Published : 10 Apr 2022, 09:30 PM
দৃশ্যটা কল্পনা করুন একবার। রাস্তায় তল্লাশী নিচ্ছে মাদ্রাসা পড়ুয়া কয়েকজন কিশোর। মুখে গোঁফ দাড়িও ভালো মতো গজায়নি। কিন্তু আপনার গালে দাড়ি নেই কেন- সেজন্য আপনাকে তারা চড় মারবে। আপনার প্যান্ট টাখনুর নিচে কেনো সেজন্য লাঠিপেটা করবে। আপনার স্ত্রী কেন একা বের হলো, সেজন্য তাকে হেনস্তা হতে হবে। নারী শিক্ষা বন্ধ। গার্মেন্টসগুলোয় কোনো নারী শ্রমিক কাজ করতে পারবে না। ১১-১২ বছর বয়সী মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। গান-বাজনা নিষিদ্ধ। রেডিও টিভিতে মেয়ে সাংবাদিক নিষিদ্ধ। প্রতিদিন নতুন নতুন আইন, নতুন নতুন শাস্তি। দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। দেশ চালাচ্ছে মোল্লারা। হ্যা, বলতেই পারেন এটা আফগানিস্তানের নিয়মিত চিত্র। কিন্তু সেই ঝড়টা বাংলাদেশের দিকেও ধেয়ে আসছে। বাংলাদেশকে 'বাংলাস্তানে' রূপ দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে স্বাধীনতাবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক চক্র। এমন ছবি অচিরেই হয়তো দেখতে হতে পারে আমাদের।
গত কিছুদিন ধরেই সোশাল মিডিয়া এবং মূলধারার মিডিয়ায় আলোচিত চরিত্র হৃদয় মন্ডল। মুন্সিগঞ্জের এই বিজ্ঞান শিক্ষক গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ধর্ম অবমাননার অভিযোগে। আদালতে তৃতীয় দফা আবেদনের পর অবশেষে উনি জামিন পেয়েছেন। মাঝে ১৯ দিন তিনি জেল খাটলেন। যদিও প্রশাসনিক ভাষ্য তাকে নিরাপত্তা হেফাজতে রাখা হয়েছিল! কিন্তু আদতে তিনি কারাবন্দিই ছিলেন। ঘটনাটা যে পরিকল্পিত এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ২১ বছর ধরে বিনোদপুর রামকুমার উচ্চবিদ্যালয়ে বিজ্ঞান শিখিয়ে আসছেন হৃদয়। তার কাছে পাঠ নিয়ে বেরিয়েছে হাজার হাজার ছাত্র। এতোদিন পর এসে হৃদয়কে জানতে হলো তিনি যা পড়েছেন যা পড়িয়েছেন তা ভুল। আসল সত্য জানে 'প্যারাডক্সিকাল সাজিদ'!
হৃদয়ের অপরাধ তিনি বলেছেন ধর্ম হচ্ছে বিশ্বাস আর বিজ্ঞান হচ্ছে প্রমাণিত সত্য। তাকে বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রশ্ন করে সেটা মোবাইলে রেকর্ড করা হলো। তারপর এলাকায় ছড়িয়ে দিয়ে লোকজনকে উত্তেজিত করা হলো। তার বিরুদ্ধে ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেয়ার মামলা করলো সেই বিদ্যালয়ের ইলেকট্রেশিয়ান। বাদী স্বীকার করেছে সে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল না, প্রধান শিক্ষকের নির্দেশে তিনি মামলা করেছেন। ঘটনা ঘটেছে ক্লাসরুমে, শিক্ষক ছাত্রের আলোচনায়। ষড়যন্ত্রটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হওয়ার পরও দুই দুইবার তাকে জামিন দেয়া হয়নি। দেশজুড়ে আলোচনা, প্রতিবাদ, মুক্তির দাবিতে সমাবেশ হওয়ার পর হৃদয় জামিন পেলেন তৃতীয় দফায়।
হৃদয়ের এই ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ভাবলে ভুল করবেন। কাছাকাছি সময়ে ঘটা কয়েকটি ঘটনায় একটা প্যাটার্ন বেরিয়ে আসছে। সেই প্যাটার্নে ভয় পাওয়ার, আতঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট অবকাশ আছে। কিছুদিন আগে হিজাব না পরায় কয়েকজন ছাত্রীকে পেটানোর অভিযোগ আসলো নওগার এক স্কুলের শিক্ষিকা আমোদিনী পালের বিরুদ্ধে। স্কুলের দুই ছাত্রী সোশাল মিডিয়ায় লাইভ করলেন নিজের শিক্ষিকার বিরুদ্ধে ধর্মবিরোধিতার! পরে জানা গেল স্কুলে ইউনিফর্ম পরে না আসায় ছাত্র-ছাত্রীদের শাসন করা হয়। ছাত্রদের শাসন করেন বদিউল আলম এবং ছাত্রীদের আমোদিনী পাল। এখানে হিজাবের কোনো ঘটনাই ঘটেনি। কিন্তু ব্যাপারটি গুরুত্বসহকারে প্রচারের দায়িত্ব নিয়েছে হেফাজত ও জামাতের প্রচারসেল। মিথ্যা ঘটনাটাই সত্য বলে চ্যালেঞ্জ করছে তারা। যে কোনো ফেইসবুক পোস্টে কেউ হৃদয়ের কথা লিখলেই সেখানে এই হিজাবের ঘটনা তুলে ধরে প্রশ্ন করছে তারা!
আরেক ঝড় তুললো নাজমুল নামে এক কনস্টেবল। তেজগাঁ কলেজের শিক্ষিকা লতা সমাদ্দারকে টিপ পরার জন্য হেনস্তা করলো ওই পুলিশ সদস্য। গায়ের ওপর বাইক তুলে দিলো, আহত করলো। অভিযোগের জবাবে বললো তার অন্তঃস্বত্বা স্ত্রীকে নিয়ে যাওয়ার সময় তাড়াহুড়োয় বাইক গায়ে লেগেছে। সিসিটিভিতে দেখা গেলো তার পিছনে স্ত্রী নয়, হলুদ রংয়ের ব্যাগ ছিল। দেশজুড়ে এটা নিয়েও বেশ প্রতিবাদ হলো। আক্ষেপের ব্যাপার- সেই পুলিশের অফিশিয়াল ফেইসবুক পেইজে পোস্ট আসলো টিপ নাকি পতিতাদের পরিচ্ছদ। যদিও তারা এটা ভুলে পোস্ট হয়েছে বলে পরে ডিলেট দেয়। কিন্তু ধর্মান্ধতা যে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে তা পরিষ্কার।
সে তুলনায় ভাগ্যবান মীরসরাই জেবি স্কুলের প্রধান শিক্ষক তুষারকান্তি বড়ুয়া। তার বিরুদ্ধেও হিজাব পরায় মারধরের অভিযোগ তোলে দুই ছাত্রী। কিন্তু স্কুলপ্রাঙ্গণে ৭০টি সিসিটিভির কোনটারই ফুটেজে এই ঘটনার সত্যতা মিলেনি। কিন্তু তারপরও হামলা হয়েছে, ভাংচুর করেছে ধর্মানুভূতিতে আঘাতপ্রাপ্ত জনতা।
প্যাটার্নের কথা বলছিলাম। তিনজনই সংখ্যালঘু শিক্ষক। তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ধর্মানুভূতিতে আঘাতের। এতদিন তাদের টার্গেট ছিল নিম্নপর্যায়ের মানুষরা। অশিক্ষিত জেলের নামে ভুয়া ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে ধর্মানুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ এনে সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে হিন্দুদের ওপর। ভাঙা হয়েছে মন্দির, আগুন দেয়া হয়েছে তাদের বসতবাটিতে। লুট করা হয়েছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। কুমিল্লায় মন্দিরে কোরআন রাখার অভিযোগ তুলে এরকম হামলা হয়েছে গত দুর্গাপূজার সময়। পরে দেখা গেল- কাজটা ইকবাল নামে একজন মুসলমানের। চট্টগ্রামে জেএমসেন হলে বসন্তবরণ উৎসবের বিরুদ্ধে মেয়রের কাছে আবেদন করা হয়েছে। আন্দরকিল্লায় রামনবমী উৎসবে কোরআন হাতে এক বৃদ্ধকে পাঠানো হলেও তৎপর জনতা সামাল দিয়েছে।
এসবের পেছনে কারা কলকাঠি নাড়ছে? সন্দেহের আঙুলটা হেফাজতের দিকেই। মাওলানা শফিকে হত্যা করার পর হেফাজতের জামাত সমর্থিত অংশটাই এখন সংগঠনটির নেতৃত্বে। তাদের ধংসযজ্ঞের ক্ষমতায় যোগ হয়েছে জামাতের গুজব ও অপপ্রচার সেলের তেলেসমাতি। কয়েকদিন পরপরই ঘটানো সাম্প্রদায়িক ইস্যুর নেপথ্য অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসছে এই যোগসাজস। আর এটা নতুনও নয়। আমরা কি ভুলে গেছি শ্যামলকান্তির কথা? নারায়ণগঞ্জের এই শিক্ষককে ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেয়ার মিথ্যা অভিযোগ তুলে কানে ধরিয়ে উঠবস করিয়েছিলেন একজন জনপ্রতিনিধি। চড় মেরেছেন। সে অভিযোগ তুলেছিল যে ছাত্র, সেই রিফাত হোসেন একাত্তর টিভিতে লাইভে স্বীকার করে সে মিথ্যা বলেছিল। চারদিন পর হেফাজতের সমাবেশে নতুন পাঞ্জাবী পরে হাজির হয় আবার আগের অবস্থান নিয়ে। শ্যামলকান্তি সেই অভিযোগে রেহাই পেলেও কয়দিন পর তাকে জেলে যেতে হয় আরেক সাজানো মামলায়।
হেফাজত এই দেশে ইসলামী শাসন চায়। বাংলাদেশকে বাংলাস্তান বানাতে চায়। সেই চাওয়ায় ঘি দিচ্ছে ইন্ধন যোগাচ্ছে জামাতে ইসলামী তাদের উগ্র সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে। সেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও জামাতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামে নিয়মিত ফতোয়া আসতো হিন্দু শিক্ষকরা ভারতের দালাল। তাদের কাছে পড়াশোনা করলে মুসলমানের ধর্ম যাবে। স্পষ্ট মনে আছে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর ব্যয় নির্বাহের জন্য হিন্দু সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার আবেদন। ভয়ের ব্যাপার হলো এই সাম্প্রদায়িক উস্কানি ছড়ানোর জন্য এরা ভোক্তাও তৈরি করেছে। গত কয়েকবছর ধরে তীব্র মৌলবাদী ও হিংসাত্মক ওয়াজের মাধ্যমে এই শ্রেণিটা তৈরি হয়েছে। ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি, নারীর প্রতি প্রতিহিংসার সবক এদের ধর্মের তাবিজে পুরে গেলানো হয়েছে রাতদিন।
ইতোমধ্যে লক্ষীপুরে এক ইউনিয়ন আত্মপ্রকাশ করেছে 'মডেল বাংলাস্তান' হিসেবে। সেখানকার চেয়ারম্যান গানবাজনা নিষিদ্ধ করেছে এবং হিজাব বাধ্যতামূলক করেছে। বাংলাদেশের আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সেখানে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে নতুন আইন।
তাহলে সরকারের করণীয় কি? হেফাজতকে জেলে ঢুকিয়ে রাখাটাই সমাধান? জেলবন্দি হেফাজতও যে ভয়ংকর সেটা তো সরকারের নতজানু নীতিতেই স্পষ্ট। মামুনুল হক ঘোষণা দিলো বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বসানো হলে সেটা বুড়িগঙ্গায় ফেলে দিবে। সেই ভাস্কর্য বসানো হয়নি আর, জায়গাটা খালি, যদিও ভাস্কর্য গতবছরই বানানো হয়ে গেছে। মামুনুলও জেলে। তাহলে? সমস্যা সর্ষেরই ভূতে। সরকারি দল আওয়ামী লীগের মধ্যে একটা নিরব বিপ্লব হয়ে গেছে। যেভাবেই হোক শীর্ষপদগুলোতে ঢুকে গেছে জামাত ও সাম্প্রদায়িক শক্তি। দেখা যাচ্ছে, এরা বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতাকে অস্বীকার করে। এলাকায় সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রশ্রয় দেয়। রাজনীতি সামনে রেখে এরা উপেক্ষা করছে এদের কোর ভোটব্যাংককে, বুকে টেনে নিচ্ছে তাদের যারা জীবন গেলেও নৌকায় ভোট দিবে না। অসাম্প্রদায়িক জনমানুষের শেষ ভরসা আওয়ামী লীগেরই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে 'বাংলাস্তান' হওয়া তো সময়ের ব্যাপার।
এখানেই দায়িত্ব নিতে হবে দেশের মানুষকে। আমরা যদি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রই চাইতাম তাহলে একাত্তরে এতো রক্ত দিয়ে, এতো নারীর আব্রুর বিনিময়ে বাংলাদেশ দরকার ছিলো না। পাকিস্তানেই থাকতে পারতাম। থাকতাম। এই স্বাধীন বাংলাদেশে পরাজিত শক্তির সংবিধান তাই চলতে পারে না। আমাদের সংস্কৃতি আমাদের সার্বভৌমত্বকে তারা চ্যালেঞ্জ করে পার পেতে পারে না। 'ধর্মগাধা'দের ঠেকাতে জরুরী সংস্কৃতির চাবুক। দরকার এদের গোপন অভিসন্ধি সম্পর্কে সচেতনতা। প্রতিটি ঘটনা চ্যালেঞ্জ করে সত্যটা প্রকাশ করতে হবে মিডিয়ায়। জানাতে হবে কারা এসব কুচক্রী, কী তাদের রাজনৈতিক অভিপ্রায়। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে একটা বড় বাধা ধর্মান্ধ শক্তি। এদের প্রশ্রয় না দিয়ে প্রতিরোধ করাটাই হোক দিনের অঙ্গীকার। না হলে হেরে যাবেন মুক্তিযোদ্ধারা। হেরে যাবেন বীরাঙ্গনারা। হেরে যাবে বাংলাদেশ।
ওরা প্রতিটি ঘটনা ঘটিয়ে আমাদের প্রতিক্রিয়া দেখছে। আমাদের সম্মিলিত জোর দেখছে। আমাদের প্রতিবাদের ওজন যাচাই করছে। প্রতিরোধের লড়াইয়ে আমরা কতখানি প্রস্তুত সেটা দেখছে। সেই লড়াইটা আরো জোরদার করাই এখন সময়ের দাবি।