অর্থনীতি, রাজনীতি, নির্বাচনসহ আরও কিছু বিষয়েও সরকারের সমালোচনা ও করণীয় উঠে আসে ‘রাজনীতি অর্থনীতি: বাংলাদেশ এখন’ শীর্ষক আলোচনায়।
Published : 05 May 2024, 12:21 AM
দুর্নীতি এখন ব্যবস্থাপনায় যুক্ত হয়ে গিয়েছে মন্তব্য করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, দুর্নীতি বেড়ে যাওয়ার আরেক কারণ হচ্ছে জবাবদিহিতা না থাকা।
শনিবার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টার ইন এ ঢাকা ফোরাম আয়োজিত ‘রাজনীতি অর্থনীতি: বাংলাদেশ এখন’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির মধ্যে গত দেড় দশক ধরে সম্পর্কটা কেমন হয়েছে সেটির বিশ্লেষণ হওয়া প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি।
তার ভাষ্য, ‘‘আমরা শুনে থাকি উন্নয়ন হয়েছে, দুর্নীতি হয়েছে। এমন কথাও প্রচলন আছে মাঠে যে, উন্নয়ন হলে দুর্নীতি কিছুটা হবে। কিন্তু দুর্নীতি এখন আমাদের ব্যবস্থাপনায় যুক্ত হয়ে গেছে।’’
তিনি বলেন, দুর্নীতি বেড়ে যাওয়ার আরেক কারণ হচ্ছে জবাবদিহিতা না থাকা।
’সরকার ও প্রশাসনে জবাবদিহিমূলক আচরণ অনুপস্থিত হওয়ার কারণ’ হিসেবে তিনি নির্বাচনি ব্যবস্থার কথা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, ‘‘শুধু ৭ জানুয়ারির নির্বাচন নয়, অতীতের ধারাবাহিকতায় দেখেছি নির্বাচনি ভোটটা অনুপস্থিত হয়ে গেছে।’’
যশোরের হাইটেক পার্ক এখন কমিউনিটি সেন্টারের জন্য ভাড়া দিতে হচ্ছে মন্তব্য করে জিল্লুর রহমান বলেন, ‘‘গত ১৫ বছরে উন্নয়নের অর্থায়নটা ঋণ নির্ভর হয়ে গেছে। উন্নয়ন খরচের অদক্ষতা অনেক বেড়ে গেছে। একদিকে ঋণ নির্ভর উন্নয়ন আমাদের ব্যবস্থাপনায় একীভূত হয়ে গেছে। আর অদক্ষতা ও জবাবদিহিতায় ধস নেমেছে।
”তৃতীয়ত ব্যাংকিং খাতে নিয়মনীতি তৈরি হচ্ছে দুর্নীতির প্রয়োজনে। নীতি তৈরি করা হচ্ছে নির্দিষ্ট কোনো দুর্নীতি করতে। এভাবে দুর্নীতি করা হচ্ছে।’’
দুর্নীতি করে ধরা পড়লেও বিচার হচ্ছে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘‘আপনি দুর্নীতি করছেন সমস্যা নেই। বলা হচ্ছে, আর করিস না। এভাবে দুর্নীতি আমাদের সিস্টেমে একীভূত হয়ে গেছে।’’
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখতে আমদানি নিয়ন্ত্রণের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘‘সামষ্টিক অর্থনীতিতে একধরনের শূন্যতা তৈরির আভাস দেখতে পাচ্ছি। আর্থিক হিসাবে কিন্তু ঘাটতি এখনও আছে। কর্মসংস্থানের জন্য শিক্ষিত যুবকরা দেশ ছাড়ছে। এতে ব্রেইন ড্রেন হচ্ছে। মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার সময়ে এটি কাঙিক্ষত না।’’
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী অধ্যাপক ও গবেষক আলী রিয়াজ বলেন, ‘‘ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ চলছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষতি হচ্ছে।
”এসব ঘটনার বাইরেও বড় একটি ঘটনা ঘটেছে, তা হলো ক্ষমতায় বর্হিশক্তির ব্যবহার বেড়েছে। বিশেষ করে রাজনীতিতে প্রতিবেশী দেশ ভারতের বড় ভূমিকা আছে বলে মনে করি।’’
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘অর্থনীতি একটি জটিল পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে তা সাধারণ মানুষও বোঝে। প্রথমত, মূল্যস্ফীতির সঙ্গে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের দায়-দেনা বড় আকারে যুক্ত হয়েছে অর্থনীতিতে। বৈদেশিক ঋণ সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতেও বাড়ছে। এটি বিনিময় হারের উপর চাপ তৈরি করছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমিয়ে দিচ্ছে।’’
মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির ধারা ধীর হয়ে গেছে এবং তা সরকারি বিনিয়োগের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে বলেও তার পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন তিনি। খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ও আয় বৈষম্য বাড়ার প্রভাব কর্মসংস্থানে পড়ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তার মতে, ‘‘যে রাজনৈতিক জবাবদিহিতার মধ্যে উন্নয়ন রাষ্ট্র পরিচালনার কাজটি হওয়ার কথা ছিল, তা হচ্ছে না। স্বার্থ সংশ্লিষ্ঠদের গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে সব খানে। তারা এক ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপানয় কু-প্রভাব বিস্তার করছে। তাদের মোকাবেলা করার জন্য যে রাজনৈতিক শক্তি করার তা দেখা যাচ্ছে না কোথাও। সরকারেও তা হচ্ছে না।’’
এর সমাধানে শুধু সমালোচনা করলেই হবে না বলেও মন্তব্য করেন দেবপ্রিয়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জমান বলেন, ‘‘সুশাসনের অভাবে রাষ্ট্রীয় নীতিগুলো একটি গোষ্টী ছিনতাই করে নিচ্ছে। তাদের সুবিধা মতো করছে। পরিস্থিতির উন্নয়নে রাজনৈতিক দলগুলো কিছু করতে পারছে না, এটা সত্য। এজন্য অতীতের মতো সুশীল সমাজ ও সাধারণ মানুষের ভূমিকা রাখা দরকার।’’
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, “বিদ্যুৎ খাতে ভুর্তুকি দেওয়া হচেছ আমাদের অদক্ষতা ও দুর্নীতির কারণে। এখন ভর্তুকির ৮১ শতাংশই দেয়া হচ্ছে ক্যাপাসিটি চার্জে, এটি তো দুর্নীতি।
”ব্যবসায়ী শ্রেণি এখন ব্যাংক খাতে লুটপাট করছে। তারা অর্থপাচার করছে তাদের কিছুই হচ্ছে না।”
তিনি বলেন, ‘‘আমি বিশ্বাস করি তত্ত্বাবধায়কের অধীনে ছাড়া নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। স্থানীয় নির্বাচন সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বর্জন করছে। তারা কেন করছে এটি, স্থানীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে তো পুরো নির্বাচন থেকে দলগুলো সরে যাবে।’’
সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘সরকারকে অর্থনীতির সমালোচনাকে গ্রহণ করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে আছে। এতে অর্থনীতির নীতি ভারসাম্য ঠিক থাকতো। বাজারকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে কিছু মানুষকে সুবিধা দেয়া দিলে তো হবে না।’’
আরও বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, অর্থনীতিবিদ মোহাম্মদ ইসলাম।