কোরবানির ঈদে চলাচল হয় দ্বিমুখি– শহর থেকে গ্রাম এবং গ্রাম থেকে শহরে। এতে পরিবহন খাত চাঙ্গা হয়ে ওঠে সরাসরি। শুধু বাস নয়, ট্রাক মালিকদেরও ভালো ব্যবসা হয়। ট্রলারে গরু-ছাগল পরিবহনও বেড়ে যায়।
Published : 16 Jun 2024, 08:34 AM
কোরবানির ঈদে কি আরও বেশিসংখ্যক মানুষ গ্রামের বাড়ি যায়? কত মানুষ ঢাকার মতো শহর ছাড়ে– সেটা জানার একটা উপায় এখন কত সেলফোন সিমধারী ঢাকা ছেড়েছে, তা বের করা। ঈদে অনেকে আবার আসে এসব নগরীতে। তবে যারাই এখান থেকে বের হোক বা প্রবেশ করুক, তারা সবাই সেলফোন ব্যবহার করবেই, এমন নয়। শিশুরাও তো ঈদে শহরাঞ্চল ছেড়ে যায় অভিভাবকদের সঙ্গে। তারা থেকে যায় সিম গণনার বাইরে। অথচ ওদের ঈদযাত্রাটাই সম্ভবত সবচেয়ে আনন্দের। অনেকে গ্রামে যায় শিশুদের জন্যই। সেখানে তাদের অপেক্ষায় থাকে নিকটাত্মীয়রা। এ অপেক্ষা বড় আনন্দময়।
নগরায়নের সঙ্গে গ্রাম থেকে শহরে মানুষের উপস্থিতি বাড়ছে প্রধানত জীবিকার কারণে। শহর জীবিকা জোগাচ্ছে বেশি। তার মান নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন আছে। এই যে প্রতিবার দেশের প্রধান রপ্তানি খাতে ঈদের ঠিক আগ দিয়ে বেতন-বোনাস নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়, তাতেই বোঝা হয়ে যায় শ্রম পরিস্থিতির অনেকটা। শেষদিকে ঈদযাত্রাও জটিল হয়ে ওঠে শ্রমিকদের। খরচ বাড়ে; বাড়ে ভোগান্তি। তাদের ভোগান্তিতে অন্যদেরও ভোগান্তি কি বাড়ে না? সড়কে পণ্যের পাশাপাশি যাত্রী পরিবহন ব্যয়ও অনেক বেড়ে উঠেছে। ঈদের সময় বোধগম্য নানা কারণে তাদের ব্যয় বাড়ে; যদিও সেবার মান অনেক নেমে যায়। একসঙ্গে বহু মানুষ একই সেবা পেতে মরিয়া হয়ে উঠলে এমনটা অবশ্য ঘটবে। কিন্তু মানুষ তো প্রত্যাশা নিয়ে বাঁচে। তারা তাই দাবি করে বলে, প্রশাসন ও সরকার চাইলে সমস্যাটা অন্তত সহনীয় হয়ে আসতে পারে।
সেটা যে একেবারে হচ্ছে না, তা নয়। সড়ক, নৌ, রেলপথে ঈদযাত্রায় ভোগান্তি থেকে গেলেও সেটা আগের মতো নেই। ইতোমধ্যে একটা বড় পরিবর্তন এনেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ঈদের টিকিট প্রাপ্তির ব্যবস্থাটি অনলাইন করে। তাতে সুদীর্ঘ সময় লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটার দুর্ভোগের দিনগুলো গেছে। নতুন ব্যবস্থা নিয়ে অভিযোগ আছে অবশ্য। বড় বড় বাস কোম্পানির টিকিটও অনলাইনে মিলছে। উড়োজাহাজের টিকিট অনলাইনে কাটার ব্যবস্থা হয়েছে আরও আগে। এখন টিকিট কাটতে আলাদা করে আসতে হচ্ছে না তাদের, যাদের ওইটুকু প্রযুক্তিজ্ঞান আছে। এর বাইরে একটা বড় জনগোষ্ঠী অবশ্য রয়েছে, যাদের কথা ভুলে থাকলে চলে না। তাদের অনেকেই ঈদে বাড়ি যাচ্ছে যেনতেন উপায়ে। বাস ও ট্রেনের ছাদে চড়ে; ট্রাক ও পিকআপ ভ্যানে। এটা বেআইনি বটে; বিপজ্জনকও। ট্রাক দুর্ঘটনায় কতজন প্রাণ হারিয়েছে এ পর্যন্ত? ঈদে এ ধরনের যাত্রায় বাধা দিতে অবশ্য পারে না প্রশাসন। তাহলে তো অনেকের বাড়ি যাওয়াই হবে না। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একবার কড়াকড়ি করায় অনেকেই ঈদে যেতে পারেনি গ্রামে।
অপেক্ষায় থাকব এ খবর শুনতে যে, পথে দুর্ভোগ পোহালেও দেশের কোটি কোটি মানুষ নিরাপদে গিয়ে পৌঁছেছে তাদের জন্য অপেক্ষমাণ কোটি কোটি মানুষের কাছে। এটা মহামিলন বৈকি। কোরবানি ঈদে অবশ্য আরেক ধরনের মিলন ঘটে, যা নিয়ে আলোচনা কম। কোরবানিযোগ্য পশু নিয়ে বিপুলসংখ্যক মানুষ এ সময়ে এসে ওঠে শহর-বন্দরের হাটগুলোয়। তারাও আসে ট্রাকে, নৌযানে, এমনকি ট্রেনে। ‘ক্যাটল ট্রেনের’ ব্যবস্থা হয়েছে। এতে কম পশু এলেও খরচ আর ভোগান্তি কম। নৌপথে কোরবানির পশু নিয়ে আসারও কিছু সুবিধা আছে। তবে সড়কপথেই আনা হয় বেশি। এভাবে যারা গরু-ছাগল নিয়ে আসছে শহরের লোকজনের চাহিদা মেটাতে, তাদের সিংহভাগই গ্রামীণ বণিক বা বেপারি। কত শত গ্রাম থেকে তারা উঠে আসে আর কত বিচিত্র আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে! এ নিবন্ধ যখন লিখছি, তখন তাদের উপস্থিতিতে গমগম করছে রাজধানীর হাট ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলো। তারাও সেলফোন সিমধারী। রোজার ঈদে কিন্তু এমনটা ঘটে না। এ দিক দিয়ে কোরবানি ঈদের একটা ভিন্ন মাত্রা আছে। রাজধানীসহ বড় বড় শহরে যারা সারাদেশের ছোট-বড় খামার থেকে পশু নিয়ে আসে, তারা আমাদের আত্মীয় নয় বটে। তবে তারা কেউ নয়, এটা বলা যাবে না। কোরবানির পশু কেনাবেচার প্রক্রিয়ায় তাদের সঙ্গে জীবনে হয়তো আমাদের দেখা হয় একবারই। কিন্তু সেটা তাৎপর্যহীন নয়। হাট থেকে কেনা পশুটি হাঁটিয়ে এনে যে আমাদের আঙিনায় বেঁধে দিয়ে যায়, তার সঙ্গেও একটা সম্পর্ক স্থাপিত হয় বৈকি।
সুতরাং কোরবানির ঈদে চলাচল হয় দ্বিমুখি– শহর থেকে গ্রাম এবং গ্রাম থেকে শহরে। এতে পরিবহন খাত চাঙ্গা হয়ে ওঠে সরাসরি। শুধু বাস নয়, ট্রাক মালিকদেরও ভালো ব্যবসা হয়। ট্রলারে গরু-ছাগল পরিবহনও বেড়ে যায়। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় যেসব রুটে লঞ্চ ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারাও ভালো যাত্রী পায় এ সময়ে। রোজার ঈদেও বটে। এদিকে শুধু কোরবানির পশু বেচতে নয়; এর মাংস প্রক্রিয়াকরণে একদল লোক নিয়োজিত হয়ে থাকে। তারা সবাই পেশাদার কসাই নয়। এ কাজ করতে করতে যারা দক্ষতা অর্জন করেছে, তাদেরও চাহিদা অনেক বাড়ে এ সময়টায়। দেশময় তাদের সচলতা বাড়ে। এ কারণে ঈদের পরদিনও সড়ক ও নৌপথে এক ধরনের ব্যস্ততা থাকে। যাদের পশু বিক্রি হয় না, ঈদের দিনও সেসব বেপারিকে হাজির দেখা যায় হাটে। কিছু অবিক্রিত গরু-ছাগল নিয়ে ফিরেও যেতে হয় অনেককে। আর বেচেও লোকসান হলে কপালের দোষ দিয়ে বাড়ি ফিরতে হয় তাদের। এসব শঙ্কা তো প্রতিবারই থাকে।
দৃশ্যপট অবশ্য বদলাচ্ছে। রাজধানীসহ বড় বড় শহরের আশপাশেই গড়ে উঠেছে গবাদিপশুর খামার। সুনির্দিষ্টভাবে বললে, ভারত থেকে গরু আসা বন্ধের পর বেড়ে উঠছে এগুলো– প্রধানত কোরবানির ঈদের বিপুল চাহিদা মেটাতে। এতে তরল দুধের সরবরাহও বেড়ে উঠেছে। বিশেষত রোজার ঈদে একটা সময় পর্যন্ত তরল দুধের সংকট তৈরি হতো, মনে পড়ে। গরু-ছাগলের সরবরাহেও ঘাটতি ছিল দেশে। আর এর বছরবাপী চাহিদার বড় অংশ পূরণ হতো সীমান্তপথে আসা গরু দিয়ে। তাতে আমরা গোমাংস পেতাম কম বা সহনীয় দামে। কোরবানির সময়ও সীমান্তপথে আসা গরুর কল্যাণে বাজার থাকতো অনেকটা ক্রেতার অনুকূলে। এখন যে এটা বিক্রেতার অনুকূলে হয়ে গেছে, তা অবশ্য নয়। কারণ বাজারে (সরকারি হিসাবে) চাহিদার তুলনায় গরু-ছাগলের সরবরাহ বেশি। দুবছর ধরে চলা উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের অবস্থা যখন কাহিল, তখন কোরবানিদাতার সংখ্যা কমে গেলে সেটা বিক্রেতার জন্য সুখবর হবে না। গরুর বদলে ছাগল বা ভেড়া বিক্রি বেড়ে গেলেও গরু পালনকারী ও এর বেপারিদের মাথায় হাত উঠবে। এরই মধ্যে খবর– সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে ভারত ও মিয়ানমার থেকে গরু আসছে। তৃণভূমিতে পালন করা এসব গরু স্বভাবতই দামে সস্তা। তাতে স্থানীয় পর্যায়ে খামারে বাড়িয়ে তোলা গরু ‘স্বাভাবিক দামে’ বেচাও কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
কোরবানির পশুর দাম এবার যে মাত্রায় বেড়েছে, সেটা মূল্যস্ফীতির হারের অন্তত দ্বিগুণ বলে মনে হচ্ছে। এর কারণ আছে নিশ্চয়ই। খামারে গরু পালন ব্যয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে অনেকদিন ধরে। সাম্প্রতিক তাপপ্রবাহেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এ খাত। সেজন্যও প্রশ্ন উঠেছে, কোরবানির জন্য তৈরি গরুর সংখ্যা বিষয়ে সরকারিভাবে দেওয়া তথ্য সঠিক কিনা। বাজারে তো এর প্রতিফলন থাকতে হবে। কোরবানির হাটে অবশ্য অনেক বেশি কাজ করে ‘স্পেকুলেশনস’ বা জল্পনা। এর প্রভাবে দামের অস্বাভাবিক হ্রাস-বৃদ্ধিও দেখতে পাওয়া যায়। শেষ মুহূর্তে হাটে কী পরিস্থিতি দাঁড়ায়, সেটা সময়েই দেখা যাবে। আমরা অবশ্য আশা করব, বাজারে একটা ভারসাম্য বজায় থাকবে এবং কোনো পক্ষই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কোরবানি যারা দিতেই চায়, তারা অবশ্য লাভ-লোকসানের কথা খুব বিবেচনা করে না। সাধ্যের মধ্যে হলে পিছপা হয় না তারা। গরু না পারলে ছাগল এবং তা না পারলে ভাগেও কোরবানি দিয়ে থাকে লোকে। অর্থনৈতিক সংকটকালেও তাই কোরবানি দেওয়া পশুর সংখ্যা খুব একটা কমতে দেখা যায় না।
আর্থিকভাবে অসমর্থদের কোরবানি দেওয়ার বিধান নেই। তবে এমন গুরুত্বারোপ রয়েছে যে, তারা যেন কোরবানি দেওয়া পশুর মাংসের একাংশ পায়। এদেশ থেকে এখনও হারিয়ে যায়নি এ সংস্কৃতি যে, কোরবানির মাংসের ভাগ হবে তিনটি। সুফি ধারার মানুষজন এটা চালু করেছিলেন সমাজে সাম্যের চেতনা জারি রাখতে। মুক্তিযুদ্ধেও এটা ছিল। কিন্তু তারপর সাম্যের চেতনা দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়েছে। এ বিষয়ে অভিযোগও কম আজকাল। কোরবানি ঈদের সময়টায় দুর্বল হয়ে পড়া ওই চেতনা জাগানোর একটা সুযোগ কিন্তু ঘটে। যাদের বক্তব্য দেশের মানুষকে বেশি প্রভাবিত করে, তারা কি এ সময়ে কোরবানির মাংস তিন ভাগ করে বিতরণ ও পরিভোগের পক্ষে একটু জোরগলায় বলবেন? তাতে সারা বছর গোমাংস কিনে খেতে না পারা মানুষজন এর ভাগ পাবে আরও বেশি করে। এতে সারা বছরের পুষ্টির অভাব দূর না হলেও তারা আনন্দিত বোধ করবে। কোরবানিদাতারাও কিছুটা একাত্ম হতে পারবে তাদের সঙ্গে।
এরই মধ্যে হজ শুরু হয়ে গেছে সৌদি আরবে। দেশের অনেক পরিবার থেকে নানা বয়সের মানুষ গেছে হজ করতে। তবে এবার হজের কোটার অনেকখানি ফিরিয়ে দিতে হয়েছে নিবন্ধন কম হয়েছিল বলে। হজ পালনের খরচ অনেক বেড়ে গেছে করোনা পরিস্থিতির পর। করোনায় তো একবার কেউই যেতে পারেনি হজে। এবার যারা হজে গেছে, তারা যেন সুস্থ থাকে। সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে যেন ফিরে আসতে পারে। স্বজনরা তাদের জন্য অধীর অপেক্ষায় থাকবে ঈদ পালনের পরেও। যারা হজ করতে পারছে না নানা কারণে, তারা পরে ওমরাহ করতে পারবে। আর কোরবানির মতোই এটা তো সবার জন্য অবশ্য পালনীয় নয়। সামর্থ্যবানদের জন্যই হজ। হজে গিয়েও পশু কোরবানি দিতে হয়। এসব বিধিবদ্ধ আনুষ্ঠানিকতায় দেশের অনেক অর্থ ব্যয় হচ্ছে বিদেশে। ওইসব দেশ থেকে আবার বিপুল অর্থ আসছে এখানে, যা মূলত আমাদের যুব জনগোষ্ঠীর আয়। কোরবানি ঈদ ঘিরে প্রবাসী আয়প্রবাহ লাফিয়ে বেড়েছে সম্প্রতি। হুন্ডিতেও এটা বাড়বে প্রায় সমপরিমাণ। আর এর প্রভাব থাকবে সমাজ-অর্থনীতিতে। সেটা অনুভব করতেও কারও কষ্ট হবে না।