অন্যের জন্য না ভাবাটাই ‘প্রকৃত দেশপ্রেম’!

সেই ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া সিস্টেম। পাকিস্তানের লালিত সিস্টেম। স্বৈরাচার পালিত সিস্টেম। দরিদ্রের রক্তচোষা সিস্টেম। ক্রমেই আবার সিস্টেমের কাছে খোলসবন্দী হলেন তিনি। সিস্টেমকে চ্যালেঞ্জ জানানোর সব উদ্যোগ-আয়োজন থেমে গেল।

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 16 August 2022, 11:20 AM
Updated : 16 August 2022, 11:20 AM

সিস্টেম। বিধি-ব্যবস্থা, নিয়মনীতি, আইন, প্রক্রিয়া। সব মিলেয়েই সিস্টেম। এটা আমাদের পরিবারে আছে। সমাজে আছে। রাষ্ট্রে আছে। তবে সবচেয়ে বড় সিস্টেম হচ্ছে রাষ্ট্রশক্তির ‘সিস্টেম’। এই সিস্টেম আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে।

আমাদের অন্যতম মৌলিক সমস্যা শাসনতান্ত্রিক। চতুর ইংরেজ শাসকেরা একটি ‘টেকসই আমলাতান্ত্রিক’ শাসনব্যবস্থা কার্যকর করে গিয়েছিল। এর কাঠামোটি এমনভাবে তৈরি হয়েছে যে, পুরো সিস্টেমটাই স্বৈরাচারী ও প্রবল দুর্নীতিগ্রস্ত। নাগরিকদের দণ্ডের ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রেখে ভারতবর্ষের সম্পদ লুটপাটে ব্রিটিশদের সহযোগিতা করাই ছিল ওই সিস্টেমের মূল লক্ষ্য।

ওই সিস্টেমে ব্রিটিশ রাজকোষ তরতাজা রাখতে সেরা লুটেরা ও বশংবদদের নিয়োগ করা হতো। এর মধ্যেই দু-চারজন কিছু ভালো কাজ করার চেষ্টা করতেন। কিন্তু শক্তিশালী সিস্টেমের কারণে তারা তা পারতেন না। তখনকার তরুণরা প্রধানত ওই সিস্টেমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন এবং ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে ইংরেজ লুটেরাদের বিদায় করেছিলেন। ইংরেজ শাসকেরা বিদায় নিলেও তাদের সিস্টেমটা ঠিকই চালু ছিল। ইংরেজদের ছেড়ে যাওয়া সিস্টেমের হাল ধরেছিলেন যারা, তারা ওই সিস্টেম বাতিল তো করেইনি, বরং সেটিকে আরও বেশি কার্যকরী করেছেন।

যে কারণে যেসব মানুষ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করেছেন, তারাই সাতচল্লিশের পরে আবার ভারত ও পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসলেন! স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের প্রধান বিরোধী রাজনীতিবিদরা ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের রাজনৈতিক কর্মী, ভারতের ক্ষেত্রেও তাই!

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের আগে রাজনীতিসচেতন মানুষ একজোট হয়ে লড়েছেন সেই পুরনো ‘সিস্টেম’-এর বিরুদ্ধে। সেখানে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ছিল খেলার পুতুল, আগের স্বৈরাচারী সিস্টেমের ক্রীড়নক।

মুক্তিযুদ্ধে অপরিমেয় ত্যাগ ও আত্মদানের মধ্যে দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র জন্ম নিল। কিন্তু সিস্টেম পুরোপুরি বদল হলো না। যা কিছু উদ্যোগ ছিল সেটাও নস্যাৎ হয়ে গেল পাকিস্তানপন্থী একটা অংশের ষড়যন্ত্রে। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে পুরনো সিস্টেমই আবার শক্তিশালী হয়ে ফিরে এলো।

সামরিক শাসক জিয়া ও এরশাদ পুরনো সিস্টেমের সঙ্গে শুধু আপসই করলেন না বরং দীর্ঘদিনের ঝড়-ঝাপটায় দুর্বল হয়ে পড়া সিস্টেমটি আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তুললেন। জিয়া ব্যর্থ হলেও, সফল ছিলেন এরশাদ। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের নামে ‘আমলাতান্ত্রিক শৃঙ্খল’ বড় বড় শহরগুলো থেকে গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে দিয়ে শতবর্ষী শাসনকাঠামো আরও মজবুত করে গিয়েছেন। ফলে, স্বাধীন বাংলাদেশের দীর্ঘতম সময় পর্যন্ত সরকার ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।

পুরনো স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে তরুণরাই শেষপর্যন্ত রাজপথে রুখে দাঁড়িয়েছেন। মার খেয়েছেন, জীবন দিয়েছেন। তরুণদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে এরশাদের পতন ঘটিয়ে বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসেছিলেন।

একানব্বইয়ে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করলেন বেগম খালেদা জিয়া। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়েও খালেদা জিয়া পারলেন না সিস্টেম পরিবর্তন করতে। ওই ইচ্ছেটা তার ছিল বলে মনে হয় না। তরুণদের রক্তের সাথে বেঈমানী করে সিস্টেমের সাথে আপস করলেন ‘আপসহীন’ নেত্রী। এরপর ১৯৯৬ সালে আরেকদফা রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় এলেন। তিনি এসেই পিতার ‘অসমাপ্ত কাজ’ বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু দীর্ঘদিনের জঞ্জাল সাফ করে শতাব্দীপ্রাচীন স্বৈরতান্ত্রিক সিস্টেমের সঙ্গে পারলেন না। ২০০১ সালে সেই সিস্টেমের কোলে চড়ে ক্ষমতায় এলেন খালেদা জিয়া।

মাতৃস্নেহে বুঁদ হয়ে অপরিণত কিন্তু উচ্চাভিলাষী ছেলের হাতে একটি গোটা রাষ্ট্রের মালিকানা তুলে দিলেন খালেদা জিয়া। জবাবদিহিহীন অপ্রতিহত ক্ষমতা পেয়ে তারেক রহমান (দলের লোকেরা যাকে ‘ভাইয়া’ ডাকা শুরু করে), আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী ও দেশিয় সিস্টেমের সমন্বয় করে ভূখণ্ডের প্রতি ইঞ্চি মাটিতে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে হয়ে উঠলেন খলনায়ক।

সুযোগ বুঝে হত্যা-প্রতিহত্যার লাল রঙে রাঙা মানচিত্রের মালিকানা নিলো সিস্টেমের দাস ফখরুদ্দীন। নানা সার্কাসের পর অবশেষে নির্বাচনের আয়োজন করলেন। নির্বাচনে ২০০৮ সালে আবার হাল ধরলেন শেখ হাসিনা।

তিনি পিতার হত্যাকারীদের বিচারের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের ৪০ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করে রাষ্ট্রের কলঙ্ক মোচনের পথে পা বাড়ান। কিন্তু শতাব্দী প্রাচীন সিস্টেমের কারণে বিচার নিয়ে শুরু হয় সন্দেহ-সংশয়। রাজাকারের ফাঁসি না হয়ে জেলহাজতে রাখার বন্দোবস্ত হলো। রুখে দাঁড়ালো তরুণ প্রজন্ম, শাহবাগে গড়ে ওঠা আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল দেশের আনাচকানাচে!

তরুণদের এমন প্রকাশ্য ম্যান্ডেট পেয়ে গা ঝাড়া দিলেন শেখ হাসিনা। আর থেমে যাওয়া নয়, এবার সময় এগিয়ে যাওয়ার। দল থেকে সংসদ, গ্রাম থেকে শহর– শেখ হাসিনা শুরু করলেন ঘাতক-দালালদের বিচার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষায় তরুণ প্রজন্ম খুশি হলো। কিন্তু সিস্টেমের কাছে আবারও পিছু হঠল সব আয়োজন।

সেই ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া সিস্টেম। পাকিস্তানের লালিত সিস্টেম। স্বৈরাচার পালিত সিস্টেম। দরিদ্রের রক্তচোষা সিস্টেম। ক্রমেই আবার সিস্টেমের কাছে খোলসবন্দী হলেন তিনি। সিস্টেমকে চ্যালেঞ্জ জানানোর সব উদ্যোগ-আয়োজন থেমে গেল।

এই সিস্টেমের কারণেই স্বৈরতান্ত্রিকতা ফিরে ফিরে আসে। এই সিস্টেমের দাসত্ব করেই রাজনৈতিক নেতা হতে হয়। এই সিস্টেমের কাছে নতি স্বীকার করেই রাষ্ট্রের নাগরিক হতে হয়। এই সিস্টেমের কারণেই দেশজুড়ে অরাজকতা চালায় অপরাধীরা। এই সিস্টেমের কারণেই সবকিছু দেখেও চোখ বন্ধ রাখতে হয়, সিস্টেমই মুখ বেঁধে দেয়। সিস্টেমই কানে তুলো গুঁজে দেয়।

এই সিস্টেমের কারণেই জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে দুর্বৃত্তায়ন চলছে। রাজনৈতিক দুবৃত্তায়ন। যে যত বড় মাপের দুর্বৃত্ত, সে তত বড় ক্ষমতাবান। সমাজে সে তত উঁচু আসনে অধিষ্ঠিত, তত বেশি সালামপ্রাপ্ত। তারা স্তাবক, পারিষদ, অস্ত্রধারী, বন্দুকধারী, লাঠিয়াল বাহিনী দ্বারা পরিবৃত্ত। তারা সমাজে ত্রাস সৃষ্টি করে, মানুষকে ভয় দেখায়, অঙ্গচ্ছেদ করে, রগ কাটে, কবজি বিচ্ছিন্ন করে দেয়, হত্যা করে, গুম করে। প্রশাসন নিজেদের স্বার্থ ও সুবিধা মতো কোনোটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় অথবা উপেক্ষা করে।

দুর্বৃত্তরা আজ বাংলাদেশের নদী, চর, পাহাড়, বন, শ্মশানঘাট, কবরস্থান– সর্বস্ব খেয়ে চলেছে। এরাই আদিবাসীদের ভিটেছাড়া করে। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানদের উপাসনালয়ে দেব-দেবীর প্রতিমা, যিশু-মেরির মূর্তি ভেঙে চূর্ণ করে। রামু, কক্সবাজার, নাসিরনগর, কুমিল্লা, সাতক্ষীরা, দিনাজপুর, যশোর, পাবনা, খুলনা, নড়াইলে বীভৎস ত্রাস সৃষ্টি করে। মন্দির তছনছ করে। গেরুয়া বসন পরা বৌদ্ধভিক্ষুদের লাঞ্ছিত করে। হিন্দু বাড়ি লুটপাট করে, জ্বালিয়ে দেয়। অসহায় গরিব খেটেখাওয়া মানুষের ওপর ধর্মের নামে চড়াও হয়। শিক্ষককে অপমান করে, জুতার মালা পরায়।

এদিকে সুইস ব্যাংকে নামে বেনামে বহু ব্যক্তি শত শত কোটি টাকার পাহাড় জমায়। তারা সেকেন্ড হোম তৈরি করে কানাডা, মালয়েশিয়া, দুবাই, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, মরিশাস, সাইপ্রাসে। শেয়ারবাজারে, ডেসটিনি, হল-মার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, বেসিক ব্যাংকে দুর্নীতির একেকটি মহা উপাখ্যান রচিত হয়েছে। হয়েছে হরিলুট আর লুটের টাকা সব বিদেশে পাচার করা হয়েছে। ব্যাংকের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা গোটা জাতীয় আর্থিক ব্যবস্থাকে ভেঙে দিয়েছে। অথচ অর্থ মন্ত্রণালয়, তার ব্যাংকিং ডিভিশন এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নির্বাক।

বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন, দুর্নীতি ও রাজনীতি সমার্থক শব্দ হয়ে পড়েছে। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে সংসদের প্রবেশদ্বার পেরোনোর পূর্বমুহূর্তে নাম স্বাক্ষর করে যে প্রতিবেদনটি নির্বাচন কমিশনে প্রেরণ করেন, তা তার নির্বাচনী খরচের হিসাব। এখানে তারা মিথ্যা হলফনামায় স্বাক্ষর করেন। শত শত কোটি টাকা নির্বাচনে ব্যয় করে ডাহা মিথ্যা প্রতিবেদন দেন। নির্বাচনের পর জাতীয় সংসদের সদস্যদের অনেকেই নির্বাচনী হলফনামার ঘোষিত সম্পদের চেয়ে শতগুণ এমনকি হাজার গুণ সম্পদের মালিক বনে যান অলৌকিক উপায়ে। অতচ সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, উপদেষ্টারা কোনো ব্যবসায় জড়িত থাকতে পারেন না। নামে-বেনামে কোনো ব্যবসা করতে পারেন না। তাহলে এ বিপুল সম্পদ কোথা থেকে আসে? এ জন্য তাদের জবাবদিহি করতে হয় না কেন?

কারণ সিস্টেম। আবার এসবের প্রতিবাদও তেমন একটা হয় না সিস্টেমের কারণে। রাষ্ট্রের ‘সিস্টেম’-এর বিরুদ্ধে গেলে বা সহমত পোষণ না করলে কী হতে পারে, তার নজির এ দেশে ভূরি ভূরি। বলা বাহুল্য, সব ক্ষেত্রে, বিশেষত সাম্প্রতিক কালে, তা কিন্তু চায়ের কাপে চিনি মেশানোর মতো মোলায়েম নয়!

আমাদের দেশে ইদানীং ‘বিদ্রোহী’ লেখক বা সাংবাদিক খুব একটা খুঁজে পাওয়া যায় না। আজকের দিনে যদিও আলাদা করে ‘বিদ্রোহী’ শব্দটার অর্থ নেই, যে কোনও বিক্ষুব্ধ বা বিরোধী স্বরই আমাদের আজকের শাসকের কাছে রাষ্ট্রদ্রোহিতা। এই রাষ্ট্রদ্রোহিতার খড়গের নিচে কেউ আর পড়তে চায় না।

বর্তমানে শাসকদের চোখে চোখ রেখে কথা বলার মতো মানুষের বড়ই অভাব। লুটেরা দুর্নীতিবাজ শাসকের বিরুদ্ধে, প্রান্তিক, অবহেলিত মানুষের হয়ে সরব হতে তেমন কাউকে দেখা যায় না। অত্যন্ত প্রভাবশালী, বিপজ্জনক ও ক্ষমতাধরদের চোখে চোখ রেখে সোজা কথা সোজা ও বলিষ্ঠ ভাবে বলার কাজটি অবশ্য অত্যন্ত কঠিন। যারা সমাজের অন্যায় অবিচার ক্ষতাধরদের জুলুম লুটপাটের বিরুদ্ধে লেখেন, আমরা জানি, তারা ব্যতিক্রমী এবং রাষ্ট্রের চোখে অত্যন্ত বিপজ্জনক। সংবিধানের শপথ নিয়ে এ দেশে গণতন্ত্র রক্ষার ভার যে শাসকরা নেন, তারা বিরুদ্ধ বা বিক্ষুব্ধ স্বর সহ্য করতে পারেন না। গত পঞ্চাশ বছরের দেশ সেটাই দেখিয়েছে।

অদম্য অসহিষ্ণুতা, প্রতিহিংসা, বিরুদ্ধ স্বর ও সাংবাদিকের সমালোচনা নৃশংস ভাবে দমিয়ে রাখার স্পর্ধা আজ প্রতি দিনের সংবাদ। সবটা মিলিয়েই আজকের ‘সিস্টেম’। আসলে, ‘দেশদ্রোহী’ বা ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ হওয়ার জন্য আজ আর বিশেষ কিছু করতে হয় না। শুধু সহমর্মিতা থাকলেই চলে। কেননা, সময় এখন আমাদের শেখায়, অন্যের জন্য না ভাবাটাই প্রকৃত দেশপ্রেম!