স্কুল-কলেজে পরীক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে, একদিকে শিক্ষকের পাঠদান পদ্ধতি যাচাই করা ও কার্যকরী পদ্ধতি প্রয়োগ করা, এবং অন্যদিকে শিক্ষার্থীর শিখনসমস্যা খুঁজে বের করে তা অতিক্রমে তাকে সহায়তা করা। এতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়েরই যাচাই ও কল্যাণ হয়।
Published : 25 Oct 2024, 08:41 AM
কারো গায়ে যদি ফোঁড়া থাকে আর সারাক্ষণ তাতে টনটন ব্যথা করে তাহলে যেমন নিশ্চিত হওয়া যায় যে সে সারাক্ষণ বেঁচে আছে, আমাদের দেশের পরীক্ষা থেকেও স্পষ্ট বোঝা যায় যে এখানে একটা জাঁদরেল শিক্ষাব্যবস্থা না থেকেই পারে না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে বেশি চোখে পড়বার দিকটাই হলো পরীক্ষা। এ পথ অনুসরণ করে আজকাল আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থারও সবচেয়ে বেশি চোখে পড়বার দিকটা হলো ডায়াগনোস্টিক সেন্টার বা রোগপরীক্ষা কেন্দ্র। চিকিৎসালয়টা নামমাত্র, ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের হাঁকডাকই বেশি। হাসপাতালের প্রয়োজনে রোগনির্ণয় কেন্দ্র গড়ে ওঠে না, রোগপরীক্ষাকেন্দ্রকে ঘিরে তার প্রয়োজনে গড়ে উঠছে হাসপাতাল। পরীক্ষাটা আমরা যারপরনাই বুঝি। পরীক্ষাবিশেষজ্ঞ রয়েছেন এদেশের শিক্ষাব্যবস্থায়, যারা পরীক্ষায় কী কী আসবে তা আগাম বলতে পারেন। অনেক টাকা খরচ করে শিক্ষার্থীদের সেই আগাম বাণী কিনতে হয়, অনেকটা দেলফির মন্দিরের মত যদিও সেখানকার আগাম বাণীগুলো অন্তত সবার জন্য ফ্রি ছিলো।
পুঁজিবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, বিকাশের এক পর্যায়ে এই চমৎকার ব্যবস্থায় কুকুরে আর লেজ নাড়ায় না, লেজেই কুকুর নাড়ায়। লেজটা যদিও শুরুতে কুকুরের প্রয়োজনেই জন্ম নিয়েছিলো, পরে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যেন লেজের প্রয়োজন মিটাতেই কুকুরের জন্ম। শরীরের ভেতর জন্ম নেওয়া কোনো কোনো কোষ যেমন হঠাৎ ক্যান্সার কোষে পরিণত হয়ে পুরো দেহটাকেই খেয়ে ফেলতে মরিয়া হয়ে ওঠে; দেহের জন্য যেমন, সমাজের জন্যও এসব পরিস্থিতি ভয়ানক।
বাজার অর্থনীতির তাত্ত্বিক পিতা অ্যাডাম স্মিথ খুব দূরদৃষ্টিতার সঙ্গে অর্থনীতিতে একটি অদৃশ্য হাত কল্পনা করেছিলেন যেটি বাজারের সুষ্ঠু চলমানতা নিশ্চিত করে। কিন্তু জোসেফ স্টিগলিজসহ অনেকেই বলছেন, বাজারের সুষ্ঠু বিনিময় ব্যবস্থাপনার জন্য কোনো অদৃশ্য শক্তি নেই, আছে খুবই শক্তিশালী গণস্বার্থবিরোধী দৃশ্যমান হাতের কারসাজি। অর্থাৎ সেই একই সমস্যা— কুকুর লেজ নাড়ায় না, উল্টা লেজে কুকুর নাড়ায়। আমাদের বাকপটু রাজনীতিবিদরা রাজনীতিক্ষেত্রে এ সমস্যার কথা অনেকসময়ই বলেন। অতএব শিক্ষাক্ষেত্রে এমন হওয়াতো স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি স্বাভাবিক।
শিক্ষাব্যবস্থাকে যদি সৌরজগতের সঙ্গে তুলনা করি, তবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখনও দুই হাজার বছর আগের টলেমির যুগে পড়ে আছে। এই দিক থেকে যে, টলেমির ধারণায় যেমন পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে সকল গ্রহ-নক্ষত্র ঘুরছিল, এখানেও পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে শিক্ষাব্যবস্থা আর তার চারপাশে ঘুরছে শিক্ষার্থী। অথচ যা হওয়া উচিত তা হলো: একেবারে কেন্দ্রে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী, তাকে ঘিরে শিক্ষাব্যবস্থা ও তাকে ঘিরে পরীক্ষা। স্পষ্টতই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখনও কোপার্নিকাস-গ্যালিলিওর যুগে প্রবেশ করতে পারেনি।
সমস্যা হলো টলেমির এই পৃথিবীকেন্দ্রিক ধারণাটি মানুষের, বিশেষ করে শাসকগোষ্ঠির খুব প্রিয় ছিলো। কোপার্নিকাস তাই জীবিতকালে এ বিষয়ে তার বই (মৃত্যুর আগে মাত্র প্রকাশিত) প্রকাশের সাহস পাননি। সৌরকেন্দ্রিক ধারণাটি প্রকাশের জন্য গ্যালিলিওকে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছে। স্বভাবতই আমাদের শিক্ষাকে টলেমিয় ব্যবস্থা থেকে গ্যালিলিয় ব্যবস্থায় পরিণত করার কাজটি মোটেও সহজ নয়। শিক্ষায় চলমান টলেমিয় ব্যবস্থাটি দেশের ব্যবসায়ী, পয়সাওয়ালা গোষ্ঠি ও শাসককুলের স্বার্থের উপযোগী, তাই খুব পছন্দেরও।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ’ প্রবন্ধে ইংরেজি শিক্ষার প্রতি আসক্তি প্রসঙ্গে লিখেছেন, “ফুলের কীটের মতো আমাদের মন, মধুকরের মতো নয়। মুষ্টিভিক্ষায় যে দান সংগ্রহ করি ফর্দ ধরে তার পরীক্ষা দিয়ে থাকি। সে পরীক্ষায় পরিমাণের হিসাব দেওয়া; সেই পরিমাণগত পরীক্ষার তাগিদে শিক্ষা করতে হয় ওজনদরে। বিদ্যাকে চিত্তের সম্পদ বলে গ্রহণ করা অনাবশ্যক হয় যদি তাকে বাহ্যবস্তুরূপে গ্রহণ করি। এরকম বিদ্যার দানেও গৌরব নেই, গ্রহণেও না। এমন দৈন্যের অবস্থাতেও কখনো কখনো এমন শিক্ষক মেলে শিক্ষাদান যাঁর স্বভাবসিদ্ধ। তিনি নিজগুণেই দান করেন, নিজের অন্তর থেকে শিক্ষাকে অন্তরের সামগ্রী করেন, তাঁর অনুপ্রেরণায় ছাত্রদের মনে মনন-শক্তির সঞ্চার হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে বিশ্বক্ষেত্রে আপন বিদ্যাকে ফলবান করে কৃতী ছাত্রেরা তার সত্যতার প্রমাণ দেয়।” এই উদ্ধৃতির প্রথমাংশে আছে টলেমিয় শিক্ষাপদ্ধতির সমস্যার কথা, আর দ্বিতীয়াংশে আছে গ্যালিলিয় শিক্ষাপদ্ধতির সফলতার প্রমাণ।
পরীক্ষা আসলে কী সে আলোচনায় আসি। পরীক্ষা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, তাই শিক্ষাব্যবস্থারও, সন্দেহ নেই। তবু সৈয়দ মুজতবা আলীর সেই বিখ্যাত উক্তি ‘কুইনাইন জ্বর সারাবে, কিন্তু কুইনাইন সারাবে কে?’— এর মত করে বলা যায়, পরীক্ষার বাণিজ্যিক নখ থেকে শিক্ষার্থীকে রক্ষা করবে কে? শিক্ষার্থীদের জন্য পরীক্ষা তার স্বাভাবিক চরিত্র হারিয়ে এন্টিবায়োটিকের অপব্যবহারের মত এক বিপদ তৈরি করেছে, যা থেকে বাঁচতে মানুষের জন্য আবার এন্টি-এন্টিবায়োটিক অথবা প্রোবায়োটিক চালুর প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে। স্কুল-কলেজে পরীক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে, একদিকে শিক্ষকের পাঠদান পদ্ধতি যাচাই করা ও কার্যকরী পদ্ধতি প্রয়োগ করা, এবং অন্যদিকে শিক্ষার্থীর শিখনসমস্যা খুঁজে বের করে তা অতিক্রমে তাকে সহায়তা করা। এতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়েরই যাচাই ও কল্যাণ হয়। এর উদ্দেশ্য মোটেও কাউকে ব্যর্থ, হেয় ইত্যাদি প্রমাণ করাতো নয়ই, বরং শিখন-শেখানো সফল করার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর এগিয়ে যাওয়া নিশ্চিত করা।
তবে জীবনে সব পরীক্ষা একরকম নয়। উচ্চশিক্ষায় ভর্তির বা চাকরির পরীক্ষায় অবশ্যই প্রার্থীর যোগ্যতা যাচাই করতে হবে, সেটাই মুখ্য উদ্দেশ্য। সেরকম পরীক্ষার উদ্দেশ্য— সমাধানের জন্য কারো সমস্যা চিহ্নিত করা নয়, বরং যোগ্যদেরকে আলাদা করে বের করা। সেখানে প্রতিযোগিতায় অনেকে হেরে যাবেন ও বাদ পড়বেন, এটাই স্বাভাবিক। সে পরীক্ষা ছাঁকনির মতো, যদিও এমন নয় যে, সে ছাঁকনি নির্ভুল। ভুল আর নির্ভুল যাই হোক না কেন, আসনসংখ্যা নির্দিষ্ট হওয়ায় অনেককে বাদ দিতেই হয়। সে কারণে একটা লটারি বা পরীক্ষাগোছের কিছু ব্যবস্থা করে হলেও বাদ দেওয়াটা যৌক্তিক করতে হবে। লটারির চেয়ে পরীক্ষা ভাল। এরকম একটা ব্যবস্থা না থাকলে পুরো রিক্রুটমেন্টই দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা শতভাগ।
কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে পরীক্ষা, দশ-বারো বছর পরের জাতীয় পরীক্ষা বাদ দিলে, তা কাউকে বাদ দেওয়ার উদ্দেশ্যে ও ভাল বা মন্দ চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে নয়। কাউকে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় কিংবা গায়ে মেধাবী, মেধাহীন ইত্যাদি লেবেল এঁটে দেওয়ার উদ্দেশ্যে নয়। এ হচ্ছে সম্পূর্ণই শিক্ষকের নিজের পাঠদান ক্ষমতা ও কৌশল যাচাই করার ও কার্যকর পদ্ধতি অনুসন্ধানের জন্য এবং শিক্ষার্থীর দুর্বলতা দূর করার জন্য। অথচ আমাদের দেশে স্কুলকলেজে সারাবছরের সব পরীক্ষাই হয় চাকরির পরীক্ষার মত করে বাদ দেওয়ার উদ্দেশ্যে। এসব পরীক্ষায় যারা ভাল করতে পারেন না, তারাও আস্তে আস্তে বাদ পড়ে যেতে থাকেন, চোখের আড়ালে।
এসব পরীক্ষার মাধ্যমে প্রথমেই শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে ভাল-খারাপ চিহ্নিত করে ফেলেন এবং নিজের সাফল্যের ফন্দি আাঁটেন। তিনি ক্লাসে তার চিহ্নিত ‘তথাকথিত’ খারাপ শিক্ষার্থীর প্রতি মনোযোগ কমিয়ে দেন। তারা নীরব অবহেলার শিকারে পরিণত হয়। শিক্ষক কেবল তার চিহ্নিত ‘তথাকথিত’ মেধাবী ভাল শিক্ষার্থীর প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়েন। শিক্ষকের সাফল্যের সহজ সিঁড়ি হিসেবে তেলে মাথায় তেল ঢালা শুরু হয়। ‘তথাকথিত’ মেধাহীনদের পায়ের নিচ থেকে সিঁড়িগুলো সরে যেতে থাকে অলৌকিক উপায়ে। শুরু হয় ‘তথাকথিত’ মেধাবীদের পায়ের তলায় নতুন নতুন সিঁড়ি বসানোর সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্র। কিন্তু এইসব মেধাবী তারকারা বেশিরভাগ সময় বিশ্বপরিমণ্ডলে কেরানির ভূমিকাই রাখে। এই সফলদের দ্বারা পরিপূর্ণ দেশের সব প্রতিষ্ঠানই এখন নৈতিক মানদণ্ডে বিশ্বের তলানিতে পৌঁছে যাওয়ার উপক্রম।
বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ স্যার কেন রবিনসন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ৩টি মৌলিক উপাদানের কথা বলেছেন, যা হলো: পাঠক্রম, শিক্ষাদান পদ্ধতি ও পরীক্ষা। পরীক্ষা বিষয়ে তিনি তার বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন, একধরনের পরীক্ষায় শিক্ষার্থীরা কী পারে ও কী না পারে তা জানা হয়, আরেকধরনের পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীকে অন্য কারো সঙ্গে তুলনা করা হয়। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন তিনি একজন নাচের ছাত্রীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন তার ৪ বছর নাচ শেখার অগ্রগতি কী। উত্তরে মেয়েটি বলে, সে ‘বি’ পেয়েছে। এতে আসলে তার নাচ শেখা সম্পর্কে কিছুই জানা গেল না, শুধুমাত্র তার সঙ্গে অন্য কারো তুলনার একটা ধারণা পাওয়া গেল। তিনি পরীক্ষার কার্যকারিতা উল্লেখ করেছেন ডায়াগনস্টিক হিসেবে, অর্থাৎ যেখানে তার সমস্যা নির্ণয় করা হবে তা দূর করার লক্ষ্য নিয়ে।
আমাদের স্কুলকলেজে পরীক্ষা নেওয়া হয় ক্লাসে সবার ডায়াগনস্টিক রেজাল্ট দিয়ে একজনের সঙ্গে আরেকজনের তুলনা বা র্যাঙ্কিং তৈরির জন্য। এরপর মা-বাবাকে ফল জাানানো হয় যাতে তারা সন্তানের রেজাল্ট ভাল করার উদ্যোগ নেন। শিক্ষকের ভূমিকা এখানেই শেষ। বাবা-মা তখন সন্তানের উপর চাপ তৈরি করেন, প্রাইভেট টিচার নিয়োগ করেন, কোচিংয়ে দৌড়ান, চারদিকে ছোটাছুটি শুরু হয়। যেসব মা-বাপের পক্ষে তা সম্ভব হয় না, তারা সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশ হয়ে পড়েন বা তা ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেন। এখনকার পরীক্ষার মৌলিক সমস্যাই হচ্ছে এ শুধু পারস্পরিক তুলনা করার জন্য, মানে কে কার চেয়ে ভাল বা মন্দ তা নির্ধারণের জন্য। আর এভাবে এই তুলনামূলক পরীক্ষা পরিণত হয়েছে এক বিরাট ইন্ডাস্ট্রি বা ব্যবসায়। রবিনসনের মতে যুক্তরাষ্ট্রে এটি মাল্টিবিলিয়ন ডলার ইন্ডাস্ট্রি। ওখানে তবু অন্য অনেক ব্যবসা আছে, তার মাঝে শিক্ষা একটা মাত্র। আর আমাদের মত পিছিয়ে থাকা দেশে পরীক্ষাই সব ব্যবসার মাঝে সেরা, চ্যাম্পিয়ন।
আমাদের পুরো শিক্ষাব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে শিক্ষার্থীদের মাঝে এই তুলনার কায়দাটা চৌকস করা নিয়ে, এরই নাম শিক্ষা। তুলনা শিশুদের প্রিয়, সুবিধাভোগী গোষ্ঠী ও শাসককুলের কাছে তা আরও বেশি প্রিয়। কারিকুলাম ও পরীক্ষা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা আমাদের শিশুর মত সরল শাসকদের কাছে তাই খুবই শখের জিনিস। টলেমিয় নভোব্যবস্থাও যেমন অনেকেরই প্রিয় ছিলো। এখন পরিবর্তন প্রয়োজন।