জলবায়ু ন্যায়বিচারের দাবিতে নির্ঘুম তরুণ প্রজন্মকে সালিমুল হকের জলবায়ু-জিজ্ঞাসাকে জাগিয়ে রাখতে হবে। তাঁকে পাঠ করতে হবে, বিশ্লেষণ করতে হবে। নতুন বাহাস তৈরি করতে হবে।
Published : 03 Nov 2023, 11:11 AM
সালিমুল হক, কী বিশেষণ দিয়ে তাঁকে বিশেষায়িত করা যায়? উইকিপিডিয়া লিখেছে ‘বাংলাদেশি-ব্রিটিশ বিজ্ঞানী’। গণমাধ্যম এবং জলবায়ু নিয়ে কর্মরত পরিসরে তিনি ‘জলবায়ু বিজ্ঞানী’ কিংবা ‘জলবায়ু বিশেষজ্ঞ’ হিসেবেই অধিক পরিচিত। যদিও তাঁর বিদ্যায়তনিক ‘উদ্ভিদবিজ্ঞানী বা জীববিজ্ঞানী’ পরিচয়টি খুব পরিচিত নয়।
বাংলাদেশে অবস্থিত বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (ইক্কাড)’-এর পরিচালক এবং বেসরকারি ইন্ডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা সাময়িকী নেচার কর্তৃক বিশ্বের ১০ জন প্রভাবশালী বিজ্ঞানীর একজন হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়িয়েছেন। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক বৈশ্বিক বাহাসে তাঁর জোরালো ভূমিকা অনস্বীকার্য। মাত্র ৭১ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়া বিশ্বখ্যাত এই জলবায়ুবিজ্ঞানীর সাথে আমার তেমন একটা নিয়মিত যোগাযোগ ছিল না, যাকে ‘ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক’ বা ‘সক্রিয় সম্পর্ক’ বলা যায়। কর্মসম্পর্কের কারণে আমাদের নানাসময় দেখা হয়েছে, আলাপ হয়েছে কিংবা একইসাথে অংশ নিয়েছি কোনো জলবায়ু-তৎপরতায়। তাঁর হঠাৎ চলে যাওয়া আমাকে বিষণ্ন করেছে, জলবায়ু-তর্কের ময়দানে একটা শূন্যতার খাদ ভেসে উঠেছে সামনে।
সব মানুষ সর্বজনের কাছে পরিচিত বা প্রিয়জন হয়ে ওঠে না। ক্ষেত্র, গণ্ডি বা পরিসর বিবেচনায় কারও কারও পরিচিতি আবার ‘বৈশ্বিক’ হয়ে ওঠে।
সালিমুল হক হয়তো দেশের জনপরিসরে ‘অপরিচিত’, কিন্তু বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক নীতিকাঠামোর ময়দানে একজন ‘বিশ্বসেরা’ মানুষ। তাঁর সাথে আমার সরাসরি সাক্ষাতের দিনটির কথা মনে আছে। যাত্রাপথে আমার স্যান্ডেল ছিঁড়ে গিয়েছিল। ‘জলবায়ু পরিবর্তন, লোকায়ত জ্ঞান, জনঅভিযোজন’ বিষয়ে মূলত গণমাধ্যমকর্মীদের কর্মশালায় আলোচনার জন্য ইক্কাড থেকে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সালিমুল হকের বিষয়ে তখনো আমার খুব জানা ছিল না। ‘ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (আইআইইডি)’, ‘ইন্টারগভর্মেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি)’ এবং ‘বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ (বিসিএএস)’সহ বেশকিছু প্রকাশনায় ‘লেখক’ কিংবা ‘সম্পাদক’ হিসেবে তাঁর নাম দেখেছি। কর্মশালাটি ছিল গুলশানে। দোতালা বাস থেকে নামার পর রাস্তায় স্যান্ডেল ছিঁড়ে যায়। সৌভাগ্যক্রমে ওভারব্রিজের তলায় একজন জুতা-কারিগর ছিলেন। কর্মশালাটি সবাই বেশ গুরুত্ব দিয়েছিল।
সেদিনই প্রথম সরাসরি আলাপ তাঁর সাথে। জলবায়ু পরিবর্তন ও লোকায়ত জ্ঞান বিষয়ক কাজগুলো আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রকাশের কথা বলেছিলেন। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার সাথে ইক্কাডের কোনো একটা কর্মসম্পর্কের কারণে বেশকিছুদিন নানাভাবে যোগাযোগ ছিল। শেষ দেখা হয় মিশরে, জলবায়ু সম্মেলনের ২৭তম আসরে। অভিযোজন এবং ক্ষয়ক্ষতি তহবিল নিয়ে কিছু আলাপ হয় তখন। জলবায়ু সংকট ও ধর্মীয় জীবনে প্রভাব নিয়ে ব্রাত্য আমিনের ‘নো আর্ক’ প্রামাণ্যচিত্রের জন্য তাঁর সাথে শেষ যোগাযোগ হয়। চলতি লেখাটি কিছু স্মৃতিভাষ্য আর জীবনকর্মের সম্মিলনে সালিমুল হকের জলবায়ু-জিজ্ঞাসার এক বিনম্র পাঠ।
সালিমুল হকের জন্ম পাকিস্তানের করাচিতে। পিতা কূটনৈতিকের চাকরি করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সালিমুল হকের পরিবার বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি সেনার চোখ এড়িয়ে আফগানিস্তান ও ভারত হয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন (সূত্র: বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ১৫.১২.২০২২)। এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন শহরে বেড়ে উঠেছেন তিনি পিতার চাকরির সুবাদে। প্রথম জীবনে জার্মানি, ইন্দোনেশিয়া ও কেনিয়াতে পড়াশোনা করেন। ১৯৭৫ সালে লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজ থেকে উদ্ভিদবিজ্ঞানে স্নাতক করেন এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৮ সালে পিএচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
বাংলাদেশে ফিরে আরেক জলবায়ু বিশেষজ্ঞ আতিক রহমানের সাথে ১৯৮৪ সালে গড়ে তোলেন ‘বিসিএএস’। মূলত পরিবেশ ও উন্নয়ন নিয়ে কাজ শুরু করলেও পরবর্তীতে সালিমুল হক জলবায়ু বিশেষজ্ঞ হিসেবেই অধিক গুরুত্ব পান। আরও পরে তিনি পরিবেশনীতি বিষয়ে কর্মরত আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘আইইইডি’তে যুক্ত হন। স্বপ্লোন্নত দেশগুলোর ভূমিকাকে গুরুত্ব দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন, প্রশমন, অভিযোজন এবং টেকসই উন্নয়নের আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন।
জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত দেশগুলোর জোট আইপিসিসি জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক বৈশ্বিক প্রতিবেদন প্রকাশ ও হালনাগাদ করে। এই আইপিসিসির প্রতিবেদনের তিনিও অন্যতম লেখক। এই প্রতিবেদনের কারণে আইপিসিসি ২০০৭ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার অর্জন করে। তিনি আইপিসিসির প্রতিবেদন প্রস্তুতকারী কর্মীদল-২ এর সমন্বয় করেন। যারা মূলত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব, বিপদাপন্নতা এবং অভিযোজনকে ফোকাস করেছেন। তিনি আইপিসিসি-এর তৃতীয় মূল্যায়ন প্রতিবেদনের ‘অভিযোজন ও টেকসই উন্নয়ন’ অধ্যায়ের একজন প্রধান লেখক ছিলেন। সংগঠন এবং তাঁর কাজ জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অন্যতম দুটি লক্ষ্য ১৩ (জলবায়ু অ্যাকশন) এবং ১৭ (লক্ষ্যপূরণে পার্টনারশিপ) অর্জনে ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করা হয়। জলবায়ু অভিযোজন বিষয়ে কর্মরত আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপটেশন (জিসিএ)’-এর উপদেষ্টা ছিলেন সালিমুল হক।
করোনা মহামারীর সময় জিসিএ-এর প্রথম আঞ্চলিক কার্যালয়টি ঢাকায় উদ্বোধন করা হয়। তিনি একইসাথে ‘ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (ভিসিএফ)’ সদস্য। এই ফোরামটি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ ও ঝুঁকিপূর্ণ দেশসমূহের একটি জোট, যারা জলবায়ু ন্যায্যতা ও তহবিল বিষয়ে সক্রিয়ভাবে কাজ করে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একসময় এই ফোরামের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় জাতিসংঘের একটি আন্তঃরাষ্ট্রিক বৈশ্বিক কাঠামো আছে, ইউনাইটেড ন্যাশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (ইউএনএফসিসিসি)। এই কাঠামো প্রতিবছর জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষমূহের একটি সম্মেলন আয়োজন করে। যা ‘কনফারেন্স অব পার্টিস বা কপ’ নামে পরিচিত। এ পর্যন্ত ২৭টি জলবায়ু আসর বা কপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সালিমুল হক প্রতিটি কপে অংশ নিয়েছেন এবং স্বল্পোন্নত দেশের পক্ষ হয়ে অভিযোজন, ক্ষয়ক্ষতি তহবিল এবং জলবায়ু অর্থায়ন বিষয়ে নানা ফোরামে দাবি উত্থাপন করেছেন। জীবনে বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছে সালিমুল হক। বিশ্ব ব্যাংকের ‘রবার্ট ম্যাকনামারা ফেলোশিপের (১৯৮৬-৮৭)’ মাধ্যমে এই অর্জন শুরু হয়। পরবর্তীতে ডুগ্গান ফেলোশিপ (১৯৮৯), বার্টনি সম্মাননা (২০০৬) অর্জন করেন। ২০২০ সালে তিনি বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় পরিবেশ পদকে ভূষিত হন। ২০২২ সালে যুক্তরাজ্য সরকার তাকে অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার (ওবিই) খেতাবে ভূষিত করে। ২০২২ সালে নর্থামব্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে তাঁকে সম্মাননা দেয়া হয়।
শারম আল শেখে ‘স্থানীয়ভাবে অভিযোজন’ বিষয়ক এক বৈশ্বিক সংলাপে তাঁর সাথে কথা হয়। উপকূল, হাওর, বরেন্দ্র, পাহাড়, চর ও বনভূমি অঞ্চলের স্থানীয় অভিযোজন ও লোকায়ত চর্চাগুলোর অভিজ্ঞতা নিয়ে তাঁর সাথে আলাপ করি। আলাপ হয় ক্ষয়ক্ষতি তহবিল নিয়েও। এই তহবিল গঠনের বিষয়ে তিনি বেশ সক্রিয় ছিলেন বিভিন্ন বৈশ্বিক ফোরামে। সালিমুল হক জানিয়েছিলেন, জলবায়ু চুক্তিতে অধিক কার্বণ নিঃসরণ দেশগুলো নিজেদের দোষ স্বীকার করেছে এবং ক্ষতিগ্রস্থ দেশসমূহের জন্য জলবায়ু তহবিলের জন্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় তহবিল গঠনে বিশ্বনেতৃত্বকে চাপ দিতে হবে। মৃত্যুর পর দেশীয় এবং বৈশ্বিক মিডিয়া তাঁকে গুরুত্ব দিয়ে স্মরণ করেছে।
জলবায়ু সুবিচার প্রশ্নে তাঁর শূন্যতা কীভাবে পূরণ হবে এ নিয়ে প্রশ্ন জেগেছে বহুজনের কাছে। শোকবার্তায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সালিমুল হক সমগ্র বিশ্বসম্প্রদায়ের জন্য একজন পথপ্রদর্শক ছিলেন। প্যাট্রিক ভার্কোইজেন ‘গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপটেশন’-এর ওয়েবসাইটে এক শোকবার্তায় জানান, তাঁর মৃত্যুতে জলবায়ুবিজ্ঞান নিয়ে কর্মরত বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের ভেতর একটা গভীর শূন্যতা তৈরি হয়েছে। কোনো মৃত্যুর শূন্যতাই পূরণ হয় না, কিন্তু মানুষ চর্চা, দর্শন ও অঙ্গীকারে সেই শূন্যতা আগলে জেগে থাকে। জলবায়ু ন্যায়বিচারের দাবিতে নির্ঘুম তরুণ প্রজন্মকে সালিমুল হকের জলবায়ু-জিজ্ঞাসাকে জাগিয়ে রাখতে হবে। তাঁকে পাঠ করতে হবে, বিশ্লেষণ করতে হবে। নতুন বাহাস তৈরি করতে হবে।
সালিমুল হক বহু বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ ও জনপ্রিয় প্রবন্ধ লিখেছে। বেশকিছু বই সম্পাদনা করেছেন। ইউপিএল থেকে আতিক রহমান ও সালিমুল হকের সম্পাদনায় ‘এনভায়রনমেন্টাল আসপেক্টস অব সারফেস ওয়াটার সিস্টেমস অব বাংলাদেশ’ বইটি প্রকাশিত হয়েছে। আলেক্সিস ডুর্যান্ড ও সালিমুল হক যৌথভাবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতির সংজ্ঞায়ন বিষয়ে একটি গবেষণাপ্রবন্ধ লিখেছেন। ইক্কাড এটি প্রকাশ করে। আলেক্সিস ডুর্যান্ড, সালিমুল হক ও অন্যান্যরা ২০১৬ সালেও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতি পূরণে অর্থায়ন বিষয়ে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। ২০০১ সালে বিজ্ঞান সাময়িকী ‘নেচারে’ প্রকাশিত হয় তাঁর ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড বাংলাদেশ’। ২০১৯ সালে স্পিঞ্জার থেকে প্রকাশিত হয় সালিমুল হক, জেফ্রি চাউ, এড্রিয়াস ফ্যান্টন, ক্লেয়ার স্টট, জুলিয়া তোয়াব এবং হেলেন রাইট সম্পাদিত বই ‘কনফ্রন্টিং ক্লাইমেট চেঞ্জ ইন বাংলাদেশ: পলিসি স্ট্র্যাটেজিস ফর অ্যাডাপটেশন অ্যান্ড রেজিলিয়েন্স’। ২০০৬ সালে আইআইইডি থেকে প্রকাশিত হয় সালিমুল হক, হান্না রেইড ও লরেল এ মুরা সম্পাদিত ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট লিংক’।
২০১০ সালে একই সংস্থা প্রকাশ করে হান্না রেউড, সালিমুল হক এবং লরেল মুরায়ের সম্পাদিত বই ‘কমিউনিটি চ্যাম্পিয়নস: অ্যাডাপটিং টু ক্লাইমেট চেঞ্জ’। তিনি প্রায় নিয়মিত ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য ডেইলি স্টারে’ ‘পলিটিক্স অব ক্লাইমেট চেঞ্জ’ শিরোনামের অধীনে কলাম লিখতেন। আইপিসিসি থেকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতি প্রতিবেদন প্রকাশের গুরুত্ব তিনি তুলে ধরেছিলেন (সূত্র: ১৯ জুলাই ২০২৩, ডেইলি স্টার)। সাম্প্রতিক সময়ের তীব্র তাপপ্রবাহ এবং বৈশ্বিক উষ্ণতার বিপদ নিয়ে লিখেছেন, আমরা একটা টগবগে সিদ্ধ পৃথিবীতে প্রবেশ করেছি (সূত্র: ২ অগাস্ট ২০২৩, দ্য ডেইলি স্টার)। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় ২০৩০ সালের ভেতর আমরা আমাদের অঙ্গীকারাবদ্ধ লক্ষ্যপূরণের দিকে হাঁটছি বলেও মৃত্যুর এক মাস আগে তিনি সতর্ক করেন (সূত্র: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, দ্য ডেইলি স্টার)। তাঁর হয়তো বহু অপ্রকাশিত, অসমাপ্ত লেখালেখি এবং কাজ রয়েছে। আশাকরি ইক্কাড এবং সংশ্লিষ্টজনেরা সেগুলো গুরুত্ব দিয়ে এবং দায়িত্ব নিয়ে পাবলিক পরিসরে প্রকাশ করবেন। কারণ এগুলো আমাদের সকলের জন্য খুব জরুরি।
এখনো পর্যন্ত আমার দেখা তাঁর সর্বশেষ লেখাটি প্রকাশিত হয় ৪ অক্টোবর দ্য ডেইলি স্টারে। নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিত ‘ক্লাইমেট অ্যাকশন সামিট’ নিয়ে একটি বিশ্লেষণধর্মী লেখা। লেখাটিতে তিনি উল্লিখিত জলবায়ু সম্মেলনকে লক্ষ্যপূরণে অসফল হিসেবে বিবৃত করেছেন। পাশাপাশি আসন্ন দুবাই জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৮ এ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় পূর্ববর্তী অঙ্গীকারসহ নতুন সিদ্ধান্তগুলো গুরুত্ব পাবে বলে আশাবাদী হয়েছেন। আমরাও তাঁর মতো আশাবাদী হতে চাই। বিশ্বাস করি, বিশ্বনেতৃবৃন্দ তাঁদের পূর্ববর্তী অঙ্গীকারগুলো সম্পর্কে সক্রিয় এবং দায়িত্বশীল হবেন। বৈশ্বিক জলবায়ু তহবিল, উষ্ণায়ন রোধে তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রির ভেতরে রাখবার প্রতিশ্রতি, অভিযোজন ও প্রশমন কর্মসূচি জোরদারকরণ এবং ক্ষয়ক্ষতি তহবিল গঠন ও জলবায়ু অর্থায়নে বাস্তবসম্মত, ন্যায্য এবং সংবেদনশীল ভূমিকা পালন করবেন।
সালিমুল হক বাংলা ভাষায় কোনো লেখা লিখেছেন কিনা আমার জানা নেই। বাংলায় অনূদিত লেখাও খুব একটা চোখে পড়ে না। আর এটি জরুরি কিনা এটি এই আলাপের কোনো তর্ক নয়। আমার বিবেচনায় সালিমুল হকের লেখালেখি অবশ্যই বাংলায় অনূদিত হওয়া জরুরি।
বাংলাদেশসহ বাংলাভাষাভাষী পাঠকের কাছে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ জলবায়ু-জিজ্ঞাসাকে পৌঁছে দেয়া জরুরি। জাতীয় শিক্ষাক্রমের পাঠ্যপুস্তকে ‘জলবায়ু পরিবর্তন’ বিষয়টি এখন যুক্ত হয়েছে। সালিমুল হকের লেখা পাঠ্যপুস্তকে যুক্ত হওয়া জরুরি। শিশুদের জানা জরুরি একজন বাংলাদেশী জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বৈশ্বিক পরিসরে কতটা সক্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন। কারণ আজকের এই জলবায়ু-দুর্গত শিশুরাই আগামীর জলবায়ু-যোদ্ধা। ভবিষ্যতে বৈশ্বিক জলবায়ু দেনদরবারে এরাই তো বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবে। শিশু কী তরুণ প্রজন্মের সকলের সাথেই সালিমুল হকের জলবায়ু-জিজ্ঞাসার পরিচয় ঘটা জরুরি। খুব বেশি দিন বাকি নেই।
এই নভেম্বরেই, ৩০ নভেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বর, দুবাইতে অনুষ্ঠিত হবে জলবায়ু সম্মেলনের ২৮তম আসর। সালিমুল হক এই সম্মেলনে শারীরিকভাবে থাকবেন না, কিন্তু তাঁর জলবায়ু জিজ্ঞাসাগুলো বহুজনের ভেতর দিয়ে দৃঢ়ভাবেই উচ্চারিত হবে আশা করি। তিনি চেয়েছিলেন, এই আসরেই বৈশ্বিক ক্ষয়ক্ষতি তহবিল গঠনের ব্যাপারে চূড়ান্ত ঐক্যমতে পৌঁছবে বিশ্বনেতৃবৃন্দ। আশা করি সালিমুল হকের এই চাওয়াখানি বাস্তবায়িত হবে। একটাই মাত্র পৃথিবীর প্রতি আমাদের দায় ও দায়িত্ব সক্রিয় হবে।