শ্রমজীবী মানুষকে পুরানো বন্দোবস্ততে রেখে নয়া বন্দোবস্তের যে কোনো উপাখ্যানই জনবিরোধী। শ্রমিকের ন্যায্য দাবির আন্দোলনে পুলিশের হামলা, সরকারের দায়হীনতা, হাজার কোটি টাকা থাকার পরও মালিকের নিজেকে অসহায় দেখানো, সরকারের মালিকের কাছে নতজানু থাকা— এসবই নতুন বন্দোবস্তকে হাস্যকর করে তুলেছে।
Published : 27 Mar 2025, 08:11 PM
এবারের ঈদ সারাদেশের অনেক পরিবারের জন্যই ভিন্ন। মিরপুরের চশমা ফ্যাক্টরির রকি, গার্মেন্টসকর্মী ফয়সাল, দিনমজুর বাবু, দোকানদার শাওনসহ কয়েক হাজার মানুষ যারা মারা গিয়েছেন, যারা চোখ, পা ও বা শরীরের নানা অঙ্গ হারিয়েছেন, তাদের পরিবারসহ পুরো বাংলাদেশেরই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের কালেক্টিভ ট্রমার ঈদ এটি। ঠিক একইভাবে দীর্ঘ ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্ত হওয়ার ঈদও এটি। এই ঈদটি ভিন্নতর হওয়ার কথা ছিল। পুরোনো ফ্যাসিবাদী কায়দা থেকে ভিন্ন কোনো ব্যবস্থার ঈদ হওয়ার কথা ছিল। ১১২ জন শ্রমিকের জীবনের ওপর দাঁড়িয়ে এক নতুন নয়া রাজনৈতিককল্পের উত্থান হওয়ার কথা ছিল! ঈদ আসার আগমুহূর্তে দেখলাম— ‘কই! সব তো পুরোনো কায়দাতে চলছে’। জুলাই অভ্যুত্থানে এত শ্রমিকের মৃত্যুও তাদের ভাগ্যে নতুন করে কিছু লিখতে পারেনি। তার প্রমাণ, ঈদের আগে বকেয়া মজুরি আর ঈদ বোনাসের দাবিতে শ্রমিকদের রাস্তায় নামা। গত ৫৪ বছর ধরে চলে আসা একই চিত্রের পুনরাবৃত্তি।
গণঅভ্যুত্থানের পরে বহু কারখানা মালিক পালিয়েছে। বহু জায়গায় মালিকানার হাতবদল হয়েছে। গত বছর সেপ্টেম্বর মাস থেকেই বিভিন্ন গার্মেন্টস কারখানার শ্রমিক বিভিন্ন সময়ে রাস্তায় দাঁড়িয়েছে। কখনো কারখানা বন্ধের প্রতিবাদে, কখনো ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদে, কখনো বকেয়া মজুরির প্রতিবাদে। এই আন্দোলনের পরিক্রমায় শ্রমিক কাউসার ও চম্পা খাতুনকে প্রাণ পর্যন্ত দিতে হয়েছে। এসবের মধ্যেই আমরা দেখছি, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সরকার থেকে শুরু করে অভ্যুত্থানের অফিসিয়াল স্টেকহোল্ডার হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কিংবা তাদের সদস্যদের তৈরি জাতীয় নাগরিক কমিটি অথবা কমিটি পরবর্তী পার্টি সবাই এক নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা বলছে। বলছে, আর কোনো ফ্যাসিবাদকে এই নতুন রাষ্ট্রকল্পে জায়গা দেওয়া হবে না। নানাবিধ জাতীয় প্রসঙ্গে তারা তৈরি করতে চাচ্ছে নতুন ন্যারেটিভ। কিন্ত এ সবকিছুর মাঝে তারা যেটি বলছে না, তা হলো নয়া অর্থনৈতিক বন্দোবস্ত। শ্রমিক প্রসঙ্গে নয়া বন্দোবস্ত! বরং মজুরির দাবিতে শ্রমিক যৌথবাহিনীর গুলিতে তার জীবন দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে, এখনো ওই ফ্যাসিবাদী কায়দাটিই অটুট রয়েছে এখানে। পুরানো কায়দায় ঠিক সময়ে মজুরি দেওয়ার আশ্বাসে শ্রমিকদের দিয়ে সারা মাস খাটিয়ে পণ্য উৎপাদন করানো হয়েছে, ওই পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশে ডলার এসেছে, কিন্তু তা দিয়ে শ্রমিকের ন্যায্য পাওনা মেটানো হচ্ছে না। কোথায় যাচ্ছে এই রপ্তানির ডলার?
অভ্যুত্থানের পর তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, “জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে তৈরি পোশাক খাত থেকে ১৯ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। আগের অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রপ্তানি ছিল ১৭ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার। সেই হিসেবে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ দশমিক ২৮ শতাংশ।” যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, কানাডার নতুন বাজারে এই পণ্য রপ্তানি হয়েছে। কেবল ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বাজার থেকে এসেছে ৯৮৭ কোটি ডলার।
অন্যদিকে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের একটি প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, “তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল খাতের অধীনে থাকা ১২২টি কারখানা এখনও ফেব্রুয়ারি মাসের বেতন পরিশোধ করতে পারেনি বলে জানিয়েছে শিল্প পুলিশ। এছাড়া ঈদের বোনাস দেয়নি ৭২৩টি কারখানা।” অন্যদিকে সম্পূর্ণ অপারেশন চলার পরেও স্টাইল ক্রাফটস লিমিটেডের শ্রমিকদের বকেয়া রয়েছে প্রায় ১৪ মাসের বেতন। বিকেএমই এর অধীনে থাকা একটা বড় অংশের কারখানা শ্রমিকেরা এখনো এক মাসের বেতন ও ঈদ বোনাস পায়নি। গত ২০ মার্চ শ্রমভবনের সামনে স্টাইল ক্রাফটস শ্রমিকদের বকেয়া বেতনের দাবিতে আন্দোলনকালে ওই কারখানার শ্রমিক রাম সিং জনির স্ট্রোক করে মৃত্যুবরণ দেখেছি আমরা।
বিষয়টি তাহলে কেমন দাঁড়াচ্ছে! রপ্তানি বেশি হচ্ছে, নতুন বাজার তৈরি হয়েছে তৈরি পোশাকের। তবে কেন শ্রমিকের মজুরি পরিশোধ হচ্ছে না? উল্টো বিজিএমইএ প্রশাসন আর সরকারের কাছে প্রণোদনা চাইছে।। সরকার তা নিয়ে আলোচনাও করছে! অথচ মালিকদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমে থাকা শ্রমিকের ঘামের টাকাটা অধিগ্রহণ করে প্রাপ্য পাওনা মেটানোর কথা শক্ত করে বলতে পারছে না! তারা ভাবছে, মালিক না থাকলে হয়ত দেশে শিল্প থাকবে না। কিন্তু শিল্প তৈরি বা চালানো মালিকের হাতে নয়, শ্রমিকের হাতে— এই কথাটা যতদিন কোনো সরকার না মানবে, ততদিন নতুন অর্থনৈতিক বন্দোবস্ত আসবে না।
শ্রমিকেরা কারখানা ছেড়ে শ্রমভবনে আসার দায়টা কিন্তু মালিকপক্ষেরই। পরিবার ছেড়ে, কয়েকশো টাকা ধার করে, পরনের দুটো কাপড় নিয়ে শ্রমভবনে এসে বকেয়া মজুরি আর ঈদ বোনাসের দাবিতে অবস্থান করছে। কারণ, তারা বাসা ভাড়া দিতে পারছে না, সন্তানের পরীক্ষার খরচ দিতে পারছে না, ছোট বাচ্চার মুখে পছন্দের খাবার তুলে দিতে পারছে না। অথচ এই শ্রমভবনে যখন তারা অবস্থান নিলো তখন সরকারপক্ষ থেকে কথা এলো আন্দোলনের উস্কানিদাতাদের প্রতিহত করা হবে! যদি তাই করা হয়, তবে এই আন্দোলনের উস্কানিদাতা তো মালিকেরাই। তাদের প্রতিহত করতে কিন্তু আমরা দেখিনি। অথচ শ্রমিক যখন শ্রম মন্ত্রণালয়ে প্রাপ্য পাওনা বুঝে নিতে গেল, তখন পুরানো কায়দার পুলিশ বাহিনী তাদেরকে আক্রমণ করল। তাদের আন্দোলনের সাথে থাকা ছাত্র-জনতাকে নিপীড়ন করল নির্মমভাবে। এমনকি শ্রমভবনে অবস্থানরত শ্রমিকদের বাথরুমে যাওয়া বন্ধ করা হলো, ভবনের আলো নিভিয়ে দেওয়া হলো যাতে শ্রমিকরা আন্দোলন ছেড়ে চলে যায়, গিয়ে মামলা করে। শ্রম আইনে করা ওই মামলার রায় যেদিন হবে ওইদিন যেন তারা ঈদ করবে, তা দুই-দশ বছর পর হলেও!
শ্রমিকদের ওপর হামলার পর শ্রম মন্ত্রণালয় ১২টি কারখানার মালিকদের বিদেশ যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিল। কিন্তু যে মালিকরা আগেই বিদেশে পালিয়েছে, তাদের কারখানার শ্রমিকদের বকেয়া বেতনের কী হবে, তা স্পষ্ট করেনি! গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে শ্রমিকরা রাস্তায় মজুরির দাবিতে আন্দোলন করছে, তখন শ্রম মন্ত্রণালয় মালিকদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়নি; বরং শ্রমিকদের আন্দোলনকে ‘ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের আন্দোলন’ বলে চিহ্নিত করে নিরাপত্তার স্বার্থে যৌথবাহিনীকে শ্রম অঞ্চলে ছেড়ে দিয়েছে!
লেখাটি যখন লিখছি, তখন ঈদের আগে একদম শেষ সময়ের ব্যাংকিং কার্যক্রম চলছে। খবর পেয়েছি, আন্দোলনরত দুটি গার্মেন্টসের এক মাসের বকেয়া পরিশোধ করার কথা শ্রম মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। কিন্তু বাকি ১২০টি কারখানার শ্রমিক কীভাবে ঈদ করবে, তাদের বাকি মাসের বকেয়া আর বোনাসের কী হবে— তা পরিষ্কার না হওয়ায় শ্রমিকরা এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছে। এদেশের কোনো মন্ত্রী-আমলার এক মাসের বেতন বা বোনাস বকেয়া থাকে? কিন্তু শ্রমিকের থাকে। পুরোনো বন্দোবস্তের মতোই।
এদেশের শ্রমজীবী মানুষকে পুরানো বন্দোবস্ততে রেখে নয়া বন্দোবস্তের যেকোনো উপাখ্যানই জনবিরোধী। শ্রমিকের ন্যায্য দাবির আন্দোলনে পুলিশের হামলা, সরকারের দায়হীনতা, হাজার কোটি টাকা থাকার পরও মালিকের নিজেকে অসহায় দেখানো, সরকারের মালিকের কাছে নতজানু থাকা— এসবই নতুন বন্দোবস্তকে হাস্যকর করে তুলেছে।