বিদেশিদের হাতে যেন না যায় রাজনীতি

বিদেশিদের হাতে বা তাদের অভিভাবকত্বে যদি রাজনীতি চলে যায় বা যাবার কোনো আশঙ্কা তৈরি হয়, তার জন্য প্রধানত দায়ী হবে শাসক দল। তাই তাদের উচিত সরকার পরিচালনায় দেশের মানুষকে সঙ্গে রাখা। কেননা, বিদেশিদের হাত থেকে দেশের রাজনীতি বাঁচাবে দেশের এই সব মানুষ।

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 9 June 2023, 08:21 AM
Updated : 9 June 2023, 08:21 AM

দেশের রাজনীতি বিদেশিদের হাতে চলে যাচ্ছে–অভিযোগটা যেমন সত্য, তেমনি এর ধারাবাহিকতাও আমাদের মনে রাখা দরকার। আজকাল রাজনীতিতে মানুষের মন নেই। মন না থাকার কারণ এই না যে, তাদের দুঃখ কষ্ট বা বেদনা নেই। না তাদের সব চাওয়া পাওয়ার মীমাংসা হয়ে গেছে। মূলত দুনিয়ার কোনো দেশের কোনো সমাজেই এখন তারুণ্যের ভেতর রাজনীতি খুঁজে পাবেন না। তাদের মনোজগৎ সম্পূর্ণ বদলে গেছে। যে সময়টায় আমরা বড় হচ্ছিলাম তখন দেশে নানা ধরনের অশান্তি আর অপশাসন চলছিল। একজন সামরিক জান্তা আর একদল সিভিলিয়ানের শাসনে পার্থক্য তো থাকবেই। সিভিলিয়ান বা নাগরিক শাসনের জন্য যেসব রাজনৈতিক দল থাকে, তাদের আর যাই হোক জনগণের কথা মাথায় রেখে কাজ করতে হয়। ওই দৃষ্টিকোণ থেকে আওয়ামী লীগ একটি বিশাল ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল। বিএনপি তার ছায়া অনুগামী না হলেও বড় শক্তি। দল বনাম শক্তি এ দুইয়ের লড়াইয়ে এখন বাংলাদেশের মানুষ ক্লান্ত। অন্যদিকে তারুণ্যের উপস্থিতি নেই কোথাও। 

বিদেশিদের হাতে বা তাদের অভিভাবকত্বে যদি রাজনীতি চলে যায় বা যাবার কোনো আশঙ্কা তৈরি হয়, তার জন্য প্রধানত দায়ী হবে শাসক দল। তাদের উচিত দেশের মানুষকে সঙ্গে রাখা। কেননা, বিদেশিদের হাত থেকে দেশের রাজনীতি বাঁচাবে দেশের মানুষ। কিন্তু নিরপেক্ষভাবে বললে শাসকদলের গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার এই প্রবণতা পুরনো। পুরনো বলছি এই কারণে, যতবার দেশে নির্বাচন হয়েছিল ততবারই তাদের নজরদারির দরকার পড়েছিল। একবার জাতীয় নির্বাচন উপলক্ষে ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেটার প্রয়াত নবাব মনসুর আলী খান পতৌদি এসেছিলেন চট্টগ্রামে। নির্বাচন পরখ করে বলে গেছেন, না মোটামুটি ঠিকই আছে সব। এটা একটা নাম বা ঘটনা মাত্র। আমেরিকা-ইউরোপ এমনকি অস্ট্রেলিয়ার মানুষজনও বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়া দেখেছেন, বারবার সফর করেছিলেন– এসব তথ্য সবারই জানা। আজকাল আমেরিকার আধিপত্য বা তাদের কথাবার্তা নিয়ে ফেইসবুক কিংবা স্যোশাল মিডিয়া যে সরগরম তা এসব কিছুরই এক ধরনের ডিজিটাল রূপান্তর। 

আওয়ামী লীগ দীর্ঘসময় ধরে দেশ শাসনে থাকায় দেশের যে উন্নতি তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তার পিতার স্বপ্ন অনেকটাই পূরণ করতে পেরেছেন। কিন্তু এত ছোট একটা দেশের এতবড় জনসংখ্যা সামলানো ও তাদের দেখভাল করা সহজ কিছু নয়। ওই জায়গায় তিনি যতটা সফল তার দল ততটাই প্রশ্নবিদ্ধ। নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে মানুষজনের ভেতর উদ্বেগ, উৎকন্ঠা আর আবেগ বাড়ছে। রাজপথে বিএনপি ব্যর্থ হলেও ভোটের বাক্সে তাদের জন্য কী ফলাফল থাকতে পারে তা অনুমান করা কঠিন নয়। 

গত কিছুদিনে নানা সমস্যা আর সংকট প্রকট হয়ে পড়ায় সরকারি দলের মনোভাবও পরিবর্তনের পথে বলে মনে হচ্ছে। যার নমুনা দেখলাম সংবাদপত্রে। এতদিন ধরে প্রায় নিখোঁজ সিনিয়র নেতাদের আবার দেখা মিলতে শুরু করেছে। চাঙ্গা হয়ে উঠতে চাইছে চৌদ্দদলীয় জোট। রাজনীতির জন্য এটি সুসংবাদ। অন্যদিকে বিএনপি কি তার জোট নিয়ে রাজপথে নামবে নাকি আলাদা করে– ওই জিজ্ঞাসাও থাকছে জনমনে।

গণতন্ত্র অব্যাহত রাখার স্বার্থে বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় বসতে আওয়ামী লীগের আপত্তি নেই বলে জানিয়েছেন দলটির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু। বিএনপির সঙ্গে আলোচনার কথা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বারবার নাকচ করে আসলেও গত ৬ জুন এক সমাবেশে বর্ষীয়ান এ রাজনীতিকের এমন বক্তব্য এলো। ১৪ দলের সমন্বয়ক আমু দাবি করছেন, শেখ হাসিনাই বলেছেন যে আলোচনার দ্বার খোলা। আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ১৪ দলের সমাবেশে বিএনপিকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘আমরা পরিষ্কার বলতে চাই, সংবিধানের ভিত্তিতে দেশ পরিচালিত হচ্ছে, যে কোনো সমাধান, যে কোনো কিছু করতে আমরা প্রস্তুত। আসুন, গণতন্ত্রকে অব্যাহত রাখার স্বার্থে আমরা আপনাদের সঙ্গে বসতে রাজি আছি। শেখ হাসিনা বলেছেন, আলোচনার দ্বার খোলা। তিনি বলেছেন, যে কোনোভাবে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে তিনি প্রস্তুত।’ ওই সভায় ১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু ‘জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় আলোচনা হতে পারে’ বলে প্রস্তাব রাখেন, যদিও পরে তিনি সেই বক্তব্য থেকে সরে এসেছেন।

বিরোধী দল এর যা ব্যাখ্যা দিক বা যা-ই বলুক না কেন এর ইতিবাচক দিকটা দেখা দরকার। এতদিন ধরে আলোচনার ওপর যে জগদ্দল পাথর চেপে বসেছিল এবার কি তা সরবে? আমেরিকার কথায় যাবার আগে বলতে চাই গণতন্ত্র মানে কিন্তু পারস্পরিক শ্রদ্ধা আর সম্মান। বিএনপি বরাবর এ জায়গাটায় ব্যর্থ। তাদের শিষ্টাচারজনিত সমস্যার কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বহুবার আলোচনা বা সমঝোতায় আসতে পারেননি। তাকে ভবনের ফটকে রেখে দুয়ার না খোলার ইতিহাসও আছে দেশে। অন্যদিকে সাংগঠনিক শক্তি আর লম্বা সময় ধরে দেশ শাসন আওয়ামী লীগের আত্মম্ভরিতা বাড়িয়ে দিয়েছে। যা গণতন্ত্রের জন্য হুমকি। বিশেষ করে লাগামহীন হয়ে পড়া দলের নেতৃত্ব আর কোনো ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকায় মনোপলি নামক বিষয়টা মাথাচাড়া দিয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচন নিয়ে দেশে যে সংকট আর অস্বচ্ছতা সেটাই আমেরিকাকে সাহস দিয়েছে নাক গলানোর।

কখনো ডলার সংকট, কখনো রিজার্ভের নিম্নগামিতা, কখনো টাকা পাচার এবং সর্বশেষ বিদ্যুৎ সংকটে নাকাল দেশবাসী। এই সমস্যাগুলো নতুন নয়। কিন্তু এতটা প্রকটভাবে দেখা যায়নি কখনো। বলাবাহুল্য আওয়ামী লীগের আমলে দেশে-বিদেশে ষড়যন্ত্র বেশি হয়। কারণ, এই ষড়যন্ত্র ও ইতিহাস সমার্থক। যখন থেকে বিএনপি তখন থেকেই মুসলিম লীগ আর জামায়াতের আবার রাজনীতিতে নামার শুরু। তারাই মূলত কলকাঠি নাড়ায়। মনে রাখা প্রয়োজন যখন আইএসআই এবং পাকিস্তান সবল ছিল তখন ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত হতো দ্রুত। এখন সময় তাদের সঙ্গে নেই। কিন্তু বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়, এ কথা লেখা থাকলেও বাস্তবে তা মানা কঠিন। এখন বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী হওয়া যে কোনো দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাদেরও লাভ আছে। নিকট প্রতিবেশী বড় দেশ ভারত। তাদের দাদাগিরি আগেও ছিল। এখন তারাই চাইবে সবচাইতে বেশি সুযোগ। এদিকে চীন তার হাত প্রসারিত করে বসে আছে। যদিও চীনের মতো সাহায্য ভারত করতে পারবে না। কিন্তু চীনা বিনিয়োগের কুফলে বেশ কয়েকটি দেশের এখন ত্রাহি ত্রাহি দশা। কিছুদিন আগে নরেন্দ্র মোদীর সফরকালে প্যাসিফিকের সম্পদশালী দ্বীপরাষ্ট্র পাপুয়া নিউগিনির শাসক তার পা ছুঁয়ে সালাম করার পাশাপাশি স্পষ্ট করে ভারতকে বলেছে চীন ও প্রতিবেশী দেশের হাত থেকে তাদের উদ্ধার করার জন্য। বাংলাদেশের আরেক সহযোগী দেশ জাপান। জাপানের কথা ও কাজ অসামান্য। কিন্তু তারা আমেরিকার অনুগামী।

সব মিলিয়ে এই জমজমাট সমীকরণ আর দ্বন্দ্বের মাথায় আমেরিকা হয়েছে নাখোশ। তাদের বাহ্যিক নাখোশের কারণ নির্বাচন সংকট বা গণতন্ত্র হলেও আরও অনেক বিষয় জড়িত। সে আলোচনা অন্যদিন হবে। আপাতত যেটা বলার তা হলো, নির্বাচন সঠিক ও সময় মতো হলে আমেরিকার রাগ কমুক আর না কমুক ঝামেলা কমবে। অনায়াসে বলা যায়, একাত্তরেও আমরা আমেরিকার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে জিতেছিলাম। কিন্তু এবার বাস্তবতা ভিন্ন। পাশাপাশি এটাও মনে রাখা দরকার আমেরিকার ছোবলও কম খাইনি আমরা। তার মাশুল দিয়েছিলেন জাতির পিতা নিজে। তাই সাবধানতা প্রয়োজন। 

দেশের রাজনীতি বাইরের মানুষজনের হাতে চলে যাওয়ার জন্য সরকারকে দায়ী করে বসে থাকলে চলবে না। রাজনীতি বাইরের মানুষের কাছে যেতে না দেয়ার দায়িত্ব আমাদের। জনগণ সঙ্গে থাকলে কেউ এত সাহস করতে পারবে না। কিন্তু যে রাজনীতি হাস্যকর কৌতুক অভিনেতার মতো নেতার জন্ম দিতে চায়, তার তো হুঁশিয়ার থাকতেই হবে। তারুণ্য মাঠে আসবে না। মধ্যবিত্তেরও শিরদাঁড়া ভাঙ্গা। ফলে একমাত্র ভরসার জায়গা বৃহৎ জনগোষ্ঠী আর সচেতন মানুষ। তাদের সঙ্গে রাখা, সমালোচনা সহ্য করা আর বিরোধিতা না বাড়িয়ে সমঝোতা মানলে হয়তো আমরা পরিত্রাণ পেতে পারি।