Published : 05 Feb 2022, 11:54 PM
কলাবাগানের লেকসার্কাস মহল্লায় বসবাস করছি আজ সতেরো বছর। এই পাড়ার কয়েকটি অংশ বেশ ঘিঞ্জি, কয়েকটি অংশ একটু খোলামেলা, কিছুটা চওড়া গলিরাস্তা। লেকসার্কাসের এই অংশটির সামনের পথটির ইদানীং নাম হয়েছে গার্লস স্কুল রোড। লেকসার্কাস বালিকা বিদ্যালয়ের কল্যাণে এই নাম। এলাকাটির মজার বৈশিষ্ট্য কনকর্ড টাওয়ার নামের সুউচ্চ অট্টালিকার তলা দিয়ে যাতায়াতের একটি গলিপথ। সেই পথ দিয়ে ঢুকতেই হাতের বাঁয়ে তেঁতুলতলা পানির পাম্প। সেই প্রাঙ্গণে একটি প্রাচীন তেঁতুল গাছের ছায়ায় নানা পদের অস্থায়ী দোকান বসে প্রতিদিন। তার পাশেই খানিক বড় একটা মাঠ, আজকাল যা ঢাকা শহরের মহল্লাগুলোয় ডুমুরের ফুল হয়ে উঠেছে।
মাঠটাকে দেখলে মনে হয় অভিভাবকহীন। ধূলিধূসরিত। মাঠের সীমানা ঘেঁষে মেহগনি জাতীয় গাছের সারি। মাঠ অভিভাবকহীন হলেও সে নিজেই যেন এলাকার শিশু-কিশোরদের অভিভাবক হয়ে উঠেছে। বছরভর সারা দিনমান শিশু-কিশোরদের কলরব সেখানে লেগেই থাকে। কয়েক বছর ধরে মিনি ফুটবল টুর্নামেন্টও হতে দেখি। এমন ফুটবল টিভিতে দেখেছি বলে মনে হয়। বেঁটে গোলবারের খেলা। যখন টুর্নামেন্ট হয় তখন যেন মেলা বসে যায় মাঠের ধার ঘেঁষে। পাড়ার তরুণ প্রাণশক্তি যেন উছলে ওঠে। পাশের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে সেই হৈহল্লা শুনলে প্রাণটা ভরে যায়।
বছর দুয়েক আগে প্রথম ধাক্কা খাই মাঠলাগোয়া গাছের গায়ে 'কলাবাগান থানার জন্য নির্ধারিত স্থান' এই জাতীয় একটি লেখাসম্বলিত সাইনবোর্ড দেখে। পূর্বে গ্রিনরোড থেকে পশ্চিমে মিরপুর রোড, দক্ষিণে কলাবাগান স্টাফ কোয়ার্টার্স থেকে উত্তরে পান্থপথ, এই বিস্তীর্ণ জনবসতির মধ্যে কোথাও দুইঞ্চি খোলা জায়গা খুজেঁ পাওয়া যাবে না যেখানে বাচ্চারা হাত-পা খুলে খেলতে পারে। পশ্চিমে মিরপুর রোডের ওপারে ধানমন্ডি মাঠ (অধুনা শেখ জামাল ক্রিকেট একাডেমির মাঠ) ও কলাবাগান ক্রিকেট একাডেমির মাঠ থাকলেও সেখানে যেতে হয় গাড়িঘোড়ায় আকীর্ণ মিরপুর রোড পার হয়ে। আবার পুবদিকে গ্রিনরোডের পূর্বে কাঁঠালবাগান, গ্রিনকর্ণার, ভূতেরগলিসহ অনেকগুলো পাড়ায় কোনো ছোট খেলার মাঠও নেই। এই বিস্তীর্ণ জনাকীর্ণ বসতির মধ্যে তেঁতুলতলা মাঠটি একটা ওয়েসিস হয়ে বেঁচে আছে। শ্বাসবায়ু জোগাচ্ছে এলাকাটির বাসিন্দা হাজারও মানুষের এবং শিশুকিশোরদের তো বটেই।
দু বছর আগের সেই ঘটনায় এলাকাবাসী সেসময় কিছু প্রতিবাদ করেছিলেন। পরে সাইনবোর্ডটি সরিয়ে ফেলতে দেখে আশ্বস্ত হয়েছিলাম সরকার বাহাদুর এলাকার বাসিন্দাদের কথায় কর্ণপাত করেছেন। কিন্তু আবারও তৎপরতা শুরু হয়েছে। দিনপাঁচেক আগে দেখি মাঠটাকে ঘিরে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হয়েছে। পুলিশের দল পাহারা দিচ্ছে দিনরাত। পুলিশগাড়ির টহলও চলছে। যদিও সাইনবোর্ড নেই কোথাও। জনমুখে শুনলাম, কলাবাগান থানার জন্যই জায়গাটি নাকি চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত হয়েছে। ভুল না ঠিক সংবাদ তা অবশ্য জানি না।
তেঁতুলতলার এই মাঠটির মালিকানা নিয়ে এলাকায় কান পাতলে বিভিন্ন কথা শোনা যায়। সবশেষ যেটি শুনলাম, এটি এক বিহারী স্থপতির জমি যিনি যুদ্ধপরবর্তীকালে বাংলাদেশ ত্যাগ করেন। জমিজিরাতের আয়তন বিষয়ে বিশেষ ধারণা নেই আমার। তবে দেখলে বিঘাখানেক বা তার কিছু বেশি জমি এখানে আছে বলে মনে হয়। এখানকার প্রবীণ বাসিন্দা কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানলাম তাঁরা ছোট থেকেই এখানে খেলাধূলা করে আসছেন। সেটা প্রায় আজ বছর পঞ্চাশেকের মতো হবে। দীর্ঘ সময়। এতদিন ধরে এলাকাবাসী যখন একটি মাঠকে সুস্থ চর্চায় ব্যবহার করে আসছেন তাহলে আজ হঠাৎ করে কেন সরকার বা সরকারের কোনো মহলের সেখানে কাঁটাতার দেওয়ার মতো অসুস্থ চিন্তা মাথায় এল?
৪ ফেব্রুয়ারি বিকালে মাঠ বাঁচাতে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে শ'দুয়েক শিশুকে সঙ্গে নিয়ে তাদের মা-বাবা এবং এলাকাবাসী প্রতিবাদে নেমেছিলেন। মানববন্ধন করেছেন তারা পান্থপথে দাঁড়িয়ে, তারপর মাঠের পারে এসে। পাঁচদিন আগেও যে শিশুটি এই মাঠে দাপিয়ে বেড়াত তাকে কাঁটাতারের এপারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মনটা বিষণ্ণ হয়ে উঠল।
মানববন্ধনে এলাকার মানুষ একটিমাত্র দাবি নিয়ে হাজির হয়েছেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন যেন মাঠটিকে অধিগ্রহণ করে একে শিশুকিশোরদের খেলার জায়গা হিসেবে স্থায়ী বরাদ্দ দেয়।
মাঠ বাঁচাতে এলাকাবাসী প্রধানমন্ত্রী, ঢাকা দক্ষিণ মেয়রসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কাছে আবেদন করেছেন। তাদের কড়া নাড়ার শব্দ লৌহকপাট পেরিয়ে মহাজনের কর্ণকুহরে প্রবেশ করবে কিনা জানি না। তবে যদ্দিন না পৌঁছায় তদ্দিন লড়ে যাওয়ার তাগদ ও হিম্মৎ উভয়ই কলাবাগানের অধিবাসীদের থাকবে বলে আশা রাখি।