় কমবে ৩ লাখ ৪০ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের মত… চলছে কর্মী ছাঁটাই। বন্ধ হয়ে গেছে দোকানপাট, রেস্তোরাঁ… চাকরি হারানোর তালিকায় তারাই সবার আগে, যেমন বিক্রয়কর্মী, ওয়েটার, রাঁধুনি, কুলি-মজুর বা পরিচ্ছন্নতাকর্মী' (দৈনিক প্রথম আলো, ৩১ মার্চ ২০২০)। লকডাউনের সময়কাল থেকে যতদিন যাচ্ছে দরিদ্র পরিবারগুলোর হাহাকার বাড়ছে।

শহরে লকডাউন চলছে বলে দরিদ্র, নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলো নিরাপত্তার আশায় গ্রামে গেছে। গ্রামে কাজ নেই। জিনিস পত্রের দাম হুহু করে বেড়েছে। গ্রাম-শহরে মন্বন্তরের পরিস্থিতি। আকাল চলছে। আইএলও এর গাই রাইডার সুপারিশ করেছিলেন এভাবে, '…তীব্র মন্দার সময়ও তাদের সুরক্ষা দিতে হবে।…যারা আত্মকর্মসংস্থান, খণ্ডকালীন বা অস্থায়ী চাকরিতে যুক্ত এবং যাঁদের বেকার-ভাতা বা স্বাস্থ্যবীমার সুবিধা নেই, এ ধরনের দুর্বল শ্রেণির মানুষের পাশেই সবার আগে দাঁড়াতে হবে।'

সচেতন নাগরিক সমাজ, কিছু বামপন্থী কর্মীসমর্থক, চাকরিজীবী, ছাত্র-ছাত্রী স্বউদ্যোগে কিছু সাহায্য সহযোগিতা করলেও সরকারীভাবে ব্যাপক কোন সাহায্য সহযোগিতা নেই। একমাত্র সরকারের পক্ষ থেকে ত্রাণের জন্য দেওয়া স্বল্প মূল্যের চাল-ডাল বেহাত হয়ে গেছে বলে সংবাদপত্রে প্রকাশ হচ্ছে। প্রকৃত দরিদ্রদের অনেকেই তা পাচ্ছেনা বলে আমরা জানতে পারি। তাই গত কয়েকদিনের পত্রিকার পাতা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত মানুষের সংকট, হাহাকার ও দুঃখের দৃশ্যগুলো দেখলে প্রত্যেকটা মানবিক মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হওয়ার কথা। কাজের জন্য কেউ রাস্তায় বের হলে পুলিশ পেটাচ্ছে। একমুঠো চালের জন্য, কয়েকটি টাকার জন্য, একটু ত্রাণের জন্য মানুষের কি হাহাকার! কি যুদ্ধ! একটি প্যাকেট নিয়ে আট-দশজন মারামারি করছে! রাস্তায় ছড়িয়ে দেয়া টাকার জন্য ধস্তাধস্তি! ত্রাণ নাই, খাবার নাই, একটু নিশ্চয়তা নাই!

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই দরিদ্রতা, বেকারত্ব, ক্ষুধা, কাজহীনতা ও ত্রাণের জন্য হাহাকারের পরে কী? করোনাভাইরাস সংকটের ভবিষ্যত কী? সমাজবিজ্ঞান ও অপরাধবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে নিশ্চিতভাবেই এর দুটি প্রভাব পড়বে বলে আমি মনে করি। প্রথমটি হলো, দরিদ্র, কাজহীন বেকার মানুষগুলো পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখতে, টিকে থাকার চেষ্টায়, নিজের জীবন বাজি রেখে সব লজ্জা-সম্মান ভুলে অবশ্যই অপরাধে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হবে। অপরাধবৈজ্ঞানিক লিটারেচার তাই বলে। যেটা আমরা দেখতে পেলাম প্রবন্ধের প্রথমে দেওয়া একটি বাস্তব ঘটনা ও আরেকটি সিনেমার গল্পের মধ্যে। এবং তা প্রাচীনকাল থেকেই ঐতিহাসিক সত্য।

এমনকি গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল পর্যন্ত যেটা বলে গেছেন, 'দরিদ্রতা অপরাধ ও বিদ্রোহকে ত্বরান্বিত করে।' যা সকল সময়ে, সকল প্রেক্ষাপট বিবেচনায় অস্বীকারের সুযোগ নেই। উপার্জনকারী ব্যক্তি হিসেবে যে বাবা, ভাই, মা কিংবা অভিভাবক মানুষ নিজের কাঙ্ক্ষিত ভূমিকাগুলো পালন করতে সক্ষম না হয় তখন তার উপর একধরনের চাপ তৈরি হয়। বাধ্য হয়ে তার উপর তৈরি হওয়া চাপ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সে বাধ্যতামূলকভাবেই বিচ্যুত আচরণ ও অপরাধের সাথে যুক্ত হতে পারে, এবং সে সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়া যায়না। সামাজিক বিশৃঙ্খলার এই সময়ে যেকোন সহিংস আচরণ, আন্দোলন সংগ্রামও ব্যতিক্রম ব্যাপার নয়।

ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইম ও আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী রবার্ট কে মার্টন এই বিষয়গুলো নিয়ে তাদের তত্ত্বে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এখানে তা বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই। আমাদের মনে একটি প্রশ্ন আসতে পারে, যারা কোনদিন অপরাধ করেনি তারা কিভাবে এত দ্রুত অপরাধের সাথে যুক্ত হয়ে যাবে? বিষয়টি হলো তারা যখন ক্ষুদার মধ্যে থাকবে, বেকারত্ব গ্রাস করবে, আকালের সময়ে জীবনকে যাপন করবে তখন তাদের মধ্যে বৈষম্যের চেতনা, শ্রেণিশোষণের ধারণা জন্ম নিবে। তারা এবং অন্যরা এইভাবে ভাবতে শুরু করবে। এইরূপ পরিস্থিতিতে যেকোন কাজকেই তাদের কাছে বাস্তব ও নৈতিকতাপূর্ণ মনে হতে পারে। অথবা আমরা বলতে পারি নৈতিকতাহীন বাস্তবতা যেজন্য মার্কস ও রিচার্ড ক্যুইনি অপরাধীদের 'লুম্পেন প্রলেতারিয়েত' হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সামগ্রিকভাবে করোনাভাইরাস সংক্রমণের এই সময়ে মোট অপরাধের হার কমলেও গত তিন-চার দিনের পত্রিকায় ছিনতাই, চুরি, সিঁদেল চুরি, মাদক পাচারের খবরগুলো পড়লেই সংকট সময়ে কিভাবে সাধারণ মানুষ সাধারণভাবে অপরাধের সাথে এবং বিশেষ করে সম্পত্তি সংক্রান্ত অপরাধের সাথে যুক্ত হয় তা বুঝতে পারবেন।

দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, মানুষের আর্থিক সংকট বাড়লে, দারিদ্রের মধ্য দিয়ে গেলে, মনস্তাত্ত্বিক সংকটের চূড়ায় চলে গেলে- অনেককেক্ষেত্রেই 'আত্মহত্যা' করতে বা 'আত্মহত্যা প্রচেষ্টা' নিতে পারে। যাদের সামাজিক শ্রেণিগত অবস্থান ও শিক্ষা-দীক্ষা, সামাজিক মূল্যবোধ মধ্যবিত্তের সামাজিক অবস্থানের সাথে মিলে যায়, তাদের অনেকেই অপরাধ প্রক্রিয়ার সাথে বিভিন্ন কারণে বাস্তবেই যুক্ত হতে পারেনা। এ অবস্থায় অর্থনৈতিক সংকট, বেকারত্ব, মূল্যবোধগত মনস্তাত্বিক সংকটের কারণে বাধ্য হয়েই আত্মহত্যার মত নেতিবাচক কাজের সাথে যুক্ত হতে পারেন বলেই পাশ্চাত্যের সমাজবিজ্ঞানী ও অপরাধবিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণামূলক বইপত্র, প্রবন্ধ ও রিপোর্টগুলোতে মতামত দিয়েছেন। যা করোনাকালীন  ও তার পরবর্তী প্রভাবের সময়ে বাংলাদেশেও অনেকক্ষেত্রে সত্য হতে পারে। যদিও এখানে বহুমুখী কারণও ক্রিয়াশীল থাকতে পারে। উপর্যুক্ত পর্যবেক্ষণকে অনেকেই আংশিক পর্যবেক্ষণ হিসেবে নিলেও আমরা যারা অপরাধবিজ্ঞানের সাথে যুক্ত আছি তারা জানি যে, সমাজে অপরাধীকরণের প্রক্রিয়াই হলো এটি।

তাই অবিলম্বে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও দরিদ্রশ্রেণির মানুষকে অপরাধ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওয়ার প্রেক্ষাপট তৈরির আগেই সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনির আওতায় সমন্বিত নীতিমালা তৈরি ও বাস্তবায়নে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ, মন্ত্রণালয়কে কাজ করতে হবে তবেই এই ধরনের সংকট থেকে মুক্ত হতে পারবো বলে আমার বিশ্বাস।