এমন স্পর্ধা এরা পায় কোথায়?

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 3 April 2022, 03:11 PM
Updated : 3 April 2022, 03:11 PM

নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব পুলিশের। মানুষ বিপদে পড়লে, আক্রান্ত হলে, জীবন ও সম্পদনাশের আশঙ্কা দেখা দিলে পুলিশের কাছেই ছুটে যায় মানুষ। তবে আশঙ্কার কথা এটাই যে ইদানীং পুলিশও নাগরিকদের বিপদ বিপন্নতার কারণ হচ্ছে। অপরাধ দমনের দায়িত্ব পালন না করে পুলিশ অপরাধ সংঘটন করে মাঝেমধ্যেই খবর হয়ে উঠছে। 

এরই ধারাবাহিকতায় একজন পুলিশের বিরুদ্ধে নারী প্রতি অসম্মানজনক আচরণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। রাজধানীর তেজগাঁও কলেজের থিয়েটার অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষক লতা সমাদ্দার রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় সাধারণ ডায়েরি করে অভিযোগ করেছেন, কপালে টিপ পরায় পুলিশের পোশাক পরা এক ব্যক্তি তাকে হেনস্তা করেন।

লতা সমাদ্দার গণমাধ্যমকে বলেন, "শনিবার সকাল ৮টা ২০ মিনিট থেকে সাড়ে ৮টার মধ্যে ফার্মগেট মোড় পার হয়ে তেজগাঁও কলেজের দিকে যাওয়ার সময় ঘটনাটি ঘটে। সেজান পয়েন্টের সামনে বন্ধ করে রাখা মোটরবাইকের ওপর বসে যে গালি দিয়েছেন তা লেখার যোগ্য নয়। আমি পেছন ফিরে গিয়ে তাঁর আচরণের প্রতিবাদ করায় আরও গালিগালাজ করেন। তবে ওই ব্যক্তির নাম বা পদবি খেয়াল করার কথা মাথায় ছিল না। কথা বলার একপর্যায়ে বলতে গেলে আমার গায়ের ওপর দিয়ে বাইক চালিয়ে দিচ্ছিলেন। আমি বাধ্য হই পিছিয়ে যেতে। তবু আমার পায়ে আঘাত লাগে। বাইকটি চালানোর পর বাইকের নম্বর যতটুকু মনে আছে তা পুলিশকে দিয়েছি।"

এই ঘটনা প্রচার হওয়ার পর সামাজিক মাধ্যমে তীব্র আলোড়ন তৈরি করেছে। অনেক নারী,  তা তিনি যে ধর্ম বিশ্বাসী হয়ে থাকুন না কেন, লতা সমাদ্দারকে হেন্থা করার প্রতিবাদ জানিয়ে নিজের টিপ পরা ছবি পোস্ট করছেন। বিষয়টি ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। পুলিশের বিরুদ্ধে দুষ্কর্মের অভিযোগ আগেও একাধিক বার উঠেছে। মধ্যরাতে সিএনজি আটকে নারীদের হয়রানি করা, বিনা অনুমতিতে ভিডিও করে পোস্ট করার অভিযোগ উঠেছিল পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে, যেসব ঘটনায়ও সামাজিক যোগযোগমাধ্যম এবং গণমাধ্যমে তীব্র সমালোচনা হয়েছিল । কিন্তু প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা শোনা যায়নি। 

টিপ নিয়ে হেনস্তার ঘটনা সম্পর্কে শেরেবাংলা নগর থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উৎপল বড়ুয়া বলেছেন, "পুলিশের পোশাক পরা এক ব্যক্তি খারাপ ব্যবহার করেছেন জানিয়ে অভিযোগ করেছেন একজন নারী। তিনি ওই ব্যক্তির নাম বা পদবি বলতে পারেননি। একটি মোটরবাইকের নম্বরের কয়েকটি ডিজিট বলতে পেরেছিলেন, কিন্তু তা থেকে গাড়িটি শনাক্ত করা যায়নি। আমরা এখন বিভিন্ন তথ্যপ্রযুক্তি দিয়ে যাচাই-বাছাই করছি। তাকে শনাক্ত করতে পারলে আমরা পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা নেবো। আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়টা নজরদারি করছেন। তদন্তের আলোকে অপরাধ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ ব্যবস্থাই নেওয়া হবে।"

পুলিশের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ উঠলে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়, এই প্রশ্নের জবাবে পুলিশের  একজন কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেছেন, ফৌজদারি এবং বিভাগীয় দুই ধরনের ব্যবস্থাই নেওয়া হয়ে থাকে। ফৌজদারি ব্যবস্থা হলে আইনের দণ্ডবিধির সংশ্লিষ্ট ধারা অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। সেটা বাদী নিজে করতে পারে বা পুলিশও করতে পারে। অপকর্মের জন্য অনেক পুলিশের বিরুদ্ধে মামলার নজীর রয়েছে। অন্যদিকে বিভাগীয় ব্যবস্থা ক্লোজ করা, তদন্ত কার্যক্রম করা, সাময়িক বা স্থায়ী বরখাস্ত হতে পারে। কোনো কোনো ঘটনায় একই সঙ্গে উভয় ধরনের ব্যবস্থাও নেওয়া হতে পারে ।

লতা সমাদ্দারকে যে পুলিশ হয়রানি করেছে তার আদৌ কোনো শাস্তি হবে কি না তা নিয়ে নাগরিকদের মধ্যে সংশয় আছে। তবে এই ঘটনাটি জাতীয় সংসদেও উঠেছে। সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ সুবর্ণা মুস্তাফা বিষয়টিকে দল-মত নির্বিশেষে বিশেষ করে নারী সমাজের জন্য এটি অত্যন্ত ঘৃণিত একটি ঘটনা উল্লেখ করে প্রশ্ন তুলেছেন, "বাংলাদেশের কোন সংবিধানে, কোন আইনে লেখা আছে যে একজন নারী টিপ পরতে পারবে না। এখানে হিন্দু-মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ এমনকি সে বিবাহিত না বিধবা সেটা বিষয় নয়। একটি মেয়ে টিপ পরেছে। তিনি একজন শিক্ষক। রিকশা থেকে নামার পর দায়িত্বরত পুলিশ অফিসার টিজ করেছেন।"

ওই নারী প্রতিবাদ করলে তার সঙ্গে অশালীন ব্যবহার করা হয়-এই মন্তব্য করে সুবর্ণা বলেছেন, "আমি সরকারি দলকে রিপ্রেজেন্ট করি, না বিরোধী দলকে রিপ্রেজেন্ট করি-বিষয়টা এগুলোর ঊর্ধ্বে। প্রধানমন্ত্রী সবসময় বলেন, মানুষ আগে। মানুষের অধিকার আগে। জাতির পিতা বলেছেন, মানুষকে ভালোবাসতে হবে। মানুষের অধিকার আগে।"

সবচেয়ে বড় কথা আমাদের সংবিধানে নাগরিকদের ধর্মের স্বাধীনতা, পোশাক নির্বাচনের স্বাধীনতা, নিজের মতো চলাফেরার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদে আছে: ''সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।''

২৮ নম্বর অনুচ্ছেদে আরও আছে: 

(১) ''কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।"

(২) ''রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারীপুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন।''

এছাড়াও সংবিধানের দ্বিতীয়ভাগে স্পষ্ট করেই লেখা আছে :

"১২। ধর্ম নিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য,

(ক) সর্ব প্রকার সাম্প্রদায়িকতা,

(খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান,

(গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার,

 (ঘ) কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ণ বিলোপ করা হইবে।"

একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রত্যাশা ছিল সব ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষের রক্ত ও ত্যাগের মাধ্যমে স্বাধীনতা পাওয়া দেশটি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সব মানুষের বাসযোগ্য একটি রাষ্ট্রই হবে। মানুষের এই ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটেছিল নতুন রাষ্ট্রের প্রথম সংবিধানে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশের যে রাজনৈতিক উল্টোযাত্রা শুরু হয় তা থেকে আর পরিপূর্ণভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। পরিকল্পিত প্রচারণার মাধ্যমে  একটু একটু করে ধর্মীয় গোঁড়ামির বিস্তার ঘটানো হয়েছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশটিকে  অনুদার ও সাম্প্রদায়িক মানুষের দেশ বানানো হয়েছে। বেশিট ভাগ মানুষের মনমানসিকতা ক্রমশ প্রচণ্ড নারীবিরোধী হয়ে উঠছে। ভিন্ন ধর্মের নারীর ক্ষেত্রে এই বিরোধিতা বিদ্বেষ, ঘৃণা ও আক্রোশে পরিণত হয়। সাধারণভাবে নারীর পোশাক নিয়ে এক ধরনের পশ্চাৎপদ মানসিকতা তৈরি হয়েছে। রাস্তায় চলাচল করতে গিয়ে অনেক নারীকেই  হয়রানি-অপমান-কুমন্তব্যের শিকার হতে হয়। দেশে বসবাসকারী সবাইকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম ও আচার পালনে বাধ্য করার মতো মূঢতা কিছু ধর্মান্ধ মানুষকে পেয়ে বসেছে।  সংখ্যাগরিষ্ঠের বিশ্বাস ও মর্জি অনুযায়ী সবাইকে চলতে  বাধ্য করার পরিণাম ভালো হতে পারে না। 

রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দেওয়া যাবে না, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার করা যাবে না, এই অবস্থান থেকে রাষ্ট্র এখন সরে এসেছে বলে মনে হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারা বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার কতটুকু দৃঢভাবে অনুসরণ করছে তা নিয়ে এখন অনেকের মনেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থ উদ্ধারের সংকীর্ণ উদ্দেশ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের পক্ষে দাঁড়াতে দোদুল্যমানতা দেখানো, তাদের জীবনে ক্ষতি ডেকে আনা কিংবা ধর্মকে ব্যবহার করে মানুষকে অসহিষ্ণু ও উত্তেজিত করে তোলার ফল ক্ষতিকর হতে বাধ্য। ধর্ম বিশ্বাসের কারণে মানুষের প্রতি বৈষম্য দেখানো বা তাদের নিপীড়ন করা কোনোভাবেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসীদের রাজনীতি হতে পারে না।

বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী চিরায়ত সংস্কৃতি চর্চার পথ রুদ্ধ করে, বিদ্বেষমূলক ধর্মীয় প্রচারণা চালানোর পথ সুগম করে দিলে গোঁড়া ধর্মবিশ্বাসীর সংখ্যা বাড়বে হয়তো, কিন্তু কমতে থাকবে মানুষ।

লতা সমাদ্দার একজন শিক্ষক। তার স্বামী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষক। আলোর ফেরিওয়ালা দম্পতির জীবনে যে ব্যক্তি কালো রং ছিটিয়ে দিয়েছে, তাকে শনাক্ত করে শাস্তির আওতায় আনতে না পারলে সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা কমবে। 

লেখাটির কলেবর না বাড়িয়ে শেষ করছি দুইজন নারীর ফেইসবুক পাতায় লেখা তাদের প্রতিক্রিয়া উদ্ধৃত করে। 

সৈয়দা তানজিনা ইমাম নিজের কপালে বড় একটি টিপ পরা ছবি পোস্ট করে লিখেছেন : 'টিপ ছাড়া এ মুহূর্ত ভাবতেই পারি না। স্নান খাওয়া ঘুমের সময়ও টিপ থাকে কপালে। যখন নিজে থেকে পরে যায় তখন নতুন করে আরেকটা টিপ পরি। টিপ যেন আমার আরেক পরিচয়। আমার শিক্ষার্থীদের প্রিয় আমার টিপটি। বহু বছর পরে দেখা হলেও টিপের কথা বিশেষ করে তারা বলবেই। আমার মা এখনো টিপ পরেন। শাড়ি টিপ বাঙালি নারীর পরিচয়। আমি টিপ পরবো। আমার সজ্জা আমার স্বাধীনতা, আমার অধিকার। আমার কপালের টিপ যার পছন্দ হবে না সে এ ভূখন্ডে কোনো অংশী নয়।"

সাবিনা ইয়াসমিন মাধবী নামের এক নারী নিজের ফেইসবুক পাতায় লিখেছেন, "একজন নারীকে রাস্তায় বিভিন্ন ভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়। প্রতিদিন প্রতিনিয়ত আমি নিজেও হই।তাই বলে পুলিশের পোশাক পরা একজন সরকারি কর্মচারী হয়ে নারীকে হয়রানি? এত বড় দুঃসাহস? আমি এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।"