সস্তাশ্রমে রক্তাক্ত উন্নয়নের নীতি

মুজতবা হাকিম প্লেটো
Published : 29 April 2013, 04:12 AM
Updated : 29 April 2013, 04:12 AM

'কথা বলেন ভাই, একটু সান্ত্বনা দেন' কথাটি এক শ্রমিকের। সাভারে ধসে পড়া ভবনে চাপাপড়া অবস্থায় নির্বিকার দৃষ্টি মেলে এ আকুতি জানান তিনি। জানি না তিনি উদ্ধার হতে পেরেছেন কিনা। ক্যামেরার লেন্সে এখন অন্যমুখ।

পোশাক শ্রমিকেরা কতবারই তো দলে দলে মরেছেন। এসব ঘটনা গোটা রাষ্ট্রকাঠামোকে বিচলিত করলেও সন্তোষজনক প্রতিকার মেলে কি? তবে মালিকদের গ্রেপ্তারের দাবি শ্রমিকের ঘর পেরিয়ে এবার গণমাধ্যমেও উঠে এসেছে। কারখানা ও ভবন মালিকই শুধু নয়, সরকারি কোন কোন কর্মকর্তার কী কী গাফিলতি ছিল তাও এখন আলোচিত হচ্ছে। অবশেষে গ্রেপ্তার হলেন সমালোচিত সবাই।

স্বাধীনতার কয়েক বছর পর থেকে সমৃদ্ধি অর্জনের একটি নির্দিষ্ট পথেই টানা হাঁটছে বাংলাদেশ। এ পথে অর্জনও আছে। আর একটু সবুর করলেই মধ্যআয়স্তর ছুঁয়ে ফেলা যাবে। বিশাল বিশাল নগর, সুউচ্চ সব ভবন, জাঁকজমকপূর্ণ গাড়ি, ঝলমলে রেঁস্তোরার ছড়াছড়ি এখন এ দেশে। এক বন্ধুর কাছে শুনেছি, সাতচল্লিশের পর কোলকাতা থেকে ঢাকার সদরঘাটে এসে সন্ধ্যায় সড়কে টিমটিমে গ্যাস-বাতি জ্বলতে দেখে তার বাবার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল এ রকম, 'এ কোথায় এলুম রে বাবা!' সাতচল্লিশ তো বটেই, মুক্তিযুদ্ধের পর সত্তরের দশকেও ঢাকা ছিল এমন মলিন, দীনহীন।। সে ঢাকার সঙ্গে বর্তমানের ঢাকার বিরাট তফাত।

এ প্রবৃদ্ধি অর্জনে খোলাবাজারে 'সস্তাশ্রমনীতি' ধ্রুবতারার মতো অনুসরণ করে এসেছে বাংলাদেশ। মজুরি কমিয়ে রাখতে এবং একে নির্বিঘ্ন করতে রাষ্ট্র মালিকদের সবরকম সহায়তাও করেছে। স্বাভাবিক কারণেই 'সস্তায় খাওয়ার সংস্কৃতি' মজুরিতে সীমাবদ্ধ না থেকে ছড়িয়েছে সর্বত্র। প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ ছাড়াই কারখানা গড়ার কাজে মালিকদের কখনওই নিরুৎসাহিত করা হয়নি। ফলে গত কয়েক বছরে একেকটি কারখানায় আগুনলাগা বা দুর্ঘটনার ফলে শত শত শ্রমিকের প্রাণ যায় আর কেঁপে ওঠে দেশ। এগুলো বিচ্ছিন্নভাবে নয়, প্রতিনিয়তই ঘটছে। আবার শুধু ঘটছে বলাও যেন ভুল হবে, স্বাভাবিকও যেন হয়ে উঠছে।

বাইরের বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা, এ দেশ গরিব, নিরুপায়। কিন্তু যেসব শক্তিশালী দেশ সস্তাশ্রমকে বাজারদখলের হাতিয়ার বানিয়েছে সেখানেও তো একই চিত্র। সস্তাশ্রম বেচে খাওয়া দেশগুলোর মধ্যে প্রধান হল চীন। ১৯৭৮ সাল থেকে সেখানে বেসরকারি মালিকানায় কারখানা গড়ার অনুমতি দেওয়া হয়। সে অর্থে বাংলাদেশ ও চীন প্রায় একই সময়ে সস্তাশ্রমে নির্ভর করে বিশ্ববাজারে ঢুকতে শুরু করে। বিশ্ববাজার দখলের মস্ত খেলোয়াড় চীনের উন্নতির চমক অনেক। লাল পতাকার দেশে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনায় অসংখ্য শ্রমিকের প্রাণহারানোর ঘটনা এভাবেই আড়াল হয়ে যায়।

সম্প্রতি রয়টার্স প্রকাশিত গত দু'দশকে গোটা বিশ্বে সংঘটিত ২১টি দুর্ঘটনার তালিকায় চীনের চারটি ও বাংলাদেশের দুটি দুর্ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। দেখা যায়, পশ্চিমা দেশের তুলনায় চীন ও বাংলাদশে নিহতের সংখ্যা অনেক বেশি। ওয়াল স্ট্রিট জর্নালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেইজিং স্বীকার করেছে যে, অব্যবস্থাপনার কারণে ২০১০-এ দৈনিক গড়ে তাদের ১৮৭ শ্রমিক প্রাণ হারায়!

এসব অব্যবস্থাপনা আকাশ থেকে পড়েনি। এর কারণ নিহিত আছে বিনিয়োগ সংস্কৃতির ভেতর। উইমেন ইন ইনফরমাল এমপ্লয়মেন্ট: গ্লোবালাইজিং এন্ড অর্গানাইজিং নামের আন্তর্জাতিক এক সংস্থার প্রতিবেদনে বিশ্বের পোশাক কারখানাগুলোর পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে। তারা জানায়, চীনে বিশেষায়িত অর্থনৈতিক এলাকায় গড়ে ওঠা পোশাক কারখানাগুলোর বেশিরভাগই বিদেশি মালিকানাধীন। সেখানকার দারিদ্র্যপীড়িত গ্রামাঞ্চলের ত্রিশ বছরের কমবয়সী মেয়েরা নিদারুণভাবে শোষিত হচ্ছেন। তারা নাগরিক অধিকারবঞ্চিত, আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রমিক বলে গণ্যও হন না; এমনকি কারখানায় কাজ না করলে শহরে থাকার অধিকারও হারান। কর্তৃপক্ষের বরাদ্দকৃত ঘরে গাদাগাদি করে বাস করা আর দিনে ১২ ঘণ্টার বেশি কাজ করা তাদের জন্য সাধারণ বিষয়। অক্সফামের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনে পোশাক শ্রমিকদের ষাটভাগের লিখিত কোনো চুক্তি নেই। আর নব্বইভাগ সামাজিক সুরক্ষাবঞ্চিত।

এর অর্থ এ নয় যে বাংলাদেশ আর চীনের অর্থনীতিকে একই পাল্লায় মাপা যায়। চীন বাংলাদেশের মতো ঠুনকো শিল্পনির্ভর দেশ নয়। দুটি অর্থনীতির মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক থাকলেও সস্তাশ্রমের সংস্কৃতি দুদেশেই পোশাক শ্রমিকদের প্রায় একই রকম শোষণ-বঞ্চনার মুখোমুখী করছে।

প্রশ্ন হতে পারে সরকারি কর্তারা বিনিয়োগকারীদের বেলায় এত উদাসীন কেন। কিন্তু সস্তাশ্রমের ভিত্তি বজায় রাখতে হলে সুরক্ষার সব ব্যবস্থাই আলঙ্কারিক হয়ে পড়ে না কি? সব দায় মিটালে সস্তা ধারণাটাই অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে। তাই উন্নয়নের হিসেবের তলে চাপা পড়ে যায় সব রক্তক্ষরণ। লাভক্ষতির হিসেবে ক্ষতির অঙ্ক আড়াল করা হয়। এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমরা মধ্যআয়স্তরে উন্নীত হওয়ার স্বপ্নে বিভোর।

অর্থকরী ফসল পাট নিয়ে বাংলার অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে। ১৮৬২ সালে পাটকল স্থাপনের পর বদলে যায় কৃষকসহ অনেকের জীবন। এ শিল্পে শ্রমিক আন্দোলনের চেয়ে বিশ্বযুদ্ধ, অর্থনৈতিক মন্দা এসব কারণে বাজার পরিস্থিতি নীতিনির্ধারণে বেশি ভূমিকা রাখে। এগুলোই শ্রমিকের শ্রমঘণ্টা কমানো বা বাড়ানোয় নিয়ামক হয়েছে।

বর্তমানেও পোশাক শিল্প শুধু শ্রমিক বিক্ষোভের মুখোমুখি নয়, এর উপর চেপে বসেছে দেশবিদেশের নানা ঘাতপ্রতিঘাত। এমনই এক সময়ে ঘটল রানা প্লাজা ধসের ঘটনা।

'৯৬ এর আওয়ামী লীগ আমলে চৌধুরী নিটওয়ারে ৪৮ শ্রমিক নিহত হন। এ সময় নরসিংদী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী আবদুল জলিলের উপস্থিতিতে মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে এক সভা হয়। যেখানে প্রথমবারের মতো সরকারিভাবে শ্রমিকদের দায় স্বীকার করা হয় নিহতের পরিবারপ্রতি লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দান করার মাধ্যমে। এত বছর পর এবারই প্রথম গাফিলতির দায়ে গ্রেপ্তার হল মালিকরাসহ সংশ্লিষ্টরাও। এটুকু অর্জন করতে আমাদের কতগুলো দুর্ঘটনা, মৃত্যু আর বিক্ষোভ পাড়ি দিতে হয়েছে! ভবন মালিক রানাসহ অন্যদের গ্রেপ্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বিদেশি বাজার পরিস্থিতি ও গণমাধ্যমের।

সস্তাশ্রমনির্ভর শিল্পে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের বড় একটা তফাৎ রয়েছে। সে দেশে এসব শিল্পাঞ্চল মূলত দেশটির পূর্ব উপকূলে এবং এ দেশে মূলত ঢাকা ঘিরে গড়ে উঠেছে। দুদেশের শাসনে পার্থক্য তো আছেই। 'গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মজুরি বৃদ্ধির চাপ থাকে' বলে থাকেন বিশেষজ্ঞরা। আবার সস্তায় চটজলদি পুঁজির সঞ্চয়ন করতে গেলে চলতি সব সমস্যা টিকেই থাকে। অসন্তোষ ফিরে ফিরে আসার সম্ভাবনাও শেষ হয় না। এবার কর্তৃপক্ষের নড়েচড়ে বসার কারণ শ্রমিক নাকি গণমাধ্যমসহ অন্য আর সব চাপ?

এ খাতের মানুষদের যত বেশি করেই আলাদা জগতে ঠেলে দেওয়া হোক না কেন, নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবে কি ঢাকা? বিনিয়োগের চলতি সংস্কৃতি জারি থাকলে কানে বাজতেই থাকবে আটকেপড়াদের আকুতি- 'কথা বলেন ভাই, একটু সান্ত্বনা দেন।'

মুজতবা হাকিম প্লেটো : সাংবাদিক।