ডুবে যাবো, নাকি থই পাবো?

তন্ময় ইমরানতন্ময় ইমরান
Published : 18 June 2022, 02:36 AM
Updated : 18 June 2022, 02:36 AM

আমার এক বন্ধুবর ছোটভাই একটি রোমান্টিক গল্প লিখেছেন। এটিকে সিনেমায় রূপ দেয়ার কাজও জোরেসোরে এগিয়ে চলছে। তো গল্পটা বলার পর সে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো- বলো তো চিলিকেই কেন গল্পের শেষটায় বেছে নিলাম? আমি উত্তর দিতে পারলাম না। ও বললো- বাংলাদেশ থেকে পায়ের নিচের মাটি খুঁড়ে সোজা যদি পৃথিবীর ও প্রান্তে কেউ পৌঁছাতে পারে, তাহলে যে দেশে উঠবে তার নাম- চিলি।

এই তো সপ্তাহখানেক আগেই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চিলির হ্রদ শুকিয়ে যাওয়া নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম রয়টার্সের একটি খবর প্রকাশ করেছে। 'চিলির হ্রদ শুকিয়ে মরুভূমি, পড়ে আছে মাছের কঙ্কাল' শিরোনামের ওই খবরে বলা হয়েছে, "দুই দশক আগেও মধ্য চিলির পেনুলাস লেক ছিল ভালপারাইসো শহরের পানির প্রধান উৎস, সেখানে যে পরিমাণ পানি ছিল, তা দিয়ে অনায়াসে অলিম্পিক-আকারের ৩৮ হাজার সুইমিং পুল ভরে ফেলা সম্ভব ছিল। এখন সেখানে দুটি পুলের সমান পানিও নেই।"

আমি ঠিক জানি না খবরে বর্ণিত চিলির পেনুলাস লেকটি সুনামগঞ্জ কিংবা সিলেটের মাটি খুঁড়লে ঠিক বিপরীত দিকেই পড়ে কিনা- কিন্তু পৃথিবীর উল্টোপাশে যেখানে খরা চলছে, ঠিক তার বিপরীত দিকেই অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ভেসে যাচ্ছে জনপদ। ভাবতে অদ্ভুত লাগছে! কিন্তু এটাই সত্য, আর এ নির্মম সত্যের শিকার সিলেট-সুনামগঞ্জের বানভাসি মানুষ। জলবায়ু পরিবর্তন ঠিক এভাবেই আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। এখন মওসুমে মওসুমে টের পাচ্ছি। এরপর বছর ধরে টের পাবো। আর তারপর এ ভোগান্তি চলবে দীর্ঘসময়, বছরের পর বছর।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবি, ভিডিও ও নানাজনের স্ট্যাটাস দেখে সিলেট ও সুনামগঞ্জবাসির জন্য মন খারাপ লাগছে। কিন্তু দীর্ঘদিনে তৈরি হওয়া সঙ্কট তো আগামী দুই-তিনদিনেই সমাধান হবে না। কাজেই সঙ্কটের মূল নিয়ে আলোচনা করে এ প্রভাব কতোটা পড়বে- সেটা নিয়েই বরং আলোচনা করাটা ভালো। বাকিটা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের উপর।

কিছু কাকতালীয় তথ্য   

গণমাধ্যমের খবর বলছে, গত তিন দিনে ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে আড়াই হাজার মিলিমিটারের মতো বৃষ্টি হয়েছে। ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে বৃষ্টিপ্রবণ অঞ্চল চেরাপুঞ্জিতে নাকি বৃহস্পতিবার থেকে শুক্রবার নাগাদ ২৪ ঘণ্টায় ৯৭২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। যা ১২২ বছরের মধ্যে এক দিনে তৃতীয় সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত। আর গত তিন দিনে সেখানে প্রায় আড়াই হাজার মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এটিও গত ২৭ বছরে তিন দিনে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের রেকর্ড। সেবারের বন্যা বাংলাদেশের জন্য ততোটা ভয়াবহ ছিল না।

কিন্তু এর ঠিক দুইবছর পর অর্থাৎ ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশে ঠিক এরকমই অতিবৃষ্টিজনিত কারণে বন্যা হয়েছিল। ১৯৯৮ সালের সেই বন্যা ছিল প্রায় দুই মাস দীর্ঘস্থায়ী। আওয়ামী লীগ সরকার সেবারও ক্ষমতায় ছিল এবং সে যাত্রা বহু ভোগান্তি সত্ত্বেও বাংলাদেশ খাদ্য শস্য ও ধান উৎপাদনে বিস্ময়করভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করায় দুর্ভিক্ষ ও মন্দা হয়তো ঠেকানো গিয়েছিল।

সেই বছরের সাথে এবছরের খুব কাকতলীয় আরো দুইটি মিল রয়েছে। সেটির একটি হলো- ১৯৯৮ সালের জুন মাসে পদ্মা সেতুর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের বৃহত্তম সেতু হিসেবে পরিচিত 'বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু' যমুনা নদীর ওপর নির্মাণের পর যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল। এবার ২৫ জুন উদ্বোধন হতে যাচ্ছে 'পদ্মা সেতু'। আর বলাই বাহুল্য, ক্ষমতায় গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে আছে সেই আওয়ামী লীগই।

আরও দ্বিতীয় মিলটির কথা শুনলে হয়তো চমকে যাবেন। তখনো বিশ্বব্যাপি একটি যুদ্ধ চলছিলো এবং সেই যুদ্ধ কিন্তু বলকান অঞ্চলেই। এ বছর ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে যেমন রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ শুরু হয়। বলকানের কসোভোতে সেই যুদ্ধও শুরু হয়েছিল ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে।

তবে এসব কাকতাল-বারোতাল হয়তো ফেইসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জন্য খুব জনপ্রিয় বিষয়। তবে এখানে আনা হলো এ কারণে আড়াই দশকের বেশি সময় পর প্রায় একই ধরনের ঘটনাগুলো ঘটছে, যেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি।

কেবলই একটি সড়কই কি সমস্যা?

সুনামগঞ্জ ও সিলেটের বন্যার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি বিষয়ে খুব আলোচনা হচ্ছে। সেটি হলো- 'কিশোরগঞ্জের অল ওয়েদার সড়ক'। কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চলের ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলার মধ্যে যোগাযোগ রক্ষাকারী এ সড়কের দৈর্ঘ্য ২৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। এ বছরের এপ্রিলে এবং মে-তে এ সড়কের কারণে ওই তিন উপজেলায় ফসলি জমি তলিয়ে গিয়েছিল। কেননা পাহাড়ি ঢলের জমি নদীতে যেতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এপ্রিলেই নির্দেশ দিয়েছিলেন হাওরে আর 'অপরিকল্পিত সড়ক' নয়। সড়ক করতে হলে উড়াল সড়কের পরিকল্পনা করতে হবে। একনেকের ওই সভা শেষে মন্ত্রী পরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল সাংবাদিকদের বলেছিলেন, 'সিলেটের (অঞ্চল) পানিটা মূলত নামে অষ্টগ্রামের দিক দিয়ে। এখানে যে রাস্তাটা করা হয়েছে মিঠামইন থেকে অষ্টগ্রাম, সেটাতে কোনো অ্যাফেক্ট হলো কিনা- এটাও দেখতে বলা হয়েছে'। পাশাপাশি সড়ক ও জনপথ বিভাগকে এ বিষয়ে সমীক্ষা চালাতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে জানিয়ে সচিব বলেন, 'প্রতি আধা কিলোমিটার পর পর দেড়শ থেকে দুই শ মিটার ব্রিজ করে দেয়া যায় কিনা সেটিও দেখতে বলা হয়েছে।'

অর্থাৎ 'কিশোরগঞ্জের অল ওয়েদার সড়ক' যে সমস্যা সৃষ্টি করছে, এমন একটি বিষয় নিয়ে সরকারের কাছে আগে থেকেই সতর্কবার্তা ছিল। মন্ত্রীপরিষদ সচিব এ তথ্যও দিয়েছিলেন- পুরো বছর হাওর অঞ্চলে ৫ হাজার মিলিমিটার বৃষ্টি হলেও, এবছরের এপ্রিলেই কেবল ১২০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। কাজেই এটাও একটি বিবেচনার বিষয়।

ভারতের মেঘালয় ও আসাম থেকে নামা ঢলের পানি সিলেট অঞ্চলের নদী ও হাওর হয়ে কিশোরগঞ্জে মেঘনা নদীতে গিয়ে মেশে। 'অল ওয়েদার সড়কে'র কারণে হাওরের উজানের থেকে নেমে আসা পানি নদীতে নামতে পারছে না- এ সংক্রান্ত অভিযোগটি তাহলে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। আবার এটাই একমাত্র কারণ তেমনও নয়। সম্ভবত এ সড়কটি দৃশ্যমান বলেই এতো আলোচনায় আসছে।

ইন্টারনেটে ঘাটতে গিয়ে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী ও হাওরের মানুষ মোস্তফা জব্বারের পুরনো একটি লেখা পেলাম হাওর নিয়ে। ২০১১ সালের ওই লেখায় তিনি উল্লেখ করেছেন- "বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের এলাকা ভারতের চেরাপুঞ্জি হাওর এলাকার উত্তরপ্রান্ত থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। বর্তমানে হাওর এলাকার সবচেয়ে সচল নদীর নাম ধনু। এটি ভৈরবের কাছে এসে মেঘনায় মিশেছে। ভারতের আহু বা বরাক নদী থেকে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীসহ শ খানেক নদী হয়ে হাওরে বিপুল পরিমাণ জলরাশি প্রবেশ করে। এসব পানি ধনু-মেঘনা সাগরে বহন করে।"

তিনি ওই একই লেখায় উল্লেখ করেছিলেন, "বিশ্বব্যাপী যে জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধির বিপদের কথা বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে তার প্রধান শিকার হবে হাওর অঞ্চলটি। এখন পর্যন্ত দেশের মানুষ কেবলমাত্র উপকূলীয় অঞ্চলের কথা বলছে- কার্যত আমরা জানিনা যে, উপকূলীয় অঞ্চল বিপন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ হাওর অঞ্চল বিপন্ন হবে। এ আসন্ন বিপদের জন্য কেবল এখানকার পরিবেশ বা জীববৈচিত্র্য নয়, পুরো জনপদ বিপন্ন হয়ে যাবে। মাত্র তিন থেকে ১০ ফুট উচ্চতার এ জনপদের অনেক অংশ এখনই সমুদ্রপৃষ্ঠের নিচের এলাকা। মাত্র তিন মিটার পানি বাড়লে বাংলাদেশের উপকূলীয় অংশের সঙ্গে সঙ্গে পুরো হাওর এলাকা প্লাবিত হয়ে যাবে। ওই এলাকার মানুষ এখনও আন্দাজ করতে পারে না যে, এর ফলে তার জীবন কতোটা বিপন্ন হবে।"

মোস্তফা জব্বারের ওই লেখাটি প্রকাশ হয়েছিল দ্বিতীয় হাওর সম্মেলনের আগে। তখন ভারতের আসামের বরাক নদীর মোহনায় টিপাই মুখ বাঁধ নির্মাণ নিয়ে টানাপড়েন চলছিল। বরাক নদী সম্পর্কে একটু বলে নেওয়া ভালো। ব্রহ্মপুত্রের পর এটি ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী এবং এর সঙ্গে ভারতের অসংখ্য উপনদী মিলিত হয়েছে। বাংলাদেশে এ নদীটি সিলেটে এসে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। যে দুইটি নদীর সাথে সিলেটের প্রায় সব নদীই সংযুক্ত। উত্তর সিলেটে সুরমা আর দক্ষিণের সিলেটের কুশিয়ারা নদী গিয়ে হবিগঞ্জে সিলেটের কালনী নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এর পরে সুরমা ও কুশিয়ারার মিলিত প্রবাহ কালনী নামে দক্ষিণে কিছুদূর প্রবাহিত হয়ে মেঘনা নাম ধারণ করেছে। সুরমা ও কুশিয়ারা নদী দুটি বৃহত্তর সিলেটে জেলাকে বেষ্টন করে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার ভাটিতে গিয়ে মেঘনা নদীতে মিলিত হয়েছে। মেঘনা ভৈরব বাজারে পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে এবং চাঁদপুরের কাছে পদ্মার সঙ্গে মিলিত হয়ে মেঘনা নামে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। আর মেঘনারই শাখা নদী সুনামগঞ্জ থেকে ইটনা পর্যন্ত ধনু নামে প্রবাহিত হয়ে সেখান থেকে ঘোড়াউত্রা নাম নিয়ে দিলালপুর এসে মেঘনার সাথে মিলিত হয়েছে।

টিপাইমুখ বাঁধ এ কারণে ভারত নির্মাণ করছিলো যে, প্রয়োজনের সময় তারা পানি ধরে রাখবে। আবার প্রয়োজন হলে ছেড়ে দিবে। এতে নি:সন্দেহে বাংলাদেশের হাওর অঞ্চল প্রয়োজনের শুষ্ক মওসুমে পানি পেত না এবং বর্ষা মওসুমে এখনকার মতো পাহাড়ি প্রলঙ্কারী ঢলের পানির কবলে পড়তো।

দেশিয় এবং আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার পরও ওই বাঁধ নির্মাণের কাজ ভারত সরকার বন্ধ রেখেছে। ২০১৫ সালের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে 'ভারতের সাংবিধানিক কারণে টিপাইমুখ প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না' বলে জানিয়েছিলেন সেদেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

তবে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ না করলেও ভারতের মেঘালয়, মিজোরাম, মণিপুর ও নাগাল্যান্ডে বরাক নদীর বিভিন্ন উপনদীকে কেন্দ্র করে প্রায় ৪০টি প্রকল্প হাতে নিয়েছে বলে সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন পরিবেশ কর্মী আব্দুল করিম কিম।

তার মতে, "একের পর এক ড্যাম ও ওয়াটার স্টোরেজ নির্মাণের মাধ্যমে বরাকের বিভিন্ন উপনদীকে নিয়ন্ত্রণ করায় শুষ্ক মওসুমে সুরমা-মেঘনা অববাহিকা পানিশূন্য হয়ে যাচ্ছে। আবার উত্তর-পূর্ব ভারতে প্রবল বৃষ্টিপাতে প্রবহমান পানির চাপ তৈরি হলে আটকে রাখা পানি ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে আকস্মিক প্লাবনে সুরমা-মেঘনা অববাহিকা প্লাবিত হচ্ছে।"

বাংলাদেশে হাওর আছে এমন জেলা হচ্ছে ৭টি। সেগুলো হলো- সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এর মধ্যে সিলেট বিভাগের চারটি জেলায় ভারত থেকে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশনের হিসাবে ১৬টি নদী। নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর বাইরেও আরও ৩০টি শাখা নদী রয়েছে। শুষ্ক মওসুমে পানি না থাকার কারণে নদীর নাব্যতা কমছে। আর বর্ষায় নাব্যতা কমার কারণে উজানের ঢলে প্লাবিত হচ্ছে হাওর।

প্রকৌশলী এনামুল হকের মতে, ব্রহ্মপুত্র নদ তার প্রবাহপথ ১৭৮৭ সালের বন্যা ও ভূমিকম্পের পর মধুপুর গড়ের পূর্বদিক থেকে পশ্চিম দিকে পরিবর্তন করলে পলিমাটি ভরাট হওয়ার অভাবে হাওর অঞ্চল নিচু থেকে যায়। তাছাড়া মেঘালয় ও বাংলাদেশের সীমান্ত বরাবর ডাউকি ফল্টে বারবার ভূমিকম্পের কারণেও অতি প্রাচীনকালেই এলাকাটি ৩ থেকে ১০ মিটার বসে যায়। এরপর নানা সময়ে বেশ কয়েকটি বড় ভূমিকম্পর হাওর অঞ্চলকে আজকের জায়গায় নিয়ে এসেছে।

হাওরবাসীদের মধ্যে প্রবীণ যারা, তারা বলেন- ১৯৩৭ সালে মেঘনা নদীর উপর প্রথম রেল সেতু স্থাপনের পর থেকেই হাওরে বানের পানি জমতে শুরু করে। এর আগে সেখানে বন্যা হতো না। মেঘনা নদীর উপর এরপরও দ্বিতীয় মেঘনা সেতু হয়েছে। দেশ আরও অনেক এগিয়ে গেছে। আর দিনে দিনে হাওরে বন্যার সংকট চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে পরিণত হচ্ছে। সবশেষ দৃশ্যমান নজির হয়তো 'অল ওয়েদার সড়ক'!

২০১৭ সাল থেকে এ সংকট ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। তবে তারও আগে থেকে ভারতের আসাম-মেঘালয়ে পাহাড় কেটে খনিজ আহরণের কারণে পাহাড়ি ঢলের সাথে কেবল মাটি নয়, নুড়ি-পাথর এসে জমা হচ্ছে। ওপাড়ে ভারতে বন ধ্বংস করে উন্নয়ন কাজ চলছে, এপাড়ে তার আঘাত আসছে। সিলেট বিভাগের প্রায় সব নদীর নাব্যতাই কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। বিপুল পরিমাণ জলরাশি তাই উপচে পড়ছে এবং সামনের দিনেও পড়বে জনপদে।

সমাধান কী?

কোভিড মহামারী সংক্রমণের তীব্রতা বাড়ার পর একগাদা পরিবেশবাদী প্রতিবেদন বৈশ্বিক গণমাধ্যমে ছাপা হয়েছে। সেলিব্রিটি থেকে শুরু করে আমজনতা- প্রত্যেকেই এ কথায় একমত ছিল যে, মানুষ পৃথিবীর প্রকৃতিকে ধ্বংসের দাঁড়গোড়ায় নিয়ে গেছে। নিজের একটু সুবিধার জন্য কার্বন নিঃসরণ বাড়িয়েছে তারা। পৃথিবীকে করেছে উত্তপ্ত। মানুষের এবার প্রকৃতির কাছে ফেরার সময়। প্রাণিকূল ও নদীর কাছে ফেরার সময়। প্রাণি ও প্রকৃতি প্রেম নিয়ে বাংলায় অনেকে লিখেছেন- 'ইত্যাদি', 'ইত্যাদি', 'ইত্যাদি', ইংরেজিতে 'ব্লা', 'ব্লা' 'ব্লা'।

কোভিড সংক্রমণ কমে আসার পরপরই পৃথিবীর মানুষ আগের জীবনে ফেরত গেছে। সেই অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, উন্নয়ন, জিডিপি, শিল্পায়ন, জীবিকা ইত্যাদি ইত্যাদিতে। প্রকৃতি প্রেম উবে গেছে। জীবন ও জীবিকার অজুহাত টেনে আকার প্রকৃতি ধ্বংসের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর মানুষ। আমরা পিছিয়ে থাকবো কেন? আমরাও উন্নয়ন করছি। এই উন্নয়নের একটি প্রতিবেদনের কথা বলি। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ওই প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল 'লেক খননের পরিকল্পনায় ক্ষোভ: মুখোমুখি বন বিভাগ আর মধুপুরের গারোরা'। প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, ৪৫ বিঘা কৃষি জমিতে পর্যটকদের জন্য লেক বানাতে চায় বন বিভাগ। কি আশ্চর্য দেখুন।

পর্যটকরা ওখানে যাবেন, ভালো কথা। কিন্তু লেক কেন হতে হবে? লেকের পানি যদি ওভারফ্লো করে, বনাঞ্চলের গাছ বাঁচবে? লেক খুঁড়তে গিয়ে যদি প্রতিবেশ বদলে যায়- প্রাকৃতিক ভারসাম্য ঠিক থাকবে? ওখানের গারোরা, যারা ওই মাটিকে তাদের ভাষায় 'আবিমা' বা 'মায়ের মাটি' বলেন, তাদের কৃষিজমি কেড়ে নিলে ওই অঞ্চলের মাটি বাঁচাবে কে?

প্রসঙ্গটা আনলাম এ কারণে যে, হাওর-বাওড়, বন-জঙ্গল সবকিছুই আজ হুমকির সম্মুখীন- কেননা পরিবেশগত বিপর্যয় আমরা উপেক্ষা করি। আমরা মনে করি, একটি 'মার্কেট চেইন' করছি। এই 'মার্কেটর চেইন' থেকে মানুষ অর্থনৈতিক সুবিধা পাবে। আয়-রোজগার বাড়বে। কিন্তু 'মার্কেট চেইন' বানানোর জন্য যেকোনও উন্নয়নমূলক কাজের পরিবেশগত দিকটা আমরা বিবেচনায় রাখি না। আমরা একবারও ভাবিনা- পরিবেশ বিবেচনায় না রাখলে পুরো 'মার্কেট চেইন' ধসে যেতে পারে যেকোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে। পাশাপাশি একটি জনপদও বিলুপ্ত হতে পারে।

কিশোরগঞ্জের 'অলওয়েদার সড়ক'টি হয়তো সত্যিকার অর্থেই উপকারের কথা ভেবে তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু হাওরের প্রতিবেশ ছিল সেখানে উপেক্ষিত। আবার মধুপুর গড় অঞ্চলের মতো একটি এলাকা যা কিনা ভূমিকম্পের কারণেই সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে যদি বড় মাপের ভূমিকম্প হয় ৪৫ বিঘার পানি পুরো মধুপুর অঞ্চল ভাসিয়ে নিবে না তো? বনবিভাগ পরিবেশ নিয়ে কাজ করে। তারাই যদি এমন অদ্ভুত পরিকল্পনা করে, তাহলে সামগ্রিক দেশের অবস্থা কী?

কাজেই সমাধান সবক্ষেত্রে একই 'আক্কেল ও বিবেক' খাটানো। অনেকেই বলবেন, সিলেটের সাম্প্রতিক বন্যার পেছনে যে কারণগুলো বললেন- সেটিতে অনেকক্ষেত্রে তো ভারতকে দায়ী মনে হলো। হ্যা, ঠিক ভারত দায়ী। তবে আমাদের মতো সঙ্কটটা সেখানকার পরিকল্পনাবিদদেরও রয়েছে, সাধারাণ মানুষের নয়। আমাদের উচিত ভারতের সঙ্গে বেশি বেশি আলোচনায় বসা। কেননা, বাংলাদেশকে সংকটে রেখে ওরাও কি আরামে থাকবে? থাকলে কতোদিন? মনে রাখতে হবে, জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। এবং এ পরিবর্তন সারা পৃথিবীর জন্য সত্যি। ওদের তো এ কথা বুঝতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়, পাশের বাড়িতে আগুন লাগলে, নিজের বাড়িতে বসে ভাত খেয়ে দিবানিদ্রা দেওয়া যায় না।

চলমান বন্যায় কতোটুকু আঘাত আসবে?

সুনামগঞ্জ ও সিলেটের এবারের ঢলের ভয়াবহ রূপে ১২ উপজেলার ৩৫ লাখ মানুষ ইতিমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকের ঘরবাড়ি ভেসে গেছে। সেই দৃশ্য ভিডিওতে ও ছবিতে সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল। ফেইসবুকে একটি পোস্ট পড়ে রীতিমতো মন খারাপ হলো- দাদী মারা গেছে, কবর দিতে পারছি না। ঘরে পানি ঢুকতে শুরু করেছে।

আরেকটি পোস্টে একটি কিশোর লিখেছে- তারা কোনও মতে ঘর থেকে বেরিয়ে আশ্রয় নিতে পারলেও, ঘরটি ডুবে গেছে। বড়বোনের সব বই পানির তলে। আশ্রয় নেওয়ার সময় পোষা বেড়ালটি রেখে আসতে বাধ্য হয়েছে। এখন খুব খারাপ লাগছে।

দুইটি ছবি ভাইরাল হয়েছে- প্রথমটিতে তিনটে গরু মরে পড়ে আছে। আরেকটি ছবিতে- একটি ছেলে বাছুর কোলে নিয়ে পানির ভেতর হাঁটছে।

কিছুদিন আগেই আগাম বন্যার কারণে ধান কাটতে হয়েছে সিলেট, সুনামগঞ্জের কৃষকদের। সেই ধান কি তারা বিক্রি করতে পেরেছিলেন? নাকি গোলায় ছিল? সামনে কোরবানি ঈদ। গরু-ছাগলগুলোকে কি বাঁচাতে পেরেছেন? ২০২১ সালের হিসাবে দেখলাম- সিলেটে প্রায় দুই লাখ এবং সুনামগঞ্জে প্রায় দেড় লাখ কোরবানি যোগ্য পশু ছিল। এ বছর নিশ্চয়ই আরও বেশি থাকার কথা। কোভিডের পর সত্যিকার অর্থে সচল বাজারে কোরবানির ঈদ তো এ বছরই হওয়ার কথা!

কেবল সিলেট-সুনামগঞ্জ নয়, বন্যার খবর পাওয়া যাচ্ছে উত্তরবঙ্গ থেকেও। চরাঞ্চলগুলো প্লাবিত হচ্ছে, যেখানে পশু পালন হয় সবচেয়ে বেশি। সেখানকার কৃষিজমি চলে যাচ্ছে পানির নিচে। ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, তিস্তা, ধরলা নদীর পানি বাড়ছে। এর মধ্যে কোনোটি বিপৎসীমার উপর, আবার কোনোটি নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।

এ বন্যা নিঃসন্দেহে বাজারে পণ্যের মূল্যস্ফীতি আরও বাড়াবে। সবজির দাম আরও বাড়বে। বাড়াবে চালের দাম। মাংস-মাছ-ডিমের দাম বাড়বে। ফলের দাম বাড়বে। অস্থিরতা বাড়বে চারিদিক। আমরা কি ডুবে যাচ্ছি? থই পাবো? প্রকৃতি কি সেই সুযোগ দিবে? সুযোগ দিলে কি শুধরাবো?