Published : 05 Apr 2021, 08:34 PM
সোনারগাঁওয়ের একটি রিসোর্টে নারী নিয়ে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকের অবস্থান; ছাত্রলীগ-যুবলীগ কর্তৃক অবরুদ্ধ অবস্থায় থাকা; খবর পেয়ে হেফাজতের অসংখ্য নেতাকর্মীর সে রিসোর্টে গিয়ে মারমুখী অবস্থান এবং তাদের নেতাকে নিয়ে যাওয়া- একের পর এক এসব নাটকীয় ঘটনা নিয়ে সারাদেশে তোলপাড় চলছে।
এ বিষয়ে একাধিক ভিডিও-অডিও নিয়ে চলছে এখন নানা রকম কথাবার্তা। ভাইরাল এসব ভিডিও-অডিওর পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে বিভিন্ন সামাজিকমাধ্যমেও। এ ঘটনার কথা উঠেছে জাতীয় সংসদেও। এ কাণ্ডের জের ধরে মামুনুল হকের নেতিবাচক সমালোচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাসদ নেতা সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল গতকাল জাতীয় সংসদে বলেছেন, "হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক নারায়ণগঞ্জের রিসোর্টে যে নারীসহ ছিলেন, তিনি তার স্ত্রী নন। ওই নারী কে, তা তিনি টেলিভিশনে নিজের মুখে স্বীকার করেছেন। তিনি তার স্ত্রী নন। এ বিষয়ে আরও ঘটনা জেনে সবাইকে জানাব।"
এসব ঘটনা বাংলাদেশে এখন টক অব দ্য সিটি তো বটেই, বলা উচিৎ বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশিদের কাছেও হট টপিক। মামুনুল হক দৃশ্যে এসেছেন বেশিদিন হয়নি। অঘটন ঘটনে পটিয়সী সমাজে একজন আসে, তো একজন যায়। হেফাজত আসার পর থেকে জামাতে ইসলামীর খবর নাই। বিএনপি মোটামুটি ব্যর্থ রাজনৈতিক দল । হেফাজতের তাণ্ডব অন্তত একটা বিষয় প্রমাণ করে দিয়েছে- সংঘবদ্ধ হলে সবাই পারে। বিএনপি পারেনি। তাদের প্রধান নেতা একাধিকবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে 'ছিনিয়ে নেওয়া' দূরের কথা- তারা একটা বড় শো ডাউন বা মিছিলও করতে পারেনি। অথচ মামুনুল হক-কে কিনা ছিনিয়ে নিল তার সমর্থকরা? এটাও অবশ্য মীমাংসিত সত্য কিনা জানা মুশকিল।
একটা বিষয় পরিষ্কার, মামুনুল হক এমন একটা কাজ করেছেন যা সমাজে এখন প্রায়ই হয়। আর হলেও কেউ তেমন খবর রাখেন না। কিন্তু মামুনুল হক তো কাণ্ডারী নেতা। তাও আবার যেমন-তেমন নেতা নন। তার নেতৃত্বে স্বাধীনতার ৫০ বছরের দিনটি ছিল বিভীষিকাময়। হেফাজত নরেন্দ্র মোদীর আগমনকে কেন্দ্র করে ঢাকা-গোপালগঞ্জ বা সাতক্ষীরায় কিছু করতে না পারলেও, তাদের ঘাঁটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আর চটৃগ্রামের হাটহাজারীতে চালিয়েছিল মহাতাণ্ডব। একদিকে জান নিয়ে টানাটানি, আরেকদিকে পুড়েছে সংগীত নিকেতন, বিকৃত করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল। এসব নাশকতায় হেফাজতের ডজনাধিক সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন। সে রক্তের দাগ না মুছতেই মামুনুল কিনা গেলেন 'রিলাক্স' করতে? তাও আবার কথিত দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে। সেই নারী কে, কী তার পরিচয়- এগুলো কি আসলেই মুখ্য? আমি অন্তত তা মনে করি না। তার নাম যেকোনও কিছু হতে পারে। তিনি রফিক-শফিক-কামাল যে কারও স্ত্রী হতে পারেন। ঘটনা সেখানে নয়, ঘটনা মামুনুল হককে নিয়ে।
যে বিষয়গুলো আমরা জানতে পারবো না, জানবোও না সেগুলোই বরং বলি।
মামুনুল হকের দাবি অনুযায়ী, তার দ্বিতীয় স্ত্রী তো ধর্ম সমাজ ও আইন সিদ্ধ। তাহলে তাকে নিয়ে হোটেল মোটেল বা রিসোর্টে যেতে হবে কেন? কেনই বা প্রথম স্ত্রীকে লিখিয়ে-পড়িয়ে দিতে হবে যে দ্বিতীয় স্ত্রীকে চিনতেন?
আর একটা বিষয় জানা দরকার, যখন মামুনুল হক জানেন তিনি আইনের চোখে চোখে, তার দিকে সরকারি-বেসরকারি চোখ সবসময় পাহারায়, এই কঠিন সময়ে কেন গেলেন ফূর্তি করতে?
ঝরে যাওয়া জান মালের প্রতি টান থাক বা না থাক নিজের ভালোটা কি তিনি বোঝেন না? যেসব যুবকেরা তাকে ঘেরাও করলো, শাস্তি দিতে চাইলো, তারাও ছিল সংঘবদ্ধ। এই সংঘবদ্ধ যুবসমাজ হঠাৎ করে নিশ্চয়ই আসেনি। আর এসে হতে যাওয়াটা কী প্রমাণ করলো? এটা তো সে ঘটনারই আরেক নজির যেদিন ঘাতক-দালাল-নির্মূল কমিটির ব্যানার ছিঁড়ে, মঞ্চ গুঁড়িয়ে ঢাকার রাস্তায় পাওয়ার দেখিয়েছিল হেফাজত। বলাবাহুল্য তারপর থেকে সরকার মুখে যাই বলুক কার্যত চলে গিয়েছিল আপসের লাইনে। আর সে আপসের ফলাফল জমি বণ্টন। হেলিকপ্টারে হুজুরের ঢাকা আগমন। ক ওমী জননী উপাধি।
মামুনুল হক এখন যে কোনও বিরোধী দলের নেতার চাইতে শক্তিশালী। মূলত লকডাইনে যাওয়া দেশ ও সমাজে শেষ পেরেক ঠেকা ধর্মীয় বক্তা। আজ সরকার যখন স্বাধীনতার ৫০ বছর আর মুজিববর্ষের অনুষ্ঠান শেষ করে লকডাউনে যাচ্ছে তখন মামুনুল হক সে যাত্রাকে করলেন প্রশ্নবিদ্ধ। সাধারণ মানুষের এক বিশাল অংশ মনে করছে তড়িঘড়ি লকডাউন ঘোষণা নাকি হেফাজত থামানোর কৌশল! সে যাই হোক আমরা দূর থেকে দেখছি নিয়ন্ত্রণহীন এক সমাজ। আমাদের চোখে ধরা পড়ছে ভয়াবহ সব অসঙ্গতি।
মামুনুল হকের মতো একজন মানুষের হাতে আজ ধর্ম সমর্পিত। ইসলামের মহত্ব, বিশ্বজনীনতাকে আজ আর কেউ মনে রাখে না। কেন উপমহাদেশের দরিদ্র-শোষিত মানুষ দলে দলে স্বধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তা আজ আর কেউ মনে রাখে না। তার বদলে উঠে এসেছে অন্ধ সব বক্তা আর উন্মাদনা। মামুনুল হকের মূল অপরাধ কি সত্যি পরকীয়া? নাকি উস্কানি জাগিয়ে স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকীতে উত্তেজনা ছড়িয়ে শান্তি বিনষ্ট করা?
সত্য কথা বলার সৎ সাহস নষ্ট হয়ে গেছে জানি। তাই বলে সব বিষয়ে? মামুনুল হক-কে ধরতে হলে বা তাকে অপরাধী প্রমাণ করতে হলে সঠিক পথটি কেন বেছে নেওয়া যাবে না? কী কারণে ছাড়? ছাড় দিতে দিতে দেশ সমাজ অসাম্প্রদায়িকতা গণতন্ত্র সব আজ হুমকির মুখে। এরপরও যদি সত্য স্বীকারে কুণ্ঠা থাকে তাহলে কি সময় ছেড়ে কথা বলবে? লেখাটার শুরুতেই শেখ হাসিনার কথার উদ্ধৃতি দিয়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রী কিন্তু বলে দিয়েছেন- সরকার জ্বালাও পোড়াও এসব সহ্য করবে না। আমি মনে করি 'মামুনুলের পরকীয়া'র চাইতে এটাই হয়ে ওঠা উচিৎ আসল ঘটনা।
মামুনুল হকের চরিত্র বিশ্লেষণ জাতির দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। বহু সমস্যায় ক্লান্ত পরিশ্রান্ত জাতি এখন করোনার ভয়ে আছে। লকডাউনে আটকা পড়া দেশ, জাতির এক বিশাল অংশ জানে না কিভাবে চলবে সংসার। কোথা থেকে আসবে টাকা? সামনে আসছে রোজার দিন। খুব স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যাবে জিনিসের দাম। মানুষের নাভিশ্বাস উঠবে । মধ্যবিত্ত-নিম্ম মধ্যবিত্তদের অনেকেই বলছেন, আত্মহনন ছাড়া পথ নাই তাদের। এমন জাতি আসলেই কারও চরিত্র নিয়ে মাথা ঘামায় না।
সামাজিক মিডিয়া আর ইন্টারনেটের বেড়াজালে মানুষ জানে না কোনটা সহজিয়া, কোনটা পরকীয়া। তার দরকার উদার সমাজ। তার চাই পেটে ভাত। পোশাক মাথার ওপর ছাদ। মামুনুল হকের চরিত্রের চাইতে তার কাছে দামি- ভয়হীন জীবন ও অস্থিরতাহীন সমাজ। মামুনুল হকেরা তা না চাইলে তাদের দমানোর বিকল্প কোথায় হে সরকার?
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
০৫.০৪.২০২১