প্রত্যাশা ছিল যে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা এবং সামগ্রিক অর্থীনীতিতে স্থিতিশীলতা আনার জন্য বাজেটে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা থাকবে এবং থাকবে বড় ধরনের পরিকল্পনা। কিন্তু সে ধরনের কোনো কর্মপরিকল্পনা আমরা দেখতে পাইনি।
Published : 09 Jun 2024, 05:05 PM
২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের বাজেটের আকার ও ঘাটতি কিছুটা কমে আসায় তা বাস্তবতার প্রতিফলন হিসাবেই দেখা হচ্ছে। তবে সরকার মূল্যষ্ফীতি নিয়ন্ত্রণের যে আাকাঙ্ক্ষা নিয়ে বাজেট পরিকল্পনা করা হয়েছে তাতে বাজেটের আকার আরেকটু ছোট হলেও হতে পারতো। মূলস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী কিছু উদ্যোগ ও ইচ্ছার কথা তুলে ধরলেও বাস্তবতার নিরিখে ও পরিস্থিতির সঠিক গুরুত্ব বিবেচনায় তা অপ্রতুল বলেই মনে হয়।
গত ৬ জুন জাতীয় সংসদে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী। প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য দেশি উৎস থেকে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব যোগান দেয়ার পরিকল্পনার পর বাজেটে ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার ঘাটতি থাকবে, যা জিডিপির ৪.৬ শতাংশের সমান। ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়া হবে। বাকি অর্থ আসবে দেশ-বিদেশের অন্যান্য উৎস থেকে। বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে ধরে রেখে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে।
এবছর যে সময়ে ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবিত হয়েছে, তখন অর্থনীতিতে অন্তত পক্ষে দুটি চ্যালেঞ্জ দৃশ্যমান রয়েছে। একটি হচ্ছে মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ অপরটি হচ্ছে সামগ্রিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার চ্যালেঞ্জ। প্রত্যাশা ছিল যে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা এবং সামগ্রিক অর্থীনীতিতে স্থিতিশীলতা আনার জন্য বাজেটে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা থাকবে এবং থাকবে বড় ধরনের পরিকল্পনা। কিন্তু সে ধরনের কোনো কর্মপরিকল্পনা আমরা দেখতে পাইনি।
সামষ্টিক অর্থনীতির ভারসাম্যের বিষয়টা মুদ্রানীতির সঙ্গে জড়িত। তারপরেও মুদ্রানীতিতে সহযোগী ভূমিকা রাখার রাজস্বনীতিসহ বাজেটে আরও কিছু সম্পূরক বিষয় থাকতে পারত।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কিছু কিছু উদ্যোগ হয়তো নেওয়া হয়েছে। তবে তা ৬ দশমিক ৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি প্রাক্কলনের লক্ষ্য অর্জনের জন্য অপ্রতুল। সাধারণত অন্যান্য সময় বাজেটের আকার ১০ শতাংশের মতো বাড়ানো হয়। এবার ৫ শতাংশের মতো বাড়ানো হয়েছে এবং ঘাটতিটা ৪ দশমিক ৬ শতাংশের মধ্যে রাখা হয়েছে। পাশাপাশি কৃচ্ছ্রতা সাধনের দুয়েকটা বিষয় রয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পারে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের এলসি খোলার ক্ষেত্রে উৎসে কর ২ শতাংশ থেকে ১ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে।
তবে অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিশেষ করে বহুল আলোচিত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাজেটের এই পদক্ষেপগুলো অনেকটা এডহক ভিত্তিতেই হচ্ছে। ছোটখাট কিছু কর্মকৌশলে পরিবর্তন আনা হয়েছে। সার্বিকভাবে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করিনি। বর্তমানে ৯ থেকে ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতির পরিস্থিতি বিবেচনা করলে এই পদক্ষেপগুলো মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষেকে কিছুটা সহায়তা করলেও খুব বেশি স্বস্তি দেবে বলে মনে হয় না।
তাহলে এখন প্রশ্ন আসে যে, বাজেটে আর কী কী করা যেতো। প্রথমেই আমি বলবো, বাজেটের আকারটা আরেকটু ছোট রেখে অভ্যন্তরীণ ঋণের মাত্রাটা আরও কম রাখার প্রয়োজন ছিল। দ্বিতয়ত, মূসক, রেগুলেটরি ডিউটি, আমদানি শুল্ক এসব জায়গায় আরও কিছু ছোটখাট পরিবর্তন করা যেত। তাতে রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রায় খব বড় ধরনের পরিবর্তন হতো না; কিন্তু সাধারণ মানুষ স্বস্তি পেত।তৃতীয়ত, বর্তমান বাজার পরিস্থিতি ও মানুষের খরচের চাপ বিবেচনায় করমুক্ত আয়সীমা আরেকটু বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল। বছরে সাড়ে তিন লাখ টাকার আয়সীমা বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তা করলে, এই টাকার ক্রয় ক্ষমতা কতটুকু আছে? বর্তমানে টাকার প্রকৃত মূল্য হিসাব করে যদি চিন্তা করি তাহলে করমুক্ত আয়সীমাটা কিছুটা বাড়ানো যেত।
আরও কিছু ভিন্নধর্মী পদক্ষেপ হয়তো নেওয়া যেত। সেটা হচ্ছে কর্মসংস্থানের জন্য ব্যক্তিখাতকে আরেকটু প্রণোদনা দেয়া, উৎসাহিত করা। শিল্পখাতের শ্রমিকদের জন্য রেশনিং, সুলভ মূল্যে খাবার-দাবার দেয়ার ব্যবস্থা করা যেত। অর্থাৎ এখন শিল্পখাতে যে প্রণোদনা দেয়া হয় সেগুলোকে কিছুটা শর্তভিত্তিক করতে পারলে তাতে একই সঙ্গে শিল্পখাতের অগ্রগতি হতো, একই সঙ্গে শ্রমিকদেরও তা স্বস্তি দিত।
আরেকটা বিষয় হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি দারিদ্র্য বিমোচন ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য মুদ্রানীতির মাধ্যমে কিছু কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। বিশেষ করে সুদহার ফ্লেক্সিবল করে মানি সাপ্লাই কমিয়ে আনা ও রেপো বা নীতিসুদহারের পরিবর্তনের মতো বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু উদ্যোগগুলো নিতে দেরি হয়ে গেছে। যখন মানুষের চাহিদাটা পড়তির দিকে। সেই কারণে সুদের হারে পরিবর্তনটা সার্বিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনেনি। এছাড়া সুদহার পরিবর্তনের মাধ্যমে ঐতিহাসিকভাবে আমরা বেশি সাফল্য পাইনি।
দেরিতে হলেও এগুলোকে আমি ভালো দিকই বলব। পাশাপাশি এটাও বলব যে এগুলোতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আরও আগে নেওয়া উচিত ছিল।
এই পর্যায়ে যখন দেখতে পাচ্ছি যে, মূল্যস্ফীতিকে বাগে আনার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হলেও বাজার ব্যবস্থাপনায় একটা দুর্বলতা থেকে যাচ্ছে। আমদানি পণ্যের মূল্যস্ফীতি ছাড়াও সার্বিক বাজার ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িয়ে একটা মূল্যস্ফীতি রয়ে গেছে। বার বার বলা সত্ত্বেও এই ক্ষেত্রে আমরা তেমন সাফল্য অর্জন করতে পারছি না। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দের দিক থেকে এবং আওতা বাড়ানোর দিক থেকে কয়েকগুণ বাড়ানোর মাধ্যমে এই পরিস্থিতিতে একটা বিকল্প সমাধান আনা যেত।
শুধু নিম্নবিত্ত নয়; মধ্যবিত্তদের জন্যও ব্যাপক পদক্ষেপ নেয়া যেত। এই ক্ষেত্রে যদি বড় ধরনের উল্লম্ফন করা যেত, তাহলে সাধারণ মানুষ স্বস্তি পেত। যেমন আরও বেশি টিসিবি কার্ডের ব্যবস্থা করা, টিসিবির পণ্যে আরও বেশি ছাড় দেয়া, পণ্যের সংখ্যা আরও বাড়ানো ইত্যাদি। এসবের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটানোর প্রয়োজন ছিল।
এখনকার সময়ে সামাজিক নিরাপত্তাখাতে যে বরাদ্দ আছে সেটা পেনশন, সুদ ও বৃত্তিকে হিসাব করলে ১৭ শতাংশের মতো। এই বিষয়গুলো বাদ দিলে মূল বাজেটের ১০ থেকে ১১ শতাংশ সরাসরি দরিদ্রদের কাছে যাচ্ছে। যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে, মাথাপিছু ভাতার পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে, নতুন করে কিছু মানুষকে ভাতার আওতায় আনা হয়েছে। এগুলোকে সাধুবাদ জানানোর মতো; তবে সার্বিক চাহিদার তুলনায় এটা একেবারেই অপ্রতুল।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে কিছু মৌলিক পরিবর্তন দরকার। এর একটি বিষয় হচ্ছে শহরাঞ্চলে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সংখ্যা বাড়ানো। শহরেরর বস্তিতে কিন্তু অনেক দরিদ্র মানুষ রয়েছে। মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে তাদের স্বস্তি দেয়ার জন্য সুস্পষ্ট যদি কিছু থাকত তাহলে তাদের জন্য সেটা অনেক উপকারে আসত।
কর্মসংস্থান তৈরির জন্যও বরাদ্দ বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল। বিশেষ করে এখন ব্যক্তিখাতে ঋণের প্রবাহ কম হওয়ার কারণে বড় ধরনের বড় ধরনের কর্মসংস্থান তৈরির সম্ভাবনা যেহেতু কম, সেখানে এই ধরনের পদক্ষেপ গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বা এনট্রিপলএস কার্যকর করবারও এটি প্রকৃত সময়। বেশ কয়েক বছর আগেই এটা জাতীয় সংসদে পাশ হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর যে চিন্তা সেটা এখন বাস্তবায়ন করার সময় এসেছে।
এখন টিসিবির বরাদ্দ ও সক্ষমতাকে কয়েকগুণ বাড়ানো দরকার। টিসিবির পণ্যগুলোতে আরও কিছুটা ভর্তুকি দেয়া গেলে, পণ্যের সংখ্যা বাড়ালে তা মানুষকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দেবে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলের দিনমজুর, খেটে খাওয়া মানুষের জন্য এটা প্রয়োজনীয়। গ্রামে নিজস্ব জমি নিজস্ব খামারের কারণে মানুষ চাপটা কিছুটা হলেও সামাল দিতে পারে। সেই কারণেই আমি শহরের কথা বেশি বলছি।
এই কথাটা অত্যন্ত জোর দিয়ে বলতে চাচ্ছি। প্রকল্পগুলো ডিজিটাল করার মাধ্যমে কিছু দুর্বলতা কমানো এবং সুবিধাভোগী নির্বাচনের পদ্ধতি হালনাগাদ করাটাও এখন জরুরি।
আরেকটা জিনিস হচ্ছে পেনশন, সুদ ও বৃত্তি— এই তিন ক্যাটাগরিকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি থেকে আলাদা করতে হবে। পেনশনটা মধ্যবিত্ত পায়, অনেক ক্ষেত্রে উচ্চবিত্তরাও পেনশন পায়। এখানে পরিবর্তনের কথাটি অনেকদিন ধরে বলা হচ্ছে।
আমরা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা যখন বলি, তখন কেবল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কথাটাই বেশি বেশি বলি। অথচ খাদ্য মন্ত্রণালয় ও কৃষি মন্ত্রণালয় মূল্যস্ফীতির সঙ্গে, সার্বিক খাদ্যব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত। এক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে একটা সমন্বয় সেল দরকার। প্রতিযোগিতা কমিশনের সক্ষমতা বাড়িয়ে বাজারে সুস্থ্ প্রতিযোগিতার পরিবেশ যদি কেউ বিনষ্ট করে এর জন্য একটা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স তৈরি করতে হবে।
বহুদিন ধরে ডলারের মূল্যমানকে ধরে রাখা, সুদহার ধরে রাখার ঘটনা ঘটেছে। এসমস্ত অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয়ের কারণ মূল্যস্ফীতি এখন লাগামছাড়া অবস্থায় চলে গেছে। তাই অর্থনীতির তত্ত্ব অনুযায়ী এবং তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে খুব দ্রুত মূল্যস্ফীতির বড় ধরনের নিয়ন্ত্রণ হবে বলে আমার মনে হয় না। এর জন্য কিছুদিন সময় লাগবে।
তবে সঠিক বাজার ব্যবস্থাপনার মধ্যমে, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিকে আরও বাড়ানোর মাধ্যমে মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে মানুষকে কিছুটা স্বস্তি দেয়া যেতে পারে।