Published : 21 Oct 2024, 04:05 PM
প্রথাগত বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে যেমন সবার শিক্ষা চাহিদা পূরণ সম্ভব নয় তেমনি পড়ালেখাকে শ্রেণীবদ্ধ না রেখে উন্মুক্ত করে দিলে সকলেরই জীবনব্যাপী শিক্ষায় সংযুক্ত হওয়ার সুযোগ থাকে। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে সে ক্ষমতা রাখা হয়েছে। বংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় (বাউবি) বিগত তিন দশকে প্রথাগত শিক্ষার বাইরে উন্মুক্ত ও দূরশিক্ষণ পদ্ধতির শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে শিক্ষাকে জনগণের দুয়ারে পৌঁছে দিয়েছে। ২১ অক্টোবর ২০২৪ বাউবির ৩২ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিক।
১৯৯২ সালের ২১অক্টোবর জাতীয় সংসদের এক অনুমোদিত আইন বলে দূরশিক্ষণের মাধ্যমে যেকোন বয়স ও শ্রেণি পেশার মানুষ এবং দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে শিক্ষা সেবা প্রদান ও কর্মক্ষম জনশক্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। বাউবি এখন ভার্চুয়াল এবং শিক্ষার্থী সংখ্যা বিবেচনায় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়।
সময ও সুযোগের অভাবে যারা সাধারণ প্রতিষ্ঠানে গিয়ে লেখাপড়া করতে পারছেন না বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় তাদের উপযোগী করে তৈরি করেছে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রকল্প। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বহুমুখী পন্থায় সর্বপর্যায়ে শিক্ষাবিস্তার এবং দেশ ও সমাজের প্রয়োজনে শতভাগ নাগরিককে শিক্ষার আওতায় আনতে প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত গণমুখী ও জীবনব্যাপী শিক্ষা বিস্তারে কাজ করে যাচ্ছে বাউবি।
সকল পর্যায়ের মানুষ, নর-নারী, গৃহবধূ, বেকার যুবক-যুবতী, কর্মজীবী ও শিক্ষা সুযোগ বঞ্চিত, শিক্ষা লাভে আগ্রহী বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত জনগোষ্ঠীকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাহায্যে হাতের নাগালে শিক্ষার সুযোগ করে দেয়ার লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করা হয়েছে আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক কেন্দ্র , স্টাডি সেন্টার ও পরীক্ষা কেন্দ্র ।
এই প্রতিষ্ঠানে রয়েছে এসএসসি থেকে পিএইচডি পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহনের সুযোগ। বিভিন্ন বিষয়ে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য দারিদ্র বিমোচন, গ্রামীণ উন্নয়ন, কৃষি, সেচ, ব্যবস্থাপনা, মৎস্য চাষ, খাদ্য তৈরি, বনায়ন, হাঁস-মুরগি, গবাদিপশু পালন, স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, মাতৃমঙ্গল শিশু পরিচর্যা, স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধি, গ্রামীণ মহিলাদের কর্মস্পৃহা বৃদ্ধি, গৃহবধূর সচেতনতা বাড়ানো, ও কৃষি সম্প্রসারণ কর্মসূচিসহ নানা বিষয়ে তৈরি করা হয়েছে ননফরমাল শিক্ষা প্রোগ্রাম। পৃথিবীর যেকোন প্রান্ত থেকে এসকল প্রোগ্রামের মাধ্যমে বিষয় ভিত্তিক দক্ষতা অর্জন করে সাবলম্বী হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশী কর্মমুখী জনগোষ্ঠী যাতে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকতে পারে এবং দেশের অর্থনীতিকে আরো সুদৃঢ় ও গতিশীল রাখতে পারে সেজন্য বাউবি চালু করেছে বহি:বাংলাদেশ শিক্ষাপ্রোগ্রাম। প্রবাসে বসে রেমিটেন্স যোদ্ধাদের শিক্ষা লাভ ও দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আমাদের জিডিপি বৃদ্ধি পাবে।
বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম যোগানদাতা দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ দক্ষিণ কোরিয়া, সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত ও ইতালিতে চালু করা হয়েছে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম। বিদেশের মাটিতে বসেই প্রবাসী বাঙালি ও রেমিটেন্স যোদ্ধারা সেখানে লেখাপড়া শিখে আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারছে। বাংলাদেশী প্রবাসী অথবা বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত প্রবাসীরা বাউবির অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে লেখাপড়া করতে পারছে। দক্ষিণ এশিয়ায় মানব সম্পদ উন্নয়নে বাউবির অপার সম্ভাবনা ও কার্যক্রম বেশ সাড়া ফেলেছে। বহির্বিশ্বের বিভিন্ন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে পারস্পরিক জ্ঞান ও মনীষা বৃদ্ধি, একাডেমিক এবং গবেষণা কার্যক্রম আরও বৃদ্ধি পেতে পারে।
বাউবির অধিকাংশ শিক্ষার্থীই কর্মজীবী, সারা দিনে কাজের ক্লান্তি এবং ব্যক্তিগত কাজ শেষে ঘরে ফিরে পরিবারকে সময় দেয়ার পর বই নিয়ে লেখাপড়া করার আগ্রহ ও সময় থাকে না তাই দিনের ক্লান্তি শেষে একটু শুয়ে-বসে ভিডিও দেখে দেখে যাতে কম সময়ে বেসিক কনসেপ্ট তৈরি করে নিতে পারে সেজন্য রয়েছে অডিও ভিডিও প্রোগ্রাম।
অনলাইনে বাউবির বিভিন্ন প্রোগ্রামের লেকচার আপলোড থাকায় শিক্ষার্থী এবং আগ্রহী যে কেউ বাউবির ওয়েব সাইট থেকে বিনা মূল্যে সেসব ই-বুক, লেকচার ও স্টাডি গাইড ডাউনলোড করে নিজ জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ করতে পারছে । বাউবি টিউব, ওপেন টিভি, ওয়েব টিভি, ইউটিউব, টুইটার ও ফেসবুকের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসে অডিও, ভিডিও লেকচার দেখতে ও শুনতে পাচ্ছে। অনলাইনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট স্থানে বসে শিক্ষকের কাছ থেকে প্রশ্নের উত্তর ও তথ্যের আদান-প্রদানের সুযোগ রয়েছে।
সাপ্তাহিক ছুটির দিনে স্টাডি সেন্টারে গিয়ে তারা টিউটোরিয়াল ক্লাসে মিলিত হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বইগুলো মডিউলার পদ্ধতিতে এমনভাবে সরল-সহজ করে লেখা। একজন গার্মেন্টস কর্মী বা শিল্প কারখানার শ্রমিক বা রিকশাওয়ালা যেমন বাউবির শিক্ষার্থী অপরদিকে সরকারি-বেসরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, গবেষক, শিক্ষক, নার্স, রাজনীতিবিদ, গণমাধ্যমকর্মী সবাই বাউবির শিক্ষার্থী।
বাউবির শিক্ষার্থীরা অনলাইন সার্ভিস অ্যান্ড পেমেন্ট সিস্টেমের (OSAPS) মাধ্যমে ঘরে বসে কাজের ফাঁকে বিভিন্ন প্রোগ্রামে ভর্তি হতে পারছে।
দেশের একমাত্র উন্মুক্ত ও দূরশিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয় বাউবিকে উদিষ্ট জনগোষ্ঠীর কাছে নতুন রূপে নতুন আঙ্গিকে প্রযুক্তি নির্ভর এবং চতুর্থ শিল্পযুগ তুলে ধরতে বিশ্ব বাজারের চাহিদানুযায়ী কোর্স চালুকরণ, ও শিল্প উন্নয়নে উদ্যোক্তা তৈরির বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রজন্মের কাছে পরিশীলিতকরণ, দেশপ্রেম ও স্বাজাত্যবোধ জাগিয়ে তোলা এবং মূল্যবোধ তৈরিতে বাউবি বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।
আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে বাঁচতে এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কর্মমুখী ও গুণগত মানসম্মত শিক্ষা প্রয়োজন। এতে করে আমরা উন্নত বিশ্বের মর্যাদায় পৌঁছাতে পারব এবং কর্মমুখি শিক্ষায় জ্ঞান সৃজনের মাধ্যমে আমরা ভবিষ্যৎ ঝুঁকি মোকাবেলা করতে সক্ষম হব।
বাউবির রয়েছে প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত নেটওয়ার্ক এবং শিক্ষার সকল সুবিধা ফলে সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে গেলে শতভাগ শিক্ষিত নাগরিক তৈরি ও মানব সম্পদ উন্নয়নে বাউবি প্রতীকী হয়ে থাকবে। দূরশিক্ষণের এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জ্ঞানভিত্তিক এবং উদ্ভাবনী ও অর্ন্তভুক্তিমূলক সমাজ গঠন সম্ভব।
শিক্ষার্থীরা যাতে স্বাধীনভাবে চিন্তা ও মানসিক বিকাশ ঘটাতে পারে এবং শিক্ষা, জ্ঞান অর্জন ও গবেষণার মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে সেজন্য জীবন ঘনিষ্ঠ শিক্ষার উপযোগী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থী, সুবিধাভোগী ও স্টেক হোল্ডারদের জন্য তথ্যের অবাধ প্রবাহ রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানে।
বাউবির অনলাইন ও ইলেকট্রনিক শিক্ষা উন্মুক্ত শিক্ষাব্যবস্থায় প্রযুক্তি বান্ধব পরিবেশ সৃজনে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিচিতি লাভ করেছে। সব বয়স ও সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, নৃগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী, তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীসহ সকলকে এক সারিতে অন্তর্ভুক্ত করে আলোকিত জনগোষ্ঠী গঠনে এগিয়ে চলেছে বাউবি। নারী শিক্ষায় এক অভূতপূর্ব সাফল্য এনে দিয়েছে বাউবির উন্মুক্ত শিক্ষণ পদ্ধতি। জেন্ডার ইক্যুইটি সৃষ্টির কারণে দেশের তরুণ সমাজ শিক্ষায় আলোকপ্রাপ্ত হচ্ছে যাতে বাউবির অবদান রয়েছে। বাউবির শিক্ষায় তৈরি হচ্ছে মানব সম্পদ। সমাজের সুযোগ বঞ্চিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এবং যারা দুর্গম এলাকায় বসবাস করেন তারা বাউবির শিক্ষার মাধ্যমে নিজ নিজ এলাকায় বসবাস করেও নিজেদেরকে শিক্ষিত ও কর্মমুখি করে তুলতে পারছে। বাউবির মাঠ পর্যায়ের অফিসগুলোকে আরও উন্নত ও সেখানে সুবিধা বৃদ্ধি করে জনগণের দোরগোড়ায় শিক্ষাসেবা পৌঁছে দেয়ার মাধ্যমে বর্তমান প্রজন্ম কর্মদক্ষতা জ্ঞানলাভের আরও সুযোগ পেতে পারে। বাউবি এগিয়ে যাবে এবং উন্নয়ন অব্যাহত থাকবে এই আমাদের প্রত্যাশা।