১৬ বছর ধরে চলা মানুষের ক্ষোভ আর এর প্রকাশ ২০২৪ সালের জুলাই-অগাস্টের ইতিহাস থেকে নেওয়া শিক্ষা ভুলে যাওয়ার সাহস কেউ দেখাবে— এমন মনে হয় না।
Published : 20 Aug 2024, 10:45 AM
সারজিস ধর্মের ঢাক বাজানেওয়ালা— এই দোষে তাকে খারিজ করতে চাচ্ছি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দোষ ধরে যাচ্ছি একের পর এক। আচ্ছা, আমরা যদি সরকার হতাম, কীভাবে দেশ চালাতাম? প্রগতিশীলতার চর্চা কতক্ষণ করতে পারতাম? জানার ইচ্ছা ভীষণ।
এই সরকার ভালো নয়, বিএনপিও ভালো হবে না, তাহলে ভালো কে? সদ্যবিদায়ী সেই খুনি সরকার, যে কিনা এই আন্দোলনেই ৬৫০টি খুন এবং অসংখ্য গুম ও আহত করেছে? সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবি থেকে সরকার পতন আন্দোলন এবং তার পরবর্তী সহিংসতায় অন্তত ৬৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে তথ্য দিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাই কমিশনারের কার্যালয়-ইউএনএইচসিআর। মৃত্যুর মিছিল প্রতিদিন বাড়ছে। মৃতের তালিকায় ১৭ অগাস্টের ‘প্রথম আলো’র জরিপ অনুযায়ী চার থেকে ১৭ বছর বয়সী ৬৭ জন শিশুকিশোরকে পাওয়া গেছে– যাদের অনেকেই ছিল হকার, নির্মাণশ্রমিক, কারখানাকর্মী, পোশাকশ্রমিক। গত সরকারের ১৬ বছরের শাসনামলের বাকি হিসেবও নিশ্চয়ই আমাদের অজানা নয়। পিলখানা ও শাপলা চত্বর হত্যার দায় কি মিটে গেছে?
সারজিস ধর্মপ্রাণ মুসলমান— এটা যদি আমাদের কাছে পাপ হিসেবে ঠেকে, তাহলে লঘুপাপে গুরুদণ্ড হয়ে যাচ্ছে না তো! নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি শেখ হাসিনার ধর্মপ্রীতির কথা—৫০০ মসজিদ আর মাদ্রাসার প্রকল্প কিন্তু তিনিই নিয়েছিলেন। মহাজোটের (২০০৮) নামে হেফাজতে ইসলামসহ ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে ‘কৌশলগত সম্পর্ক’ রেখেছেন তিনিই। হেফাজতের দাবির মুখে পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন এনেছিলেনও তিনি। হেফাজত সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ভাস্কর্য সরানোর বিষয়ে আন্দোলন শুরু করলে গণভবনের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এটা (ভাস্কর্য) এখানে থাকা উচিত নয়।’ ওই অনুষ্ঠানেই কওমী মাদ্রাসার সনদের সর্বোচ্চ স্তরের স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা করেছিলেন শেখ হাসিনা। পেয়েছিলেন ‘কওমী জননী’ খেতাব। এর আগে কয়েক বছর ধরেই ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রা করলেও ২০১৭ সাল থেকে অনিয়মিত হয়ে যায় কেবল হেফাজতকে খুশি রাখতেই। ভুলে যাবেন না, একই ‘কৌশলগত’ কারণ দেখিয়ে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গেও জোট বেঁধেছিলেন তিনি। অথচ কদিন আগে কিনা সেই জামায়াতে ইসলামীকেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন! হা, হাসিনা, একই অঙ্গে এত রূপ!
শেখ হাসিনার আমলের রামু আর নাসিরনগরের ঘটনা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি? ভুলে গেলে আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিই। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ‘বৌদ্ধ পুরুষ’ নামে একটি ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে ধর্মকে অবমাননার অভিযোগের প্রতিক্রিয়ায় উত্তেজিত জনতা ১২টি বৌদ্ধমন্দির, মঠ ও ৫০টি বাড়িতে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল। প্রায় অভিন্ন অভিযোগে ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর নাসিরনগরে ১৫টি মন্দির ও তিন শতাধিক বাড়িঘরে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয়। এসব ঘটনায় করা ২৬টি মামলার মধ্যে কেবল ১টি মামলার রায় ঘোষণা করেছে আদালত। সংখ্যালঘু নির্যাতনের বাকি ঘটনাগুলোকেও নিশ্চয়ই বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে খারিজ করে দেওয়া যাবে না। এখন আমাদের ঘুম হারাম হয়ে যাচ্ছে, শেখ হাসিনার আমলে কেন মনে হলো না যে দেশ আফগানিস্তানের পথে?
আমরা আরেকদল আছি পোশাকের স্বাধীনতা নিয়ে। বড় টিপ আর হাতাকাটা ব্লাউজ পরার মধ্যেই যেন জীবনের সমস্ত স্বাধীনতা নিহিত। পোশাকের স্বাধীনতা হারানোর ভয় আমাদের আছে বৈকি, কিন্তু আমাদের এই সাধ কি ইয়ামিন আর মুগ্ধের জীবনের চেয়েও বেশি! ওরা আমাদের সন্তান নয় বলে আর কতদিন গ্রিক ট্র্যাজেডির ক্যাথারসিসের আনন্দ ভোগ করব? আমাদের সন্তান হয়তো আজকে ছোটো, হয়তো আজকে তাদের আটকে রাখতে পারছি, কিন্তু কতদিন সেটা পারব? আরও আরও বিপ্লব হবে, তখন আমাদের সন্তান কিংবা সন্তানের সন্তান যে মুগ্ধের জায়গা নেবে না, সেটা নিশ্চিত করে বলতে পারি কি? তখনও এদের হত্যা করার নির্দেশ দেবে কিন্তু কোনো-না-কোনো ফ্যাসিস্ট সরকারই। আমি সব মেনে নিতে রাজি, কিন্তু মায়ের বুক খালি করা পিশাচকে সরকার হিসেবে দেখতে রাজি নই। ‘প্রগতিশীলতা’ আর ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ নামক হ্যামিলনের বাঁশি শুনতেও রাজি নই আর।
আওয়ামী-বিএনপি— দুই আমলই তো দেখলাম; বিশেষভাবে সংরক্ষিত কিছু জায়গা ছাড়া পোশাকের স্বাধীনতা কোথাও কি পেয়েছি? কিছুদিন আগেই টিপ পরে হেনস্তা হয়েছিলেন লতা সমাদ্দার। কে করেছিল সেই হেনস্তা? পুলিশ। সেই পুলিশ কে ছিল? সরকারের চাকর। সেই ঘটনাও নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি। মাসখানেক আগেও বাজারে যাওয়ার আগে কপাল থেকে টিপ খুলে নিয়েছিলাম আমি। জানি, এখনো খুলতে হবে। সেই কারণেই বলছি, ‘পোশাকের স্বাধীনতা’ নামের জুজুর ভয়ে আর কতকাল ভীত থাকব!
ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসেবে আগেকার সরকারের একটা আলগা চাপ ছিল নিজেদের ধার্মিক প্রমাণের। তাই তারা মসজিদ বানাত, মন্দির ভাঙলে বিচারকার্য ‘ধীরে বহে মেঘনা’র গতিতে চালাত। একসময়কার আওয়ামী মুসলিম লীগ সর্বস্তরের মানুষের আস্থা পাওয়ার জন্য নাম থেকে ‘মুসলিম’ বাদ দিয়েছিল। যাদের ভোট তাদের জয়ী হওয়ার জন্য অনিবার্য ছিল একসময় তারাই হয়ে গেল সংখ্যালঘু এবং ধর্মনিরপেক্ষ মতাদর্শের কারণে এই সংখ্যালঘুদের আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোনো বিকল্প রইল না। এদিকে সংখ্যালঘুদের ভোট নিশ্চিত জেনে এদের প্রতি চূড়ান্ত উদাসীনতা দেখাতে লাগল আওয়ামী লীগ। আর জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলামসহ ধর্মভিত্তিক অন্যান্য দলগুলোকে হাতে রাখতে শেখ হাসিনা একের পর এক পদক্ষেপ নিলেন যা আওয়ামী লীগের আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই নিয়ে দুর্দান্ত এক গল্প লিখেছেন কথাসাহিত্যিক মশিউল আলম ‘বাংলা দেশ’ শিরোনামে। ‘বাংলাদেশ’ শব্দটির মাঝে একটি স্পেস দিয়ে লেখক সংখ্যালঘুদের প্রতি তাদের উদাসীনতা ও ধর্মীয় সংগঠনগুলোর সঙ্গে আওয়ামী লীগের ‘কৌশলগত সম্পর্ক’টা দেখাতে চেয়েছিলেন। এত কেচ্ছা টানার একটাই কারণ: সরকারে থাকাকালীন ধর্মের প্রতি আলগা প্রেম শেখ হাসিনাকে দেখাতে হয়েছিল তার প্রগতিশীল ভঙ্গির কারণে এবং ধার্মিক হওয়ার কারণে বিএনপির আলগা চাপ থাকবে নিজেদের উদার প্রমাণের।
২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের আমল দেখেছি। সবকিছুই স্বাভাবিক ছিল, আমরা নির্দ্বিধায় জিন্স পরেছি, ফতুয়া পরেছি। শিবিরের আমলেও ক্যাম্পাসে কনসার্ট হয়েছে, সরস্বতীপূজা হয়েছে। হল, বিভাগ আর অন্যান্য সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর অনুষ্ঠানও ব্যাহত হয়নি। হ্যাঁ, যেহেতু ফিল্ম সোসাইটিগুলো ছাত্রলীগের দ্বারা সংগঠিত ছিল, তারা আর ছবি প্রদর্শনের উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও এই অনুষ্ঠানগুলোকে শিবির মেনে নিয়েছিল। কারণ তারা জানত, ধর্মের ধ্বজা ধারণ করার জন্য শিল্পসংস্কৃতির পরিপন্থী হওয়ার একটা আলগা চাপ তাদের আছে। তাই গোটা ক্যাম্পাসের ইচ্ছাকে অগ্রাহ্য করার সাহস তারা করেনি।
বর্তমান সময়ে প্রগতিশীল সুশীল গোষ্ঠী সংখ্যায় কম হলেও এরা দেশের শক্তিশালী কণ্ঠস্বর। নিরন্তর সরকারের সমালোচনা করে সরকারকে চাপের মুখে এরাই রাখতে পারে। এত বড়ো একটা গোষ্ঠীকে অবহেলা করতে পারে কেবল স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার সরকারই। তবে তার আমলে এরা কতটুকু সমালোচনা করতে পেরেছে— এটাও দেখার বিষয়। হাসিনার আমল ছাড়া এরা কথা বলতে পারবে কি না তাও দেখার অপেক্ষায়। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে এরা কথা বলতে পারছে। সরকার এদের অগ্রাহ্য করবে বলে মনে করি না। আর সমালোচনা করলে বিএনপি তাদের জন্য আয়নাঘরেরর জায়গায় ‘বায়নাঘরে’ বন্দি করে ফেলবে— এটাও ধরে বসে থাকা যায় না। ১৬ বছর ধরে চলা মানুষের ক্ষোভ আর এর প্রকাশ ২০২৪ সালের জুলাই-অগাস্টের ইতিহাস থেকে নেওয়া শিক্ষা ভুলে যাওয়ার সাহস কেউ দেখাবে— এমন মনে হয় না।
সংবাদে দেখলাম, ২০২৪ সালের রোজার মাসে ক্যাম্পাসে কোরান পাঠের অনুষ্ঠান বন্ধের নির্দেশ দেওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আবদুল বাছিরকে দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছে শিক্ষার্থীরা। এই সময়ে ডিনের কক্ষে শিক্ষার্থীরা যা করেছে, সেটা আমাদের আঘাত দিচ্ছে বটে, কিন্তু তারুণ্যের ক্ষোভও ভুলে গেলে তো চলবে না। ওরা কিন্তু আঘাত করছে না, করছে প্রত্যাঘাত। একবার ভেবে দেখুন একই ক্যাম্পাসে ২০২৪-এর মার্চের ৯ তারিখে অনুষ্ঠিত হোলি উৎসব যদি জায়েজ হয় তাহলে কোরান পাঠে সমস্যা কোথায় ছিল? দেশটা যতটা সাধারণ মানুষের, যতটা প্রগতিশীলের, ততটাই ধর্মপ্রাণ মুসলমানদেরও। ধর্মের বাণী শুনতে ভালো না লাগলে ওই পথে না হাঁটলেই হয়, নিষেধাজ্ঞা কেন? ক্যাম্পাসে সরস্বতী পূজায়ও কিন্তু কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। আমার কোরান পাঠের অনুষ্ঠান কিংবা সরস্বতী পূজা দুটোর প্রতিই সমান সম্মান আছে। আমি চাই নিজের ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা প্রাণভরে নিজের ভালোলাগা কিংবা সে নিজে যে সংস্কৃতি ধারণ করতে পছন্দ করে তারই চর্চা করুক।
এখন জায়গায়-জায়গায় ক্যালিগ্রাফি আঁকা হচ্ছে, দেয়ালচিত্রে মেয়েদের মাথায় ঘোমটা দেওয়া হবে। এর কারণ: বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের মানসিকতাই এমন। শেখ হাসিনার আমলে ভয়ে এরা চুপ ছিল, এখন স্বাধীনতা পেয়ে আত্মপ্রকাশ করছে। মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠ এমন মানসিকতার দেশে আপনার-আমার মতো সংখ্যালঘুর প্রগতিশীলতার চর্চাই সবাই করবে— এই আবদার হাস্যকর। আর আমি যদি চাই গোটা দেশ আমার মতো করেই ভাববে, আমার মতোই শিল্পচর্চা করতে বাধ্য হবে, তাহলে আমার চিন্তাও যে ফ্যাসিবাদী চিন্তা— সেটাও মেনে নিতে হবে।
তবে এখনই হতাশ হওয়ার কারণ দেখি না। ১৬ বছর ধরে ওদের আঁকতে দেওয়া হয়নি। একটু অপেক্ষা করি, অবদমন প্রশমনের প্রথম ধাক্কাটা কেটে গেলে ঘোমটা-পরা বালিকার ছবি আঁকা কমে যাবে বলেও আমার বিশ্বাস। এই দেশ যতটুকু আমার, ততটুকু বাকি সবারও। মিলেমিশে থাকতে চাই।