পাকিস্তানের নির্বাচন: ইমরানের বিজয় স্মরণীয় হয়ে থাকবে

জনগণ সেনাছাউনির সাজানো ছক তছনছ করে দিয়েছে। ইমরানের নিষিদ্ধ ঘোষিত দল পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্রদের সর্বাধিক আসনে বিজয়ী করে সেনাদের সাজানো নকশা ভণ্ডুল করে দিয়েছে।

মঞ্জুরে খোদামঞ্জুরে খোদা
Published : 13 Feb 2024, 06:56 PM
Updated : 13 Feb 2024, 06:56 PM

এক বছর ১০ মাস আগে ইমরান খানকে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। সেই ক্ষমতাচ্যুতির নেপথ্যে ছিল যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ইন্ধন। ইমরান খানও তার একাধিক বক্তব্যে ওই কথা ক্ষোভের সঙ্গে বলেছেন। আর এর মূল কারিগর ছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক অ্যাসিসটেন্ট সেক্রেটারি ডনাল্ড লু— এমনটি দাবি করেছিলেন ইমরান খান নিজেও। তার সেই বক্তব্যের প্রমাণ পাওয়া যায় মার্কিন সংবাদ মাধ্যম দ্য ইন্টারসেক্টে। গণমাধ্যমটি ডনাল্ড লু এবং ওই সময়ের পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আসাদ মজিদ খানের কথোপকথনের গোপন তারবার্তাটি প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন।

কেন ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করতে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ইন্ধন দিয়েছিল? এর পেছনে প্রধানত দুটি বিষয় কাজ করেছে। এক, ইমরান খানের কিছু কর্মকাণ্ড মার্কিন নীতি বিরোধী হওয়ায় তারা এমন সিদ্ধান্ত নেয়। যেমন, রাশিয়া যখন ইউক্রেইন অভিযান শুরু করে ওই সময় ইমরান খান রাশিয়া সফরে যান ও রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই সময় তিনি ইউক্রেইন প্রশ্নে পাকিস্তানের নিরপেক্ষতার কথা বলেন। দুই, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গেও ইমরানের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না। ওই দ্বন্দ্বের একটি বড় কারণ ছিল, ইমরান পাকিস্তানের রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থাকে অধিক জনকেন্দ্রিক করতে চেয়েছিলেন, যা সেনা কর্মকর্তাদের পছন্দ ছিল না।

সুতরাং প্রধানমন্ত্রী ইমরানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে তাকে ক্ষমতা থেকে সরানো হয়। ইমরান এতে দমে না গিয়ে মানুষের ওপর আস্থা না হারিয়ে প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে পড়েন। ওই সময় এতটাই তীব্র প্রতিবাদ হয়েছিল যে, তার সমর্থকরা পাকিস্তানের সেনা চৌকিতে পর্যন্ত হামলা করেছিল। সে সময় তাকে হত্যার চেষ্টাও করা হয়েছে। তিনি আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে বেঁচে যান, কিন্তু তার একজন কর্মী নিহত হন। এর আগেও তার ওপর আত্মঘাতী হামলা হয়েছিল। তিনি ও তার দল রাজপথে সব ধরনের বিপদ মোকাবেলা করেন। সরকারের অন্যায়-জুলুমের প্রতিবাদ ও অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি তোলেন। ওই আন্দোলনের পক্ষে ব্যাপক জনমত গড়ে ওঠে।

পাকিস্তানের শাসক দল নির্বাচনের আয়োজন করে ঠিকই, কিন্তু ইমরান খানকে নির্বাচনের বাইরে রাখার পাকা বন্দোবস্ত করে। কেননা, ইমরানের দল নির্বাচনে অংশ নিলে তাদের হিসেব মিলবে না। তাদের ভয় ইমরানের জনপ্রিয়তা। ইমরানকে ঠেকাতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তাদের হাতে থাকা সব অস্ত্রই ব্যবহার করে। পাকিস্তানের রাজনীতিতে ইমরান খান, তার দল ও মার্কাকে নিষিদ্ধ করা হয়। মামলা দিয়ে তাকে ২৪ বছরের জেল দেওয়া হয়। চেষ্টা করা হয় তার দল ভাঙ্গার। নেতা-কর্মীদের ওপর সীমাহীন দমন-পীড়ন চলে। জেলে পোরা হয়। কিন্তু তাদের মনোবল টলানো যায়নি।

ইমরান খানের বয়স ৭২। দুটি মামলায় তাকে ২৪ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। সেই হিসেবে ২৪ বছর পর যখন তিনি জেল থেকে ছাড়া পাবেন তখন তার বয়স হবে ৯৬ বছর। তিনি কি ততদিন বেঁচে থাকবেন? বেঁচে থাকলেও কি কর্মক্ষম থাকবেন? এ তো গেল দুই মামলার রায়! তার বিরুদ্ধে আরও ১০টি মামলা বিচারাধীন! তার মানে পাকিস্তানের রাজনীতি থেকে তার বিদায়ের সব ব্যবস্থা করা হয়েছে। 

ইমরানকে নির্বাচনে হারাতে-ঠেকাতে ব্রিটেনে নির্বাসনে থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। অন্যান্য দলগুলোর সঙ্গে গোপন সমঝোতা করা হয়েছে। 

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেও ইমরান খানের লোকজন কৌশলে সারাদেশে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে যায়। তারা সরকার ও সেনাবাহিনীর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও আত্মবিশ্বাসের দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। বিদেশী প্রভুর আশ্বাস ও বিরোধিতার তোয়াক্কা করেনি তারা। জনগণের শক্তিতে ভরসা রেখেছে। দল-মার্কা-মূল নেতাদের নিষিদ্ধ করলেও দলের সদস্যরা নির্বাচন করেছে। নির্বাচনে এআই (আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স) প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে জেলে থাকা ইমরান ও অন্যান্য নেতাদের বক্তব্য প্রচার করেছে। এআই ব্যবহার করা কতটা নৈতিক হয়েছে এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। তবে এতে করে মানুষের সহানুভূতি ও সমর্থন আদায় করেছেন ইমরান খান। নির্বাচনে তার দলের প্রার্থীরা, যাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোট করতে হয়েছে, সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছেন।

নানা সূত্র বলছে, ৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের নির্বাচনের ফল পাল্টে দেয়ার বহুবিধ চেষ্টা চলেছে। একদিনে ফলাফল প্রকাশ করা হয়নি। ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সেনাবাহিনী নির্বাচন কমিশনকে ভোটের ফলাফল পরিবর্তন করতে নানাভাবে চাপ দিয়েছে কিন্ত কাজ হয়নি।

এতকিছুর পরও শেষ রক্ষা হয়নি। জনগণ সেনাছাউনির সাজানো ছক তছনছ করে দিয়েছে। ইমরানের নিষিদ্ধ ঘোষিত দল পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্রদের সর্বাধিক আসনে বিজয়ী করে সেনাদের সাজানো নকশা ভণ্ডুল করে দিয়েছে।

এই নির্বাচন নিয়ে পাকিস্তানের কথিত মিত্র দেশগুলোও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আগ্রহোদ্দীপক বিষয় হচ্ছে, যারা ইমরানকে ক্ষমতা থেকে সরাতে নেপথ্যে কলকাঠি নাড়লেন তারাই কিনা নির্বাচনে কারাসাজির কথা বলছেন। তার মানে ইমরানের জনপ্রিয়তায় তাদের সুর পাল্টে গিয়েছে। এটাই পশ্চিমা শক্তির গাছকাটা ও পানিঢালার নীতি। 

ইমরানের দলের স্বতন্ত্র সদস্যরা জেল গেটে ভিড় করছে নেতার নির্দেশনার জন্য। এআই ব্যবহার করে নেতার বক্তৃতা প্রচার করছে। বিরোধীরাও সুর পাল্টে তার শরণাপন্ন হচ্ছে। দূতাবাসগুলোও শুভেচ্ছা জানাতে শুরু করেছে। জনপ্রিয়তা থাকলে, জনসমর্থন থাকলে, জনগণের শক্তিতে ভরসা থাকলে বুলেট কোনো কাজে লাগে না, ব্যালটই সে প্রশ্নের উত্তর দেয়।

এক মাসের ব্যবধানে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। আমার এক লেখায় পরিস্থিতি বিবেচনায় বলেছিলাম, বিএনপি নির্বাচনে না এসে ভুল করল। তারা আওয়ামী লীগের সাজানো ছকে পা রেখে নিজেরা ক্ষতিগ্রস্থ হলো। পাকিস্তানে পিটিআই, ইমরান, দলের মূল নেতৃত্ব জেল অথবা আত্মগোপন থেকে সেনাবাহিনী ও পশ্চিমা শক্তির বৈরিতায় নির্বাচন করে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়েছে। সেটা কীভাবে সম্ভব হলো? তারা যদি জনগণের শক্তিতে আস্থা রেখে সরকার, সেনাবাহিনী, পশ্চিমা শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করে জিতে আসতে পারে তাহলে বিএনপি কেন ওই ভরসা করতে পারল না? এখানে বিএনপি ও দলীয় প্রতীক কোনোটিই নিষিদ্ধ করা হয়নি। মূল নেতৃত্ব সে অর্থে জেলেও নেই। তাদের সঙ্গে অন্যান্য নেতা ও দলের যোগাযোগ ছিল। তারপরও তারা নির্বাচনে না যাওয়ার মতো একটি অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিল, তার কারণ বোধগম্য নয়।

পিটিআই চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার গওহর আলী খান। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি শিগগির পিটিআইকে সরকার গঠনের জন্য আহ্বান করবেন বলে জানিয়েছেন গহর। অন্যদিকে মুসলীম লীগের নওয়াজ শরীফ সরকার গঠনের কথা বলছেন। এখন সরকারপ্রধান যাকে আহ্বান করবেন তিনিই হয়তো সরকার গঠন করবেন। যে-ই সরকার গঠন করুক তাকে জোট সরকার গঠন করতে হবে। যদিও পাকিস্তানের জোট সরকারের ইতিহাস-অভিজ্ঞতা খুব ভালো নয়। ক্ষমতার রাজনীতিতে সেনাবাহিনীকে আস্থায় নেয়ারও প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইমরান খানকে সেনা সমীকরণেই ক্ষমতাচ্যুত হতে হয়েছে। পাশাপাশি সরকার ও দেশ-বিদেশের নানা স্বার্থ-সমীকরণ তো আছেই।

পিটিআইয়ের স্বতন্ত্র সদস্যরাও মন্ত্রীত্বসহ নানা ধরনের প্রলোভনের মুখে পড়বেন এবং পড়ছেনও। ইতোমধ্যে একজন মুসলিম লীগে যোগও দিয়েছেন। সর্বশেষ ঘোষিত ২৬৫ আসনের ফলাফলে জাতীয় পরিষদে ১০১ আসনে জয়লাভ করেছেন স্বতন্ত্ররা যার মধ্যে ৯৩ জনই হলেন ইমরান সমর্থিত। এরপরই পাকিস্তান মুসলিম লীগ–নওয়াজ (পিএমএল-এন) ৭৫ আসনে, পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) ৫৪ ও মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট পাকিস্তান (এমকিউএম) ১৭ আসনে জয়ী হয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য দল পেয়েছে ১৭টি আসন।

পিপিপি নেতা বিলওয়াল ভুট্টোকে প্রধানমন্ত্রী করার শর্তে জোট সরকার গঠন নিয়ে পিপিপি ও পিএমএল-এন এর মধ্যে এক ধরনের বোঝাপড়ার চেষ্টা চলছিল। অবশ্য এরই মধ্যে পিএমএল-এন ও পিপিপি দীর্ঘ আলোচনার পর নতুন সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। পাকিস্তানের জিও নিউজ জানায়, নওয়াজের দলের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থীকে সমর্থন দেবে বলে জানিয়েছেন পিপিপি-র প্রধান বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি। তাছাড়া, কেন্দ্রীয় সরকারে তার দল অংশ হবে না বলেও তিনি জানিয়েছেন।

মঙ্গলবার রাজধানী ইসলামাবাদে দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে এই ঘোষণা দেন পিপিপি চেয়ারম্যান বিলাওয়াল। এর ঘোষণার মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড় থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন তিনি। কারণ, পিপিপি কেন্দ্রে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় জনরায় পায়নি।

বিলাওয়াল বলেছেন, পিএমএল-এন ও স্বতন্ত্ররা জাতীয় পরিষদে পিপিপি-র চেয়ে বেশি আসনে জয়ী হয়েছে। পিটিআই পিপিপির সঙ্গে জোট গঠনে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। ফলে পিপিপি-কে সরকারের যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো একমাত্র দল পিএমএল-এন।

‘দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতেই পিপিপি সিদ্ধান্ত নিয়েছে পিএমএল-এন প্রার্থীকে প্রধানমন্ত্রী পদে সমর্থন দেওয়ার’, বলেছেন বিলাওয়াল।

অন্যদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুবাদে ইমরানের দল পিটিআইও নানা প্রক্রিয়ায় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল সরকার গঠনের নতুবা সংসদে বৃহত্তম বিরোধী দলের মর্যাদা পাওয়ার।সে যাই হোক, নির্বাচনে পাকিস্তানের জনগণ যে সিদ্ধান্ত দিয়েছে তা গণতন্ত্রের পক্ষে এক অভূতপূর্ব উদাহরণ। ইমরান খান সরকার গঠন করতে না পারলেও পাকিস্তানের ইতিহাসে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।