আওয়ামী লীগ ও বিএনপি— এই দ্বিদলীয় বৃত্তে আটকে থাকা রাজনীতির চক্র থেকে মুক্তির জন্য বাংলাদেশের মানুষ একটি নতুন দলের প্রত্যাশা করছে। তবে এই নতুন দলকে হতে হবে জনকল্যাণে নিবেদিত, যেখানে গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকবে।
Published : 01 Mar 2025, 08:19 PM
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে আত্মপ্রকাশ ঘটেছে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের— জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি। এই দলের জন্ম নিয়ে দেশজুড়ে নানা আলোচনা, সমালোচনা, প্রত্যাশা এবং আবেগের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। নতুন এই দলটি যাত্রা শুরু করছে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহ্য ও সংগ্রামের চেতনা নিয়ে।
তারুণ্যের শক্তিতে উদ্দীপ্ত গণ আন্দোলনের মূল নেতাদের সামনের সারিতে রেখে এনসিপি নামের এই রাজনৈতিক দল আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিজয়ী হওয়াকেই লক্ষ্য হিসেবে নিয়েছে। নতুন এই রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে শীর্ষ পদের নেতাদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। দলের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন নাহিদ ইসলাম। যিনি গেল সপ্তাহে এই দলের হাল ধরার জন্য সরকারের উপদেষ্টা পদ ছেড়েছেন।
২৮ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে দলটির আত্মপ্রকাশের পর যে বিষয়টি সামনে চলে এসেছে, তা হলো তাদের মূল নেতৃত্বে জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নগণ্য উপস্থিতি। নতুন দলটি ইনক্লুসিভ বাংলাদেশ গড়ার ও বৈষম্যের অবসান ঘটানোর কথা বললেও ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উল্লেখযোগ্য প্রতিনিধিত্ব না থাকাটা দৃষ্টিকটু ঠেকছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ সংখ্যালঘু– যার মধ্যে ৭.৫ শতাংশ হিন্দু সম্প্রদায়ের।
কয়েকদিন আগে অন্তর্বর্তী সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেছিলেন, বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ নাগরিক মুসলিম হওয়ায় সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটির প্রয়োজন নেই। এই বক্তব্যের আলোকে সংবিধান সংস্কার কমিশন একটি নতুন খসড়া প্রস্তুত করেছে, যাতে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা' শব্দটি বাদ দেওয়া হয়েছে। এই নতুন খসড়া প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এনসিপিও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাদ দেবে বলেই মনে হচ্ছে। এটা ইনক্লুসিভ বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হতে পারে।
শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পরে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, “ছাত্ররা বলেছে, আমরা ‘রিসেট বাটন’ পুশ করেছি; এভ্রিথিং ইজ গন; অতীত নিশ্চিতভাবে চলে গেছে। এখন নতুন ভঙ্গিতে আমরা গড়ে তুলব। দেশের মানুষও তা চায়। সেই নতুন ভঙ্গিতে গড়ে তোলার জন্য আমাদের সংস্কার করতে হবে।” তার সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন জুলাই আন্দোলনের অন্যতম নেতা নাহিদ ইসলাম। সরকার থেকে সদ্য পদত্যাগ করা এনসিপি প্রধান নাহিদ ইসলামের ভাষ্য, তাদের দলের প্রধান লক্ষ্য ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ বা দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা। তিনি দাবি করেন যে বিভাজনের রাজনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষকে দুর্বল করে রাখা হয়েছিল, কিন্তু গত বছরের জুলাই অভ্যুত্থানে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে সেই রাজনীতি ভেঙে দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশকে আর কখনই বিভাজিত করা যাবে না। নতুন দলটির আরেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা হাসনাত আবদুল্লাহও একইভাবে বিভাজনের রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে একতার রাজনীতি চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সারজিস আলমের বক্তব্যও নাহিদ ও হাসনাতের মতোই। তারা বলছেন, তাদের নতুন দল গঠনের মূল উদ্দেশ্য হলো ভারতপন্থী ও পাকিস্তানপন্থী রাজনীতির পরিবর্তে বাংলাদেশকেন্দ্রিক রাজনীতি গড়ে তোলা।
নাহিদ ইসলাম বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের সময়ে ‘তুমি কে আমি কে, বিকল্প বিকল্প’ স্লোগানের ভিত্তিতেই এই নতুন দল গঠন করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, “এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে আমরা কেবল সামনের কথা বলতে চাই। পেছনের ইতিহাস অতিক্রম করে সম্ভাবনার বাংলাদেশের স্বপ্নের কথা বলতে চাই।”
নতুন দলের নেতাদের মতে, তাদের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষ্য হলো নতুন বাংলাদেশে দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা। এই ‘সেকেন্ড রিপাবলিকে’ জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষায় শক্তিশালী প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা, ভেঙে পড়া রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠন করা এবং গণতান্ত্রিক চরিত্র রক্ষা করা হবে তাদের রাজনীতির অগ্রাধিকার।
নতুন দলের নেতারা দাবি করেন যে বাংলাদেশে আর শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী রাজনীতিকে ফিরতে দেওয়া হবে না। তাদের মতে, সাধারণ মানুষই হবে ক্ষমতার সর্বময় উৎস। সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক এবং মৌলিক অধিকারের শক্তিশালী সুরক্ষাই হবে তাদের রাজনীতির মূলমন্ত্র।
তবে যে কোনো নতুন রাজনৈতিক দলের মতো এই দলটিও প্রতিষ্ঠালগ্নে সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর কেন্টিনের সামনে দলের ছাত্র সমর্থকদের মধ্যে দফায় দফায় মারামারির ঘটনা ঘটে। এতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুজন সমন্বয়কসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। শুধু তাই নয়, সপ্তাহদুয়েক আগে খুলনা ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) নতুন ভর্তি হওয়া ছাত্রদের হাতে ফর্ম দিতে গিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্র শিবিরের কর্মীদের হাতে মার খেতে হয় ছাত্রদলের নেতাদের। তখনই ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি ওঠে। মারামারি ও কাটাকাটির জেরে শেষ পর্যন্ত কুয়েটের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করতে হয়।
এই সব কারণে অনেকে এ প্রশ্নও তুলেছেন যে, এই দলটি কি আদৌ রাজনৈতিক পটপরিবর্তন করতে সক্ষম হবে? নাকি এটি হবে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের আরেকটি খেলার গুটি? এছাড়াও, এই দলের নেতৃত্বে থাকা প্রাক্তন ছাত্রনেতাদের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কতটা গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই দলটির সামনে চ্যালেঞ্জ অনেক বড়। তাদেরকে প্রমাণ করতে হবে যে তারা বর্তমানের সমস্যা ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম।
এদিকে, সুকান্তের সেই অমর কবিতার লাইন ‘এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান’-এর মতো দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও নতুন এই দলকে স্থান দেওয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে। নতুন চিন্তা, নতুন কর্মসূচি ও নতুন নেতৃত্বের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনা এই দলটির মধ্যে রয়েছে। তবে, এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে দলটিকে অবশ্যই জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে এবং তাদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে আন্তরিক হতে হবে।
মনে রাখা দরকার যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস মূলত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এই দুই দলের মধ্যে আবর্তিত হয়েছে। দশকের পর দশক ধরে এই দ্বিদলীয় ব্যবস্থা দেশের রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছে। তবে এই দুই দলের মধ্যে বারবার ক্ষমতার পালাবদল হলেও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আসেনি। দলে গণতন্ত্রহীনতা, পেশীশক্তির ব্যবহার, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় যাওয়া ও ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা, পরিবারতন্ত্র, দুর্নীতি, লুটপাট এবং প্রতিপক্ষ দমন— এসব বিষয়ে দেশের মানুষ ক্রমশ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি— এই দ্বিদলীয় বৃত্তে আটকে থাকা রাজনীতির চক্র থেকে মুক্তির জন্য বাংলাদেশের মানুষ একটি নতুন দলের প্রত্যাশা করছে। এই নতুন দলকে হতে হবে জনকল্যাণে নিবেদিত, যেখানে গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকবে। নতুন দলের জন্য প্রয়োজন নতুন চিন্তা, নতুন কর্মসূচি এবং নতুন স্লোগান। জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান, মানুষের রুটিরুজির ব্যবস্থা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা— এই তিনটি বিষয় নতুন দলের জন্য অপরিহার্য।
নতুন দল গঠন এবং সেই দলকে গণভিত্তি দেওয়া সহজ কাজ নয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শক্তিশালী অবস্থান এবং তাদের পেশীশক্তি, অর্থ ও প্রভাব নতুন দলের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। তবে জনগণের সমর্থন ও আস্থা অর্জন করতে পারলে নতুন দল এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম হতে পারে। নতুন দলকে অবশ্যই জনগণের সমস্যা ও চাহিদার প্রতি সংবেদনশীন এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। যদি তারা জনগণের সমর্থন ও আস্থা অর্জন করতে পারে তাহলে কেবল বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে।