সাফ ফুটবলে ‘নারী বিপ্লব’

একটি মেয়ে এবং তার শরীর এমনই নিরাপত্তার বলয়ে পরিবেষ্টিত, যা শেষ পর্যন্ত রক্ষণশীলতার নামান্তর। জার্সি পড়ে মেয়েরা খেলবে, দৌড়াবে, শরীর দোল খাবে, অংসখ্য লোলুপ দৃষ্টি তাকিয়ে দেখবে-অভিভাবকরা তা মানবেন কীভাবে?

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 19 Sept 2022, 01:50 PM
Updated : 19 Sept 2022, 01:50 PM

সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়শিপে নতুন ইতিহাস গড়েছে বাংলাদেশ। নেপালকে ৩-১ গোলে ধসিয়ে দিয়ে সাফ নারী ফুটবলে চ্যাম্পিয়নের মুকুট পরেছে। এই শিরোপা জয়ে দেশবাসী স্বভাবতই আনন্দিত ও উল্লসিত।

বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে সম্মানিত করার এই নেপথ্য নায়িকারা অন্ধকার থেকে উঠে এসেছে আলোর মঞ্চে। তারা এসেছে দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রাম থেকে। এই কিশোরীদের কারও কারও বাবা কৃষক, ছোট ব্যবসায়ী বা সামান্য মাইনের চাকুরে। তৃণমূলের অভাবী পরিবারের কিশোরীরাও যে সুযোগ পেলে জাতীয় মর্যাদা বয়ে আনতে পারে সেটা দেখিয়ে দিয়েছে এই ফুটবলাররা।

বস্তুত গোটা টুর্নামেন্টেই বাংলাদেশের নারীরা দাপটের সঙ্গে খেলেছেন। তারা শুধু শিরোপাই জেতেননি, টুর্নামেন্টে তারা ছিলেন অপরাজিতও। এ কৃতিত্বের জন্য তাদের প্রতি রইল প্রাণঢালা অভিনন্দন। অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন দলটির কোচ, কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে জানাই অভিনন্দন। দেশবাসীর প্রত্যাশা, এই নারীদের হাত ধরেই একদিন দেশে ফুটবল ফিরে পাবে হারানো গৌরব।

গত কয়েকবছর ধরে আমাদের আনন্দের উৎসটা মূলত ক্রিকেটকে ঘিরেই হয়েছে। বামপন্থি দলগুলোর মতো আমাদের ফুটবলও সাফল্যহীন। বিশ্ব দরবারে আমাদের ফুটবল মান এখনও হতাশাজনক। এই হতাশার মধ্যে দেশের মেয়েরা গৌরবময় সাফল্য বয়ে এনছে। দেশবাসীকে আনন্দ ও গৌরব করার মুহূর্ত উপহার দিয়েছে। বিশেষত এবারের নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে দেশবাসীকে একের পর এক আনন্দঘন মুহূর্ত উপহার দিয়েছে আমাদের মেয়েরা। একের পর এক বিজয় তাও আবার বিশাল ব্যবধানের−তা সত্যি আমাদের গর্বিত করেছে। বাংলাদেশের রুপনা চাকমা, আঁখি খাতুন, মাসুরা পারভীন, শিউলি আজিম, শামসুন্নাহার, মনিকা চাকমা, মারিয়া মান্দা, সানজিদা আক্তার, কৃষ্ণা রানী সরকার, সাবিনা খাতুন, সিরাত জাহানরা অসাধারণ ফুটবল নৈপুণ্যে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। 

নিঃসন্দেহে এই মেয়েরাই আমাদের ক্রীড়াঙ্গনের শ্রেষ্ঠ সাফল্যের দূত। ভবিষ্যতে আমাদের ফুটবলকে এগিয়ে নেওয়ার কারিগর। অর্থনৈতিকভাবে সংকটগ্রস্ত সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে অধঃপতিত এই দেশে মেয়েরাই বাংলাদেশের স্বপ্ন হয়ে মাঠে নেমেছে। দুচোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে অন্য দেশের মেয়েদের সাথে লড়াই করেছে। জয় ছিনিয়ে এনেছে। আমাদের মেয়েরা প্রমাণ করেছে অন্য দেশের মেয়েদের থেকে আমাদের দেশ পিছিয়ে নেই। শক্তি তো মাঠেই প্রমাণ হয়েছে। সেই শক্তিপরীক্ষায় আমাদের মেয়েরা বিজয়ী। সেই সঙ্গে বিজয়ী হয়েছে দেশ, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি।

আজ আমরা নারী ফুটবলারদের সাফল্যকে আমরা উদযাপন করছি। আমরা কি জানি তাদের এগিয়ে আসার গল্প? কতটা পারিবারিক-সামাজিক বাধা অতিক্রম করে তারা আমাদের জাতীয় জীবনে এমন সাফল্যের উপলক্ষ এনে দিয়েছে? কত ত্যাগ, কত অবহেলা, কত কটাক্ষ তাদের শুনতে হয়েছে?

সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংসকারের কারণে আমাদের দেশের ক্রীড়াঙ্গন থেকে মেয়েরা প্রায় নির্বাসিত। এটাকে বলা যায় ‘সুপরিকল্পিত কুসংস্কার’, ক্ষমতা ধরে রাখার একচ্ছত্র অবলম্বন। এমন ভাবনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের নারী ক্রীড়া। এ দেশের মেয়েদের খেলার মধ্যে সবচেয়ে করুণ অবস্থা ফুটবলের। স্বাভাবিক। যে দেশে মেয়েদের পর্দা আর রান্নাঘরের মধ্যে আটকে রাখার চেষ্টা করা হয় সেখানে মেয়েদের ফুটবল নিতান্তই ‘অলীক’। প্রগতিশীল সামাজিকতার আড়ালে আটপৌরে সংস্কৃতি চিরকালীন বৈষম্যের প্রতীক; সেখানে নারীদের খেলায় অংশগ্রহণ মানেই সামাজিক অবরোধ। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পার করলেও আমাদের দেশের মানুষের মানসিকতা এখনও মেয়েদের খেলাধুলাকে তেমনভাবে সমর্থন করে না। মেয়েদের ফুটবল, ব্যাডমিন্টন, ক্রিকেট এমনকি ভারোত্তোলনও সামাজিক সমর্থন পায় না। সেখানে নারী ফুটবলারদের অত্যন্ত কৃতিত্ব দেখিয়ে সাফ পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা নিঃসন্দেহে গৌরবময় ও তাৎপর্যপূর্ণ। নিষ্ঠুর সামাজিক প্রতিবেশ থেকে উঠে এসে মেয়েরা যখন বিশাল অতিক্রমণের ইতিহাস তৈরি করেন তখন তারা হয়ে ওঠেন নারীত্বের আলাদা অভিজ্ঞান। ফুটবলে বাংলাদেশে নারীদের উত্থানও তেমনই এক অবিস্মরণীয় আখ্যান।

দেশের জন্য এই অনন্য গৌরব বয়ে আনা এই ফুটবল দলের সদস্যদের এই পথ চলাটা কিন্তু মোটেও সহজ ছিল না। অন্তত আমাদের মত পশ্চাদপদ, মৌলবাদী ধ্যানধারণাপুষ্ট বাংলাদেশে। একটি মেয়ে এবং তার শরীর এমনই নিরাপত্তার বলয়ে পরিবেষ্টিত, যা শেষ পর্যন্ত রক্ষণশীলতার নামান্তর। জার্সি পড়ে মেয়েরা খেলবে, দৌড়াবে, শরীর দোল খাবে, অংসখ্য লোলুপ দৃষ্টি তাকিয়ে দেখবে-অভিভাবকরা তা মানবেন কীভাবে? পুরুষ কোচও একটা বিরাট সমস্যা। যদি গায়ে হাত দেয়! কানে ফিসফিসিয়ে মন্ত্রটি পড়ে দেওয়ার জন্য বহু খালা-ফুপু মজুত থাকে। কী হবে খেলে? সেই তো বিয়ে করে বাচ্চা মানুষ করতে হবে! যেন মরতে হবে বলে কেউ আর বেঁচে থাকার জন্য ভাত খায় না! বেশি খেলাধুলা করলে মেয়েদের স্বাভাবিক শ্রী যদি নষ্ট হয়ে যায়!

মেয়ে বলেই ‘হার্ডল’ এসেছে পদে পদে। ঘরে, বাইরে, জীবনের সর্বত্র। সমাজ, সংস্কার, পিছুটান অনবরত সামনে এগিয়ে চলার গতির পায়ে লাগাম পরানোর চেষ্টা করেছে। থমকে দিতে চেয়েছে এগিয়ে চলার গতি। কিন্তু অদম্য জেদ, অফুরান উৎসাহ-উদ্দীপনার কাছে তা হার মেনেছে বার বার। ‘মুখোশ’- এর যাবতীয় চক্রান্ত ভেস্তে দিয়ে মেয়েরাই হয়ে উঠছেন ‘মুখ’। আশা করি ভবিষ্যতও এই ধারা অব্যাহত থাকবে।

বাংলাদেশে নারী ফুটবল এখনও অস্পৃশ্য। অথচ নারী ফুটবলের সাফল্য আমাদের দেশে গর্ব করার মতো। নারীর ক্ষমতায়নের স্বার্থেও নারী ফুটবলকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া দরকার। এ জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। ফুটবলকে মেয়েদের জন্য পক্ষপাতমুক্ত হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এ সাফল্য ধরে রাখতে হলে উন্নত প্রশিক্ষণ ও পরিচর্যার মাধ্যমে মেয়ে ফুটবলারদের মানোন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। সারা দেশে তৃণমূল পর্যায় থেকে কিশোর-কিশোরীদের বাছাই করে নিয়মিত ফুটবলের প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার। ক্রিকেটে এ ধরনের উদ্যোগের সুফল পাচ্ছি আমরা। ফুটবলের ক্ষেত্রেও একই পদক্ষেপ নেওয়া হলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ খেলায় আমাদের ব্যর্থতা ঘুচবে অবশ্যই। বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও আকর্ষণীয় খেলা ফুটবলকে অবহেলা করার সুযোগ নেই।

আশা করি, কর্তাব্যক্তিরা এবার আরেকটু উদার ও মনোযোগী হবেন নারী ফুটবলের ব্যাপারে। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও পরিচর্যার পাশাপাশি পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতা পেলে এভাবেই এগিয়ে যাবে আমাদের নারীরা। এগিয়ে যাবে লাল সবুজের আমাদের প্রিয় সুন্দর দেশটিও।

কয়েক বছর আগেও জাতীয় নারী দলের প্রতি কর্তৃপক্ষের অনাদর বুঝিয়েছে। এটা এমন যৌথ পরিবার যেখানে বেশিটা পাওয়া, বড়টা খাওয়া, ভালোটা পরার অগ্রাধিকার পুত্রসন্তানটির। জাতীয় দলের মেয়েদের ডায়েট, ট্রেনিং, কিটস সবেতেই কার্পণ্য। কোনও বাণিজ্যিক সংস্থা মেয়েদের জার্সিটি পর্যন্ত স্পনসর করত না। ফেডারেশন একটা ব্র্যান্ডেড কোম্পানি থেকে সরাসরি কিনে দিত মেয়েদের। অথচ আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিং -এ বরাবর নারী দল পুরুষ দলের থেকে অনেক সন্তোষজনক স্থানে। জাতীয় পুরুষ দলের বিলাসের পাশে মেয়েদের ফুটবলের প্রতি এই অবহেলা দেশের সমাজচিত্রে পৌরুষের জয়গান।

আমাদের দেশে মেয়েদের খেলাধুলা করাটা মোটেও সহজ কোনো ব্যাপার নয়। কারণ অনেক জায়গায় মেয়েদের খেলার কোনো সুযোগই নেই। অনেক ক্ষেত্রে তারা ফুটবল শিখতে চাইলেও বিদ্যালয়ের ক্রীড়া শিক্ষকদের তেমন উৎসাহ থাকে না। গ্রামের মাঠেও মেয়েরা খেলার জায়গা পায় না। অনেক মেয়ে আছে যারা জীবনে ফুটবলে একটা লাথি দেয়ার সুযোগ পর্যন্ত পায়নি।

এই সমস্যা সমাধানে কী করা উচিত? ছোট থেকে ফুটবল চর্চার সুযোগ তৈরি করা। স্কুলগুলোতে মেয়েদের খেলার সুযোগ করে দেওয়া। ছোট থেকে মেয়েদের মাঠে আনার কাজটিও সেই সঙ্গে করতে হবে। আন্তঃস্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করতে হবে। স্কুলপর্যায়ে প্রতিযোগিতা শুরু হলে মেয়েদের ফুটবল খেলায় আগ্রহ বাড়বে। উপজেলা, জেলা, ও বিভাগীয় পর্যায়ে ফুটবল প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা থাকলে মেয়েরা পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাটাও চালিয়ে যেতে পারবে।

খেলাধুলায় মেয়েদের অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই খেলার মাধ্যমে মেয়েদের আত্মবিশ্বাস বাড়বে। এতে মেয়েদের সামাজিক উন্নতি ঘটবে। সমাজের সর্বাঙ্গীন উন্নতিতে সাহায্য করবে। সুযোগ বাড়ালে অংশগ্রহণ বাড়বে। আর অংশগ্রহণ বাড়লে সাফল্যও আসবে।

পরিশেষে আবারও স্যালুট জানাই বাংলাদেশের নারী ফুটবল দলকে! তারা অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। এখন তারাই হোক বাংলাদেশের সফল নারীর সেরা বিজ্ঞাপন!