Published : 07 Feb 2020, 05:35 PM
অ্যান্থনি ফন লিউয়েনহুক যখন আজ থেকে মাত্র সাড়ে তিনশ বছর আগে আতশী কাঁচের নিচে কিলবিল করা প্রাণগুলোকে দেখতে পেলেন, তখনো তিনি জানেন না যে তিনি এক নতুন দুনিয়ার সন্ধান পেয়ে গেছেন। তিনিই প্রথম আণুবীক্ষণিক প্রাণের দুনিয়াকে মানুষের সামনে উন্মোচিত করেন, ওই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণগুলোর নাম দেন 'এনিম্যালকুলস'। ইতিহাসের শুরু থেকেই মানুষ এই অণুজীবদের আক্রমণের শিকার হয়েছে, প্রাণ হারিয়েছে কোটিতে কোটিতে, অথচ কারা এই প্রাণহাণির কারণ তা মানুষের বুঝে উঠতে লেগেছে লাখ লাখ বছর। ক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়া আবিষ্কারেরও বেশ কিছু সময় পর, রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাস সম্পর্কে মাত্র মানুষ জানতে শুরু করে উনবিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষভাগে।
কয়েকশ বছর আগেও এই বিপর্যয় সৃষ্টিকারী মহামারীগুলোর কারণ হিসেবে অণুজীবকে কল্পনা করা দুরূহ ছিল। বিভিন্ন দেব-দেবীর কর্মকাণ্ড, বা মানুষের পাপের শাস্তি ইত্যাদিকে অণুজীবসৃষ্ট মহামারীর কারণ হিসেবে কল্পনা করা হতো। কিছুদিন আগেও আমাদের দেশের মানুষ কলেরার কারণ হিসেবে কাল্পনিক 'ওলা বিবি'কেই চিহ্নিত করতো, জহির রায়হানের 'হাজার বছর ধরে' উপন্যাসে যার উল্লেখ আমরা পাই। মানুষ কারণ সম্পর্কে জানুক আর না জানুক, ইতিহাসে এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুজীবসৃষ্ট মহামারীর প্রভাবে সভ্যতা ধ্বংস হয়েছে, পাল্টে গেছে সমাজ সংগঠন-অর্থনীতি। মহামারীর ইতিহাস ও মানুষের মধ্যে তার প্রভাব নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, বইপত্র লেখা হয়েছে।
মানুষের প্রাচীন ফসিল বিশ্লেষণ করে স্মলপক্স, টিউবারকুলোসিসসহ বিভিন্ন রোগের নিদর্শন পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। আদিম মানুষ যেহেতু জানতো না অণুজীব সম্পর্কে, অণুজীব থেকে বাঁচতে তার নিজের শরীরেরা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় ছিল না। কখনো কখনো দৈবক্রমে কোন ভেষজ গুণাবলী সম্পন্ন ফল-মূল, লতাপাতা ইত্যাদি তাদের বিভিন্ন রোগ থেকে রক্ষা করলেও, অণুজীবের বিরুদ্ধে সচেতন লড়াই তাদের করা সম্ভব ছিল না।
প্রাচীন যুগে যুগে মানুষ যেহেতু ছিল ছোট ছোট গোত্রে বিভক্ত, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় তারা দ্রুত চলে যেত, জীবনযাপন ছিল যাযাবর ধরনের, তখন মহামারীর ব্যাপক বিস্তৃতি সেভাবে সম্ভবপর ছিল না। আজ থেকে প্রায় বারো হাজার বছর আগে মানুষ কৃষি বিপ্লবের ফলে যাযাবর জীবন থেকে জমিতে থিতু হওয়া শুরু করে, পত্তন হয় নগর সভ্যতার। উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে জনসংখ্যা যেমন বাড়লো, তেমনি বাড়লো রোগ বালাইয়ের প্রকোপ। মানুষ পশুপাখিকে যখন গৃহপালিত করতে শিখলো, তখন সেই গৃহপালিত পশু পাখি থেকেও মানুষ সহজে সংক্রমিত হয়েছে। অন্যদিকে, নগর সভ্যতায় বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা, পয়নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা একটা জটিল কাজ। সেই কারণেও মহামারী ব্যাপক আকার ধারণ করে। এর ফলে গ্রামকে গ্রাম উজার হয়েছে, নগরসভ্যতা হারিয়ে গেছে মহামারীতে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক রচনাতে আমরা এসব মহামারী ও মানব সভ্যতায় তার সুদূরপ্রসারী প্রভাবের নিদর্শন পাই। ওল্ড টেস্টামেন্টে যেমন ঈশ্বরের শাস্তি হিসেবে মহামারীর নিদর্শন আমরা পাই, তেমনি প্রাচীন গ্রিসের ইতিহাসবিদ থুসিসাইডিসের রচনাতেও মহামারীর উল্লেখ পাওয়া যায়। থুসিসাইডিসের রচনা থেকে আমরা জানি, পেলোপনেশিয়ান যুদ্ধ যখন সংগঠিত হয়েছিল গ্রিক নগররাষ্ট্র এথেন্স ও স্পার্টার মধ্যে তখন টাইফাস মহামারীতে এথেন্সের জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ মারা যায়, যার কারণে স্পার্টার জয়লাভ সম্ভব হয়েছিল।
ইতিহাস থেকে আমরা জানি, ১৬৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮০ খ্রিস্টাব্দে রোমে স্মল পক্স মহামারীতে বহু মানুষ মারা যায়, রাজপরিবারের সদস্যরাও এর প্রকোপ থেকে বাঁচেনি। বিখ্যাত রোমান সম্রাট মার্কাস অরেলিয়াসের ভাই লুইসিয়াস ভেরাসের মারা গিয়েছিলেন। ২৫০ খ্রিস্টাব্দে সাইপ্রিয়ানের প্লেগ মহামারী রোমান সাম্রাজ্যকে দুর্বল করে দেয়। এর পর, পঞ্চম শতাব্দীতে একদিকে যুদ্ধ অন্যদিকে এই মহামারী পরাক্রমশালী পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যকেই শেষ করে দেয়। আবার ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথমভাবে সালে রোমান সাম্রাজ্যেও পূর্ব অংশের সম্রাট জাস্টিনিয়ান ওয়ান, রোমান সাম্রাজ্যকে আবার আগের মত প্রতাপশালী অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেন, বিউবনিক প্লেগ মহামারীতে তাঁর মৃত্যু সেই সম্ভাবনাকেও শেষ করে দেয়। পরবর্তী দুই শতাব্দীতে বিউবনিক প্লেগে প্রায় ৫ কোটি মানুষ মারা যায়, যা তৎকালীন জনসংখ্যার ২৬ শতাংশ।
১৩৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে 'দ্য ব্ল্যাক ডেথ' বলে পরিচিত প্লেগ মহামারী পৃথিবীর জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশের মৃত্যুর কারণ হয়। এই রোগ সম্ভবত এশিয়ায় উৎপত্তি হয় এবং পরবর্তীতে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। এই প্লেগের কথা বিভিন্ন সাহিত্যে উঠে এসেছে, এবং আমরা দেখেছি গোটা ইউরোপের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এটা ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। গোটা ব্রিটেনের সামন্ত ব্যবস্থা এই প্লেগের কারণে বিপর্যস্ত হয় এবং নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার শর্ত তৈরি হয়। গ্রিনল্যান্ডের প্রতাপশালী ভাইকিং জলদস্যুরা এই মহামারীর ফলে সমুদ্রে তাদের নিয়ন্ত্রণ হারায়। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে, ক্যারিবিয়ান দীপপুঞ্জে স্প্যানিশ বণিকেরা নিয়ে আসে ভয়ংকর স্মলপক্স, বিউবনিক প্লেগ ও হামের মত জীবাণু। ইউরোপিয়ানরা এইসব রোগ প্রতিরোধী হলেও ক্যারিবিয়ানের মানুষের শরীরে এই রোগের প্রতিরোধ করার ক্ষমতা ছিল না। এর ফলে প্রায় ৯০ ভাগ আদিবাসী জনগোষ্ঠী এইসব রোগে মারা যান। উপনিবেশিক শক্তি গোটা আমেরিকা মহাদেশে শুধু তরবারি দিয়েই হত্যা করে নি, রোগ বালাই নিয়ে এসেও মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে। ১৫২০ সালে ইউরোপিয়ানদের সাথে আসা একজন আফ্রিকান দাস স্মলপক্স নিয়ে আসলে গোটা অ্যাজটেক সাম্রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে এই মহামারী। সাম্প্রতিক গবেষণা, বলছে ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে ইউরোপিয়ানদের বয়ে আনা জীবাণুর কারণে আমেরিকা মহাদেশে প্রায় ৫ কোটি ৬০ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। আদিবাসীদের এই গণহারে মৃত্যু গোটা আমেরিকা মহাদেশে ইউরোপিয়ানদের আধিপত্য করার সুযোগ করে দেয়।
১৬৬৫ সালের দিকে 'দ্য গ্রেট প্লেগ অব লন্ডন'-এ লন্ডনের জনসংখ্যার ২০ শতাংশ মৃত্যুবরণ করে। এছাড়া, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সাথে সাথে সৈনিকদের মাধ্যমে ভারতবর্ষে কলেরা ছড়িয়ে পরে। ভারতবর্ষ ছাড়াও স্পেন, আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া, চীন, জাপান, ইতালি, জার্মানি ও আমেরিকায় দেড়শ বছরের মধ্যে প্রায় দেড় কোটি মানুষ কলেরায় মারা যায়। ১৮৫৫ সালের দিকে চীন, হংকং ও ভারতে প্রায় দেড় কোটি মানুষ প্লেগে মারা ভুগে যায়। ১৯১৮ সালে শুরু হওয়া স্প্যানিশ ফ্লুতে পৃথিবীতে মারা যায় ৫ কোটি মানুষ। মহামারীর এরকম বহু নিদর্শন পাওয়া যায় ইতিহাসে, যা শুধু মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে এমন নয়, গোটা সমাজ-রাজনীতির সমীকরণকেই বদলে দিয়েছে। মহামারী বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের ডেমোগ্রাফিকে বদলে দিয়েছে, বদলে দিয়েছে তার অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে, রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহেও ফেলেছে সুদূরপ্রসারী প্রভাব।
আজকের যুগে বিজ্ঞানীরা খুব কম সময়ের মধ্যে এখন মহামারীর জন্য দায়ী অণুজীবকে সনাক্ত করতে পারেন। তবুও ক্রমবর্ধমান অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স, ভাইরাসের জিন নকশা পরিবর্তন ইত্যাদি মানুষকে আজও বিপর্যয় সৃষ্টিকারী মহামারীর বিপদে ফেলছে। জীবাণুঘটিত মহামারীতে আগের মত এক ধাক্কায় লক্ষ কোটি মানুষের মৃত্যু বা একটা গোটা সভ্যতার পতন হয়ে যাওয়ার মত সম্ভাবনা আপাতত দেখা না গেলেও, আণুবীক্ষণিক অণুজীবেরা যে এই একবিংশ শতাব্দীতেও মানুষের জীবন সংহার করতে এবং জীবনযাত্রাকে স্থবির করতে সক্ষম তার প্রমাণ আমরা প্রায়শই দেখছি। এর সর্বশেষ উদাহরণ মহামারী সৃষ্টিকারী নভেল করোনাভাইরাস।
করোনাভাইরাস কোনো নির্দিষ্ট ভাইরাসের নাম নয়, বরং এটি ভাইরাসদের এক 'ফ্যামিলি'কে নির্দেশ করে। এই ভাইরাস একটি এক সূত্র বিশিষ্ট আরএনএ নিয়ে গঠিত, যে আরএনএ'র মিউটেশন- এর কারণে করোনাভাইরাস গোত্রের ভাইরাসগুলো প্রাণীদেহ থেকে মানবদেহে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। প্রাকৃতিকভাবে ঘটা এই মিউটেশনের কারণে ভাইরাস নিজেকে বদলে ফেলে, সে কারণেই নতুন নতুন মহামারী দেখা দেয়, এবং নতুন করে যুদ্ধে নামতে হয়ে অণুজীববিজ্ঞানীদের। এর আগে ২০০২ সালের নভেম্বর থেকে ২০০৩ সালের জুলাইয়ের মাঝে এই করোনাভাইরাস গোত্রেরই আরেক সদস্য সার্স (সিভিয়ার একিউট রেস্পিরেটরি সিনড্রোম) ভাইরাস ১৭টি দেশে ৭৭৪ মানুষের প্রাণ সংহার করেছিল। ২০১২ সালে সৌদি আরব থেকে উৎপন্ন এই গোত্রেরই আরেকটি ভাইরাস মার্স (মিডল ইস্ট রেস্পিরেটরি সিনড্রোম) মধ্যপ্রাচ্যে মহামারী সৃষ্টি করেছিল। বিজ্ঞানীরা জেনেছেন, সার্স ভাইরাসটি ছড়িয়েছিল বাদুড় থেকে, আবার মার্স এসেছিলো উট থেকে। নভেল করোনাভাইরাসটি চীনের উহান প্রদেশে একটি পশুপাখির বাজার থেকে ছড়িয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন।
চীনে এখন পর্যন্ত নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণকারীর সংখ্যা সাড়ে ছয়শ ছুইছুই করছি। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ ২৪টি দেশে ৩০ হাজারের বেশি মানুষের দেহে পাওয়া গেছে এই ভাইরাসের সংক্রমণ। ভাইরাসটির উপস্থিতি পাওয়া গেছে আমাদের পাশ্ববর্তী ভারত ও নেপালেও। বিস্তৃতি ও ক্ষয়ক্ষতির দিক থেকে সার্স ও মার্সসৃষ্ট মহামারীকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে এই নভেল করোনা ভাইরাসসৃষ্ট মহামারীটি। ইতিমধ্যে চীনের বিভিন্ন প্রদেশে জীবনযাত্রা স্থবির হয়ে পড়েছে। শুধু চীন নয়, গোটা বিশ্বের অর্থনীতিতে এই ভাইরাস বিপর্যয়কর প্রভাব রাখতে শুরু করেছে।
নভেল করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে বিশ্বব্যাপী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার এই করোনাভাইরাস সম্পর্কে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাও নিচ্ছে। নভেল করোনাভাইরাসের পূর্ণাঙ্গ জিন নকশা উন্মেচিত হয়েছে, এর বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন তৈরির প্রক্রিয়াও এগিয়ে নিচ্ছেন বিভিন্ন দেশের অণুজীববিজ্ঞানীরা। চীন সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে এই ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে, মাত্র ১০দিনে তারা নির্মাণ করেছে আক্রান্তদের জন্য একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল। জীবাণুর সাথে যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই যুদ্ধে আজ মানুষের হাতে রয়েছে জ্ঞানসম্পদ এবং আধুনিক জৈবপ্রযুক্তির অস্ত্র। নভেল করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আনা বা এর প্রতিষেধক আবিষ্কার এখন মানুষের পক্ষে সম্ভব হলেও, তার আগেই এই ভাইরাসটি বিশ্বব্যাপী কতটা ক্ষতি ডেকে আনে তাই এখন দেখার বিষয়।
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে এই নভেল করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি না পাওয়া গেলেও আমাদের সতর্ক থাকার বিকল্প নেই। বাংলাদেশের মত জনবহুল দেশে এই ভাইরাস সংক্রমণ শুরু হলে তা বেশ বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। সম্প্রতি চীনের উহান ও অন্যান্য প্রদেশ থেকে বাংলাদেশিদের ফেরত আনা হয়েছে একটি বিশেষ বিমানে। কিন্তু দেশে ফিরিয়ে এনে তাদের যে পরিবেশে ও পদ্ধতিতে 'কোয়ারেন্টাইন' করে রাখা হয়েছিল, সেটি এই ধরনের ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে বাংলাদেশের প্রস্তুতি ও সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সম্প্রতি চীন থেকে আগত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে আমাদের বিমানবন্দরে গৃহীত স্ক্রিনিং ব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এসব ক্ষেত্রে ন্যূনতম গাফিলতি বা অদক্ষতা দেশকে একটি বড় বিপর্যয়ের মুখোমুখি করতে পারে।
আমাদের মনে রাখতে হবে মহামারী প্রতিরোধে শুধু বিজ্ঞানীদের কাজ করলেই চলে না, রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের এই মহামারী ঠেকাতে উপযুক্ত উদ্যোগ নিতে হয়। সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে হয়, রোগ প্রতিরোধ সম্পর্কে সাধারণ ধারণা দিতে হয়। এক্সপার্টদের জ্ঞানকে মাঠপর্যায়ে কাজে লাগাতে হয়। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে লড়াই করতে হয় মহামারীর বিরুদ্ধে। বাংলাদেশে সরকারকে এখন থেকেই সম্ভাব্য সংক্রমণ মোকাবিলার সর্বাত্মক কার্যকর প্রস্তুতি নিতে হবে। স্বল্প সময়ে রোগ নির্ণয় ও ভাইরাস সনাক্ত, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও জরুরি চিকিৎসা পরিসেবার ব্যবস্থা করতে হবে গোটা দেশে। এর পাশাপাশি আতঙ্ক না ছড়িয়ে করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য সংক্রমণের সম্ভাবনা সম্পর্কে জনসাধারণকে অবহিত করা, প্রচারমাধ্যম ব্যবহার করে এই সম্ভাব্য সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের কী ভূমিকা থাকতে পারে সেই বিষয়ে ব্যাপক প্রচার করা দরকার। সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি না করে মহামারী মোকাবেলা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
অণুজীববিজ্ঞান, জিন প্রকৌশল ও জৈবপ্রযুক্তির প্রসারের এই যুগে, মানুষ যেমন এখন মহামারী সংক্রান্ত দুর্যোগ সামলাতে যেমন ইতিহাসের যেকোন সময়ের তুলনায় বেশি সক্ষম, তেমনি এই গ্লোবাল ভিলেজে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি ঘটায় রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু মানুষের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও বেশি। অথচ, মহামারী ব্যবস্থাপনায় বিশ্বের সব দেশ সমানভাবে প্রস্তুত নয়। বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশে মহামারী প্রতিরোধের জন্য পর্যাপ্ত সচেতনতা ও গবেষণা, মাঠ পর্যায়ের কাজের ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। এসব দেশে কম আয়ের মানুষেরা আছে বিরাট স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। আজকের যুগে কেবল মহামারীর কারণ ও এর প্রতিরোধের রাস্তা আবিষ্কারই যথেষ্ট নয়, পাশাপাশি বিশ^ব্যাপী মহামারী ব্যবস্থাপনাও অত্যন্ত জরুরি।