বঙ্গবন্ধু হত্যার নেপথ্যের কুশীলবদের মুখোশ উন্মোচিত হবে না?

এর মধ্যেই ১৪ অগাস্ট দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি এলাকা, কার্জন হল ও অ্যানেক্স ভবনে একযোগে তিনটি বোমা বিস্ফোরণ ঘটেছিল। ভোরের দিকে জগন্নাথ হলের উত্তর গেটের (শামসুন্নাহার হলের উল্টোদিকে) দেওয়ালে সাঁটা পাওয়া গিয়েছিল কাগজে তৈরি একটি ছোট্ট পাকিস্তানি পতাকা।

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 14 August 2022, 04:02 PM
Updated : 14 August 2022, 04:02 PM

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কথা মনে হলে এখনও আমার বুকটা কেঁপে ওঠে, চোখ ভিজে আসে। ওই দিনটি আমাদের জন্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার তথা ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য হওয়ার কথা ছিল অত্যন্ত আনন্দ-উচ্ছ্বাসময়, স্মরণীয় একটি দিন। রাষ্ট্রপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগমনের কথা ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার তাকে স্বাগত জানাতে, বরণ করতে অধীর আগ্রহে প্রহর গুনছিল। বেশ কদিন ধরেই বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে চলছিল সাজগোজ, আয়োজন, প্রস্তুতি।

আমরা যারা ছাত্রকর্মী, যারা বঙ্গবন্ধুকে বরণ করার জন্য স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নানা প্রস্তুতি-কাজে যুক্ত ছিলাম, আমাদের মধ্যে চলছিল দারুণ উত্তেজনা। বঙ্গবন্ধুকে আমরা আবার খুব কাছ থেকে দেখতে পাবো, শুনতে পাবো তার জাদুকরি কণ্ঠস্বর। সোনার বাংলাদেশ গড়ার জন্য তার নতুন রাজনৈতিক পরিকল্পনার কথা তিনি তুলে ধরবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক-কর্মচারীদের সামনে, যে বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ে সূতিকাগার হিসেবে কাজ করেছে।

কিন্তু ১৫ অগাস্ট রাতের আঁধার কেটে দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কানে এলো সেই ভয়াবহ দুঃসংবাদ। ঘাতক মেজর ডালিমের নির্দয় কণ্ঠ ইথারে ছড়িয়ে দিয়েছে সেই নিষ্ঠুর শব্দাবলী: ‘শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে!’

বলে কী? এ-ও হতে পারে! পাকিস্তানি জালেমরা অনেক ষড়যন্ত্র করে, বিচারের নামে প্রহসন করে যাঁকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করতে চেয়ে সফল হতে পারেনি, তার বক্ষ ভেদ করেছে, তারই সৃজিত স্বাধীন বাংলাদেশের কতিপয় কুলাঙ্গার বাঙালি সৈনিকের ছোঁড়া বুলেট!

না, না, এ হতে পারে না। এ মিথ্যা। এ অপপ্রচার। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের শত্রুরা, পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা নিশ্চয়ই কোনো গোপন বেতার থেকে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপপ্রয়াসে চালাচ্ছে।

হ্যাঁ, প্রথম যখন শুনি বঙ্গবন্ধু হত্যার কথা, তখন প্রাথমিকভাবে আমার মতো অনেকের এ রকমই মনে হয়েছিল। কারণ এ খবর ছিল অবিশ্বাস্য। আকাশ ভেঙে মাটিতে পড়তে পারে, কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা কীভাবে সম্ভব!

বঙ্গবন্ধুর আগমন উপলক্ষে বেশ কয়েক দিন ধরেই সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় চলছিল পরিচ্ছন্নতা অভিযান। শিল্পীরা তৈরি করছিলেন দৃষ্টিনন্দন তোরণ ও অন্যান্য উপকরণ। এর মধ্যেই ১৪ অগাস্ট দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি এলাকা, কার্জন হল ও অ্যানেক্স ভবনে একযোগে তিনটি বোমা বিস্ফোরণ ঘটেছিল। ভোরের দিকে জগন্নাথ হলের উত্তর গেটের (শামসুন্নাহার হলের উল্টোদিকে) দেওয়ালে সাঁটা পাওয়া গিয়েছিল কাগজে তৈরি একটি ছোট্ট পাকিস্তানি পতাকা।

বঙ্গবন্ধুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আগের দিনের এ ঘটনাগুলো সে সময় বিচ্ছিন্ন বলেই আমাদের অনেকের কাছে মনে হয়েছিল। ১৪ অগাস্ট পাকিস্তানের ‘স্বাধীনতা’ দিবস, তাই হয়তো পাকিস্তানপন্থীরা এসব করে নিজেদের হারানো মনোবল ফিরে পাবার দুঃস্বপ্ন দেখাচ্ছিল। কিন্তু পরে বোঝা গেছে, এগুলো ছিল তাদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ।

তখন দেশে একটি নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি হয়েছিল। নাশকতা-অন্তর্ঘাতের মাত্রা বাড়ছিল। দুর্ভিক্ষের কবলেও পড়েছিল দেশ। সদ্যস্বাধীন দেশের সমাজ ও রাজনীতি অস্থিতিশীল করার নানামুখী ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় ১৯৭৫ সালের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন এবং ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু গড়ে তুলেছিলেন দেশে সক্রিয় এবং ইচ্ছুক সব রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে একটিমাত্র রাজনৈতিক দল– বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ– সংক্ষেপে, বাকশাল।

বহুদলীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তনে একদলীয় ‘বাকশাল’ ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে দেশের রাজনীতিতে কিছুটা গুমোট পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল বৈকি। বাকশাল নিয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনা যতটা ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল সন্দেহ-সংশয়। বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে গড়া দল আওয়ামী লীগের সব স্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যেও বিষয়টি নিয়ে সমান আগ্রহ ছিল না। আবার বাকশাল এবং এর বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতৃত্বে থাকা অর্থাৎ পদ-পদবি পাওয়া না-পাওয়া নিয়েও ছিল অসন্তোষ-ক্ষোভ। পদবঞ্চিতরা ছিলেন হতাশ ও ক্ষুব্ধ। আবার যারা পদ পেয়েছিলেন তাদের মধ্যেও বাকশাল ব্যবস্থার সাফল্য বা অগ্রযাত্রা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল।

আওয়ামী লীগের মধ্যে অসন্তোষ ছিল ‘ক্ষমতার’ ভাগ যৎসামান্য হলেও অন্যদের হাতে চলে যাওয়ার বাস্তবতা তৈরি হওয়ায়। আবার অন্যরা, বিশেষত বাকশাল নিয়ে অতিউৎসাহী বলে মনে হওয়া সিপিবি-ন্যাপও শেষ পর্যন্ত খুশি হতে পারেনি বাকশালের কমিটিতে তাদের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব না থাকায়। বাকশালের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী কমিটিতে ন্যাপ-সিপিবির কেউ ঠাঁই পাননি। ন্যাপের সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ অন্তত ওই কমিটিতে থাকবেন বলে আশা করা হয়েছিল। কিন্তু সেটা হয়নি। আবার আওয়ামী লীগের যাদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ ছিল, যাদের নিয়ে বিতর্ক ছিল তাদের ঠিকই জায়গা হয়েছিল ওই কমিটিতে।

মোট কথা, বাকশাল গঠনকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনীতিতে নতুন গতিবেগ প্রতিষ্ঠার যে আশা ছিল, বাস্তব সে রকম ছিল না। বরং এক ধরনের সন্দেহ-অবিশ্বাস নিয়েই যাত্রা শুরু হয়েছিল। তারপরও ধরে নেওয়া হচ্ছিল যে, ধীরে ধীরে পরিস্থিতি বদলাবে, কিছুটা সময় পেলে বঙ্গবন্ধু সবকিছু সামাল দিতে পারবেন। তখন সব কিছুই আবর্তিত হচ্ছিল একমাত্র বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করেই। মানুষের সব স্বপ্ন-প্রত্যাশাই ছিল তাকে ঘিরে। এমনকি বাকশালে যে সব রাজনৈতিক দল ও নেতারা যোগ দিয়েছিলেন, সবাই তার মুখ চেয়েই তা করেছিলেন।

অগাস্ট মাস এলে আমাদের পঁচাত্তরের সেই ভয়াবহ ১৫ অগাস্টের কথা যত তীব্রভাবে মনে পড়ে, অন্য সময় ততটা মনে পড়ে কি? অগাস্ট মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন সংগ্রাম, তার ত্যাগ-তিতিক্ষা, বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র গঠনে তার অসামান্য অবদান নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি তার নির্মম হত্যাকাণ্ড নিয়েও কথা হয়। তাকে সরাসরি যে ঘাতকদল হত্যা করেছে তাদের কথা সবাই জানলেও নেপথ্যে কার কী ভূমিকা ছিল, কে, কীভাবে ঘাতকদের নৈতিক সহযোগিতা দিয়েছিল এবং কীভাবে এবং কারা স্বাধীনতার পর থেকে অব্যাহতভাবে নানা ষড়যন্ত্রমূলক অপতৎপরতার মাধ্যমে পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল, সে বিষয়গুলো এখনও পরিষ্কার হয়নি। কাদের পরামর্শে বা ঠিক ঠিক কী কী কারণে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিশ্বস্ত থেকে সব ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত সফলভাবে মোকাবিলা করে মুক্তিযুদ্ধকে বিজয়ের তীরে নিয়ে আসেন সেই বিচক্ষণ নেতা তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর দূরত্ব তৈরি হলো, এসব বিষয়েও হয়নি কোনো বিশ্বাসযোগ্য গবেষণা।

ইতিহাসের সত্য সন্ধানে আমাদের আগ্রহ কম। ইতিহাসের নামে কখনও কখনও কল্পগল্পও আমরা বানিয়ে থাকি। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হঠাৎ কোনো ঘটনায় হয়নি, কোনো ব্যক্তি হুইসেল বাজিয়েছেন আর গোটা বাঙালি জাতি জীবনবাজি রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, বিষয়টি মোটেও তেমন নয়। এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ এবং ধারাবাহিক নানা ছোটবড় রাজনৈতিক সংগ্রাম। নামাজের আগে আজান দেওয়া কিংবা সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালানোর আগে সলতে পাকানোর মতো মূল কাজের আগে থাকে প্রস্তুতি। বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডের রাজনৈতিক সংগ্রামের ধারাবাহিক এই সংগ্রামের প্রধান নেতা বা কাণ্ডারি অবশ্যই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার সঙ্গে তুলনীয় না হলেও আরও অনেক নেতা-কর্মীর শ্রম ও নিষ্ঠার কথাও অস্বীকার করা ঠিক হবে না। আওয়ামী লীগ দল হিসেবে নেতৃত্বের অবস্থানে থাকলেও আরও দুচারটি দলও কম অবদান রাখেনি। বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগের অনেকে যেমন জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন, তেমনি অন্য বাম-প্রগতিশীল দলের নেতারাও জেল-নিগ্রহের বাইরে ছিলেন না। সবার অবদানের কথা এক ভাবে না হলেও, যার যার অবস্থান অনুযায়ী উল্লেখ থাকা প্রয়োজন। ইতিহাস রচনায় সত্যনিষ্ঠ হয়ে ভারসাম্য রক্ষা করতে ব্যর্থ হলে এক সময় ইতিহাসই আমাদের বিদ্রুপ করবে।

জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে গত বছর ঢাকা মহানগরী আওয়ামী লীগের দুই অংশের আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্টের হত্যাকাণ্ডে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের নেতাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছিলেন, "আমাদের বাসায় যখন গুলি শুরু হয়, বঙ্গবন্ধু কিন্তু সবাইকে ফোন করেছিলেন। আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে কথা হয়, তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে কথা হয়, সেনাপ্রধান শফিউল্লাহর সঙ্গে কথা হয়। এ রকম একটা ঘটনার পর আমাদের দল, সমর্থক, মুক্তিযোদ্ধাদের যে ভূমিকা ছিল তা হয়তো তারা করতে পারেনি। সেনাবাহিনীরও যার যা ভূমিকা ছিল তারাও সঠিকভাবে তা পালন করেনি। এর পেছনের রহস্যটা কী? সেটাই প্রশ্ন।"

সত্যি, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ৪৭ বছর হতে চললো অথচ এই দীর্ঘ সময় পরেও ‘পেছনের রহস্য’ উন্মোচিত হলো না। এটা দুঃখজনক এবং এই ব্যর্থতার দায় আমাদের সবার। বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ ঘাতকদের বিচার হয়েছে, কয়েকজন ফাঁসির দড়িতে ঝুলেছেন। কয়েকজন এখনও পলাতক কিংবা অজ্ঞাতবাসে আছেন। অন্তত দুজনের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু নেপথ্যে ভূমিকা পালনকারীদের খোঁজে কোনো বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে সরকারে থাকা সত্ত্বেও এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ কেন নেওয়া সম্ভব হলো না তা জানার কৌতূহল আমাদের থাকাটাই স্বাভাবিক।

বঙ্গবন্ধু কোন্ সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছিলেন অথবা বাকশাল প্রতিষ্ঠা করা গেলে দেশের চেহারা কী দাঁড়াতো কিংবা শাসক বঙ্গবন্ধু কতটা সফল আর কতটা ব্যর্থ- এ সবই রাজনৈতিক বিতর্কের বিষয়। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে এসব বিতর্কের বিপরীতে তার নিজের কথা তুলে ধরতে পারতেন। তবে তিনি যে একদলীয় শাসনপদ্ধতি চালু করলেন, সেটি বিশ্বরাজনীতিতে নতুন কিছু ছিল না। লেনিনীয় দর্শনের একদলীয় শাসনব্যবস্থা দ্বারা পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্রই পরিচালিত হয়েছিল একসময়। বঙ্গবন্ধু অবশ্য প্রক্রিয়াটি ওপর থেকে চাপিয়ে দিয়েছিলেন, স্বাধীনতার পর পরই অনেকে যখন তাকে একদলীয় বিপ্লবী সরকার গঠন করার পরামর্শ দিয়েছিলেন, তখন তাদের সেই পরামর্শ শুনলে প্রক্রিয়াটি চাপিয়ে দেয়া মনে হতো না। সে যাক, প্রশ্নটা হলো, পৃথিবীর কোন্ শাসনব্যবস্থার প্রক্রিয়া অবিতর্কিত থেকেছে? ৭০ বছর পর মার্কস-লেনিন নির্দেশিত শাসনপদ্ধতি এবং এর প্রক্রিয়াগত দিকগুলো কি খেলো হয়ে যায়নি? চূড়ান্ত সত্য কে কবে কোথায় নির্দিষ্ট করে বলতে পেরেছে?

এটা স্পষ্ট, বঙ্গবন্ধু যে একদলীয় শাসনব্যবস্থা বেছে নিয়েছিলেন, তা 'ভুল'ও যদি হয়, তাহলে সেটা মানুষের প্রতি তার ভালোবাসার ভুল প্রকাশ। স্বাধীনতা দিয়েছেন অথচ দেশটা গড়তে পারছেন না- এই অস্থিরতা বিকল্প পন্থা টেস্ট আউট করার দিকে ঠেলে দিয়েছিল তাকে। '৭২-'৭৫ সালে যারা প্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন, তারা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, স্বাধীনতার অব্যবহিত পরপরই বঙ্গবন্ধুর ‘আমি তোমাদের তিন বছর কিছু দিবার পারুম না'র প্রত্যুত্তরে যারা দুই হাত তুলে রাজি হয়েছিলেন, তাদের অনেকেই তিন বছরের অনেক আগেই অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিলেন। আ স ম রবের নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগের একাংশ তো (তখনও জাসদ প্রতিষ্ঠিত হয়নি) হয় মাসের মাথায় 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিটিও প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। ‘বেশি স্বাধীনতা পেয়ে গেলে আমি পরাধীন হতে ভালোবাসি’- মনে হচ্ছিল কবির এই পদ্ধতির মর্মার্থের মতোই কেউ কেউ পাকিস্তানি পরাধীন জীবনে ফিরে যেতে চাইছিল। এদের সংখ্যা খুবই নগণ্য, তবে এটিও একটি বাস্তবতা। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে, তাও আবার স্বাধীনতা-যুদ্ধশেষে- সমাজে অনেক নতুন উপসর্গ দেখা দেয়, দিতে বাধ্য যেগুলোর কোনো কোনোটি নেতিবাচকও হতে পারে; কিছুসংখ্যক মানুষ এসব নতুন উপসর্গের সঙ্গে নিজেদের ঠিক খাপ খাওয়াতে পারছিলেন না। যেমন- যুদ্ধের সময় যে অস্ত্রের খেলা হয়, যুদ্ধশেষেও অস্ত্রের সেই ঝনঝনানি থেকে যায়। এই ঝনঝনানি তারা মেনে নিতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুর প্রতি ঈর্ষাও যে কাজ করেনি, তা নয়। ফরিদপুরের এক অজপাড়াগাঁয়ের লোক জাতির পিতা হয়ে গেল- ভাবতে কষ্ট হয়েছে রাজধানীর কথিত অনেক এলিটের। এদেরই কেউ কেউ, মরহুম এনায়েতুল্লাহ খান যাদের অন্যতম; ১৫ অগাস্টের দুই কী তিন দিন পর ঢাকা ক্লাবের মদের আসরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সেলিব্রেট করেছিলেন।

প্রবীণ সাংবাদিক তোয়াব খান ছিলেন বঙ্গবন্ধুর প্রেস সেক্রটারি। তিনি একটি লেখায় লিখছেন : ‘১৫ আগস্ট এক দিনে ঘটেনি। এর পেছনে আরও ষড়যন্ত্র ছিল, সেটা দীর্ঘদিন ধরে চলছিল। এবং তাতে কারা কারা জড়িত আর সেটা কীভাবে হতে পারে, তা যাঁরা জেনেছেন, বলারও চেষ্টা করেছেন। মুশকিল হচ্ছে, দেশের মানুষের ওপর বঙ্গবন্ধুর খুব বেশি আস্থা ছিল। তিনি মনে করতেন, জাতির পিতাকে কেন কেউ হত্যা করবে?’

তোয়াব খান লিখেছেন :

পরে যখন অনেক সময় ভেবেছি, ঘটনাটা শুধু এভাবে ঘটলো? কয়েকজন বহিষ্কৃত সেনাসদস্য কি তা ঘটাতে পারে? তা তো হতে পারে না। ঘটনার পেছনে কী কী ছিল?

কয়েকটা ঘটনা মনে পড়লো। একবার বঙ্গবন্ধু একটা ইংরেজিতে টাইপ করা চিঠি দিয়ে বললেন, এটা নাও।

নিলাম।

তোমার কাছে রাখো।

আমি ওটা পড়তে গিয়ে দেখি, একটা ইয়ং অফিসার্স নামে টাইপ করা। তাতে সিনিয়র অফিসারদের কে কী চরিত্রের লোক, তার ব্যাখ্যা করা আছে। বঙ্গবন্ধু বললেন, আমি জানি। এদের প্রত্যেকের চরিত্র জানি। ওটা রেখে দাও।

আমি এগুলো বাড়ি নিয়ে যাইনি। অফিসেই ছিল। ১৫ আগস্টের পর থেকে আমাদের গণভবনে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। তাই কী হয়েছে সেই চিঠিটার, তা আর জানা হয়নি।

আরেকটি ঘটনার কথা লিখেছেন তোয়াব খান:

১৫ আগস্টের ঘটনার আগে জুন মাসের একটা ঘটনার কথা মনে পড়লো। ৭ জুন বাকশালের একটা সরকারি ঘোষণা হলো। এখন যেখানে ডিএফপি অফিস, সেখানে আগে ছিল একটা অফিস, যেখানে আওয়ামী লীগ অফিস করল। বৃষ্টির মধ্যে সেখানে হাজারে হাজারে মানুষ দল বেঁধে বাকশালে জয়েন করতে এসেছিল। কাজ শেষ করে বঙ্গবন্ধু বাড়ি চলে এলেন। সঙ্গে এলাম আমি, হানিফ আর মহিউদ্দিন। বাড়িতে এসে বঙ্গবন্ধু তিনতলায় বসতেন। ওখানে বসে বারান্দামতো যে জায়গাটা আছে, সেখানে আলোচনা করতেন। আমি বঙ্গবন্ধুকে সেখানে রেখে নিচে এসে দেখি জিয়াউর রহমান বসে আছেন। বললাম, আরে আপনি এখানে!

জিয়াউর রহমান বললেন, দেখেন তো তোয়াব সায়েব। বাকশালে আমার নাম নেই। এটা কী রকম কথা। আমি কেন বাকশালে থাকবো না?

বললাম, দেখা করবেন?

বললেন, হ্যাঁ, বঙ্গবন্ধুকে বলার জন্য এসেছি।

বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে বললাম, স্যার, জিয়াউর রহমান এসে বসে আছেন।

বঙ্গবন্ধু বললেন, নিয়ে আস তারে।

আমি জিয়াউর রহমানকে বঙ্গবন্ধুর কাছে দিয়ে চলে এসেছি।

তোয়াব খান শেষ করেছেন এভাবে :

ব্যাপার হচ্ছে, পরবর্তীকালে বিভিন্ন ডকুমেন্ট আমি পড়েছি। তাদের মধ্যে একজনের কথা পড়েছি, যিনি ছিলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে। চট্টগ্রামের একজন। জুলাই মাসের দিকে জিয়াউর রহমানকে জিডিআরের (তখনকার পূর্ব জার্মানি) অ্যামবাসেডর করে পাঠানোর কথা হয়েছিল। জিয়াউর রহমান এক মাস সময় চেয়েছেন। বিভিন্ন লেখায় এ বিষয়টা দেখেছি। এক মাস সময়। তখন জুন মাস। ঘটনাগুলো মেলালেই বোঝাই যায়। ১৫ আগস্ট-সংক্রান্ত দুটো বাক্য স্মরণীয় হয়ে থাকা উচিত। একটা হলো, একজন বঙ্গবন্ধুকে বলছেন, আপনি পালাতে পারেন নাকি দেখেন।

বঙ্গবন্ধু মারা যাওয়ার খবর পেয়ে বলা আরেকটা বাক্য, সো হোয়াট? ভাইস প্রেসিডেন্ট ইজ দেয়ার।

ষড়যন্ত্রের পেছনের চরিত্রটির মুখ কি আমাদের কাছে স্পষ্ট হচ্ছে না?

বঙ্গবন্ধু তাঁর বুকের রক্ত দিয়ে গেছেন এই দেশের জন্য। এখন কেঁদে আমরা যত অশ্রুই ঝরাই না কেন তিনি আর ফিরে আসবেন না। তাকে আমরা স্মরণ করবো, তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাবো, সবই ঠিক আছে। কিন্তু তাকে হারানোর শোককে শক্তিতে পরিণত করে তার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার প্রতিজ্ঞা থেকে যেন আমরা বিচ্যুত না হই। একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গঠনের প্রক্রিয়া জোরদার হলেই বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো সম্ভব হবে।