Published : 02 Mar 2022, 04:11 PM
চীন এক অভিনব প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশকে। চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত চারটি কোম্পানি অর্থাৎ চীন সরকার নিজেদের খরচে চট্টগ্রাম মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়নের একটি প্রস্তাব দিয়েছে। বিনিময়ে তারা বাংলাদেশের উপকূলে মীরসরাইয়ের কাছে সমুদ্র থেকে জেগে ওঠা জমিতে একটি টাউনশিপ বা স্মার্ট সিটি গড়ে তুলবে। সেখান থেকেও বাংলাদেশকে তারা একটি লভ্যাংশ দিতে চায়। অর্থাৎ চীন মেট্রোরেল এবং স্মার্ট সিটি দুটোই নিজেদের খরচে করতে চায়। চীনের এই প্রস্তাবের মাত্র কয়েকদিন আগে দক্ষিণ কোরিয়ার উন্নয়ন সংস্থা কোইকা বিনিয়োগ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের বডি ল্যাঙ্গুয়েজে মনে হচ্ছে তারা চীনের বিনিয়োগের ব্যাপারে অধিক আগ্রহী। কিন্তু এই ফাঁদে বাংলাদেশ পা দেবে কি? একটু হিসাব কষলেই বাংলাদেশের কাছে পরিষ্কার হতে পারে চীনের উদ্দেশ্য। তাতে বিপদগুলো বুঝতেও বাংলাদেশের কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা না। চীনের বিনিয়োগের এই লোভ বাংলাদেশকে পেয়ে বসলে কী পরিণতি হতে পারে তার বিশ্বব্যাপী উদাহরণ আছে। ইতোমধ্যেই তো অনেক হলো!
চীন যে শুধুই নির্দোষ বিনিয়োগের জন্য এই প্রস্তাব রেখেছে এরকম ভাবার কোনো অবকাশ নেই। চীনের পরিকল্পনাগুলো এখন আর কোনো লুকোচুরির বিষয়ও নয়। সেটা বুঝতে হলে প্রথমে জানা দরকার চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনেশিয়েটিভ কী, এর উদ্দেশ্য ও কৌশলগুলো কী? প্রাথমিকভাবে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর উচ্চাভিলাসী প্রকল্পের নাম ছিল 'One Belt One Road'। জিনপিং-এর ২০১৩ সালে কাজাকিস্তান সফরের মধ্য দিয়ে প্রাথমিকভাবে এর পত্তন। এই উদ্যোগের মাধ্যমে ইতোমধ্যেই বিশ্বের ৭০টি দেশে বাণিজ্য এবং সেই সঙ্গে চীনের রাজনৈতিক প্রভাব ও কোথাও কোথাও ঋণের বোঝা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রথম পর্যায়ে এর উদ্দেশ্য ছিল প্রাচীন সিল্ক রোড উন্মুক্ত করা অর্থাৎ ইউরেশিয়ার মধ্যে বাণিজ্য পথ তৈরি। কিন্তু বর্তমান Belt and Road Initiative (BRI) হলো প্রায় সমস্ত বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিনিয়োগ, বাণিজ্যের পাশাপাশি চীনের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের এক মহাপরিকল্পনা। এই রোড হলো মেরিটাইম রোড। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য দক্ষিণ চীন সাগর ও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের সমুদ্রপথকে ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও উচ্চাভিলাসী। চীন এতে দুই দিক দিয়ে সফলতার কৌশল অবলম্বন করেছে। চীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল আমদানিকারক দেশ। বিআরআই চুক্তির মাধ্যমে চিন নতুন বাণিজ্য ও জ্বালানী উৎস বিস্তার করে চলেছে। সেটা খারাপ কিছু বলা যাবে না, কেউ বাণিজ্য করতে চাইলে তাকে খুব দোষারোপ করাও যায় না। কিন্তু বাণিজ্যের পাশাপাশি তারা রাজনৈতিক ফায়দা আদায় করতে তৎপরতা চালাচ্ছে অর্থের প্রয়োজন এমন দেশগুলোকে ভারী ঋণ দিয়ে আটকে ফেলার মধ্য দিয়ে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অধিকাংশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। এই দেশগুলোকে ঋণগ্রস্থ করে চীন আষ্টেপৃষ্ঠে বেধে ফেলার কৌশল গ্রহণ করেছে। এ ধরনের ঘটনার বেশকিছু উদাহরণ রয়েছে। প্রথমেই শ্রীলঙ্কার দিকে তাকানো যেতে পারে। শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ায় সুযোগটি গ্রহণ করেছে চীন। শ্রীলঙ্কার চাহিদার অধিক ঋণ দিয়েছে চীন। শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর প্রকল্প তৈরির পূর্বে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে দেখা যায় এই বন্দর তৈরি হবে একটি অসফল প্রকল্প। সে কারণেই ভারত এই বন্দরে বিনিয়োগে অনীহা প্রকাশ করে। কিন্তু তাতে চীনের কী! চীন ভারী বিনিয়োগে এগিয়ে আসে। চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত সর্ববৃহত 'চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি'র সঙ্গে এটির দায়িত্ব নিয়েও ব্যর্থ হয়। হাজার হাজার জাহাজ শ্রীলঙ্কার এই রুটে যাতায়াত করলেও বন্দরটির সক্ষমতার অভাবে ২০১২ সালে সেখানে মাত্র ৩৪টি জাহাজ বন্দরে প্রবেশ করে। শ্রীলঙ্কার ব্যর্থতার ফল লাভ করে চীন। ঋণের অর্থ না দিতে পেরে প্রচণ্ড চাপে শ্রীলঙ্কা ১৫ হাজার একর জায়গাসমেত চীনের কাছে বন্দরটি ৯৯ বছরের জন্য ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
পাকিস্তানের অর্থনৈতিক মন্দাভাব দীর্ঘকালের। পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় ঋণদাতা এখন চীন। ২০১৩ সালে গৃহীত চীন-পাকিস্তান ইকোনোমিক করিডোর হলো বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভেরই অংশ। যোগাযোগ, জ্বালানী, বিদ্যুৎ সর্বক্ষেত্রে এখন চীনের বিনিয়োগ। ২০১৩ সালে পাকিস্তানের ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৪.৩৫ বিলিয়ন ডলার, যার ৯.৩ শতাংশ ছিল চীনের নিকট। ২০২১ সালে পাকিস্তানের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯০.১২ বিলিয়ন ডলার, যার ২৭.৪ শতাংশই চীনের নিকট। পাকিস্তান দুটি কারণে চীনের নিকট দায়বদ্ধ হয়ে পড়েছে– ১. অর্থ, ২. চীনের ওপর রাজনৈতিক ভরসা। বিশেষ করে ভারতের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক তৎপরতার জন্য চীনের সহায়তা প্রয়োজন তাদের। জাতি হিসাবে পাকিস্তান অর্থনৈতিক অগ্রগতির চেয়েও ভারতের সঙ্গে বিরোধীতাকে অধিক প্রাধান্য দিয়ে থাকে, যার ফলস্বরূপ দেশটি দিনে দিনে অর্থনৈতিকভাবে অধিক দুর্বল হয়ে পড়ছে। উল্লিখিত দুটি কারণে পাকিস্তানের গোটা অর্থনীতিকেই গ্রাস করে ফেলছে চীন। ২০১৬ সালে পাকিস্তানের শেয়ার বাজারের ৪০ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয় চীনের একটি কনসোর্টিয়াম। ২০১৮ সালে আলীবাবার একটি প্রতিষ্ঠান পাকিস্তানের টেলিনর মাইক্রোফিনান্স ব্যাংকে ১৮৪. ৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে ৪৫ শতাংশ কিনে নেয়। ২০২০ সালে দুটি চাইনিজ কোম্পানি ফয়সালাবাদের সেলফোন ম্যানুফাকচারিং প্ল্যান্ট তৈরির জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। লাহোরে চাইনিজ টেক্সটাইল ম্যানুফাকচারার স্পোর্টস পোশাক তৈরির জন্য অবকাঠামো তৈরি করেছে। এমনকি রক্ষণশীল পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে, যে দেশে ইসলামিক শরিয়াহ কার্যকর, সেখানে হুই কোস্টাল ব্রিউয়ারি অ্যান্ড ডিসটিলারি একটি বিয়ার তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠা করছে। এভাবেই পাকিস্তান জড়িয়ে পড়ছে চীনের ঋণের জালে। দেশটির ভবিষ্যত তাই অন্ধকারাচ্ছন্ন বলেই বিশ্বের বড়বড় অর্থনীতিবিদরা ধারণা করছেন।
দক্ষিণ এশিয়ার আরেক দেশ লাওস। ইতোমধ্যেই অবকাঠামো উন্নয়ন ও হাইস্পিড রেলওয়ে প্রকল্পের জন্য ৬ বিলিয়ন ডলারের অধিক ঋণের বোঝা মাথায় নিয়েছে তারা। এই যৌথ উদ্যোগের ৭০ শতাংশ শেয়ার চীনের। ৬২১ মাইল দীর্ঘ এই রেলওয়েটি চীনের কুনমিঙ থেকে রাজধানী ভিয়েনশিয়েন পর্যন্ত দীর্ঘ। পরিকল্পনা রয়েছে এই রোড থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে।
ভেনিজুয়েলার হুগো শ্যাভেজ এবং তার উত্তরসূরি নিকোলাস মাদুরোর সঙ্গে রাজনৈতিক কারণে পশ্চিমা দেশগুলোর রয়েছে বৈরি সম্পর্ক। এক পর্যায়ে তেলসমৃদ্ধ ভেনিজুয়েলার তেল উৎপাদন তলানিতে গিয়ে পৌঁছে। সুযোগ গ্রহণ করে চীন। ভেনিজুয়েলার রয়েছে বিশাল তেলের মজুদ। সেটা চীনের চোখ এড়ায়নি। ভেনিজুয়েলার অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক সরকারের সঙ্গে লোনস ফর অয়েল পার্টনারশিপ চুক্তি করে। বর্তমানে ভেনিজুয়েলা চীনের নিকট ১৯ বিলিয়ন ডলার ঋণের দায়ে রয়েছে। আকরিক, লোহাসহ বিভিন্ন খাতে চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের কয়েক বিলিয়ন ডলার ঋণ রয়েছে। কোনো কোনা ক্ষেত্রে ভেনিজুয়েলাকে ৭৫ শতাংশ ছাড়ে খনিজ দ্রব্য সরবরাহ করতে হচ্ছে যা দেশটির ঋণের বোঝাই কেবল ভারী করবে। চীন ইকুয়েডরকেও এমনভাবে ঋণের দায়ে ফেলছে যে দেশটির ১৩ বিলিয়ন ডলারের তেলের বাজারের লাভ চীনের পেটে গিয়ে নামছে। তেলের বাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমে তারা কিন্তু তেল চীনে আনছে না বরং ইকুয়েডরেরই স্থানীয় কোম্পানির কাছে বিক্রি করছে। সেই সঙ্গে ইকুয়েডরের গালাপাগোস আইল্যান্ডের আশেপাশে চীনের শতশত মাছধরা নৌযান অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু ইকুয়েডোরের তা নিয়ে বলার কিছু নেই।
চীনের ঋণের বোঝা ইতোমধ্যেই টানতে শুরু করেছে অ্যাঙ্গোলা, কেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, জাম্বিয়া, ক্যামেরুন, উগান্ডা, নাইজরিয়া, কঙ্গো ও ইথিওপিয়া। দক্ষিণ আমেরিকায় ব্রাজিল, ইকুয়েডর, আর্জেন্টিনা এবং ভেনিজুয়েলাতে চীনের তৎপরতা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সারা বিশ্বে চীনের নিকট থেকে ঋণ নেওয়া দেশের সংখ্যা ৭০টি। লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, চীনের বিনিয়োগ যেসব দেশে সর্বাধিক সে দেশগুলোতে অথরিটারিয়ান সরকার বসে আছে।
বাংলাদেশে আজ যে শিশু জন্মগ্রহণ করছে, তার মাথায় বৈদেশিক ঋণের বোঝা ২৩,৪২৫ টাকা। বাংলাদেশে চীনের ঋণের পরিমাণ ইতোমধ্যেই ৩৮ বিলিয়ন ছাড়িয়েছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, জাইকার মতো প্রতিষ্ঠানে সুদের হার ০.৭৫ শতাংশ হলেও চীনকে পরিশোধ করতে হবে সার্ভিস চার্জসহ ২.৪৫ হারে। সেই সঙ্গে চীনের কনসালট্যান্ট নিয়োগ, ইক্যুইপমেন্ট চীন থেকে ক্রয়, ঠিকাদার নিয়োগ সংক্রান্ত শর্তাবলী তো আছেই। সুতরাং চীনের কাছে এভাবে শ্রীলঙ্কার মতো, পাকিস্তানের মতো বাধা পড়া উন্নয়নের স্বার্থে কতটা যৌক্তিক সেটা ভাবতে হবে।