লবি বা মামলা করে কি র‍্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার সম্ভব?

সাঈদ ইফতেখার আহমেদসাঈদ ইফতেখার আহমেদ
Published : 1 March 2022, 05:24 PM
Updated : 1 March 2022, 05:24 PM

বাংলার ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় ইউরোপীয়দের কাছে প্রথম লবি বা দেনদরবার করেন সৈয়দ মীর জাফর আলী খান। ইরানি বংশোদ্ভূত মীর জাফর ছিলেন পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্রধান সেনাপতি এবং প্রধান বিশ্বাসঘাতক। তিনি ব্রিটিশদের কাছে লবি করেছিলেন যে, যুদ্ধে সিরাজ পরাজিত হলে তাকে যেন বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব করা হয়।

মীর জাফর লবি করে সফল হয়েছিলেন। কেননা মীর জাফর এবং ইংরেজদের স্বার্থ এক বিন্দুতে মিলেছিল। একটি বিদেশি রাষ্ট্রের কাছে লবি করে সফল হবার মূলসূত্র এই জায়গাটিতে। অর্থাৎ লবি যারা করছেন, তাদের সাথে বিদেশি রাষ্ট্রটির স্বার্থ এক জায়গায় মিলে গেলেই লবি করে সফলতা পাওয়া যায়। কিন্তু দুই পক্ষের স্বার্থ যদি ভিন্নমুখী হয়, তাহলে সেখানে লবি কোনও সুফল বয়ে আনে না।

বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে যারা অ্যাকাডেমিক পর্যায়ে পড়াশোনা করেন তারা জানেন, মার্কিন যুক্ত্ররাষ্ট্র থেকে মালদ্বীপ– দুনিয়ার সমস্ত রাষ্ট্র তাদের ভৌগলিক সীমানার বাইরে নিজেদের সর্বোচ্চ স্বার্থ নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়েই পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করে।

রাজনীতিবিদ এবং নীতিনির্ধারকেরা যখন দেশের স্বার্থের বাইরে গিয়ে বিদেশি রাষ্ট্রের অনুকূলে লবি করেন বা সিদ্ধান্ত নেন তখন বাংলাদেশে তাদেরকে বলা হয় মীর জাফর বা বিশ্বাসঘাতক। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বলা হয় 'কুইসলিং'। উল্লেখ্য, মীর জাফরের মতো নরওয়ের ভিদকুন কুইসলিং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি জার্মানির সহায়তায় সে দেশের ক্ষমতা দখল করেছিলেন।

সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর মীর জাফর নবাব হয়েছিলেন। তবে চুক্তি ছিল এর বিনিময়ে তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে পাঁচ লক্ষ পাউন্ড ও কলকাতায় বসবাসকারী ইউরোপীয়দের আড়াই লাখ পাউন্ড দিবেন। তিনি সেই চুক্তি পালনে ব্যর্থ হওয়ায় ইংরেজরা তাকে পরবর্তী সময়ে ক্ষমতাচ্যুত করে। এর মধ্য দিয়েই ভারতীয় উপমহাদেশে প্রায় দুইশ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের সূত্রপাত হয়।

ঔপনিবেশিক শাসন থেকে পাকিস্তান আমল হয়ে এরশাদের সামরিক শাসনের সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের মূলধারার রাজনীতিবিদদের দেশের বিষয় নিয়ে ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ধর্ণা দিতে দেখা যায়নি। জনগণের ওপর নির্ভর করে, আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে দেশের সমস্যার সমাধান– রাজনীতিবিদরা তখন এভাবেই বুঝতেন।

রাজনীতিবিদদের মূল মতাদর্শ ছিল বিভিন্ন ঘরানার জাতীয়তাবাদ। ফলে বাইরের কারো পরামর্শ নিয়ে তাদের চলতে হবে, বিষয়টিকে তারা এভাবে দেখতেন না। তবে ব্যতিক্রম ছিল 'মস্কোপন্থি' ঘরানার বামপন্থিরা বা আজকের সিপিবি। আন্তর্জাতিকতাবাদের কথা বলে বাস্তবে তারা জাতীয় রাজনীতির বিশ্লেষণ এবং কর্মপদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর নির্ভরশীল ছিল।

৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পর আস্তে আস্তে অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি জনগণ নব্বই পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে প্রত্যাশা করেছিল, তারা তা পূরণে ব্যর্থ হয়। এ সময়কালেই প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে দেশের সমস্যা নিয়ে ধর্ণা দিতে দেখা যায়। তবে, জনগণের কাছে যেটা প্রতীয়মান হয় সেটা হলো, দেশের সমস্যা সমাধানের চেয়ে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর সমর্থনে ক্ষমতায় যাওয়াটাই যেন ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। বস্তুত এর ফলেই রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর জনগণের আস্থার ঘাটতি পরিলক্ষিত হতে থাকে।

শুধু মূলধারার দল নয়, ইসলামপন্থীদেরও বিশেষত জামায়াতকে দেখা যায় যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে ব্যাপকভাবে ধর্ণা দিতে। এমনকি মরিয়া হয়ে তাদেরকে ঢাকাস্থ রুশ দূতাবাসের কাছেও সাহায্য চাইতে দেখা যায়।

সুবিধাজনক অবস্থানে থেকে দীর্ঘসময় ধরে রাজনীতি করবার পরও, বাংলাদেশে 'ইসলামপন্থা' মূলধারার রাজনীতি হিসাবে বিকশিত না হবার অন্যতম কারণ হলো পশ্চিমা রাজনীতি, সমাজ ব্যবস্থা, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতির প্রবল বিরোধিতা করে আবার সেই পশ্চিমাদের কাছেই আবেদন নিবেদন করবার দ্বিচারিতা।

দ্বিচারিতা শুধু ইসলামপন্থিদের মাঝে নয়, বামপন্থিদের মাঝেও প্রবল। এ কারণে তাদের রাজনীতিও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। তারা বাংলাদেশের সরকারগুলোকে মনে করে অগণতান্ত্রিক। কিন্তু স্তালিনের সোভিয়েত ইউনিয়ন, মাও-এর গণচীন, কিম-এর উত্তর কোরিয়া, ভিয়েতনাম, কিউবা ইত্যাদি দেশের শাসন ব্যবস্থাকে মনে করে গণতান্ত্রিক।

জামায়াতের আবেদনের সাথে সুর মিলিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশ সরকারের কাছে লবি করে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি না দেবার জন্য। বাংলাদেশের কাছে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের মতো রাষ্ট্রগুলো যেখানে লবি করে সফল হতে পারেনি; সেখানে বাংলাদেশের পক্ষে, র‌্যাবের সাবেক-বর্তমান কর্মকর্তাদের ওপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে লবিস্ট নিয়োগ বা মামলা করে কি সেটা প্রত্যাহার করা সম্ভব হবে?

বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ৫০ বছর পূর্তি হয়েছে। এই ৫০ বছরে বাংলাদেশ সরকার কি কোনও বিষয়ে মার্কিন সরকারের কাছে লবি করে সফল হয়েছে? উল্লেখ্য, এর আগে ২০১৩ সালে ওবামা সরকারের সময় শ্রমিকদের কাজের নিরাপত্তার অভাবের কারণ দেখিয়ে জিএসপি বা পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুবিধা স্থগিত করে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এ সুবিধা বাতিল করার পর সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে বাংলাদেশ একাধিক পদক্ষেপ নিলেও সে সুবিধা আর ফিরে পায়নি।

লক্ষণীয় বিষয় যে, যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে ওকালতি এবং জিএসপি সুবিধা বাতিল করেছিল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সরকার। ওবামা পরবর্তী সময়ে ট্রাম্প সরকার ক্ষমতায় আসবার পর বাংলাদেশ বিষয়ক কোনও পদক্ষেপ নেয়নি।

ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতির মূল বৈশিষ্ট্য ছিল গণচীন ও ইরান বিরোধিতা, ইসলামপন্থিদের চাপের মধ্যে রাখা এবং রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করা। এর মাধ্যমে আস্তে আস্তে যুক্তরাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে সরিয়ে এনে জাতীয় অবকাঠামো এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে মনোনিবেশ করা। গণচীন, ইরান এবং ইসলামপন্থিদের বিষয়ে তিনি সফল হলেও মার্কিন Establishment এর প্রবল চাপে তিনি রাশিয়া বিষয়ে সফল হতে পারেননি।

এটা মনে করা হচ্ছিল যে, বাইডেনের নেতৃত্বে ডেমোক্র্যাটিক দল ক্ষমতায় আসলে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিকে আবার গতানুগতিক ধারায় ফিরিয়ে আনা হবে। এ পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম লক্ষ্য হবে, ট্রাম্প পূর্ববর্তী সময়ের মতো ডান এবং দক্ষিণপন্থি শক্তিকে সমর্থন দিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে মার্কিন প্রভাব বলয় বজায় রাখবার চেষ্টা করা।

আওয়ামী লীগের রাজনীতি এ সময়ে মধ্য-বাম থেকে মধ্য-ডানে সরে এলেও, ওবামা সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে, বাইডেন সরকারের সাথে বাংলাদেশ সরকারের সমস্যা হতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছিলেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিসহ অনেকে এখন আশঙ্কা করছেন, সামনে হয়ত আরো নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে।

মার্কিন স্বার্থ আদায় করবার জন্য নানবিধ কারণে নিষেধাজ্ঞা প্রদান একটি অতি ব্যবহৃত কৌশল। মার্কিন স্বার্থের অনুকূলে যে সমস্ত রাষ্ট্র সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে না সাধারণত সে সমস্ত রাষ্ট্রের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পারমাণবিক কর্মসূচি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য ইরানের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নানাবিধ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।

এর বিপরীতে ইসরায়েল পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হয়ে উঠলেও এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা থেকে শুরু করে গণহত্যা করলেও, ইসরায়েলের উপরে কখনোই কোন নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি। শুধু তাই নয়, ইসরায়েলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের শর্তে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে দক্ষিণ সুদানের উপর থেকে।

শিয়া মুসলিমপ্রধান ইরানকে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের নানাবিধ নিষেধাজ্ঞায় কোণঠাসা করে রাখা হলেও সেই একই ইরানে শাহ যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন তার পুলিশ এবং গোয়েন্দা বাহিনী সাভাক হত্যা, গুম, নির্যাতনসহ বহুভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করলেও, সেটি উপেক্ষা করেছে পুরো পশ্চিমা দুনিয়া।

নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবার ক্ষেত্রে চাপ প্রয়োগের মাধ্যম হিসেবে গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং বাক-স্বাধীনতা– এ তিনটি বিষয়কে মূলত সামনে আনা হয়। এছাড়া অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবার জন্য শ্রম আইনের লঙ্ঘন, শ্রম শোষণ, ট্রেড ইউনিয়নের পর্যাপ্ত অধিকার না থাকা ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরা হয়।

বাংলাদেশ দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনে থাকবার ফলে রাজনৈতিক নেতাকর্মী, সুশীল সমাজ এবং বুদ্ধিজীবী শ্রেণির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ঔপনিবেশিক মনন দ্বারা নানাভাবে আক্রান্ত। ফলে তাদের অনেকে মনে করেন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং বাক-স্বাধীনতা নিশ্চিত করবার জন্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন সোচ্চার হয়।

গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং বাক-স্বাধীনতাকে স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে চাপে রাখবার রাজনীতি, মনোজগতে ঔপনিবেশিকতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক দীনতার ফলে অনেকে বুঝে উঠতে পারেন না। শুধু গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং বাক-স্বাধীনতা নিশ্চিত করবার জন্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে– এমন নজির এখন পর্যন্ত বিশ্বে একটিও নেই।

২০০৪ সালের ২৬ শে মার্চ খালেদা জিয়া সরকারের আমলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে গঠিত হয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন, সংক্ষেপে র‍্যাব। ওই বছরের ১৪ এপ্রিল থেকে এর কার্যক্রম শুরু হয়। অস্ত্র এবং প্রশিক্ষণ দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র র‍্যাবকে নানা সময়ে সাহায্য করে।

৯/১১ পরবর্তী সময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ'– এ সমর নীতি গ্রহণ করেন। ওবামা প্রশাসন অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে তা অনুসরণ করে। মার্কিন সরকার বাংলাদেশে র‍্যাবকে এ যুদ্ধে তার একজন সহযোগী হিসেবে দেখে। ফলে গঠনের পরপরই 'বন্দুকযুদ্ধ/ক্রসফায়ার' ইত্যাদি নামে বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ডের যে অভিযোগ বারংবার র‍্যাবের বিরুদ্ধে ওঠে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন তার লক্ষ্য সাধনের উদ্দেশ্যে সে বিষয়ে চুপ থাকা শ্রেয় মনে করে।

বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশের বিরুদ্ধেও। দেশটিতে প্রতি বছর গড়ে ১১০০ থেকে ১২০০ মানুষ পুলিশ কর্তৃক বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। সংখ্যার দিক থেকে এটা বিশ্বে সর্বোচ্চ। আর কোনও রাষ্ট্রে এত বেশি সংখ্যক মানুষ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিহত হন না।

এ হত্যাকাণ্ডের তালিকায় শুধু পুরুষ নন, রয়েছেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারীও। শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গ এবং অশ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী অসমানুপাতিক হারে পুলিশ কর্তৃক বেশি হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।

এছাড়া গ্রেপ্তারের পর নানাভাবে নির্যাতন করবার ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশের বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে শিশুদের হ্যান্ডকাফ পরিয়ে পুলিশ কাস্টডিতে নেওয়ার। এ নিয়ে সিএনএন কয়েকদিন আগে একটি ভিডিও প্রতিবেদন তাদের টিভি এবং ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে।

বাংলাদেশে যেমন সচেতন নাগরিক সমাজ র‍্যাবের বিষয়ে সোচ্চার, তেমনি সচেতন মার্কিন সমাজও সেদেশের পুলিশের বিষয়ে সরব। সেখানে পুলিশের নিষ্ঠুরতা বন্ধ করবার পাশাপাশি কেউ কেউ দাবি তুলছেন পুলিশের সমস্ত ফান্ড বন্ধ করে দেওয়ার। সিভিল সমাজের কেউ কেউ এমনকি পুলিশের আদৌ প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা, এ প্রশ্ন তুলছেন। পুলিশ সম্পূর্ণরূপে উঠিয়ে দেবার দাবিতেও মাঠে নেমেছেন কেউ কেউ।

মার্কিন পুলিশ নিয়ে যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের মাঝে রয়েছে নানা প্রশ্ন, সেখানে এককালীন মার্কিন সাহায্যপুষ্ট র‍্যাবের কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে, বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টির তাগিদ যুক্তরাষ্ট্র কেন অনুভব করল? বিষয়টা বুঝতে হলে আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির সাম্প্রতিক যে গতি পরিবর্তন, সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে।

সোভিয়েত পতন পরবর্তী সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক যে বিশ্ব ব্যবস্থার উদ্ভব হয়েছিল, সেটি দীর্ঘদিন স্থায়ী হবে বলে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধাকরা ধরে নিয়েছিলেন। ফলে ৯/১১-এর পর তারা 'সন্ত্রাস বিরোধী' যুদ্ধের নীতি হাজির করে। 'ইসলামপন্থার' সাথে পশ্চিমা দুনিয়ার দ্বন্দ্বকে মূল দ্বন্দ্ব ধরে নিয়ে তারা কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করেন। মার্কিন মিডিয়া তাদের সহযোগী হয়।

'সন্ত্রাস বিরোধী' যুদ্ধে ইরাক এবং আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৭ হাজারের বেশি সেনা হারায়। আহত হয় ৫০ হাজারের মতো। এ যুদ্ধের পেছনে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হয়, যার অভিঘাত পড়ে মার্কিন অর্থনীতিতে।

আফগানিস্তান থেকে ভিয়েতনামের চেয়েও ন্যাক্কারজনক অবস্থায় বিদায় নিতে হয় মার্কিন বাহিনীকে। আফগানিস্তানে পরাজয় সেনাবাহিনী এবং জনগণের মনস্তত্ত্বের ওপর ফেলেছে প্রবল চাপ। তদুপরি কোভিড মোকাবেলায় ব্যর্থতা এবং চলমান অর্থনৈতিক সংকট, যুক্তরাষ্ট্রের একটা দুর্বল ইমেজ বিশ্বে তৈরি করেছে।

রাশিয়া বিশ্ব রঙ্গমঞ্চে আবার ফিরে আসতে পারবে এটা মার্কিন নীতিনির্ধারকদের হিসেবের বাইরে ছিল। তারা ধরে নিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্যে দিয়ে বিশ্বে রাশিয়ার ভূমিকার চির অবসান ঘটেছে। ফলে রাশিয়া যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের 'সন্ত্রাস বিরোধী' যুদ্ধের সুযোগে তাদের সমরাস্ত্র উন্নয়নসহ নানা বিষয়ে এগিয়ে আসছিল, তখন এ বিষয়ে মার্কিন প্রশাসনের ভূমিকা ছিল উপেক্ষা করা, গুরুত্ব না দেওয়া বা তাচ্ছিল্য করার।

অনেকে আবার রাশিয়া যে ক্রমশ আগের ভূমিকায় ফিরে আসছে, এ বিষয়টা নিয়েই সচেতন ছিলেন না। ফলে রাশিয়া যখন বিশ্ব রাজনীতিতে ইউক্রেইনসহ নানা বিষয়ে চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে, সেটি মার্কিন প্রশাসনের কাছে ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশ্বে তাদের আধিপত্য বজায় থাকবে কিনা, এ প্রশ্নে।

চীন সম্পর্কে মার্কিন মূল্যায়ন ছিল একটা দীর্ঘ সময় পরে আঞ্চলিক ক্ষেত্রে চীন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবে। অর্থনৈতিক এবং সামরিকভাবে এত দ্রুত চীনের উত্থান তাদের চিন্তার বাইরে ছিল। ফলে দক্ষিণ এবং পূর্ব এশিয়াতে চীনের প্রভাব কী করে যুক্তরাষ্ট্র মোকাবেলা করবে, এ চিন্তা তারদেকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে। পাশাপাশি একের পর এক ভুল পররাষ্ট্রনীতি এবং ক্রমাগত নানা রাষ্ট্রের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির ফলে এশিয়াতে যুক্তরাষ্ট্র ক্রমশ মিত্রহারা হচ্ছে।

পাকিস্তান ষাটের দশক থেকে চীনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আবদ্ধ থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের সাথেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলছিল। কিন্তু সম্প্রতি আফগানিস্তান, মানবাধিকার, 'ইসলামপন্থার' রাজনীতি, ইত্যাদি বিষয়ে ক্রমাগত মার্কিন হস্তক্ষেপের ফলে সামরিক, বাণিজ্যিকসহ নানা বিষয়ে রাশিয়ামুখি হচ্ছে পাকিস্তান।

ইমরান খান চাইছেন যুক্তরাষ্ট্রের বলয় থেকে বেরিয়ে যেয়ে রাশিয়ার সাথে সম্পর্ককে এক নতুন মাত্রায় নিয়ে যেতে। অপরদিকে, 'হিন্দুত্ববাদী' মোদীর মার্কিন ঘেঁষা নীতি, রাশিয়াকে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করতে উৎসাহ যোগাচ্ছে।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত মিয়ানমার এশিয়াতে চীনের তিন ঘনিষ্ঠ মিত্রের একটি। অপর দুটি হলো উত্তর কোরিয়া এবং পাকিস্তান। মিয়ানমার একই সাথে রাশিয়া ঘেঁষাও। ফলে এ অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে বাংলাদেশ। তাই বাংলাদেশে চীন এবং রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে।

যুক্তরাষ্ট্র চায় না কোনওভাবেই যাতে বাংলাদেশে চীন এবং রাশিয়ার অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি পায়। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে চীনমুখি না হয়ে বাংলাদেশ ভারতমুখি হোক। ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে চীনবিরোধী যে জোট 'কোয়াড' যুক্তরাষ্ট্র গঠন করেছে, বাংলাদেশ তার সদস্য হোক অথবা জোটকে নানাভাবে সহযোগিতা করুক।

কিন্তু বাংলাদেশের সামনে এই মুহূর্তে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বিপুল বিনিয়োগের নিশ্চয়তা। বিশ্বের সবচেয়ে ঋণগ্রস্থ দেশ যুক্তরাষ্ট্র অথবা ভারতের পক্ষে অবাকাঠামো উন্নয়নে পর্যাপ্ত অর্থ প্রদান সম্ভব নয়। আবার 'কোয়াডের' সাথে যুক্ত হলে বন্ধ হয়ে যেতে পারে চীন-রাশিয়ার অর্থ এবং কারিগরি সাহায্য।

পঁচাত্তর পরবর্তী সময় থেকে বাংলাদেশের যুক্তরাষ্ট্র মুখিনতার যে অভিযাত্রা, তা রাজনৈতিক কর্মীসহ অনেকের মাঝে জন্ম দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর মনোজাগতিক নির্ভরতার। আবার তৈরি পোশাক রপ্তানিসহ আরো অনেক বিষয়ে রয়েছে মার্কিন নির্ভরতা। বস্তুত এ জায়গাটিতেই বাংলাদেশের ওপর নানাভাবে চাপ সৃষ্টির সুযোগ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের।

বিশ্ব রাজনীতির জটিল হিসাব-নিকাশ নিয়ে যারা অতটা সচেতন নন অথবা যারা সত্যিকার অর্থেই বিশ্বাস করেন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, এ উভয়পক্ষই মনে করে লবি বা মামলা করে এবং র‍্যাবের কিছু প্রয়োজনীয় সংস্কার করে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতা থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব।

প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে মার্কিন সংবিধানে আইনগতভাবে লবি করবার সুযোগ দেওয়া হলেও মার্কিন নাগরিকদের কাছে লবি একটি প্রশ্নবিদ্ধ প্রক্রিয়া। সিভিল সোসাইটি, সচেতন নাগরিক সমাজ এবং অ্যাকাডেমিশিয়ানদের অনেকে একে বৈধ ভাবে দুর্নীতি করবার পন্থা বলে মনে করেন।

যুক্তরাষ্ট্রে লবি ৩০ বিলিয়ন (৩০০০ কোটি) ডলারের একটি শিল্প। যত টাকা লবি করবার কাজে প্রতিবছর ব্যয় হয় তার পুরো হিসেব কখনো পাওয়া যায় না। মূল অর্থটা জাতীয় পর্যায় থেকে আসলেও বিদেশিদের লবি করবার সুযোগ দেবার ফলে প্রচুর টাকা বাইরে থেকেও তাদের অর্থনীতিতে যুক্ত হয়।

রাজধানী ওয়াশিংটনে ১২ হাজারের ওপর লবিস্ট এবং ৩০০ এর মতো লবি ফার্ম রয়েছে। পুরো যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট রয়েছেন ১ লাখের মতো। স্থানীয় সরকার থেকে শুরু করে রাজ্য সরকার এবং ফেডারেল সরকার পর্যায় পর্যন্ত এরা লবি করে থাকেন। মার্কিন বড় বড় করপোরেশনগুলো বিপুল অর্থ লবি করবার কাজে ব্যয় করে থাকে নিজেদের পক্ষে নীতি প্রণয়নে আইনপ্রনেতা এবং নীতিনির্ধারকদের প্রভাবিত করবার জন্য।

লবির মাধ্যমে বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজেদের পক্ষে আইন এবং নীতি প্রণয়নের সুযোগ তৈরি হবার ফলে, এ লবি প্রক্রিয়া যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক দর্শনের সাথে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ– এ প্রশ্ন রয়েছে খোদ মার্কিন সমাজেই।

দেখা গেছে, বাংলাদেশের মতো যে সমস্ত উন্নয়নশীল দেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে নাই, সে সমস্ত রাষ্ট্রের ওপর কোনও বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি হলে, সেখানকার রাজনৈতিক দলগুলো সমন্বিত অবস্থান নিতে ব্যর্থ হয়। এতে বিদেশি রাষ্ট্রের সাথে দর কষাকষি করবার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রটির দুর্বল অবস্থান ফুটে  ওঠে।

অন্যদিকে, গণতন্ত্র যেখানে শক্তিশালী, সেখানে দলগুলোর মাঝে অভ্যন্তরীণ প্রশ্নে যতই মতবিরোধ থাকুক, জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে তারা একক অবস্থান নিতে পারে। পার্শবর্তী ভারত হচ্ছে এর বড় উদাহরণ।

কোনও বিদেশি রাষ্ট্রের সাথে নিষেধাজ্ঞা বা অন্য কোনও সমস্যা মোকাবিলার সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হচ্ছে সমস্ত রাজনৈতিক দলের সমন্বিত অবস্থান নেওয়া। একমাত্র গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করে, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার মাধ্যমেই এ ধরনের শক্ত অবস্থান নেওয়া সম্ভব।