Published : 24 Apr 2021, 11:39 PM
স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম বীর বিক্রম আব্দুল হকের সাথে চুনারুঘাটের মিরাশি গ্রামের যে কাঁচা রাস্তায় দেখা হলো, তার দুইপাশেই ধানক্ষেত। তার ছবিটা যদি আগে থেকে আমি না দেখতাম আর টেলিফোনে যোগাযোগ না হতো- তাহলে সন্ধ্যা নামার বেশ পড়ে, দিন ছেড়ে চলে যাওয়া আলোয়, আমি তাকে কোনওভাবেই খুঁজে পেতাম না।
মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য খেতাবপ্রাপ্তদের তালিকা খুঁজে আব্দুল হক এর অর্জনের জন্য একজন টেলিভিশনের সাংবাদিক তার কাছে এসেছে- এ খবরে তিনি ছিলেন আনন্দিত। তাই অন্যের বাড়ির অন্দর আর ক্ষেতের আইল ধরে তিনি আমার কাছে চলে এসেছিলেন, আমার বাজার পার হওয়ার খবর পেয়েই। কত আক্ষেপ তার মনে ছিল, যা তিনি বলছিলেন আর আমি ভাবছিলাম একজন যুদ্ধ জেতা বীর বিক্রমের কথা।
হবিগঞ্জের মাধবপুরের ইটাখোলা গ্রামে অক্লান্ত খুঁজে যে বাড়িতে পেয়েছিলাম যুদ্ধের আরেক রণনেতা ও বীর বিক্রম-কে, সে ঘরের কি উঠোন, কি ছাউনি! তার সব জীর্ণতাকে সঠিকভাবে বর্ণনার সাহস আমার নেই। বললাম- আপনি-ই কি তৎকালীন সেনাবাহিনীর হাবিলদার আব্দুর রহমান? আমার কাছে থাকা নথি দেখে খুশি হলেন। এটা ধরেই আপনি আসলেন- তার এ বাক্যের মধ্যে ঠিক প্রশ্ন ছিল না।
তার ঘরে ঢুকতে যতখানি মাথা নিচু করতে হয়, যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীকে একের পর এক আক্রমন করে বিপর্যস্ত করে দেওয়া, দুরন্ত সাহসে ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়া একজন বীরযোদ্ধা- ততখানি মাথা নিচু করতে পারেন না। তার ঘরের মলিনতা বলে দেয়, একজন বীর বিক্রমের বসতঘরের চারপাশ প্রকৃতিগতভাবেও কতটা বিবর্ণ হয়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধের পর সেক্টর কমান্ডারদের অনেকেই যে খেতাব পাননি, সেটাই অর্জন করে নীরবে নিভৃতে অনারারী ক্যাপ্টেন আফতাব আলী সিলেটের গোলাপগঞ্জের দক্ষিণ ভাদেশ্বরে বসবাস করেন। বীর উত্তম ছাড়াও বঙ্গবন্ধুর সরকার তাকে বীর প্রতীক খেতাবও দেন। লক্ষ্য করুন তার নামের পাশের দুইটি পদবী- বীর উত্তম আর বীর প্রতীক। তার দিকে ক্যামেরা তাক করতে সহকর্মী সবুজও কেমন অস্বস্তিতে ছিলেন।
রণাঙ্গনের বীর সেনানীর আক্ষেপ অন্তরে জমে আছে। গোলাপগঞ্জের হাতিমগঞ্জে গিয়ে আমরা পেয়েছিলাম আরেক বীর বিক্রম মো. তাহের আলীকে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ২৭ মার্চ জিয়াউর রহমান যখন বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন, সেখানে তাহের আলী রাইফেল হাতেই উপস্থিত ছিলেন। কালুরঘাটে এ বীর বিক্রমের নির্লিপ্ত স্মৃতিচারণ প্রমাণ করে স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস লেখার এখনো অনেক বাকি। চলে আসার আগে অনুনয় করলেন রাতের খাবার খেয়ে আসার জন্য। বললেন, "আমি কোনও কিছুর মধ্যে যেতে চাই না বলে কেউ আমার খবর নেয়নি।" ধরে আসা গলায় অনুরোধ তার- শরীরের অবস্থা ভালো নয়, রাষ্ট্র যেন তার উত্তরাধিকারদের একটু খোঁজ নেয়।
২০১৩-১৪ সালের দিকে এটিএন নিউজে 'বিজয়ের গল্প' অনুষ্ঠানের জন্য গ্রামে গ্রামে গিয়ে বীর উত্তম, বীর বিক্রম, বীর প্রতীকের সাথে কথা বলার এ বিরল সুযোগ মিলেছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ- এ বেঁচে থাকা খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের অনুসন্ধান করতে করতে এমন অনেক বীর যোদ্ধার সাথে সরাসরি কথা বলার সৌভাগ্য হয় তখন আমার। কখনো সীমান্ত ধরে, কখনো দুর্গম এলাকার মাঝ দিয়ে সেসব যাত্রা ছিল। একের পর এক বধ্যভূমি আর লড়াকু যুদ্ধের ঘটনা শুনেছিলাম। সবচেয়ে ভালো লেগেছিল ছাতকের টেংরাটিলা গ্রামে গিয়ে। যে টেংরাটিলা নাইকো গ্যাস বিস্ফোরণের জন্য পরিচিতি পেয়েছিল, সেখানেই এক ইউনিয়নে আমরা পেয়েছিলাম সাড়ে চারশ মুক্তিযোদ্ধার সন্ধান। সুরমা পার হয়ে ছাতকের বাংলাবাজারে দেখা পাওয়া বীর প্রতীক ইদ্রিস আলীর কথা মনে পড়ে এখনো। কী জাদরেল যোদ্ধা! কিন্তু কী বিনয়! কী গম্ভীর!
ঢাকার রাজপথে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পরিচয়ে অগ্রাধিকারের চিৎকার শোনার পরই আমার সে-ই কসবা, চুনারুঘাট, গোগারা, মাধবপুর, হাতিমগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, সুন্দিশাইল, বাংলাবাজার, ভাদেশ্বর অথবা টেংরাটিলার মুক্তিযোদ্ধাদের, তাদের সন্তানদের জীবনযাপন মনে পড়লো।