যে প্রতিষ্ঠানে একটি গোষ্ঠীর কমিটি আছে সেখানে অন্যান্য বৈধ রাজনৈতিক দল কেন তাদের সদস্য ফরম বিতরণ করতে পারবে না? এটা কি গণতন্ত্রের সংকেত? এটাই কি জুলাই-অগাস্ট বিপ্লবের বৈষম্যবিরোধিতা?
Published : 24 Feb 2025, 06:36 PM
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) ক্যাম্পাসে ছাত্রদল, শিবির ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়িত হয়। ত্রিপক্ষীয় এই সংঘর্ষের ঘটনাটি ঘটেছে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি। সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, কুয়েট ছাত্রদলের নতুন সদস্য সংগ্রহের ফরম বিতরণ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের শুরু। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটা ভিডিও দেখে এমনটাই ধারণা করা যাচ্ছে যে ছাত্রদলের কয়েকজন নেতা-কর্মী শান্তভাবে অন্যান্য শিক্ষার্থীদের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ, বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী চিৎকার তাদের শাসাতে শুরু করে। পরে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে ছাত্রদলের বিপক্ষে ক্যাম্পাসে মিছিল করতে দেখা যায় কিছু শিক্ষার্থীকে। এই উত্তেজনাটিই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপান্তরিত হয়। ঘটনার সূত্রপাত যেভাবেই হোক না কেন, শিক্ষাঙ্গনে এ ধরনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ অযৌক্তিক এবং অগ্রহণযোগ্য।
এবার অগ্নি বিজ্ঞানের দিকে একটু নজর দেই। আগুন তিনটি সত্তার দ্বারা জ্বলে— তাপ, অক্সিজেন ও জ্বালানি। অগ্নি বিজ্ঞানীরা দাবি করেন যে, আগুন ধীরে ধীরে তিনটি পর্যায়ে বিকশিত হয়— তৈরি বা প্রাথমিক, ক্রমবর্ধমান ও উন্নত পর্যায়। আগুন প্রাথমিক পর্যায়ে ছোট থাকে এবং এটি ক্রমবর্ধমান পর্যায়ে যাওয়ার জন্য পরিবেশ থেকে তাপ, অক্সিজেন ও জ্বালানি সংগ্রহ করতে চায়। আগুন যদি পর্যাপ্ত পরিমাণে তিনটি জ্বলন্ত উপাদান পায়, তবে এটি অবশ্যই পূর্ণগতিতে উন্নত পর্যায়ে চলে যায়। আগুন যখন উন্নত পর্যায়ে পৌঁছায়, তখন পোড়ানোর উপকরণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এটি নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব। প্রাথমিক পর্যায়ে আগুন নিয়ন্ত্রণ করা সহজ, অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও বুদ্ধিমানের কাজ। প্রাথমিক পর্যায় ব্যর্থ হলেও, আমরা কখনো কখনো ক্রমবর্ধমান পর্যায়ে আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। যদি ক্রমবর্ধমান পর্যায়ও ব্যর্থ হয় এবং আগুন উন্নত পর্যায়ে পৌঁছায়, তবে আমরা কেবল অসহায় বা আশাহীন ব্যক্তির মতো আগুনের জ্বলন্ত শক্তিই দেখতে পাই। অগ্নি বিজ্ঞানের এই তত্ত্বের সাম্প্রতিকতম উদাহরণ হলো যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার দাবানল।
মানুষের ক্ষোভ, হিংসা ও ক্রোধ আগুনের মতোই কাজ করে। কুয়েটের সংঘর্ষ ও সহিংসতার প্রাথমিক বা সৃষ্টির পর্যায়টি ছিল ছাত্রদলের কর্মীদের ওপর কিছু শিক্ষার্থীর অকারণ চিৎকার-হুঙ্কার, ভিডিও দেখে তেমনটিই মনে হয়েছে। ছাত্রদলের ফরম বিতরণ কর্মসূচির বিরুদ্ধে কিছু শিক্ষার্থীর ক্যাম্পাসে মিছিল করা ছিল সংঘর্ষের ক্রমবর্ধমান পর্যায়। অবশেষে, উন্নত পর্যায়টি ছিল ছাত্রদল, শিবির ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। জ্বলন্ত উপাদানগুলো ছিল— বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করতে কোনো গ্রুপের গোপন এজেন্ডা, অন্যের সঙ্গে দ্বন্দ্বের মানসিকতা এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও স্থানীয় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা বা দুর্বল প্রশাসনিক ক্ষমতা।
গত জুলাই-অগাস্টে ফ্যাসিবাদবিরোধী সকল রাজনৈতিক দল ও আপামর জনসাধারণের গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দুঃশাসন থেকে মুক্তি পায়। বিএনপিও তাদের সকল সামর্থ্য নিয়ে ওই গণআন্দোলনে যুক্ত হয়েছিল। এই মুহূর্তে দেশের অন্যতম জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলটির নামও বিএনপি। গত ১৬ বছরে রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তারা। কেন্দ্র থেকে থানা পর্যায়ে কোথাও তাদের কোনো পূর্ণাঙ্গ কমিটি ছিল না এই সময়কালে। এছাড়াও, এই সময়ের মধ্যে দেশে বিপুলসংখ্যক তরুণ ভোটার নিবন্ধিত হয়েছে যাদের অনেকেরই বিএনপি ও এর কার্যক্রম সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা নেই। আগামী জাতীয় নির্বাচনে এই তরুণদের ভোট অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
ওই বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে, ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে দেশের প্রায় প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিজেদের আদর্শ ও কর্মপরিকল্পনা শিক্ষার্থীদের ভেতর তুলে ধরার কার্যক্রম শুরু করে ছাত্রদল। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমিটি গঠন ও সংস্কার করছে। একইভাবে বিএনপির অন্যান্য ইউনিটগুলোও নতুন সদস্য সংগ্রহ ও কমিটি গঠনের জন্য কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে বিজয় অর্জনই সকল কর্মকাণ্ডের মূল উদ্দেশ্য। একটি রাজনৈতিক দলের জন্য এই সব কাণ্ডকীর্তি খুবই স্বাভাবিক।
এবার আসি কুয়েট প্রসঙ্গে। কেউ কেউ কুয়েটকে অরাজনৈতিক ক্যাম্পাস বলে দাবি করছেন। মানলাম এটা। এখন প্রশ্ন, অরাজনৈতিক ক্যাম্পাসে কীভাবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কমিটি করে? তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম এটা জুলাই অভ্যুত্থানের প্ল্যাটফর্ম। কিন্তু তারা শুধু কুয়েটে নয়, দেশের প্রায় প্রতিটি ক্যাম্পাসেই কমিটি করছে। জুলাই-অগাস্টের ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের প্ল্যাটফর্মটিকে তো তারা রাজনৈতিক দলে রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় আছে, যার মাধ্যমে আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছে। আবার, গণমাধ্যম সূত্রে এটাও মোটামুটি দৃশ্যমান হয়েছে যে, কিছু বিশেষ শিক্ষার্থী নিজেদেরকে সাধারণ ছাত্র দাবি করলেও কিছুদিন পর তাদেরকে একটি নির্দিষ্ট দলের ছাত্র সংগঠনের কমিটিতে দেখা যাচ্ছে, বিশেষ করে জুলাই-অগাস্টের পর থেকেই। যে প্রতিষ্ঠানে একটি গোষ্ঠীর কমিটি আছে সেখানে অন্যান্য বৈধ রাজনৈতিক দল কেন তাদের সদস্য ফরম বিতরণ করতে পারবে না? এটা কি গণতন্ত্রের সংকেত? এটা কি জুলাই বিপ্লবের বাস্তবতা? এটাই কি জুলাই-অগাস্ট বিপ্লবের বৈষম্যবিরোধিতা?
গত ২২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম কলেজেও ফরম বিতরণের চেষ্টাকালে ছাত্রদলের নেতাকর্মীর ওপর চড়াও হয়েছেন কিছু শিক্ষার্থী। এই ‘শিক্ষার্থী’ ছদ্মাবরণে কারা এই সব হামলা করছে? এভাবে কোনো রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনকে বারবার তার সদস্য সংগ্রহের পথে বাধা দেওয়া বা দেওয়ার চেষ্টা করা কি কোনো অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির সংকেত? বারবার বাধা দিয়ে যে কাউকে দমন করা যায় না এই সত্যটি কি আপনারা ৬ মাসেই ভুলে গেলেন?
প্রতিটি রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যই রাজনীতি করে। ক্ষমতার রাজনীতিতে যখনই আপনি কোনো দলকে বারবার বাধা দিয়ে অগ্নিময় পরিবেশ তৈরি করবেন, তখনই কুয়েটের মতো রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা তৈরি হবে। বিষয়গুলোকে এড়াতে চাইলে সকল পক্ষকেই সচেতন হতে হবে। কুয়েট সংঘর্ষের সবচেয়ে উপযুক্ত সমাধান হতে পারে যারা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের বা অগ্নির সূচনা করেছেন তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া। সহিংসতায় জড়িত যুবদল নেতাকে বহিষ্কার করে বিএনপি শুভ পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রশাসন তাকে উপযুক্ত শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে পারে। সহিংসতায় জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিতের পাশাপাশি সরকার ও প্রশাসন যদি সংঘর্ষের সূচনাকারীদের যথোপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হয়, তবে ভবিষ্যতে অন্যান্য ক্যাম্পাসগুলোতেও একই ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে সরকারকে তার শক্তি প্রয়োগ করতে হবে এবং আইন অনুযায়ী অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আশা করি সরকার ওই পথেই হাঁটবে।