ক্যান্সারের কাছে অসহায় হওয়া কেন? লড়াইটা শুরু করার আগেই হেরে বসে থাকা কেন? যারা লড়াইটা করে সুস্থ হয়ে উঠেছেন বরং তাদের কথা বেশি বেশি শুনতে হবে।
Published : 02 Jun 2024, 05:58 PM
অক্টোবর ২০১৮। কানাডা থেকে দীর্ঘ উড়াল ভ্রমণে ফিরলাম ঢাকায়। সারা শরীর ক্লান্ত, ভেঙে আসছে। টরেন্টো বিমানবন্দর। মেয়ের জামাই তুলে দিয়েছিল। এবার উড়ে যাওয়া। অনেক দীর্ঘ সময়। প্রায় ২০ ঘণ্টা, টার্কিশ এয়ারে। পিঠে ব্যথা, পিছকোমরে ব্যথা, উঠছে বারবার। তীব্র ব্যথা সহ্য করে থাকছিলাম, উফ! পাশে স্ত্রী। সে আমার কাতরানি দেখে অস্থির হয়ে উঠল। মনের জোর চাই। অনেক জোর চাই। টুঁ শব্দটি করা যাবে না। করলাম না। ঢাকা গিয়ে পৌঁছাতে হবে তো! আজ কিন্তু ভাবি, আমি এত সময় কী করে এ ব্যথা সয়েছিলাম? ‘মনকে বোঝাই, সহ্য করো।’ তাই করেছিলাম। সিটটা পেছনে ঠেলে চোখ বুঁজে থাক।
হোস্টেস পাশে এসে দাঁড়াল। স্যার, এনিথিং ইউ লাইক টু ড্রিংক?
হুম, প্লেইন ওয়াটার প্লিজ।
ওকে, প্লাস্টিক গ্লাসে জল।
আমি পানিতে চুমুক দিয়ে চোখ বুঁজলাম। আমার স্ত্রী আমার দিকে তাকাচ্ছে। কী? ভাবছে, এমন চুপচাপ? আমার যে খুব ব্যথা হচ্ছে তা কি টের পেয়েছে? আমি মৃদু হেসে বললাম, কিছু বলবে?
“না।”
দু’জনের হাতে দুটো ট্রলি ব্যাগ। তাই নিয়ে উঠেছিলাম প্লেনে। এয়ার হোস্টেস ছিল বেশ সদয়। বলেছিলাম, পিঠে ব্যথা, উপরে একটু তুলে দেবে ব্যাগটা? স্মিত হেসে সে তুলে দিল। তাই কি যে স্বস্তি। তুললে কি যে হতো! আমি ওয়াশরুমে যাব, নিজেই চেষ্টা করে যাব। আইল ধরে এগুলাম। ব্যথা উঠছে আবার। কোনোরকমে পৌঁছালাম ওয়াশরুমে, সিট ধরে ধরে। কাজ শেষ করে ফিরে এলাম সিটে।
কেমন লাগছে তোমার?
“ঠিক আছে।”
ব্যথা করছে?
“একটু একটু। ও কিছু না।”
মাস দুয়েক আগে কানাডার কানমোরে মেয়ে ও জামাইকে দেখতে যখন এলাম, তখন তো ভালোই ছিলাম। মেয়ে ও জামাইকে নিয়ে কত আনন্দ করলাম! কত জায়গায় ঘোরা হয়েছে। কত ছবি তোলা হলো। পাহাড়ে ওঠা, লেকের ধারে বসা, হেঁটে হেঁটে বনের পথে পথে যতদূর ইচ্ছে যাওয়া, ঝরনার জল পড়া দেখা। প্রায় জনহীন পথে ড্রাইভ। অনেকদূর পর্যন্ত। মাঝে মাঝে থেমে থেমে স্মৃতিগুলো ক্যামেরাবন্দি করা। কী নির্মল বাতাস! নির্মল জল, বিশুদ্ধ খাবার! কী দারুণ সবুজ চারধার! উঁচু পাইন গাছ। ভালুকের দেখা পাওয়া। চলচ্চিত্রের রিল কি পেছনে ফিরে আসছে মনে? রিউইন্ড হচ্ছে!
পাশে স্ত্রীও ঘুমে, আমার কাঁধে মাথা হেলিয়ে। ও ঘুমাক। তাই ভালো। সেও বেশ ক্লান্ত। আমার জন্য দুঃশ্চিন্তায় আছে। বুঝতে দিচ্ছে না। খুব চাপা। মনের হদিশ পাওয়া কঠিন। রওনা দেবার দিন ঠিকঠাক ছিলাম। ফেরা হবে টরেন্টো হয়ে। তাই ঠিকঠাক ছিল। ক্যানমোর থেকে ক্যলগিরি হয়ে প্লেনে টরেন্টো। আমি টরেন্টো আসব জেনে আমার এক সময়ের ছাত্র-ছাত্রীরা আয়োজন করল একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠান, আমাকে ঘিরে। ডা. আবদুল আলি মানু মেডিকেল কলেজের আমার ছাত্র ছিল, সে-ই আয়োজনটি করল। রাতে সংবর্ধনা এবং ডিনার। আমাদের সপরিবার নিমন্ত্রণ। পেছনে টাঙানো আমার ছবি, বড় একটি ছবি, ভাবছিলাম কি করে পারল ওরা? ক্যালগিরি থেকে ফ্লাই করে মেয়ে, জামাই ও আমরা দু’জন পৌঁছেছিলাম টরেন্টোতে। অক্টোবরে। এয়ারপোর্ট থেকে জামাই ড্রাইভ করে নিয়ে গেল টরেন্টোতে আমাদের আগে থেকে ঠিক করা রেস্ট হাউজটিতে। রাতে পিছকোমরে তীব্র ব্যথা শুরু হলো। একটু হালকা একটা সুটকেস তুলেছিলাম। সেজন্য কি? কী হলো? ব্যথা কমছে না। সহ্য করি। মেয়ে বলল, বাবা ট্রিপল নাইন ডাকি। আমি বাধা দিই। হাসপাতালে নিয়ে গেলে ঢাকা পৌঁছতে পারব না। ওরা এখানে রেখে দেবে। ভয়ানক অসুখ কিছু, বুঝতে পারছিলাম। মনের জোর পরীক্ষা করছি। ব্যথা নিয়েই গেলাম ছাত্র-ছাত্রীদের সংবর্ধনায়। ওরা সবাই ডাক্তার, টরেন্টোতে প্রতিষ্ঠিত। আছে নানা কাজে। ব্যথা হচ্ছে, সহ্য করে আছি। মুখে হাসি। অবাক হই, এত অমলিন হাসি বানালাম কী করে! জীবনে অনেক নাটকে অভিনয় করেছি, তা কাজে লাগল। নিখুঁত অভিনয়। বক্তৃতা দিলাম। স্বাভাবিক। কেউ বুঝল না। আমার ছাত্র-ছাত্রী যারা ডাক্তার, তাদের ভক্তি শ্রদ্ধা আমার প্রতি উপচে পড়ছে। আমার ব্যথা বেদনা কি সেজন্য উবে গেল সে সময়? তাদের আদরের জন্যে আর আমাকে সেই পুরোনা দিনের মত সম্মানের জন্য আমি কি ভুলেছিলাম সব ব্যথা বেদনা!
পরদিন যাত্রা। এর আগে নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখার প্ল্যান। আমার স্ত্রী কানাডা আসার আগে ইচ্ছে প্রকাশ করেছিল, নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখবে। মেয়ে জামাইও সব ব্যবস্থা করে রেখেছে। রাতে সংবর্ধনা যে হোটেলে হলো সেখান থেকে রেস্ট হাউজে এসে শুয়ে পড়লাম শয্যায়। স্থির নিশ্চল হয়ে চোখ বুঁজে রইলাম। নড়াচড়া করলাম না, যদি ব্যথা ওঠে।
পরদিন সকালে প্রাতরাশ করে রওনা দিলাম নায়াগ্রার উদ্দেশ্যে। আমার জামাতা নিজে ড্রাইভ করে আমাদের নিয়ে গেল নায়াগ্রা। কানাডার রাস্তা পরিপাটি ও মসৃণ। এদিকে জামাতার নিখুঁত ড্রাইভিং, যেতে যেতে ভালোই লাগছিল। জলপ্রপাত সামনে। কানাডার দিক থেকে নদী ও জলপ্রপাত। কি গম্ভীর সৌন্দর্য! কি অপার বিস্ময় আমাদের সামনে! পৃথিবীর সর্ববৃহৎ জলপ্রপাত। বাংলাদেশ থেকে কত কত দূরে? বিশ হাজার কিলোমিটার। ‘কি মায়ায়, কি ছায়ায় সম্মৃত অম্বর, হে গম্ভীর।’ আকাশ ভেঙে সব জল কি মহাদানবের মত সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে আছড়ে পড়ছে নিচে? টরেন্টো থেকে ১২৮ কিলোমিটার ড্রাইভ করে এসেছে জামাই, আমাদেরকে নিয়ে এই নায়াগ্রায়। নায়াগ্রার অর্থ জলরাশির বজ্রধ্বনি। তাই শুনতে পারছিলাম। কি আওয়াজ! জলদ গম্ভীর। আমরা উপরে দাঁড়িয়ে। নিচে পড়ছে জল, আছড়ে আছড়ে অনেক নিচে নামছে।
আমার ব্যথা খুব উঠেছে। বললাম, ব্যথা হচ্ছে, নিচে নাইবা গেলাম। এবার চল উপর থেকেই দেখে, দেখে যাই। আমরা যে শিলাখণ্ডের সামনে সেই পাথরের বিশাল টুকরোর উপর হঠাৎ এসে বসল দুটো পাখি। চিনতে পারলাম না এদের। কি পাখি? কিন্তু এরা পরস্পর চোখে চোখ মিলিয়ে বসে আছে আমাদের সামনে। আমাদের চোখাচোখি হলো। আমরা মৃদু হাসলাম।
“কে প্রথম কাছে এসেছি কে প্রথম চেয়ে দেখেছি।
কিছুতো পাইনা ভেবে, কে প্রথম ভালোবেসেছি।”
ব্যথা উপশমের জন্য কি এরা উড়ে এল? তাই হয়তো! নায়াগ্রার বাগান ও দর্শনীয়স্থান ঘুরে, স্ন্যাকস খেয়ে ফিরলাম টরেন্টোর পথে। রাতে ফ্লাইট। টরেন্টো-ঢাকা। ১৬ ঘণ্টার বেশি উড়াল এখন। এয়ারপোর্টে মেয়ে ও জামাই এলো। প্লেনে তুলে দিয়ে গেল। তাদের মুখ আমাদের বিদায় দিতে গিয়ে মলিন, মনে হলো উদ্বেগও আছে। মেয়ের চোখে জল। আমাদেরও।
“আকাশ থেকেও জল ঝরে, চোখ থেকেও জল ঝরে, দুটোর কারণ আলাদা।” প্লেনে উঠলাম। এরপর লম্বা ভ্রমণ। ঢাকা নেমে সরাসরি বাসায়। এসেই ফোন করলাম বারডেমে। অধ্যাপক জাফর এ লতিফ তখন মহাপরিচালক। বললাম তাকে আমার অবস্থা। তার পরামর্শ, বারডেমে এসে ফিজিওথেরাপি বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক জামানকে দেখানোর জন্য। আমি এলাম। আমার সমস্যা শুনে বললেন ইনফ্রারেড নিতে। নেয়ার পরও ব্যথা কমল না, আগের মতোই ছিল। ডা. জামান এবার হাত বুলালেন আমার শিরদাঁড়া বরাবর উপর-নিচ। তার চেহারায় উদ্বেগ, শংকা। শিউরে উঠি। স্যার, খারাপ কিছু হয়েছে মনে হচ্ছে। আমার স্ত্রী ভাবলেন, এ কেমন ডাক্তার খারাপ হয়েছে এমন খোলাখুলি বলছেন। কিন্তু ডা. জামান যে কত সত্য তা পরে বোঝা গেল। ফিজিওথেরাপি করে গেলে ডায়াগনোসিস দেরি হতো। তার ক্লিনিক্যাল হাঞ্চ দারুণ। তিনি কি বুঝতে পেরেছেন কী হয়েছে? “স্যার একটা সিটি স্ক্যান করান জলদি।” দৌড়ে গেলাম ইমেজিং বিভাগে সিটি স্ক্যান হলো। শিরদাঁড়াতে ভাঙ্গনের চিহ্ন। রোগ নির্ণয় নিয়ে বিতর্ক রেডিওলজিস্টদের মধ্যে। শেষপর্যন্ত প্রশ্নবোধক চিহ্ন নিয়ে রোগ নির্ণয় হলো। এমআরআই করতে হবে, তাহলে দৃঢ প্রমাণ মিলবে এমন অভিমত বিশেষজ্ঞদের। বারডেমে হয় না এমআরআই। মডার্নে যান ওখানে হবে। চটজলদি। কিন্তু যাব কী করে? গাড়িটা বাসায়। ড্রাইভারকে ডেকে গাড়ি আনতে অনেক দেরি হবে। এগিয়ে এলো আমার সহকর্মী ডা. দিপা। তার স্বামী নামকরা সার্জন গাড়ি নিয়ে এসেছে তাকে নিতে। এরা দুজনেই আমাদের নিয়ে গেল মডার্নে। এমআরআই হলো, হলো বিএমডিও। মাল্টিপল মায়েলোমা ১ প্রমাণিত প্রায়। বাকি কিছু টেস্ট। কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট, বিপিএফ। মায়েলোমা প্যানেল, আর বায়োপসি। কেমন লাগছিল আমার? আমার স্ত্রীর? আর জানে আমার ছোট ভাই ডা. অরূপরতন চেীধুরী। মনকে বোঝাই। ‘মনরে, সত্য লও মেনে সহজে’। ইলেকট্রো ফোরেসিস রিপোর্টে এলো। গ্লোবুলিন বেশি। বেনস জোনস টেস্ট পজিটিভ।
কিন্তু কোথায় হবে চিকিৎসা?
আমার কশেরুকাতে ভাঙন। হাড়ে ওস্টিওলাইটিক লিজন। ছোট ছোট গহ্বর। ধসে পড়েছে কশেরুকাগুলো। লো ব্যাক পেইন বাড়ছে। সহ্য করতে হবে আমাকে।
আমার চেহারায় বেদনার রেখা ফুটতে দেয়া যাবে না। তা তো হলো। চিকিৎসা কী করে হবে? মেডিকেল বোর্ড হলো। বারডেমে ক্যান্সার চিকিৎসা হয় না। আমার শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে। শুনলাম কেউ কেউ বলছেন, পাঠাতে হবে ইন্ডিয়ায়। নয়তো থাইল্যান্ডে। টাটার হেমাটোলজি ক্যান্সার বিভাগ চলে এসেছে কলকাতায়, সেটা ভালো। তাই ওখানেই যেতে হবে। তাহলে এখন কী হবে? আপাতত আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো ঢাকা মেডিকেল কলেজে হেমাটোলজিতে, বিএমটি সেন্টারে। রোগ নির্ণয়ের পাঁচদিন পর চলে এলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজে। হেমাটোলজির অধ্যাপক আর ঢাকা মেডিকেলে কলেজের বিএমটি (বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট) প্রধান স্থির করলেন, ডিভিডি প্রটোকল। বর্টেজুমিব-থেলিডোমাইড এবং ড্যাকসামিথাসন- এ হলো মাল্টিপল মায়েলমার জন্য কেমো থেরাপি প্রটোকল। বর্টেজুমিব হলো শুরু। ট্রেড নেম ভ্যালকেড। কেমোথেরাপি। নতুন ঔষধ। কপাল ভালো। এবার চিকিৎসা অনেক স্মার্ট। ওষুধটি আমদানি করা হয় বেলজিয়াম থেকে। আমার ছাত্র ক্লিনিসিয়ানরা সে ব্যবস্থা করল। শুরু হলো ড্যালকেড। এদিকে ফ্লুইডও দেয়া হচ্ছে সেইসাথে। স্ত্রী আছেন সব সময়ের সঙ্গী। এর মধ্যে এলেন অধ্যাপক নাজমুন নাহার। প্রখ্যাত শিশু বিশেষজ্ঞ, বারডেমের প্রাক্তন ডিজি। দেখতে এসেছেন। আধঘণ্টা খানেক অনেক কথা হলো। নার্স একজন। পুরো ওয়ার্ডে একজন ডিউটি ডাক্তার। সেও চেলে গেল, সমস্যা হলে বলবেন স্যার। ফোন নম্বরও দিল। ডাক্তার নাজমুন গল্প করে চলে গেলেন। আমার বাথরুমে যাবার তাগিদ হচ্ছে। আমার ফ্লুইড চ্যানেল হাতে ধরে স্ত্রী সঙ্গে গেলেন। জল বিয়োগ সমাপ্ত করে উঠে মনে হলো শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছে। আমি বললাম স্ত্রীকে, টেলিফোন দাও তাড়াতাড়ি ফোনে বললাম, তাড়াতাড়ি এসো আমার অক্সিজেন স্যাচুরেশন মনে হয় কমে যাচ্ছে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। অক্সিজেন দাও। এসো। দৌড়ে এল ডিউটি ডাক্তার। সেন্ট্রাল অক্সিজেন চালু করা হলো। শ্বাসকষ্ট কমল। এদিকে খবর পেয়ে এসেছেন অনেকে। এসেছেন আমার সম্বন্ধী অধ্যাপক মানিক মজুমদার। আমার ছোট ভাই অধ্যাপক ডা. অরূপ রতন চৌধুরী বারডেম থেকে এসেছে অক্সিজেন সিলিন্ডার ও অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে। এদিক আইসিইউ-এর এখানে ডাক্তাররা আমার অবস্থা বেগতিক দেখে অ্যাপোলো মানে বর্তমানে এভারকেয়ার আইসিইতে যেতে বললেন। আমাদের পছন্দ বারডেম আইসিইউ। এছাড়া অ্যাপেলো দারুণ ব্যয়বহুল। আমার মতে বারডেমের আইসিইউ ঢাকাতে সবচেয়ে ভালো ও সাশ্রয়ী। সেখানকার প্রধান ডা. আরিফ। ইনটেনসিভ কেয়ারের ব্যাপারে তার ওপর আমার অগাধ বিশ্বাস।
ক্যান্সার সারাতে নিয়ে আমার ভেতরে অন্য সমস্যা হলো। ফ্লুইড ওভারলোড হয়ে যা ঘটে গেল। তাহলো পালমোনারি ইডেমা। ফুসফুসে জল জমেছে। পরে বোঝা গেল বারডেম গিয়ে আমার এ অবস্থা দেখে সেখানে আইসিইউতে যারা তারা একে মনে হয় মোকাবেলা করার সাহস পেলেন না। আমার ভালো বিকল্প বারডেম আইসিইউ। সেখানে যাত্রা শুরু করলাম। নাকে আক্সিজেনের নল লাগানো। শ্বাস নিচ্ছি। অক্সিজেনে ভরছে বুক কিন্তু শ্বাসের তেমন জোর নেই। অ্যাম্বুলেন্স এসে থামল বারডেমের গেটে। সবাই আমাকে নিয়ে এলেন বারডেম আইসিইউ। শয্যা তৈরি ও যন্ত্রপাতি প্রস্তুত। আমি যে সংকটে ছিলাম আগে থেকেই জেনে গেছেন সবাই। পরীক্ষা নিরীক্ষা হলো নানারকম, ত্বরিৎ গতিতে।
আমার চারধারে পরিচিত মুখ। বিভাগ প্রধান ডা. আরিফ ও তার সহকর্মীদের অনেকেই আমার ছাত্রছাত্রী। পোর্টেবল এক্সরে হলো। ভাইটালস দেখা গেল, ডপলার করা হলো। রক্ত পরীক্ষা করা হলো। সংকট মোকাবেলার জন্য যা যা দরকার সবই করা হলো। এই বারডেম আইসিইউ দক্ষ হাতে সাজিয়েছিলেন খুব মেধাবী চিকিৎসক অধ্যাপক ওমর ফারুক। ডা. আরিফ তার হাতে গড়া, এখন বিভাগের প্রধান। বারডেমের চিকিৎসক নার্স সবাই খুব দক্ষ।
আমার সংকট অবস্থা ধীরে ধীরে কাটছে। ফুসফুসের যে ক্ষত হয়েছে তা অত সহজে সারবে না। ছোট ভাই ডা. অরূপ রতন দৌড়াদৌড়ি করে সব গোছগাছ করেছে। আমার অবস্থার ফলোআপ করছে প্রায় সার্বক্ষণিক এসব আমাকে অনেক সাহস ও স্বস্তি দিলো, যা অন্যত্র পাওয়া কঠিন। এত নিশ্চিন্ত পরিচর্যার মধ্যে এ হলো উত্তাল সুখ, তা দেখে বেদনারা ফিরে যায়।
আমি আইসিইউতে। আমাকে ধরাধরি করে নিয়ে এলেন যারা তাদের মধ্যে ছিলেন আমার আত্মীয়-স্বজন ও সহকর্মীরা। অক্সিজেন ট্যাংক লাগানো। আমার স্ত্রী উদ্বিগ্ন, ব্যাকুল মন। আমি দেখলাম শুভ্র শয্যা। আমার জন্য তৈরি। মৃত্যুর নিবিড় ছায়া কি আমাকে অভিভূত করেছে তখন? আমার বিলুপ্ত চৈতন্য। আমি অন্ধকার জগতে হয়তো বা আমি যখন চোখ মেললাম তখন দেখি আমার চারপাশে স্ত্রী, স্বজন ও চিকিৎসক। তাদের মনে উৎকণ্ঠা আমার জন্য ছিল তা শুনে ভেবে আমার মনে কিঞ্চিৎ আশা জাগল। আমার মনে সুখ এলো। চিকিৎসকদের অনেকে আমার ছাত্র; তারা রোগশয্যা পাশে এতক্ষণ থেকে আমাকে যেন অচৈতন্য দশা থেকে উদ্ধার করলেন; সে ঋণ শোধ হবার নয়। আমার ডুবে যাওয়া জীবনতরী যে আবার ভেসে উঠল। আমার এ পরিণত বয়সে সে কম কথা নয়। অক্লান্ত সতর্ক সেবার সাথে মমতা ও প্রীতি যুক্ত হলে তাতে রোগীর আরওগ্য হবার সম্ভাবনা যেন বেড়ে যায়। মৃত্যু আমার যেন খুব কাছে এসেছিল সে বিষয়ে আমার সন্দেহ নাই। আমার ক্ষণ ভঙ্গুর শরীরে বল পাবো কবে সে বিষয়ে চিন্তা হচ্ছিল। এদিকে আমার স্ত্রী নিশ্চল পাথরের মতো যেন ঘটনাপ্রবাহ প্রত্যক্ষ করছে সে আর এর প্রতিক্রিয়া তার হৃদয়ে যেন তোলপাড় করতে করতে স্থির হয়ে গেছে। তার মুখের দিকে চাইতে পারি না। আইসিইউতে ঢুকতে মানা ছিল ঢুকে আমাকে সচেতন ও জাগ্রত দেখে আশ্বস্ত হলো সে। তার স্থির চেহারায় মনে হলো স্বস্তির মৃদু ঢেউ সাড়া দিলো। মুখে কিছু বলে না কেবল কপালে তার হাতের স্পর্শ অনুভব করলাম এরপর আমরা একা।
“স্বপনে দোহে ছিলাম কি মোহে।”
শরীর অবসন্ন। সে সঙ্গে মনে যেন কুয়াশা ছড়িয়ে পড়েছে। একে কি ব্রেইনফগ বলে? ছোট ভাই অধ্যাপক অরূপ রতন সঙ্গে সবসময়। আইসিইউতে আমার চেতনা ফিরে পাওয়া দেখে তারও মনে স্বস্তি। আমার তখন মনের মধ্যে দিয়ে কি যে যাচ্ছে বলতে পারি না। লাইফ সাপোর্টের যন্ত্রপাতি পাশে। দুর্বল ঝাপসা মুহূর্তগুলোতে আমার তেমন মনে হচ্ছে না কিছু। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের প্রান্তিক কাব্য গ্রন্থে সংকলিত প্রথম কবিতার একটি চরণ,
“বিশ্বের আলোক লুপ্ত তিমিরের অন্তরালে এল
মৃত্যুদূত চুপে চুপে, জীবনের দিগন্ত আকাশে”
আমি কিছুটা অস্থির ও বিচলিত। তবে মনকে স্থির করার চেষ্টা করি। আমি আবার রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করি
“অন্ধতামস গহ্বর থেকে
ফিরিনু সূর্যালোকে”
তবে আইসিইউতে আমার থাকার সময় দীর্ঘ হলো আরও তিনদিন। ফুসফুস জলে ভরে ছিল। একে নিষ্কাশন করা আর শুকিয়ে আনা আগের মতো সবল করা সহজ কাজ ছিল না।
এদিকে ক্লান্তি বিরতিহীন। রোগ সহকারীরা আমাকে বড় ভালোবেসে, পরিচর্যা করল, সে ঋণও শোধ হবার নয়। হঠাৎ একটি আশ্চর্য ঘটনা ঘটে গেল। অধ্যাপক একে আজাদ খান সঙ্গে মহাসচিব জনাব সাইফউদ্দিন। সঙ্গে বয়সে প্রবীণ একজন ভদ্রলোক। আজাদ খান বললেন তোমার জন্য কাকে এনেছি দেখো। খুব ভালো হেমাটোঅনকোলানিস্ট। অধ্যাপক মনজুর মোরশেদ। তিনি আমাকে বললেন, স্যার আমি আপনার ছাত্র। আমি অবাক। কবে, কখন? আপনি স্যার বিলেত যাবার আগে আমাদের শেষ যে ব্যাচ পড়িয়েছিলেন আইপিজিএম-এর আমি সেই ব্যাচে ছিলাম। মনে পড়ল। আমি তখন সহযোগী অধ্যাপক আইপিজিএমআর। ১৯৮০ তে পড়িয়েছি তাকে। আমি দারুণ খুশি। আমি বললাম, “তাহলে আপনি আমার চিকিৎসা করুন। অনেকে বলছিল এদেশে চিকিসা হবে না এ রোগের, আমি মানি না। আপনি করুন। অধ্যাপক সালমা আছে, অধ্যাপক তাসমিম ফারহানা দীপ্তাও আছে, আরও আছে বিশেষজ্ঞরা। দেশেই হবে আমার চিকিৎসা।”
আমার ছাত্র আমার চিকিৎসা করবে এ যে কত বড় স্বস্তির ব্যাপার তা বোঝানো যাবে না। আমার চিকিৎসা নিয়ে যে অন্ধকার ছিল মনে তা কেটে গেল। আইসিইউর-এর মধ্যে যারা দেখতে এসেছিলেন আমার অনেক স্বজন ও সহকর্মীরা তাদের চেহারায় যেন দেখেছিলাম উৎকন্ঠা আমার জন্য। জানি তারা প্রার্থনা করছিলেন আমার রোগমুক্তির জন্য। আমাকে তারা ভালোবেসেছিলেন তাই।
“কারা যেন ভালোবেসে আলো জ্বেলেছিল
সূর্যের আলো যেন নিভে গিয়েছিল”
হাজার জোনাকির আলোও ভালোবাসা হয়ে মনে আলো ছড়ায়। আমার অবস্থা সুস্থিত এমন ডাক্তাররা যখন বুঝলেন, তখন আমাকে স্থানান্তর করা হলো কেবিনে। আমি আইসিইউতে যখন তখন পাশের ঘরে আমার স্ত্রী প্রায় সর্বক্ষণ ছিল, আমার শ্যালিকা স্বপ্না। অরূপের স্ত্রী গৌরি ও আমার ভায়রা বিকাশ এসেছেন কয়েকবার। এসেছেন দুই বেয়াই ও বেয়ান। সম্বন্ধি, তার স্ত্রী ও ছেলে ড. মানস মজুমদার। সবাই প্রার্থনা করছিলেন আমার রোগ মুক্তির জন্য। আমার নতুন উপসর্গ হচ্ছিল, মলাশয় থেকে যাচ্ছিল তাজা রক্ত। একে সামলানো হলো এন্টাবোলজিস্টের গ্যাস্ট্রো এন্ট্রালজিস্টের পরামর্শে। এসব কিছু ঝুটঝামেলা সারার পর আমাকে স্থানান্তর করা হলো ইন্টারন্যাল মেডিসিনের অধীনে কেবিনে। মেডিকেল বোর্ড গঠিত হলো চটজলদি। আসগর আলী হাসপাতালের হেমাটোঅনকলোজিস্ট অধ্যাপক মনজুর মোরশেদের নেতৃত্বে বারডেম ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের হেমাইলোজি, বারডেমের মেডিসিন, সার্জারি, ডায়বেটলজি ও কার্ডিওলজি, ইন্টারন্যাল মেডিসিন, হেমাটোলোজি বিভাগের বিশেষজ্ঞদেও নিয়ে। এদের অনেকেই আমার ছাত্র। তাই আমার ভরসাও বেশি।
ভারতে যাবার জন্য যে অ্যাপয়েনমেন্ট করা হয়েছিল তা ক্যান্সেল করা হলো। সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো দেশেই চিকিৎসা হবে। আমার চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার এত বড় আয়োজন সম্ভব হয়েছে আমার ছাত্রছাত্রীদের দ্বারা। আর সহকর্মীদের রয়েছে এতে অসামান্য অবদান। তারা আমাকে সত্যি ভালোবেসেছিলেন বিপদে তার প্রমাণ পেলাম। আমাকে নানাভাবে তারা সাহায্য করেছেন, কোনো অপূর্ণতা তারা রাখেনি। যেকোনো পর্যায়ে বা তদারকি কোনো কিছুতেই।
আমার তাদের কাছে এ ঋণ শোধ হবার নয়। যেখানে ঘাটতি বা অপূর্ণতা দেখেছে ছাত্রছাত্রীরা যেচে এসে সে অপূর্ণতা পূর্ণ করেছে, জানতে দেয়নি। কেবল দেশে কেন, প্রবাসে বসবাসকারী ছাত্রছাত্রীরাও অনেক উদ্বিগ্ন ছিল।
আমার চিকিৎসার প্ল্যান, আমার শারীরিক অবস্থা— তারা সবই চেয়ে নিলো এখানকার মেডিকেল বোর্ডের কাছ থেকে। প্রবাসে আমার চিকিৎসাপ্ল্যান মনিটর করেছে ডা. সিনহা মনসুর, আজ সে প্রয়াত। কিন্তু আমার কাছে সে চির জাগ্রত। তার ঋণ অপূরণীয়। তারা আমেরিকা ও বিলেতে আমার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান নিয়ে আলাপ করল, ওখানকার অনকোলজিস্টদের সাথে। তাই দু’তরফে মিল করেই চলল আমার চিকিৎসা। এ একধরনের প্রিভিলিজ যা ছাত্রছাত্রীরা, সহকর্মীরা আমাকে দিয়েছিল তাদের অন্তরের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা থেকে। এ জোর করে পাওয়া নয়।
আমার জীবনের এ এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা, অবলীলায় চলে এলো। ছাত্রছাত্রীদেরকে মন থেকে দিলে, তাদের কাছে বাবার মত থাকলে, সহকর্মীদের ভালবাসা দিলে, তাদের ক্ষতি না করলে, প্রতিদানে যা পাবেন তা কল্পনাও করতে পারবেন না। আমার শিক্ষকতা জীবন সার্থক আমার নিজের কাছে। ছাত্রছাত্রীরা আমাকে যা দিলো তা কেউ দিতে পারবে না। আমার স্বজনরাও পাশে দাঁড়িয়েছেন। পুরো চিকিৎসা প্রদানের সময় যতদিন হাসপাতালে ছিলাম ততদিনই অরূপ ছিল। খবর পেয়ে আমার ছেলে এলো। এলো মেয়ে আর জামাই। ওরা আমাকে দিলো সঙ্গ ও সাহস। তাদের মাধ্যমে ফিরে পেলাম মনোবল। ক্যান্সার ছাড়াও আমার ছিল ক্রনিকরোগ, তাই সবগুলো মোকাবেলার জন্য করা হয়েছিল বড় মেডিকেল বোর্ড। ছিল ডায়েবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও সি.কে.ডি। ক্যান্সার নতুন বিপদ। আরও অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা হলো। করা হলো কলোনোস্কোপি। রক্তের নমুনা পাঠানো হলো ভারতে। মাল্টিপল মায়েলমা প্যানেল দেশে পরীক্ষা হয় না। তবে দেশে করা হলো বোনম্যারো বায়াপসি। সযত্নে করলেন, অধ্যাপক এ বি এম ইউনূস, বিএসএমএমইউ-তে হেমাটোলজির প্রধান। পাওয়া গেল প্লাজমা সেল সংখ্যায় বেশি। শতকরা বেশি, প্লাটিলেট বেশ কম। হাসপাতালে আছি, আমার বোন এসে গেল। সঙ্গে বোন জামাই ও মেয়েরা। ছেলে ও মেয়ে জামাই থাকে প্রায় সময়। রাতে ছেলে বা মেয়ে থাকে আমার স্ত্রীর সাথে। সে কেমন যেন নীরব হয়ে গেছে, কথা বলে কম। মুখে হাসি নাই। ভাবের অভিব্যক্তি নাই। খাচ্ছে না ঠিকমত। পিঠে খুব ব্যথা আমার। উঠতে কষ্ট, বসতে কষ্ট। ব্যথার কষ্ট লুকাতে চেষ্টা করি। মুখে চিহ্ন আসুক চাই না। অন্যরা ভয় পাবে। আমি ভয়কে জয় করব। কে জিতবে জানি না! ক্যান্সার, এ লড়াই আমার লড়াই আমার লড়াই তোমার সাথে। এ লড়াইয়ে জিততে হবে। মেডিকেল বোর্ড বসছে ১৫ দিনে একবার। নতুন সমস্যা সমাধান হয় সেখানে। ক্লান্তি আমাকে আচ্ছন্ন করলেও একে দূর করার চেষ্টা করি। ক্ষিধা নেই। তবু খাই। গিলি বলা যায়। হাসপাতালের খাবার। সেইসাথে বেয়ান, অরূপের স্ত্রী, স্বপ্না, আমার বোন মধুশ্রী এরা টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার পাঠায়। কিডনি একটু বিদ্রোহ করছে। ক্রিয়েটিনিন একটু বাড়ছে। রক্তাল্পতা হচ্ছে। ইরিথ্রোপয়টিন দেয়ার পরামর্শ দেয়া হল। এর মধ্যে স্টেরোয়েড দেয়া হয়েছে।
আমার মাল্টিপল মায়েলোমা। এটি এক ধরনের ব্লাড ক্যান্সার, আগে বলেছি। এই রোগ চিকিৎসাযোগ্য তবে নিরাময়যোগ্য নয়। অধ্যাপক আজাদ খান আবার এসে বললেন। আর তাই যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া জরুরি। কোমর ব্যথা হাত পা ঝিনঝিন অকারণে। সারাক্ষণ ক্লান্তি। মাল্টিপল মায়েলোমা হলো এক ধরনের ব্লাড ক্যান্সার। অস্থি মজ্জাতে বসবাস যে কোষের, “প্লাজমা সেল”-এর ক্যান্সার। স্বাভাবিক অস্থিমজ্জা থাকলে স্বাভাবিক প্লাজমা কোষ তৈরি করে এন্টিবডি যা শরীরকে সংক্রমণ থেকে আগলে রাখে। প্লাজমা কোষ হলো একধরনের শ্বেতকণিকা। মাল্টিপল মায়েলমা হলে, প্লাজমা কোষগুলো হয়ে যেতে থাকে ক্যান্সার সেল। এরা বাড়ে নিয়ন্ত্রণহীন গতিতে। স্বাভাবিক কোষদের সরিয়ে ভিড় করে। সংহারী এই প্লাজমা কোষগুলো তৈরি করে অস্বাভাবিক প্রোটিন, এম প্রোটিন। এর উচ্চ মাত্রা হলো মাল্টিপল মায়েলোমার একটি বড় বৈশিষ্ট্য। তাই রক্তে প্লাজমা কোষ যখন অনিয়মিতভাবে বেড়ে চলে, অনেক সময় এতে শরীরের একাধিক অঙ্গ হয় প্রভাবিত। সেজন্যই মায়েলোমা অসুখটির সাথে মাল্টিপল কথাটি যুক্ত হয়েছে।
রোগটি কীভাবে বা কেন হয়, সে বিষয়ে সঠিক জানা না গেলেও এক্ষেত্রে জিনগত পরিবর্তন বা জিনোটিক মিউটেশন থাকতে পারে। মাল্টিপল মায়েলোমা বয়স্কদের রোগ, ৬৫ ঊর্ধ্বে লোকদের বেশি হয়। মহিলা বা পুরুষ যে কারও হতে পারে। তবে অল্প বয়সে এমন ক্যান্সার বিরল। হেমোগ্লবিন কমেছে। কমছে প্লাটিলেটও। আয়রণ বড়িতে হেমোগ্লবিন বাড়ে না। ব্যথার ওষুধে ব্যথা যাবে না। সহজ পরীক্ষায় কিছু পরিবর্তন দেখা যাবে। সিবিসি, এল এফটি, ক্রিয়েটিনিন, টোটাল প্রোটিন। ক্রিয়েটিনিন বাড়তি, এল এফটি ফলাফল স্বাভাবিক নয়, টোটাল প্রোটিনে গ্লবুলিনের মাত্রা বেশি। চিকিৎসার জন্য হেমাটোঅনকোলজিস্ট। কমপ্রিহেনসিভ মাল্টিপল মায়েলোমা প্যানেল ও প্রয়োজনে বায়োপসি করা দরকার। লক্ষণগুলো বলেছি। কোমরে শিরদাঁড়ার আশেপাশে এমনকি পাঁজরের দিকেও ব্যথা হয়েছিল। অস্থি ভঙ্গেও নিদর্শনও ছিল আমার শরীরে আর রক্তাল্পতা আরেক লক্ষণ আর, সেজন্য আয়রন ট্যাবলেট খাওয়া ঠিক না। কারণ খুঁজতে হবে। ছোট ছোট গহ্বরে হয়েছিল আমার হাড়ে। বড় আঘাত না পেলেও হাড় ভেঙে যেতে পারে। আমি বেশ কিছুদিন খুব সতর্ক হয়ে লাঠি ভর দিয়ে হেঁটেছি। তাও অল্পক্ষণ। ক্রিয়েটিনিন বাড়ছিল। মায়েলোমাতে বেশি প্রভাব পড়ে হাড় ও কিডনির ওপর। ঠিক সময়ে তাই চিকিৎসা করানো খুব জরুরি। রোগ নির্ণয়ের জন্য প্রথমেই কিছু রক্ত পরীক্ষা ও বোনম্যারো টেস্ট করা হয়েছিল। এই পরীক্ষায় যদি প্লাজমা কোষ ১০% বেশি হয় বা টিস্যু বায়োপসি করে প্লাজমা কোষের ক্লাস্টার পাওয়া যায়, তাহলে প্রাথমিকভাবে মাল্টিপল মায়েলোমা ধরে নেয়া যায়।
এরপর নজরদারিতে আসে সিআরএবি বা ক্রাব ক্রাইটেরিয়া। এর যেন কোনও একটি পজিটিভ হলে মাল্টিপল মায়েলোমা শনাক্তের পক্ষে থাকে জোরালো প্রমাণ। ক্রাইটেরিয়ার প্রতিটি শব্দের মানে আছে। সি হলো ক্যালসিয়াম। মাল্টিপল মায়োলেমা রোগীর রক্তে ক্যালসিয়াম মাত্রা বাড়ে, হাইপারক্যালসেমিয়া। আর হলো রেনাল। ক্রিয়েটিনিন থাকতে পারে বেশি। এ হলো অ্যানিমিয়া। রক্তাল্পতা। বি হলো বোন বা হাড়ের রোগ। হাড়ে ছিদ্র হওয়ার ফলে হাড়গুলো ক্ষয় হয়, হয়ে পড়ে দুর্বল। সামান্য চাপেও তা হয় ভঙ্গুর। বহুদিন আমার তেমন অবস্থা ছিল। এখন কিছুটা ভালো। সাধারণ টেস্টগুলোও চলেছে। লিভার ফাংশন টেস্ট করতে গিয়ে টোটাল প্রোটিন এবং এলবুমিন গ্লবুলন অনুপাত দেখা যায়। এলবুমিন গ্লবিলনের অনুপাত বাড়ে। উল্টো হয়ে যায়, এলবুমিন কম গ্লুবিলন বেশি। এছাড়া করা হয় ইমুনোফিকসেশন ইলেকট্রোফোরেসিস, প্রোটিন ইলেকট্রোফোরেসিস, সিরাম ফ্রি লাইট চেইন অনুপাত। এসব হলো নির্দিষ্ট পরীক্ষা। কাপ্পা ল্যাম্বডা অনুপাত দেখা খুব গুরুত্বপূর্ণ রোগের পর্যায় এবং ঝুঁকিও নিরূপণ করা প্রয়োজন হয়। চিকিৎসা হয় ক্ষেত্রে বিশেষ, পর্যায়ে ভেদে, নানা বিবেচনায়। আমাকে দেওয়া হয় বটোজোমিব বা ভ্যালকেড ইনজেকশন। এটি প্রটিওজোন ইনহিবিটার ড্রাগ।
এটি লম্বা নির্দিষ্ট চিকিৎসা, টার্গেটেড ট্রিটমেন্ট। সঙ্গে লেনালিডামাইড, এটিও কেমোথেরাপির অংশ। এটি ক্যান্সার কোষের বাড়ন রোধ করে বা ধীর করে। সঙ্গে স্টেরোয়েড ডেক্সামেথাসোন চলে কিছুদিন। ক্যালসিয়াম দমাতে দেয়া হয় জোমেটা ইনজেকশন। জোলেড্রোনিক এসিড। নিতে হয় ইমেটিব ইনজেকশন রক্তাল্পতার জন্য। এই ঔষধটি অস্থি মজ্জাকে উদ্দীপিত করে লোহিত কণিকা উৎপাদনের জন্যে।
নিরাময় না হলেও এক বছর ঘুরে আসার মধ্যেই ক্যান্সারটি উপশমে গেছে। এক বছর আগে ভবিষৎ ছিল অনিশ্চিত। তখন ইমুনোমডুলেটর ওষুধ নিয়েছি। এরপর আমার প্রধান চিকিৎসক হেমাটোঅনকোলজিস্ট অধ্যাপক মনজুর মোর্শেদের পরামর্শ মতো মেইনটেনেন্স ড্রাগ নিতে হলো, ক্যান্সারকে সে অবস্থায় রাখার জন্য।
এর মধ্যে ২০২২ সালে কানাডায় গিয়েছিলাম। মেয়ে, জামাই ও নাতনিদের দেখতে। সেখানে এক সময় কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট (সিবিসি) করে দেখলাম, আমার রক্ত কণিকা ও প্লাটিলেট বেশ কমে গেছে। কানাডাতে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখানো সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। প্রথমেই জিপি। এরপর তিনি রেফার করবেন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে। তার অ্যাপয়েমেন্ট পাওয়ার জন্য অপেক্ষা। অপেক্ষার কাল তিন থেকে ছয় মাস। আমার অত অপেক্ষার সময় নেই। দ্রুত চাই সিদ্ধান্ত কী করব?
আমি তখন কানাডা থেকে অধ্যাপক মনজুর মোর্শেদের সঙ্গে ভিডিওকলে পরামর্শ নিলাম। তিনি লিনামাইড ওষুধ বন্ধ করে আবার এক সপ্তাহ পর সিবিসি দেখতে বললেন। আশ্বর্য হলাম, ওষুধ বন্ধ করার পর আমার রক্তকণিকাগুলো স্বাভাবিক হয়েছে হিমোগ্লবিনও বেড়েছে। মানে হচ্ছে আমার আর ক্যান্সারের ঔষধও লাগছে না। এখনও ক্যান্সারের ওষুধ ছাড়াই উপশমে আছি।
প্রতি তিনমাসে একবার ফলোআপ করি। ভারতের ল্যাবে আমার রক্তের নমুনা পাঠিয়ে করাই মাল্টিপল মায়েলোমা প্যানেল। এদেশে পুরো মাল্টিপল মায়োলমা প্যানেল হয় না। এখনও সব ভালোই আছে।
রক্তের সর্ম্পক নেই তবু কেউ হতে পারে পরম আত্মীয়, পরম স্বজন। আমার জীবনে সে এসেছিল এক সহায়ক শক্তি হয়ে, প্রায় সর্বক্ষণের বিপদসঙ্গী হয়ে— সে আমার ল্যাবের সহকারী জাবেদ হোসেন। সে আমার জন্য যা করেছে তা আমি ভুলতে পারি না, তার ঋণ আমি কোনোদিন শোধ করতে পারব না। কিছুর বিনিময়ে নয়, কেবলই ভালোবেসে মানুষের বিপদে কত উপকার করতে পারে সে এর উদহারণ। প্রার্থনা করি তার জন্য। এমন আরও অনেক সহকর্মী আমাকে ঋণে আবদ্ধ করেছে। বারডেমের কর্তৃপক্ষের কাছেও ঋণী হাসপাতাল ও পরীক্ষা-নিরীক্ষণ যারা আমার জন্য লঘু ও সাশ্রয়ী করেছেন, বিশেষ বিবেচনায়। আমার অবদানের এর চেয়ে বড় স্বীকৃতি আর কি হতে পারে!
আমার দেশের ও বিদেশের চিকিৎসার বিশেষজ্ঞ যারা অনেকেই ছাত্রছাত্রীদের, এদের এমন ঐকান্তিক সেবা ও আমার জন্য এত দরদভরা সাহায্য, পাশে থেকে সাহস দেয়া, কি করে যাবো ভুলে? তাই বিপদসংকুল পথে কন্টকগুলো ফুল হয়ে ফুটেছে। এ এক আশ্চর্য অনুভব! বলে বোঝানো যাবে না। একসময় ক্যান্সারের উপশম হলো। রিপোর্টে তাই বলল। সেদিন বাসায় পলান্ন, ডিমের রসা ও মোরগের রোস্ট রাঁধা হলো। পলান্নে যে কিসমিসগুলো ছিল সেগুলো বেছে বেছে স্ত্রীর পাতে দিলাম জানি তিনি কিসমিস ভালোবাসেন। তিনি স্মিত হেসে গ্রহণ করলেন। তার গম্ভীর মুখে একচিলতে হাসি।
পুনশ্চ: হাসপাতালে যখন ছিলাম কেবল ভিজিটিং আওয়ার্স কেন প্রায় সবসময় লোকজন আসছে আমাকে দেখতে। পরিচিত অনেকেই। স্বজনরা তো আছেনই। কতজন যে আমার এ বিপদের সময় আমাকে উৎসাহ জুগিয়ে পাশে থেকে, কাঁধ ছুয়ে, স্মিত হেসে, আমার আত্মীয় হয়ে গেলেন তা আমার জানার বাকি ছিল। জীবনটা পুরোটা হলো শেখার। অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের বছরগুলোর সমষ্টি মানেই জীবন। এখানকার যারা নার্স তারা খুব দরদ আর মমতা দিয়ে সেবা করছেন। প্রায় সবাই পরিচিত। ল্যাব ডিরেক্টর থাকা অবস্থায় পরিচয় হয়েছে আর নিশ্চয়ই আমাকে তাদের মন্দ লাগেনি, আমার জন্য বাড়তি সর্তকতা ছিল। তাদের মধ্যে, যেন আমি তাদের স্বজন। ল্যাবের সব কর্মীরা একবার আসছেন, যাচ্ছেন, তাদের চোখে যেন আমার জন্য আশা জাগানিয়া দীপ্তি, অন্তরে তাদের প্রার্থনা, আমি যেন ভালো হয়ে যাই। এসব দৃশ্য আর মানুষের আনাগোনা আমাকে ক্যান্সারের ভয় থেকে বিরত রাখার জন্য যথেষ্ট ছিল। বোনের, ভাইয়ের বিষণ্ন চেহারা দেখে উদ্বেগ জাগে মনে। তবু নিজেকে স্বাভাবিক রাখি।
বোনজামাই ও বোন মেয়েদের নিয়ে এসেছিল আইসিইউ থেকে কেবিনে চলে আসার পরদিনই। “ভাল হয়ে যাবে, ভেবো না”, এমন উৎসাহ বাক্য আমাকে ইতিবাচক ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে; ভালো হয়ে যাব নিশ্চয়ই। আমার ছেলে এসেছে সুদূর জার্মানি থেকে, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্স মাত্র শেষ হয়েছে। এখানে এসে সবসময় হৈ-হুল্লোড় করত বন্ধুদের নিয়ে, অনেক রাতে ফিরত বাসায়। সে আমার অবস্থা দেখে সব ছেড়েছুড়ে দিয়েছে। একা ঠায় বসে আছে আমার পাশের শয্যায়, মনে তার ভাবনা উড়েছে ডানা মেলে, তার মুখ দেখে বুঝতে পারি। আমার জন্য উদ্বেগ উৎকণ্ঠা চেপে রেখেছে, বুঝতে পারি। অরূপ যতসময় কাজ থাকে না, থাকে আমার পাশে। চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় করে নজরদারি। তারও স্ত্রীও আসে প্রায়ই সঙ্গে খাবার নিয়ে। মেয়ে আর মেয়ে জামাই তারা পাশে। উৎসাহ দেয়, আমরা আছি, ভাবো কেন? আমার স্ত্রী নীরব, চেহারায় কোনো ছায়া পড়ে না ভেতরে উত্থাল পাথাল করা ভাবনা ও দুশ্চিন্তায় ঢেউয়ের। আমি যখন সেরে উঠেছি প্রায়, তখন তার চেহারায় খুশির দীপ্তি, একদিন জিজ্ঞেস করি এমন কি চিন্তা ছিল সেদিনগুলোতে? আমি একেবারে চলে গেলে, কী হবে, তাই?’
“না তো”
তাহলে?
“আমি ভেবেছি, ক্যান্সার চিকিৎসার কত খরচ, কী করে সে খরচ মেটাব যদি বাড়াবাড়ি কিছু হয়। বাঁচাবো কী করে?” কিন্তু অর্থ নানাভাবে এসে যায় বিপদের সময়, সংকটের সময়। ঈশ্বর ব্যবস্থা করে দেন। আর অসুখকে তা এমন সীমার মধ্যে রেখে দেন হয়তো বা খুব বেশি বাড়তি না হয়ে যেন তা সাধ্যের বাইরে না চলে যায়। আমি অনেক সময় ভাবি, অলৌকিক অনেক কিছু ঘটে জগতে এর ব্যাখ্যা হয় না। আর বিপদেই তেমন কিছু লীলা আমরা দেখি পরম পিতার। আমি ঈশ্বরের কাছে এক গভীর রাতে প্রার্থনা করি, কেউ জানে না। আমার স্ত্রী ঘুমিয়েছিল কি না জানি না। মনে দ্বিধা ছিল খুব বেঁচে থাকব না মরে যাব? চলে যেতে মন চায় না। আরও কিছু দেবার বাকি। ঈশ্বরের কাছে একান্তে নিজেকে সমর্পণ করলাম। আমি কিন্তু কিছু চাইনি, মনে মনে বলি: যা মনে করেন ভালো, তাই করুন ঈশ্বর।
আমি এখন উপশমে আছি। যখন শুনলাম আমি, তা আমার মধ্যে এলো আত্মহারা আনন্দ। আমার ছাত্রছাত্রীদের কথা মনে হলো তারা যেভাবে আমাকে সাহায্য করছে আমার কাছে তা অভাবিত ছিল এতো কী করে করল, বিশ্বাস হয় না। তোমরা এত করছো আমার জন্যে! ওরা বলে, স্যার এ গুরু দক্ষিণা। কিন্তু ঋণী করেছে তারা আমাকে, আমাকে ঋণী করেছে আমার সহকর্মীরা, বেঁচে থাকার জন্য অর্থ খুজে পেলাম। যে জন্য কি হার মেনেছিল ক্যান্সার মানুষের ভালবাসার কাছে? মারণরোগের কবল থেকে বেরিয়ে এলাম চারদিক থেকে প্রিয়জনের সাহায্য, আমার জন্য তাদের প্রার্থনা আমাকে বাঁচার শক্তি দিলো। আমাকে হারতে দিলো না। আরও কাজ করার তাগিদ এনে দিলো। যে কাজে ছিলাম, সে কাজে আর থাকা হলো না। বেশ শ্রমসাধ্য, তাই আমার জন্য উপযুক্ত থাকল না। শরীর সবল নয়, মনের জোরে চলি। কিন্তু কি করি? আমি যা পারি তাই করি। লেখালেখি চলছিল তাই করতে থাকি। লিখি আরও কয়েকটি বই। ক্যান্সার গ্রুপ ও সামাজিক অনেক গ্রুপের সঙ্গে কাজ করি। ক্যান্সার নিয়ে আমার লেখা বই বেরুল। কাজে ব্যস্ত থাকি তা না হলে মনের জোর ও মগজের জোর পাবো না। ক্যান্সার আমাকে যেন বেঁধে না রাখে। ক্যান্সার থেকে সেরে উঠে জীবনকে দুচোখ মেলে গভীরভাবে দেখতে চেষ্টা করেছি, স্বাস্থ্যের প্রতি অবশ্য আমি যতটা দিতে পারি এরচেয়ে বেশি নজরদারি আমার স্ত্রীর। তবে অল্পতেই খুশি হতে শিখেছি। মানুষ উপকার করলে কৃতজ্ঞ হতে শিখেছি। ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞতা আরও বেশি করে প্রকাশ করি মনে মনে। ক্যান্সার তার ছোবল যাদের উপর দিয়েছে কিছু না কিছু ছাপ রেখে গেছে।
“নিজের জীবনে নিজের শর্তেই বাঁচুন। সমাজ কী বললো তাতে কী?” ভয় না পেয়ে চলুন ক্যান্সারের মোকাবেলা করি। সঠিক সময়ে নির্ণয়, সঠিক চিকিৎসা আর সচেতনতার মাধ্যেমে ক্যান্সার মৃত্যুর হার অনেকটা কমানো সম্ভব। ভয় নয়, প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সারও নিরাময় হয়। চাই সচেতনতা ও নিয়মিত স্ক্রিনিং প্রয়োজন। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম বাংলাদেশে চিকিৎসা করার। সঠিক ছিল যে সিদ্ধান্ত। আমার ছাত্রদের হাতে নিজেকে ছেড়ে দিয়েছিলাম। তারা যথাসাধ্য করেছে, দিয়েছে সবটুকু আমাকে বাঁচাবার জন্য, সবদিক দিয়ে। অনেকে বলেছে বিদেশে নিয়ে যান, নইলে বাঁচবে না। আমার ছেলেদের ওপর ভরসা ছিল। তারাও যা পারে তা করেছে আমি সেরে উঠেছি।
এ ক্যান্সার তো নিরাময় হয় না, আমি বেঁচে আছি প্রায় ৪ বছরের ওপর হল। মন সতেজ আছে। শরীর একটু দুর্বল হয়েছে। হবেই তো এত বড় ধকল গেল। আর একটি কথা, আমার উপায়ও ছিল না। দীর্ঘ চিকিৎসার খরচ টানা, তাও বিদেশে, সে সামর্থ্য ছিল না। এভাবে লড়াইতে নেমেছিলাম মহাকালের সাথে।
ঈশ্বর সীমারেখা টেনে দেন। পরিণতি কি হবে ভাবিনি। সবাই যখন খুব দুশ্চিন্তায় আমি তখন ছিলাম বেশ শান্ত। জানি না তখন আমার অনুভূতি ভোঁতা হয়ে ছিল কিনা। একটা কথা আছে, “কান্সার একটি মারণ রোগ” এমন বিজ্ঞাপন অনুচিত আমার কাছে মনে হয়। আর পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ হাসপাতালে গেলেই যে ক্যান্সার থেকে মুক্তি পাবেই, তা নয়। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ক্যান্সার সেন্টার আমেরিকার মেমোরি স্লোয়ান ক্যাটারিং ক্যান্সার সেন্টারে চিকিৎসা নিয়েও প্রখ্যাত সাহিত্যিক জননন্দিত হুমায়ূন আহমেদও বাঁচতে পারেননি।
ক্যান্সার হলেই মৃত্যু হবে, কে বলল? আগেভাগে চিহ্নিত হলে, সময়মত চিকিৎসা হলে ক্যান্সারকে বেশ উপশমে রাখা যায়, এ থেকে বেঁচে ওঠা যায়, বেঁচে থাকা যায় বেশ কিছুদিন। আর মৃত্যু হতে পারে যেকোনো কারণে। আগে আর পরে। নির্ধারিত সময়ে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে তাৎক্ষণিক, প্রায় সময়। তবে ক্যান্সার হলে জানায়, আমার সময় সীমিত। জীবনের যা কিছু করার প্ল্যান করে নিন। মানতে পারবেন এ সত্যটি? তাহলে ক্যান্সারকে জয় করেই ফেলবেন প্রায়। আর একটি কথা আমাদের অনেকের মধ্যে ক্যান্সার লুকানোর একটি প্রবণতা আছে। নারীদের মধ্যে এ প্রবণতা বেশি। তারা এমনিতেও কষ্ট চেপে রাখেন উপসর্গ হলেও একে অগ্রাহ্য না করে থাকার প্রবণতা আছে তাদের। যখন অবস্থা শোচনীয়, তখন আসতেই হয় ডাক্তারের কাছে, আর সেজন্য দেরি হয়, মৃত্যু তখন হয়ে পড়ে সম্ভাব্য পরিণতি।
আমাদের দেশে ক্যান্সার হাসপাতাল কম, চিকিৎসার সুবিধাও কম, রোগ নির্ণয় হয় না সব ক্যান্সারের, প্রায় বিদেশে যেতে হয় রোগীদের, এর পরিবর্তন হওয়া চাই। আর গরিব ক্যান্সার রোগী যারা তাদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য চাই সাশ্রয়ী চিকিৎসাও।
ক্যান্সার থেকে সেরে ওঠার পর একটু জীবনকে উপভোগ করুন। ঘুরে আসুন কোথাও। আমি বেড়াতে গিয়েছিলাম কানাডায়, মেয়ে, মেয়ে জামাই ও নাতনির কাছে। ভালোই ছিলাম। মনে আছে আমার কেমো যখন চলে ইমুনোমডুলেটর যখন চলে, তখন শরীরে এর জানান দিয়েছিল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ঘটিয়ে, খুব স্বাভাবিক। ছিল সতর্কবার্তা। ভয়ের কিছু নাই। পরিস্থিতিকে সামলে চলা চাই। ক্যান্সার নির্ণয় হলে অনেকে আত্মগ্লানিতে ভোগেন। অনেকে বিব্রত হন, ক্যান্সার হওয়াটা কষ্টের বটে, এটি জটিল অসুখও বটে কিন্তু সে জন্য মনকে খারাপ করা কেন আগে থেকেই? মেমোরিয়াল স্লোয়ান কেটারিং সেন্টারের ক্যান্সার সারভাইভার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ক্রিস্টি রেড ফিল্ড বলেন “Humans are meaning making creatures. We want to understand how somethinghappened so we have some control. But cancer can happen to anyone. It is an illness not afailing.” আমার যখন মায়োলেমা হলো তখন আমার উপসর্গ ছিল হাড় ব্যথা ও ক্লান্তি কিন্তু আমি দ্রুত এর কারণ খোঁজার জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করালাম। আমার ক্রনিক কিডনি রোগ ছিল, ডায়েবেটিস ছিল, নিয়ন্ত্রণে রেখেছি। মাথা ঝিম ঝিম মাঝে মাঝে করেছে। রক্তস্বল্পতা হয়েছিল এর চিকিৎসাও হয়েছিল। আমার বুকে ফ্লুইড লোড হবার জন্য শ্বাসকষ্ট হয়েছিল। আমার পিছকোমরে প্রচুর ব্যথার কারণ খুঁজে পেয়েছিলাম। সিটি স্ক্যানে ধরা পড়েছিল ওস্টিওলাইটিক লিজন। হাড়ে ছোট ছোট ভাঙ্গন ধরেছিল। তাই ব্যথা হয়েছিল। ব্যথা শিরদাঁড়ায় কশেরুকা আমার ধসে পড়েছিল। হাড়ে এমন ভাঙ্গন হওয়ার কারণে হয় এমন ব্যথা। ক্লান্তি, অবসন্নতা— আমাকে আছন্ন করেছিল ক্লান্তি, রোগের অগ্রগতির সময়। মায়েলোমা কোষের বাড়ন চলছিল, অনেক মায়েলোমা কোষ জমছিল রক্তে (আমার প্লাজমা কোষ হয়ে গেল ৪০%।) লোহিত কণিকার উৎপাদন কমে, এছাড়া কিডনির উপর পড়ল চাপ (ইতিমধ্যে আমার ছিল সি কে ডি) কিডনি ঠিকমত হরমোন ইরিথ্রোপয়টিন দিতে পারছিল না, এতে লোহিতকণিকা, উৎপাদন এত ছিল না, সেজন্য হলো। পিপাসা হচ্ছিল, বারবার প্রস্রাবও ছিল। হাড়ে ছোট ফ্রাকচার হবার জন্যে হাড় রক্তে ছেড়ে দেয় ক্যালসিয়াম। বেড়ে গেল ক্যালসিয়াম রক্তে। হয় হাইপার ক্যালসেমিয়া। এর জন্য আমার হল ক্ষুধামান্দ্য, ক্লান্তি পেশির দুর্বলতা, হতবিহবল ভাব, কোষ্টবদ্ধতা, পিপাসা, বমি ভাব। আমার রক্তে ক্যালসিয়াম তুঙ্গে উঠতে পারেনি। সবসময় নজরদারি আর চিকিৎসার জন্য তা এসেছিল নিয়ন্ত্রণে। আমার সুবিধা ছিল আমার রোগ চিহ্নিত হয়েছিল আগেভাগে, সঠিক ডায়াগনোসিস হয়েছিল যা অনেকের হয় না। আমার সর্বোত্তম চিকিৎসা হয়েছিল যা অনেকের ভাগ্যে হয় না। আমি মেডিকেল শিক্ষক থাকাতে আমার হয়েছিল এমন সৌভাগ্য। আর একটি বিষয়, মন মাঝে মাঝে খারাপ হলেও আমি পজিটিভ ছিলাম। ক্যান্সার জয়ের জন্য মনের জোর খুব দরকার। ভেঙে পড়িনি। তাই জয়ী হয়েছি।
ক্যান্সারের বিষয়টি অত ভাবনার মধ্যে ছিল না, মনে হয়েছিল নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, প্রিয়জনদের জন্য যারা এত ভালোবাসা দিলো তাদের জন্য বাঁচতে হবে। আমার ক্যান্সারটি হয়ত জেনেটিক কারণ বা অজ্ঞাত কারণ। কিন্তু অধিকাংশ ক্যান্সার হচ্ছে দেশে পরিবেশ দূষণ, ভেজাল খাদ্য, ধূমপান, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্যে। এই বিষয়গুলো দমন না হলে দেশে ক্যান্সার কমবে না। আর সচেতনতা কম, অনেক কুসংস্কারও আছে। আর ক্যান্সার রেজিস্ট্রি, ক্যান্সার স্কিনিং এখনও সন্তুষ্টির মাত্রায় এসে পৌঁছায়নি। ভয় পাবেন না। প্যানিক করবেন না। জয় করতে পারবেন, মনোবল সমুন্নত রুখতে হবে। রোগ নির্ণয় হলেও আতঙ্কিত হবে না। এ এক লড়াই, এ লড়াই যে জিততে হবে। হলে লড়াই করতে হবে দ্বিগুণ মনোবল নিয়ে, নিজের জন্য ও পরিবারের জন্য। চিকিৎসা শেষে দেখবেন অনেকেই হাসিমুখে জীবন শুরু করতে পেরেছেন। চিকিৎসা শয্যায় শুয়ে, “আমি মরতে চাইনা”— এই আবৃত্তি আর মনোবল নিয়ে অনেক বিখ্যাত লোক জয়ী হয়েছেন। আর দরকার সমমর্মিতা। বিপদ-আপদে পড়া একজনের জন্য সাহায্য করা এর চেয়ে বড় আর কি হতে পারে? এমন দুর্ভোগের সময় একজনের জন্য অন্যের অনুভব করা। তার দুঃখ নিজের বলে মানা— এই অনুভব পাওয়া গেলে মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকা হয় সম্ভব।
ক্যান্সার চিকিৎসারকালে সময় যত কঠিন হোক রাখতে হবে মনোবল। প্রখ্যাত সাহিত্যিক হূমায়ূন আহমেদ আমেরিকায় তার ক্যান্সার নিয়েও লিখেছেন, ঘুরে কাটিয়েছেন, আর শেষ তিনটিই ইচ্ছের কথা বলেছেন মৃত্যুর আগে: প্রথমটি হলো, এস্টোরিয়াতে একটি সিফুড রেস্তোরায় সবাইকে নিয়ে লাঞ্চ করবেন। দ্বিতীয় হলো, পিআর ১৭ হলে একটি ওপেন ফুডকোর্টে বাচ্চাদের নিয়ে যাবেন। আর তৃতীয় হলো, স্ত্রীকে নিয়ে যাবেন ক্যান্ডেল লাইট ডিনারে, সেখানে থাকবেন কেবল তিনি আর শাওন।
আমরা সবাই মরব কিন্তু মৃত্যু যেন হয়ে ওঠে লাবণ্যময় এবং হয় মর্যাদার। আমার অসুস্থতার প্রিজমের মধ্য দিয়ে, ত্রিপার্শ্ব ওই কাঁচের মধ্য দিয়ে কিছুটা দেখতে পেলাম দেশে ক্যান্সার সেবার হাল। ক্যান্সার সেবার অনুষঙ্গ কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা থাকলেও অসম্পূর্ণতা রয়েই গেছে। ল্যাব সাপোর্ট দুর্বল। আমার মাল্টিপল মায়েলোমা প্যানেল করাতে হয়েছে ভারতে। এদেশে কেন করা যাবে না জিজ্ঞাসা করায় ল্যাবরেটরি কর্তৃপক্ষ বলেন, স্যার যেহেতু আমাদেরকে রোগী রেফার করেন না অনকোলজিস্টরা সেজন্য আমরা শুরু করা কঠিন কারণ দু-একটি করে খরচ পোষায় না। তবে চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে তা শুরু হওয়া উচিত। সরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অনকোলজি ল্যাব আরও সমৃদ্ধ হওয়া উচিত।
আমি মেডিকেল শিক্ষক হওয়াতে কিছু সুবিধা পেয়েছি, দেশ ও বিদেশের অনকোলজিস্টদের সমন্বয়ে আমার চিকিৎসা দেশে বসে হয়েছে। আমার ছাত্রছাত্রীরা এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। আমি মনে করি অনকোলজি দেশে আরও বিকশিত হওয়ার প্রয়োজন। দেশে খুব কম দক্ষ অনকোলজিস্ট, নাই তেমন সমৃদ্ধ অনকোলজি ল্যাব। আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি তাই।
অনেক মানুষ যারা ক্যান্সারে ভুগছেন তাদের জন্য সাশ্রয়ী ক্যান্সার সেবা এখন সুদূরের ধন। চিকিৎসার জন্য এখনো পকেট থেকে অনেক খরচ করতে হয় সাধারণ মানুষকে, নিঃস্ব হতে হয়, দারিদ্র্য আরও বন্য, আরও গভীর হয়। আমার এ গল্পে সবসময় হাসিমুখের চেহারা দেখাতে পারব না, হারিয়েছি, পেয়েছি, ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়েছে, পেয়েছি ভালোবাসা অনেকের। আমি মনে মনে শক্তিশালী ও সাহসী হবার চেষ্টা করেছি আর ঈশ্বরের কাছে পূর্ণ সমর্পিত হয়েছি।
সে সময়ে সত্যকে প্রত্যক্ষ করে দেখেছি এর মুখ “The best thing about the worst time in your life, is that you get to see the true colors of everyone everyone loves you when you are a winner.” রাত্রির নিবিড় অন্ধকারে ঈশ্বর আসেন প্রেরণা হয়ে গভীর দুঃখের সময়,
“মৃত্যু যে ধরে মৃত্যুর রূপ
দুঃখ হয় হে দুঃখের কূপ
তোমা হতে যবে হই যে বিমুখ
আপনারে পানে চাই।
তোমার অসীমে প্রাণ মনে লয়ে
যতদূরে আমি ধাই।”
গভীর দুঃখে, গভীর বিপদে রবীন্দ্রনাথ আমার সঙ্গী সবসময়ে দুঃখ বিপদ ভোলানোর কবি।
“অন্ধকারে অন্তরেতে অশ্রুবারি ঝরে
কোথাও কোথাও আলো
আকাশ ভরা কালোয় কালো।”
দেশে সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও আমি দেশে চিকিৎসা নেবার পক্ষপাতি আর আমরা সবাই বিশেষ করে সমাজের যারা উঁচুতে তারা দেশেই চিকিৎসা নিলে এর উন্নতি হবে, ঘাটতিগুলো চোখে পড়বে আর তখন কর্তাব্যক্তিরা নিজেরা উদ্যোগী হয়ে এসব অপূর্ণতা পূর্ণ করবেন রবাট ফ্রস্টের একটি কবিতা স্মরণীয় এক্ষেত্রে,
`The road not taken’ -এর কটি লাইন
“I shall be telling this with a sigh
Somewhere ages and ages hence:
Two roads diverged in a wood,
and I took the one less traveled by,
And that has made all the difference.”
আমাদের দেশের উচ্চবিত্তরা বা প্রভাবশালীরা যদি দেশের চিকিৎসা নেন চিকিৎসা নিতে বিদেশের পথে যদি তারা কম হাঁটেন, তাহলে এক বিরাট পরিবর্তন আসবে দেশের চিকিৎসা সেবায়। আমার বিপদে অনেকে আমাকে সাহায্য করে আমাকে ঋণী করেছেন। সবার নাম করলাম না।
বিশেষ করে ছাত্রছাত্রী ও সহকর্মীরা। আমি একে বুকে ধরে রাখি আর সবাই যারা এমন উপকার পেয়েছেন বিপদে মনে রাখবেন তাদেরকে। ক্যান্সার নিয়ে কত কিছু করার আছে, কেবল সরকারকেই কেন? নিজেরা যারা ক্যান্সার সার্ভাইবার তারা তৈরি করতে পারি ক্যান্সার সাপোর্ট গ্রুপ অ্যালায়েন্স। দারুন হবে। নিজের অভিজ্ঞতা বিনিময় আর ক্যান্সারের জন্য আরও দেশে যা করা দরকার তা কর্তৃপক্ষকে জানানো আর ক্যান্সার সচেতনতা সৃষ্টি করা। ক্যান্সার মারণরোগ নয় তা জানানো। আর আগেভাগে চিহ্নিত হলে চটজলদি চিকিৎসা নিলে পরিণতি হয় অনেক ভালো, আর করতে হবে ক্যান্সার স্ক্রিনিং নিতে হবে এইচপিভিও হেপাটাইটিস বি টিকা। এমনভাবে সচেতন করতে হবে সবাইকে।
আর দূর করতে হবে ক্যান্সার নিয়ে কুসংস্কার ও ভীতি।
পুনরায় ফিরে আসি আগের কথায়। মাসাধিক কাল কেটেছে হাসপাতালের কেবিনে। দিন থেকে দুঃসহ ছিল রাতগুলো আর সে রাতগুলোতে একমাত্র সঙ্গী আমার স্ত্রী। সকালে পুজোআর্চা করে আসে হাসপাতালে এরপর থাকে আমার সঙ্গে। সারাক্ষণ। রাতেও ঘুমায় পাশের শয্যায়। কিন্তু খুব ঘুমায় না। আমি বুঝি। আমি উঠতে পারি না তখনও শয্যা থেকে জানালা দিয়ে দেখি রাতের আকাশ। হাসপাতালে সুনশান
“ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে
আমি হয়ে গেছি তারা,
এই জীবনে ছিল নদীর মত...”
প্রায় ৪০ বছর একসঙ্গে কাটল জীবন। ভাবি কত হাসি কত আনন্দ। কত বড় হয়ে গেল সন্তানেরা। আমাদের আবেগের সম্পর্ক থাকবে তো অথবা অনেকদিন? মনে অনিশ্চিত আগামীর জন্য শঙ্কা। তবু মনে জোর রাখি। আমি বালিশ উঁচু করে শয্যা উঁচু করে শুয়ে আছি। ব্যথায় নড়তে পারি না। তখনও। মায়েলমা ক্ষত করেছে হাড়গুলোতে কশেরুকাতে তাই বেশি সবল হতেও ভয়।
আমার প্রাকৃতিক ডাক এলে আমার স্ত্রী হাসপাতালে দেখা সেই প্যানটি এগিয়ে আমার নিচে দেয় আমার শায়িত দেহের নিচে বাঁকানো গলা সেই বেড প্যান প্রাকৃতিক ক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য। আমরা দুজনেই এক অনিশ্চিত গহিন অরণ্যের পথিক...। আমি কি জীবন স্মৃতি লিখব? কি জানি। নিশ্চয় আমি মাল্টিপল মায়োলোমাতে মরব না। কি জানি। আমার ডাক্তাররা অনেক আশা দিয়েছেন, দেখি।
জীবনের নতুন পর্যায়ে এসে চলেছি। নিজের মুখোমুখি দাঁড়াবার সময় যাচ্ছিল। আমি উষ্ণ, আলোকিত সহায়তা পেয়েছিলাম। ব্যথা বেদনা, পরীক্ষা নিরীক্ষা, চিকিৎসা, যন্ত্রপাতির প্রয়োজন, ড্রাগ প্রটোকল, সব গিয়েছিল আমার ওপর দিয়ে। আর মনে হলো, চিকিৎসার ব্যাপারে রোগীদের থাকা উচিত সক্রিয় ভূমিকা। আর কেয়ারটেকারদের ভূমিকা আর সমন্বিত পরিচর্যা বড় দরকার।
একটা কথা বলি, ক্যান্সারের কাছে অসহায় হওয়া কেন? লড়াইটা শুরু করার আগেই হেরে বসে থাকা কেন? যারা লড়াইটা করে সুস্থ হয়ে উঠেছেন বরং তাদের কথা বেশি বেশি শুনতে হবে। ক্যান্সার নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাদের সাথে জোট বেঁধে নেমে পড়লে হয় ক্যান্সার সচেতনতার কাজ নিয়ে। অন্তত আগেভাগে লক্ষণগুলো বোঝা আর ডাক্তারের কাছে যাওয়া। কান্সার যে অভিশাপ নয় অন্য অসুখের মতো তা বোঝানো। আর তা অনেকটাই প্রতিরোধযোগ্য। মনের জোরকে সঙ্গী করে চলুন। হেরে যাওয়াটা সহজ, লড়াই করাটা কঠিন। লড়াই করার মধ্যে মহত্ব আছে, লড়াকু নাম পাওয়া কম কি?
আরেকটা কথা, অনেক ক্ষেত্রে হয়ত ঠিক সময়ে ধরা পড়ল। চিকিৎসা হলো। কিন্তু সেরে ওঠার পর ফলোআপ হলো না। খুব বিপদের ব্যাপার। এ ব্যাপারেও চাই সচেতনতা। আমাদের লাইফস্টাইল বদলানো বা শোধরানো খুব প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞ মতে তিনটি হলো খাদ্যাভ্যাস, নেশা ও যৌন অভ্যাস এই তিনটিতে রাশ টানলে প্রতিরোধ হয় সহজ। ক্যান্সার জয়ী যারা তারা যাদের ক্যান্সার তাদেরকে বার্তা দেবেন, “হাল ছেড়ো না বন্ধু”। রোগ চিহ্নিত করার কাজ করতে পারেন অনেক স্বেচ্ছাসেবীরা প্রত্যন্ত গ্রামেও অনেকেই মৃত্যুর মুখে বসে যে যন্ত্রণা এবং উপশমের জন্য কাজ করতে হয় একে বলে প্যালিয়েটিভ কেয়ার। ক্যান্সারের প্রাথমিক উপসর্গগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। গলা ব্যথা হচ্ছে গিলতে পারছে না, শরীরের কোথাও মাংস পিণ্ড, পিছ কোমরে ব্যথা ক্ষুধা কমছে, ওজন কমছে অকারণে, অবিরাম কাশি এসব হলে বাড়তি গুরুত্ব দিতে হবে।
ভাবছিলাম ক্যান্সার কি এখনও অপরাজেয়? এদের চেপে রাখা যাচ্ছে, রোগী বেশ কিছুদিন ভালো থাকছেন, প্রথম স্টেজে ধরা পড়লে পরিণতি খুব ভালো। অথচ বেশিভাগ লোক মনে করেন ক্যান্সার মানে মৃত্যু। Of all Maladies, A Biography of Cancer, লিখেছেন নামকরা ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ সিদ্ধার্থ মুখার্জী।
ব্লাড ক্যান্সারের কোষগুলো কেমন লাগে? অণুবীক্ষণের যন্ত্রের নিচে কত কদর্য, ফুলে ফেঁপে ঢোল হয়ে ওঠে সে কোষগুলোর দিকে নজর দিলে কেমন দেখতে তার নিজের ভাষায় “Normal cells are identically normal; malignant cells become unhappily malignant in unique ways”
ক্যান্সার আধুনিক যুগের অসুখ বলে জানা কিন্তু প্রাচীন যুগেও ছিল এযুগে বাড় বাড়ন্ত তাই এত জানি এ সম্বন্ধে। ক্যান্সারে মৃত্যু এত হতো না আগে, কেন? মানুষ অতদিন বাঁচত না। স্তন ক্যান্সারের গড় বয়েস হলো ৬১ বছর আর ছেলেদের প্রোটেস্ট ক্যান্সার গড় ৬৭। অথচ বিশ শতকের প্রথম দিকে আমেরিকাতে গড় আয়ু ছিল ৪৭। বলছিলেন খ্যাতনামা ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ সিদ্ধার্থ মুখার্জী। রোগীর মানসিক টানাপোড়েনের কত কাহিনী। তাদের মনস্তত্ত্ব। সিগারেটের সঙ্গে ক্যান্সারের সম্পর্ক নিবিড়, জেনেও ছাড়েন না অনেকে। তাই এ হলো নেশা। বদনেশা। সিদ্ধার্থ মুখার্জি তার বইটি এভাবে শেষ করেছেন,
“The story of cancer is not the story of doctor who struggle and survive, It is the story of the patient who struggle and surviveÓ The emperor of all maladies: লেখক সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায় Fourth Edition, নভেম্বর ২০১০।
মনের জোরে ধরাশায়ী করুন ক্যান্সারকে। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের কথায়, আসলে পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটাই একটি জার্নি যেটা কেউ বোঝে, কেউ বোঝে না, একজন সৃষ্টিশীল মানুষের বিশেষত্ব হলো এই জার্নিটা তুলে ধরা।” এখন দিন কাটাই। দুজন। আমরা দুজনা। যুগলেশু। The Duo. ভালো আছি এখনও। এরপর বলি “থাকবে বাকি অনেক কিছুই সবই তো বলা হয় না।
নিজের ব্যথা নিজেরই হয়। অন্য কেউ তো সয় না।” একজন ক্যান্সার জয়ী ব্যক্তি হতে পারেন আরেকজন ক্যান্সার রোগীর অনুপ্রেরণা।
লেখক: চিকিৎসা বিজ্ঞানী, অধ্যাপক ও গবেষক
(সেন্টার ফর ক্যান্সার কেয়ার ফাউন্ডেশনের ‘এখানে থেমো না’ বইয়ে লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে)