জনগণের করের টাকায় কি কেবল চিকিৎসকরাই পড়েন!

এ বি এম কামরুল হাসানএ বি এম কামরুল হাসান
Published : 14 June 2022, 01:33 PM
Updated : 14 June 2022, 01:33 PM

'চিকিৎসকরা জনগণের করের টাকায় পড়ে, অন্যরা বাবার টাকায় পড়ে'- জ্ঞান হওয়ার পর থেকে কথাটি শুনে আসছি। বস্তুত সবাই জনগণের করের টাকায় পড়েন। শিক্ষার্থী থাকাকালীনকে কতো টাকা জনগণের দেওয়া কর থেকে নিচ্ছে সেটাই দেখার বিষয়। তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ওই একই সময়ে কে কত টাকার সেবা জনগণকে দিচ্ছেন। সেই দেওয়া-নেওয়ার ফারাকটা হিসেব করা প্রয়োজন। তাহলেই বোঝা যাবে লেখাপড়ার জন্য জনগণের কাছে কার কতটা দায় রয়েছে।

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সম্প্রতি আগামী অর্থবছরের (২০২২ -২০২৩) জন্য  বরাদ্দ চূড়ান্ত করেছে। দেশের ৫০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এবারের প্রস্তাবিত বাজেট প্রায় সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) পেয়েছে সর্বোচ্চ ৮৬৪ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) পেয়েছে ২২১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) পেয়েছে ১৬৪ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। এ তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জনগণের করের টাকা থেকে জনপ্রতি কতো নিচ্ছেন ও দিচ্ছেন- সেটাই আজকের আলোচনার বিষয়।

আসুন, প্রথমেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোচনায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েব সাইট ও উইকিপিডিয়া থেকে জানা যায়, এখানে নিয়মিত শিক্ষার্থী সংখ্যা ৩৭ হাজার। এর মধ্যে স্নাতক  শিক্ষার্থী ২৩ হাজার (৬২ শতাংশ) । বাকিরা স্নাতকোত্তর। এবার বরাদ্দকৃত বার্ষিক বাজেটকে ৩৭ হাজার দিয়ে ভাগ দেই। ঢাবি-তে শিক্ষার্থীপ্রতি বাজেট দাঁড়ায় ২ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। উইকিপিডিয়ার মতে, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর শিক্ষার্থী সংখ্যা ৯ হাজার ২৩৪ জন। এর মধ্যে সাড়ে ৫ হাজারের বেশি স্নাতক পড়ছেন (৬১ শতাংশ)। বুয়েটে শিক্ষার্থীপ্রতি বাজেট ২ লাখ ৪০ হাজার। এ দুইটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীপ্রতি বাজেট প্রায় একই। স্নাতক পড়ুয়া শিক্ষার্থীর আনুপাতিক হারও প্রায় সমান।  জনগণের দেওয়া করের ঝুলি থেকে এরা একই পরিমাণ টাকা নিচ্ছেন।  কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন এরা জনগণকে কী দিচ্ছেন? উত্তর আমার জানা নেই। এটা হয়তো আমার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা। শিক্ষা জীবন শেষে কে কী দিচ্ছেন সেটা আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু নয়।

এবার দেখে নিবো শাহবাগে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)- এর কী অবস্থা। এখানে কোনও স্নাতক কোর্স নেই। যারা এখানে পড়েন সবাই স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী। তাই খরচের পরিমাণ একটু বেশিই হওয়ার কথা। পোস্ট গ্রাজুয়েট শিক্ষার্থীর সংখ্যা এখানে শতভাগ হওয়ায় এই তিন বিশ্ববিদ্যালয়কে এক পাল্লায় মাপাটা সমীচীন নয়।  তবুও আলোচনা ও বোঝার সুবিধার্থে এ তুলনা করছি। ২০২১ সালের ৩০ এপ্রিল 'দ্য ডেইলি সান' পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধ মতে, এ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট গ্রাজুয়েট ছাত্রের সংখ্যা ৪ হাজার ৮০০। শিক্ষার্থীপ্রতি বার্ষিক বরাদ্দ ৩ লাখ ৪৩ হাজার। বুয়েট ও ঢাবি থেকে প্রায় ৩৫ শতাংশ বেশি। 

যদিও এখানে কোনও স্নাতক শিক্ষার্থী নেই, তবুও মেনে নিলাম স্নাতকোত্তর মেডিকেল শিক্ষার্থীরা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের থেকে বেশি খরচ করছে। তার মানে, জনগণের দেওয়া করের টাকা বেশি নিচ্ছে। কত বেশি? ৩৫ শতাংশ বেশি। এই ৩৫ শতাংশ বেশি নেওয়ার জন্য কথায় কথায় শুনতে হয়, চিকিৎসকরা জনগণের করের টাকায় পড়ে। যারা ৩৫ শতাংশ কম নেন তারাও বলেন। যারা জনগণের ট্যাক্সের টাকা নিয়ে পড়েন না, তারাও বলেন। এই ৩৫ শতাংশ বেশির জন্য এতো খোঁচা ?

কাহিনী কিন্তু এখানেই শেষ নয়। এবার দেখে নেই শুভঙ্করের ফাঁকিটা। এটি না বুঝলে ভাববো আপনি অংকে খুবই কাঁচা। নয়তো সাধারণ জ্ঞানে খুবই দুর্বল। এ দুইটি বিষয়ে দুর্বল হলে বিসিএস- এর প্রিলিমিনারি টেস্টে উর্ত্তীর্ণ হওয়া কঠিন। 'দ্য ডেইলি সান'  পত্রিকায়  প্রকাশিত একই নিবন্ধ মতে, বছরে ২০ লাখের বেশি রোগী বিএসএমএমইউ হাসপাতালের বহির্বিভাগ থেকে ব্যবস্থাপত্র নেয়। ইনডোরে চিকিৎসা নেয় বছরে ৪০ হাজারের বেশি রোগী। বছরে ৫০ হাজারের বেশি রোগীর ছোট-বড় অপারেশন হয়। এ অপারেশনগুলোর মধ্যে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট, ককলিয়ার ইমপ্লান্ট, হৃদপিণ্ডে রিং পরানোর মতো ব্যয়বহুল চিকিৎসাও  রয়েছে। 

আসুন এবার হিসাব মিলাই। বছরে ২০ লাখ রোগী দেখা হয় বহির্বিভাগে। প্রতি রোগী দেখার ফি ১০০ টাকা। বছরে বহির্বিভাগে সেবা দেওয়া অর্থের পরিমাণ ২০০ কোটি টাকা। ইনডোরে রোগী দেখা হচ্ছে ৪০ হাজার। ইনডোরে প্রতি রোগী বাবদ খরচ ধরলাম ১০ হাজার টাকা। বছরে ইনডোরে সেবা দেওয়া হচ্ছে ৪০ কোটি টাকা। এবার অস্ত্রপচার। ছোট-বড় অপারেশনে গড়ে ধরলাম ৫০ হাজার টাকা করে। অপারেশন বাবদ বছরে সেবা দিচ্ছে  ২৫০ কোটি টাকার । সব মিলিয়ে বছরে ৪৯০ কোটি টাকার সেবা দিচ্ছেন এই হাসপাতালটির চিকিৎসকরা। বরাদ্দের পরিমাণ প্রদত্ত সেবার তিন ভাগের এক ভাগ। যা নিচ্ছেন, দিচ্ছেন তার তিনগুণ।  এবার বলুন, কারা বাবার টাকায় পড়েন, কারা জনগণের দেওয়া করের টাকায় পড়েন।