কে বলে প্রকৃতিবিরুদ্ধ?

অভিজিৎ রায়
Published : 28 July 2013, 09:37 AM
Updated : 28 July 2013, 09:37 AM

সম্প্রতি নানা কারণে সমকামিতা বিষয়টি আমাদের দেশে আলোচনায় উঠে এসেছে। এ নিয়ে ফেসবুকসহ সোশাল মিডিয়ায়ও বিভিন্ন ধরনের আলোচনা চলছে। সমকামিতা নিয়ে বেজায় বিব্রত আমাদের সমাজ। শব্দটা শুনলেই যেন আঁতকে উঠে। সমাজের শক্তপোক্ত ভিত্তিটা বুঝি আগাগোড়া কেঁপে উঠে। কাঠমোল্লারা গালি দিয়ে বসেন- 'সমকামীরা হচ্ছে খচ্চর স্বভাবের, কুরুচিপূর্ণ, মানসিক বিকারগ্রস্ত'!

এমনকি প্রগতিশীলদের মধ্যেও রয়েছে নানা ওজর-আপত্তি। যারা 'আধুনিক' শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন, গে-লেসবিয়ান ইত্যাকার তথাকথিত 'পশ্চিমা' শব্দের সঙ্গে কমবেশি পরিচিত, তারাও খুব কম ক্ষেত্রেই ব্যাপারটি মন থেকে 'স্বাভাবিক' বলে মেনে নিতে পারেন।

তাদের অনেকেই একে 'প্রকৃতিবিরুদ্ধ' মনে করেন। আর নয়তো ভাবেন– এটা উৎকট ব্যতিক্রমধর্মী কিছু– এ নিয়ে 'ভদ্র সমাজে' যত কম আলোচনা হয় ততই মঙ্গল। উপরে উপরে না বললেও ভিতরে ভিতরে ঠিকই মনে করেন, সমকামীরা হচ্ছে গা-ঘিনঘিনে বিষ্ঠা– কৃমিজাতীয় এঁদো জীব। মরে যাওয়াই মনে হয় এদের জন্য ভালো। সমাজ-সভ্যতা রক্ষা পায় তাতে!

'সমকামিতা' নিয়ে একটা বই লিখেছিলাম বছর কয়েক আগে। বইটির পুরো শিরোনাম 'সমকামিতা: একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান' । বইটি ২০১০ সালে শুদ্ধস্বর থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। ঘূণাক্ষরেও ভাবতে পারিনি যে, এত তাড়াতাড়ি বইটির সংস্করণ নিঃশেষ হয়ে যাবে। একে তো এটি মোটেও 'মেইনস্ট্রিম' ধারার নয়, তার উপর ব্যাপারটা আমাদের দেশের অনগ্রসর সমাজে 'ট্যাবু টপিক' হিসবেই পরিচিত। এমনকি যারা প্রগতিশীল বলে পরিচিত, তারা এ ধরনের বই বুকশেলফে রাখার জন্য কিনবেন তা আমার ধারণায় ছিল না।

মাত্র দুবছরের মাথায় যখন বইটির সব কপি বিক্রি হয়ে গেল, বুঝলাম আমার ধারণা ঠিক ছিল না। পাঠকরা বইটি কিনেছেন তো বটেই, অনেকে মেইল করে জানিয়েছেন যে, তারা এত উপকৃত হয়েছেন যে, অন্যদেরও কেনার জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন। শুধু সমকামী কিংবা রূপান্তরকামী ব্যক্তিরা নয়, বইটি পড়ে উপকৃত হয়েছেন বহু বিষমকামী ব্যক্তিও। এমনকি মেডিকেলের ছাত্ররা আমাকে মেইল করে জানিয়েছেন যে, এত বিস্তৃত পরিসরে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা বাংলাদেশের অন্য কোনো বইয়ে তারা পাননি। ব্যাপারটি আমার জন্য নিঃসন্দেহে আনন্দের ও গর্বের।

বইটিতে বৈজ্ঞানিক তথ্য-প্রমাণ হাজির করে দেখাতে চেষ্টা করেছিলাম যে, সমকামিতা বিকৃতি বা মনোরোগ নয়, এটি যৌনতারই আরেকটি স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। ২০০৬ সালের হিসেব অনুযায়ী বিজ্ঞানীরা প্রাণিজগতে পনেরশ'রও বেশি প্রজাতিতে সমকামিতার সন্ধান পেয়েছেন। আর মেরুদণ্ডী প্রাণির তিনশ'রও বেশি প্রজাতিতে সমকামিতার অস্তিত্ব খুব ভালোভাবেই নথিবদ্ধ। সংখ্যাগুলো কিন্তু প্রতিদিনই বাড়ছে।

ওদিকে নৃতত্ত্ববিদরা এমন কোনো মানবসমাজ পাননি যেখানে সমকামিতা বলে কিছু নেই। সমকামিতা ছিল গ্রিক ও রোমান সাম্রাজ্যে, সাইবেরিয়ান সামানদের মধ্যে, নেটিভ আমেরিকানদের সমাজে, আফ্রিকান ট্রাইবে, চৈনিক রাজবংশে, আরব ও ভারতীয় সভ্যতায়। সেই প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীর তাবৎ সাহিত্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, শিল্পকলা, দর্শন, পুরাণ কিংবা প্রত্নতত্ত্ব বিশ্লেষণ করে গবেষকেরা জেনেছেন, সমকামী মনোবৃত্তিসম্পন্ন মানুষেরা ইতিহাসের প্রতিটি ক্ষণে, প্রতিটি মুহূর্তে এবং প্রতিটি স্থানেই ছিলেন। তারপরও অনেকেই একে 'প্রকৃতিবিরুদ্ধ', 'অস্বাভাবিক', 'অনাচার' ইত্যাদি বিশেষণে বিশেষায়িত করে থাকেন।

আসলে এ ধরনের শব্দচয়ন এবং ঢালাওভাবে তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে খোলামনে বিষয়টি পর্যালোচনা করা দরকার। বাংলায় এমন একসময় বাল্যবিবাহ ছিল 'স্বাভাবিক' (রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমসহ অনেকেই বাল্যবিবাহ করেছেন); আর বাইরে মেয়েদের কাজ করা ছিল 'প্রকৃতিবিরুদ্ধ'।

এ যুক্তি এখন মানতে গেলে কপালে টিপ আর হাতে দুগাছি সোনার বালা পরে গৃহকোণ উজ্জ্বল করে রাখা রাবীন্দ্রিক নারীরাই সত্যিকারের 'প্রাকৃতিক'! আর শতসহস্র আমিনা-রহিমা যারা রোদ্দুরে-বৃষ্টিতে ভিজে ইট ভেঙে, ধান ভেনে সংসার চালাচ্ছেন কিংবা পোশাক শিল্পে নিয়োজিত থেকে শ্রমে-ঘামে নিজেদের উজাড় করে দিচ্ছেন– এরা সবাই 'প্রকৃতিবিরুদ্ধ' কুকর্মে নিয়োজিত! কারণ 'প্রকৃতিই বলে দিচ্ছে যে, বাইরের কাজ মেয়েরা করতে পারবে না'।

বাংলাদেশের অখ্যাত আমিনা-রহিমাদের কথা বাদ দিই। আমেরিকায় নাসা থেকে শুরু করে মাইনিং ফিল্ড পর্যন্ত এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে মেয়েরা পুরুষদের পাশাপাশি কাজ করছেন না। তাহলে?

তাহলে আর কিছুই নয়। নিজের যুক্তিকে তালগাছে তোলার ক্ষেত্রে 'প্রকৃতি' খুব সহজ একটি মাধ্যম। অনেকের কাছেই। তাই প্রকৃতির দোহাই পাড়তে আমরা 'শিক্ষিতজনেরা' বড্ড ভালবাসি। প্রকৃতির দোহাই পেড়ে আমরা মেয়েদের গৃহবন্দি রাখি, জাতিভেদ বা বর্ণবাদের পক্ষে সাফাই গাই, অর্থনৈতিক সাম্যের বিরোধিতা করি। তেমনই সময় সময় আমরা সমকামী ও উভকামীদের বানাই 'অচ্ছুৎ'!

কিন্তু যারা যুক্তি নিয়ে একটু-আধটু পড়াশোনা করেছেন তারা জানেন যে, প্রকৃতির দোহাই পাড়লেই তা যুক্তিসিদ্ধ হয় না। বরং প্রকৃতির কাঁধে বন্দুক রেখে মাছিমারার অপচেষ্টা জন্ম দেয় এক ধরনের কুযুক্তি বা হেত্বাভাসের (logical fallacy)। এ ধরনের ফ্যালাসি-আক্রান্ত বক্তব্য যারা দিতে পছন্দ করেন, তাতে যত না যুক্তির ছোঁয়া থাকে, তার চেয়ে ঢের বেশি লক্ষ্যণীয় 'প্রকৃতি' নামক মহাস্ত্র পুঁজি করে গায়ের জোরে পাহাড় ঠেলার প্রবণতা।

সংখ্যাগরিষ্ঠ ষাঁড়দের স্বভাবজাত 'অ্যাপিল টু নেচার'এর শিকার হচ্ছেন সমকামীরা। একসময় সমকামীদের প্রতি সুপরিকল্পিত উপায়ে ও সাংগঠনিকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ঘৃণা। একে দেখা হয়েছে মনোবিকার, মনোবৈকল্য বা বিকৃতি হিসেবে। সমকামীদের সংস্রব থেকে দূরে থাকার প্রবণতা অনেক দেশেই আছে। কখনও কখনও সমকামীদের ঠেলে দেওয়া হয়েছে আত্মহননের পথে। আর এগুলোতে পুরোমাত্রায় ইন্ধন যুগিয়ে চলেছে ধর্মীয় সংগঠন ও রক্ষণশীল সমাজ।

সমকামীদের প্রতি হিংসাত্মক মনোবৃত্তির কারণে ইংরেজিতে সৃষ্টি হয়েছে নতুন একটি শব্দ– হোমোফোবিয়া (Homophobia)– মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি নিতান্ত অন্যায়। মানবাধিকার এবং সমানাধিকারের প্রেক্ষাপট থেকে এগুলো নিয়ে পরে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করার আগে সমকামিতা বলতে আসলে কী বোঝায় তা আমাদের জানা দরকার।

সমকামিতার ইংরেজি প্রতিশব্দ 'হোমোসেক্সুয়ালিটি' তৈরি হয়েছে গ্রিক 'হোমো' এবং ল্যাটিন 'সেক্সাস' শব্দের সমন্বয়ে। ল্যাটিন ভাষায়ও 'হোমো' শব্দটির অস্তিত্ব রয়েছে। তবে 'ল্যাটিন হোমো' আর 'গ্রিক হোমো' সমার্থক নয়। ল্যাটিন 'হোমো' অর্থ মানুষ। ওই যে আমরা নিজেদের 'হোমোস্যাপিয়েন্স' ডাকি– তা এসেছে ল্যাটিন ভাষা থেকে। কিন্তু গ্রিক ভাষায় 'হোমো' বলতে বোঝায় 'সমধর্মী' বা 'একই ধরনের'। আর 'সেক্সাস' শব্দের অর্থ 'যৌনতা'। তাই সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বোধ করার (যৌন) প্রবৃত্তিকে বলে 'হোমোসেক্সুয়ালিটি'।

প্রকৃতিতে সমকামিতার কিছু উদাহরণ

প্রথম কথা হচ্ছে, সমকামিতার ব্যাপারটি নিখাদ বাস্তবতা। শুধু মানুষ নয়, প্রাণিজগতের ক্ষেত্রেই। জীববিজ্ঞানী ব্রুস ব্যাগমিল তার 'বায়োলজিকাল এক্সুবারেন্স: অ্যানিমেল হোমোসেক্সুয়ালিটি অ্যান্ড ন্যাচারাল ডাইভার্সিটি' বইয়ে প্রায় পাঁচশ প্রজাতিতে সমকামিতার অস্তিত্বের উদাহরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। গুগলে বা উইকিপিডিয়ায় সার্চ দিলেই যে সব প্রজাতিতে সমকামিতার আলামত পাওয়া গেছে তার তালিকা পাওয়া যাবে। আমার বইয়েও অনেক উদাহরণ হাজির করেছিলাম।

তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ, টেক্সাস, মেক্সিকো এবং নিউ মেক্সিকোর 'হুইপটেল গিরগিটি'। পাঠকরা হয়তো অবাক হবেন জেনে যে, এ প্রজাতির সব প্রাণিই নারী। তাদের পুরুষ শয্যাসঙ্গীর দরকার নেই। কিন্তু তারপরও তাদের মধ্যে সেক্স-সদৃশ একধরনের ব্যাপার ঘটে। দেখা গেছে এক গিরগিটি আরেক গিরগিটিকে যদি জড়িয়ে ধরে রাখে তাহলে তাদের ডিমপাড়ার হার বেড়ে যায়। প্রকৃতির সমকামী প্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত! তাই জীববিজ্ঞানী জোয়ান রাফগার্ডেন এ গিরগিটিকে 'লেসবিয়ান লিজার্ড' হিসেবে তার 'ইভল্যুশনস রেইনবো' বইয়ে উল্লেখ করেছেন।

যৌনতার মাধ্যমে বংশবৃদ্ধির ব্যাপারটি যেহেতু বিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি, সেহেতু বহু বিজ্ঞানীই প্রাণিজগতের মাঝে বিদ্যমান সমকামিতাকে প্রথমদিকে তেমন গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেননি। তারা প্রকৃতিতে সমকামিতা দেখেছেন। কিন্তু ভেবে নিতেন যে এটি বিবর্তনের বিচ্যূতি, তাই এ নিয়ে গবেষণার দরকার নেই।

যেমন, ল্যারিএস গিস্ট নামের এক বিজ্ঞানী ক্যানাডিয়ান রকি পর্বতমালায় পাহাড়ি মেষদের মধ্যকার সমকামিতা পর্যবেক্ষণ করেও সেটা গুরুত্ব দিয়ে গবেষণায় লিপিবদ্ধ করেননি। আজ তিনি সেই 'ব্যর্থতা'র জন্য প্রকাশ্যেই দুঃখ প্রকাশ করেন। ব্রুস ব্যাগমিলের 'বায়োলজিকাল এক্সুবেরেন্স' বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর বিজ্ঞানীদের চিন্তাভাবনা অনেকটা বদলে গেছে। তারা সমকামিতাকে গুরুত্ব দিয়েই জীববিজ্ঞানে গবেষণার দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করেন। টাইম ম্যাজাজিনে এ নিয়ে আলোচনা-
http://www.time.com/time/magazine/article/0,9171,990813,00.html

ব্রুস ব্যাগমিলের পর অন্যান্যরাও বিষয়টি নিয়ে গবেষণা চালিয়ে গেছেন। এ প্রসঙ্গে জীববিজ্ঞানী পিটার বকম্যানের উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য–

"এমন কোনো প্রজাতির অস্তিত্ব নেই যেখানে সমকামিতা দেখা যায় না– অবশ্য কিছু ব্যতিক্রমী প্রজাতি ছাড়া যাদের মধ্যে আসলে সেক্স ব্যাপারটাই নেই– যেমন আরচিন (sea urchin) কিংবা এফিড (aphid)। অধিকন্তু, প্রাণিজগতের একটা অংশ আবার হার্মাফ্রোডিক– সত্যিকারের উভলৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন– যাদের ক্ষেত্রে সমকামিতা কোনো বিষয় নয়।"

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে সম্প্রতি 'Out in Nature: Homosexual Behavior in the Animal Kingdom' নামের একটি ডকুমেন্টারিতে প্রাণিজগতের অসংখ্য সমকামিতার উদাহরণ তুলে ধরা হয়। ব্রুস ব্যাগমিল এবং জোয়ান রাফগার্ডেনের কাজের উপর ভিত্তি করে অসলোর ন্যাচারাল হিস্ট্রি যাদুঘরে 'অ্যাগেইনস্ট নেচার?' নামে একটি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। প্রদর্শনীটি ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে শুরু হয়ে ২০০৭ সালের আগস্ট পর্যন্ত চলে। এতে জীবজগতের সমকামিতা, উভকামিতাসহ প্রকৃতির নানা ধরনের বৈচিত্র্যময় উদাহরণ হাজির করে ব্যতিক্রমধর্মী উপস্থাপনার ব্যবস্থা করা হয়। প্রদর্শনীটি বছরজুড়ে দেশ-বিদেশের অসংখ্য দর্শকের আগ্রহ ও মনোযোগ আকর্ষণে সমর্থ হয়।

অন্য প্রাণিতে যেমন সমকামিতার অস্তিত্ব আছে, মানুষের মধ্যেও তেমন। এটা স্বাভাবিক। কারণ মানবসমাজ প্রাণিজগতের বাইরের নয়। ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী আলফ্রেড কিনসের প্রথমদিককার গবেষণার রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতি দশ ব্যক্তির একজন সমকামী। কিনসের গবেষণা ছিল সেই চল্লিশের দশকে।

সম্প্রতি (১৯৯০) ম্যাকহৃটার, স্টেফানি স্যান্ডার্স এবং জুন ম্যাকহোভারের গবেষণা থেকে জানা যায়, পৃথিবীর জনসংখ্যার শতকরা প্রায় চৌদ্দভাগের মতো সমকামী। ১৯৯৩ সালে 'জেনাস রিপোর্ট অন সেক্সুয়াল বিহেভিয়ার' থেকে জানা যায়, পুরুষদের মধ্যে ৯ ভাগ এবং নারীদের ৪ ভাগ সমকামী। তার মানে সমকামীদের সংখ্যা কম নয়। ওদিকে সায়েন্টিফিক আমেরিকান মাইন্ড-এর ২০০৬ এর একটি ইস্যুতে সমকামীদের সংখ্যা সমগ্র জনসংখ্যার ৩ থেকে ৭ ভাগ উল্লেখ করা হয়েছে।

কিন্তু এ কথা মানতেই হবে যে, পরিসংখ্যানগুলোর পরিসীমা একে অন্যের খুব কাছাকাছি (মোটামুটি ৫-১৫ ভাগ) হলেও কোনোটাই প্রকৃত অবস্থা নির্দেশ করছে না। কারণ ব্যক্তিকে সমকামিতায় নিরুৎসাহিত করে বিষমকামিতায় উৎসাহিত করার সামাজিক একটা চাপ সবসময়ই থেকে যায়।

অনগ্রসর সমাজে এ চাপ আরও প্রবল। ফলে অনেক সময় দেখা যায়, একজন প্রকৃত সমকামী বিষমকামী জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। স্বামী কিংবা বউ-বাচ্চা নিয়ে সংসার করছেন। এদের বলা হয় 'নিভৃত সমকামী' (closet gay)। বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত মানবাধিকার কর্মীর কথা জানি যিনি নিভৃত সমকামী হয়ে তার স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহিত জীবনযাপন করছেন।

আরেকজন 'বিবাহিত সমকামী'র কথা উল্লেখ করেছি আমার বইয়ে দেওয়া একটি কেস স্টাডিতে। উনি দিল্লিতে বসবাসরত দন্তচিকিৎসক। নাম রমেশ মণ্ডল। পারিবারিক চাপে পড়ে তাকে একসময় বিয়ে করতে হয়। কিন্তু স্ত্রীর সঙ্গে তার সম্পর্ক স্রেফ যান্ত্রিক। তিনি গোপনে যৌনচাহিদা মেটান তার এক সমকামী বন্ধুর সঙ্গে। মাঝে মাঝে জব্বলপুরে বা কোলাপুরে চলে যান তারা। রমেশের স্ত্রী আজও ব্যাপারটি জানেন না। সম্পূর্ণ মিথ্যার উপর দাঁড়িয়ে আছে তার দাম্পত্যজীবন। আরেক সমকামী ভদ্রলোক নীতিন দেশাই স্ত্রীকে ফাঁকি দিয়ে প্রায়ই চলে যান মুম্বাই-এর চৌপাট্টির সমুদ্রসৈকতে। কারণটা সহজেই অনুমেয়।

অনেক পাঠক সমকামী পাকিস্তানি কবি ইফতি নাসিমের ব্যক্তিগত জীবনের সমপ্রেমের মর্মন্তুদ কাহিনী জানেন। ইফতি ছোটবেলা থেকেই তার সমবয়সী একটি ছেলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। তারপর তারা কৈশোরকাল অতিক্রম করে বড় হলেন। পড়াশুনার পাট চুকিয়ে প্রতিষ্ঠিত হলেন। স্বাভাবিকভাবেই বাসা থেকে এল বিয়ের চাপ।

একসময় ইফতির বন্ধুর বাসার লোকজন তার বিয়ে ঠিক করে ফেলেন। বন্ধু সেদিন তার সমকামী জীবনের কথা কাউকে খুলে বলতে পারেননি। গোঁড়া পাকিস্তানি সমাজে বড় হওয়ার কারণে সমকামীদের প্রতি ঘৃণা-উদ্রেককারী ধর্মীয় আইন-কানুনের কথাও তাদের ভালোই জানা ছিল। ফল যা হওয়ার তাই হল। বেশ ধুমধাম করে বিয়ে হল ওই বন্ধুর।

বিয়েতে ইফতিও আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। হাজিরও হলেন তিনি। ফুলশয্যার রাতে বন্ধুর বাড়িতেই ছিলেন তিনি। যে মানুষটির সঙ্গে তার এতদিনের প্রেমের সম্পর্ক, সে মানুষ সমাজের চাপে পড়ে এক অচেনা নারীর বাহুলগ্ন হবেন, এ চিন্তা তাকে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে। 'আজকে রাতে তুমি অন্যের হবে, ভাবতেই চোখ জলে ভিজে যায়'! সারারাত তিনি ঘুমাতে পারলেন না। এ-পাশ ও-পাশ করে কাটালেন। শেষরাতে হঠাৎ দরজায় ধাক্কা। হুড়মুড় করে বিছানায় উঠে বসলেন ইফতি। দরজা খুলে দেখলেন, অসহায়ভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন বন্ধুটি। দুজনেই নির্বাক। এ ধরনের বহু উদাহরণ আমি আমার বইয়ে হাজির করেছি।

সমকামিতা ও মানবাধিকার

আধুনিক চিকিৎসক ও মনোবিজ্ঞানীরা এখন সমকামিতাকে একটি স্বাভাবিক যৌনপ্রবৃত্তি মনে করেন। ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর American Psychiatric Association (চিকিৎসক ও মনোবিজ্ঞানীদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সংগঠন) বিজ্ঞানসম্মত আলোচনার মাধ্যমে একমত হন যে সমকামিতা নোংরা ব্যাপার নয়, নয় মানসিক ব্যাধি। এ হল যৌনতার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। ১৯৭৫ সালে American Psychological Association একই রকম অধ্যাদেশ দিয়েছিলেন। http://psychology.ucdavis.edu/rainbow/html/facts_mental_health.html

http://psychology.ucdavis.edu/rainbow/html/facts_mental_health.html

তারপরও বাংলাদেশসহ অনেক রাষ্ট্রেই সমকামিতা স্বীকৃত নয়। অনেক জায়গাতেই এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এখানে সমকামীদের হয় লুকিয়ে থাকতে হয়, কিংবা অভ্যস্ত হতে হয় 'ক্লোসেট গে' হয়ে 'বিবাহিত' জীবনযাপনে। কখনও-বা হতে হয় সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় হেনস্থার শিকার।

পশ্চিমা বিশ্ব অবশ্য বেশ কিছুটা উদার হয়েছে গত কয়েক দশকে। গে ও লেসবিয়ানরা বিশ্বের বহু দেশে সামাজিক স্বীকৃতি ও আইনগত বৈধতার জন্য কয়েক যুগব্যাপী আন্দোলন করছেন, অংশ নিয়েছেন 'গে-প্রাইড' মার্চে। তাদের আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে আমেরিকার কয়েকটি স্টেটে সমকামী বিয়ে আজ স্বীকৃত। ব্রিটেনও টনি ব্লেয়ারের সরকারের আমল থেকেই সমকামী যুগলদের স্বীকৃতি দিয়েছে। কানাডায় সমকামী, রূপান্তরকামী, উভকামী ও উভলিঙ্গ মানুষেরা অন্যান্য নাগরিকদের মতোই সুবিধা ভোগ করে থাকেন। এমনকি তাদের মধ্যকার বিয়েও 'সিভিল ম্যারেজ' হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত।

সম্প্রতি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন যে, তিনি ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন সমকামীদের মধ্যকার বিয়ে সর্বত্রই রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত হওয়া প্রয়োজন। আমেরিকার প্রেসিডেন্টদের মধ্যে ওবামাই প্রথম যিনি এ ব্যাপারে সরাসরি দৃঢ় ও অবিচল একটি অবস্থান গ্রহণ করলেন। মার্কিন সুপ্রিম কোর্টও এক যুগান্তকারী রায়ে সমকামী দম্পতিদের সরকারি সুবিধা পাওয়ার স্বীকৃতি দিয়েছে। এতদিন বিয়েকে শুধুমাত্র নারী-পুরুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার সরকারি আইন বাতিল করে সমকামীদের ঘর বাঁধার এবং সকল রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার পথ প্রশস্ত করে দিয়েছে এ রায়।

পশ্চিমের সমকামী-অধিকার আন্দোলনের সাফল্য এখন উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকার কয়েকটি প্রধান দেশ তাদের আইন সংস্কারে এগিয়ে এসেছে। চীনে মাও সে তুংয়ের আমলে মনে করা হত সমকামিতা হচ্ছে 'পুঁজিবাদের বিকৃতি'। কিন্তু আশির দশক থেকে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে। নেলসন ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে সাউথ আফ্রিকায় বর্ণবাদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর যে নতুন সংবিধান চালু হয় তাতে শুধু ধর্মই নয়, যৌনতা বিষয়ে কোনো বৈষম্য করা হবে না এমন ধারা সংযোজিত হয়।

কিন্তু আমাদের দেশে সমকামীরা সত্যিকার অর্থেই 'হিডেন মাইনোরিটি', তাদের অস্তিত্ব এখানে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে অস্বীকৃত– যদিও বিভিন্ন নিরপেক্ষ গবেষণায় দেশে ৬ থেকে ১২ মিলিয়ন সমকামীর অস্তিত্বের কথা উঠে এসেছে। প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল এবং সচেতন বুদ্ধিজীবী সমাজ নারীস্বাধীনতা, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানদের সমানাধিকার এবং পাহাড়ি ও আদিবাসীদের অধিকারের বিষয়ে কিছুটা সোচ্চার হলেও, যৌনস্বাধীনতা ও সমকামীদের অধিকার নিয়ে একদমই ভাবেন না।

সম্প্রতি ভারতে একটি পরিবর্তন এসেছে। নয়াদিল্লির হাইকোর্ট 'সমকামিতা অপরাধ নয়' বলে রায় দিয়েছে (জুলাই, ২০০৯)। ১৪৮ বছরের পুরনো ঔপনিবেশিক আইনে সমকামিতাকে যেভাবে 'প্রকৃতিবিরুদ্ধ যৌনতা' হিসেবে গণ্য করে নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছিল– এ রায়ের মধ্য দিয়ে সেটির অবসান ঘটেছে। এর ফলে সমকামিতা ভারতে প্রথমবারের মতো পেল আইনি স্বীকৃতি। দিল্লি হাইকোর্ট সমকামিতা নিষিদ্ধ আইনকে বৈষম্যমূলক আখ্যা দিয়েছ; সুস্পষ্টভাবে একে মানুষের 'মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন' বলেছে। নিঃসন্দেহে এ এক ঐতিহাসিক যাত্রা; শুধু সমকামীদের জন্য নয়, সার্বিকভাবে মানবাধিকারের জন্যও।

পাকিস্তানের মতো রক্ষণশীল রাষ্ট্রেও উভলিঙ্গ মানুষদের জন্য সমানাধিকারের আইন পাশ করা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশে সেসব কিছু হয়নি, বরং প্রকারান্তরে সঙ্গিন করে তোলা হচ্ছে সমকামীদের জীবন।

২০০৪ সালে ভারতের একটি পত্রিকায় একটি আত্মহত্যার খবর দেখেছিলাম। খবরটি এরকম–

''২৬ নভেম্বর, ২০০৪ সকাল ১০টা নাগাদ উত্তর ২৪ পরগণার বনগাঁ স্টেশনের কিছু দূরে অপর্ণা বিশ্বাস (২০) এবং কাজলী ঘোষ (১৮) নামে দুই তরুণী একসঙ্গে ট্রেনের নিচে মাথা দিয়ে আত্মহত্যা করেন। এই দুই তরুণী ছিলেন সমপ্রেমী। এরা একে অপরকে ভালোবাসতেন গভীরভাবে। তাদের লেখা সুইসাইড নোট থেকে সমপ্রেমের মর্মান্তিক পরিণতির কথা জানা যায়-

'মা, আমায় তুমি ক্ষমা কর। আমি কাপুরুষের মতো পালিয়ে গেলাম। কিন্তু কী করব মা, আমি যে কাজলীকে খুব ভালোবাসি, ওকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না। এমনকি ও আমাকে ছেড়ে থাকতে পারবে না। তাই আমরা দুইজনে মৃত্যুপথ বেছে নিলাম। আমাদের মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।

ইতি
অপর্ণা ও কাজলী

পুনশ্চ- আমাদের ভালোবাসার দাবি হিসেবে একটাই অনুরোধ, আমাদের দুজনকে যেন একই শশ্মানে দাহ করা হয়। এটা আমাদের শেষ ইচ্ছা।' "

আমি কায়মনোবাক্যে চাইব, আর কোনো সমকামী যুগলকে যেন অপর্ণা ও কাজলীর ভাগ্যবরণ করতে না হয়। সে সঙ্গে আশা করব, যুগের দাবির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশও একসময় সমকামিতার প্রতি সহিষ্ণু মনোভাব গড়ে উঠুক, সংখ্যালঘু যৌনপ্রবৃত্তির মানুষজনের আইনি অধিকার স্বীকৃতি পাক।

সে জন্য দরকার আমাদের সবার বিজ্ঞানমনস্ক উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি।