Published : 17 Mar 2021, 08:50 PM
অমর একুশে গ্রন্থমেলা মাস দেড়েক দেরিতে হলেও অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আয়োজনের পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত থাকলেও, আমি সেসব নিয়ে আলোকপাত করব না। আমি বরং একটা প্রশ্ন উত্থাপন করতে চাই: কেন এ গ্রন্থমেলা?
সাধারণভাবে বইমেলার আদি উদ্দেশ্য বই সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী মানুষের সঙ্গে বইয়ের ক্রেতা বা পাঠকের যোগসূত্র বা মিলনমেলার সুযোগ তৈরি করা। এটি বিবেচনায় এ মিলনক্ষেত্রের মানুষেরা হচ্ছেন প্রকাশক, লেখকস্বত্বা প্রতিনিধি, বিক্রয় প্রতিনিধি, বই সরবরাহকারী, খুচরা বিক্রেতা এবং বইয়ের প্রতি অনুরাগী মানুষ বা পাঠক। এদের সবার জন্য বইমেলা হচ্ছে একটি একক আয়োজন। আর এর দ্বিতীয় ধাপে এর সঙ্গে যারা যুক্ত, তারা হলেন- খোদ লেখক এবং গণমাধ্যমের কর্মীবাহিনী। বইমেলার পেছনে আদি ও অকৃত্রিম উদ্দেশ্য হচ্ছে বইয়ের তৎক্ষণাৎ বা দীর্ঘমেয়াদী কিংবা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বিপণন।
একটি মেলার ঐতিহ্য বা চেতনা নিয়ে আমরা যত বুলিই আওড়াই আখেরে বিনিয়োগ উঠে না আসলে কোন প্রকাশকই গাটের টাকা খরচ করে বইমেলা নিয়ে মেতে উঠবেন না। বই প্রকাশনা, শিল্প বা ব্যবসা কোন দাতব্য কার্যক্রম নয়। এ সত্য মেনে নিয়ে আমাদের বইমেলা ঘিরে আবেগ, অসঙ্গতি, গোঁজামিল ও ন্যাকামোগুলো বিচার বিশ্লেষণ করতে হবে।
উপরোক্ত উদ্দেশ্য ছাড়াও একটি আধুনিক বইমেলা আরও কিছু দাবি মিটিয়ে থাকে। তা হচ্ছে- বইয়ের শিল্প ঘিরে নানা স্বত্ব আদানপ্রদান বা বিক্রির চুক্তি সম্পাদন অনেক সময় মেলাতেই হয়ে থাকে। একই সঙ্গে বাণিজ্যিক ও পেশাদারি দাবির পরে বইমেলা একটি জাতির বা জনগোষ্ঠীর অনন্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির মেলা বা উৎসব। এ শেষোক্ত বিবেচনায় বইমেলায় আয়োজন করা হয়ে থাকে নানা উদ্ভাবনী অনুষ্ঠানমালার। সেমিনার, আলোচনা, সংলাপ, বিতর্ক এবং নতুন বই বা বিষয়ের উপস্থাপনা, লেখকদের সঙ্গে মতবিনিময়সহ সঙ্গীত, নৃত্য, প্রামাণ্যচিত্র, ছোট কলেবরে থিয়েটারসহ অসংখ্য কার্যক্রম। এসব কিছু মিলিয়ে বইমেলা হচ্ছে একটা জনগোষ্ঠীর সার্বজনীন বা সামগ্রিক উৎসব। যে কারণে দুনিয়ার উল্লেখযোগ্য বইমেলাগুলো সরকারি-বেসকরকারি অংশিদারিত্ব বজায় রেখে আয়োজন করা হয়ে থাকে। যেখানে মূল আয়োজন বা পরিকাঠামোতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতামুক্ত স্বাধীন কোন সংস্থা বা কোম্পানি আর প্রকাশক সমিতি। মেলার বাণিজ্যিক দিকটাও এদের এখতিয়ারে। সরকারি কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনে অনুদান, প্রণোদনা বা পরামর্শ দিয়ে থাকে। এর বিপরীতে শিক্ষা ও সংস্কৃতির যে অনুষ্ঠান, সেখানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়, লেখকদের সংস্থা, একাডেমি, গণমাধ্যম নানা পর্যায়ে যার যার জায়গা থেকে ভূমিকা রাখে। তাতে একটি জিনিস স্পষ্ট। বইমেলার দুইটি দিক, একটি বাণিজ্যিক অন্যটি শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক দিক।
এবার আমাদের অমর একুশে বইমেলার দিকে নজর ফেরাতে চাই।
আমরা যেই সময়ে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ আর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছি, সেই সময়ে আমাদের অমর একুশে গ্রন্থমেলা চার দশকের বেশি সময় পার করছে। এটি ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্যের উপর গড়ে ওঠা গ্রন্থমেলা বিধায় এটি প্রতিবছর ভাষার মাসে অনুষ্ঠিত হয়। মহামারীর কারণে সময়ের ব্যতিক্রম এবছর। একুশের চেতনার সঙ্গে মিলিয়ে এটিকে বলা হয় অমর একুশে গ্রন্থমেলা। দীর্ঘদিন শোক দিবস হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের নিজেদের দিন থাকলেও দিবসটি এখন কেবল আমাদের একার নয়। ১৯৯৯ সাল থেকে জাতিসংঘের স্বীকৃতির কারণে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সেই একই উপজীব্য ধারণ করলেও আমাদের অমর একুশে গ্রন্থমেলা কতটা আন্তর্জাতিক? এ প্রশ্ন জোরেশোরে তোলা যায়।
প্রশ্নটি নিয়ে লেখার পরবর্তী পর্যায়ে আলোচনা করব। তার আগে গত চল্লিশ বছরে বইকে বা বইমেলা ঘিরে আমাদের সংশ্লিষ্ট পরিকাঠামো বা অবকাঠামোর অগ্রগতি কোন্ দিকে কেমন সে বিষয়ে একটু ধারণা নেওয়া যাক। গত চার দশকে জনসংখ্যা অনুপাতে বইয়ের দোকান বাড়েনি। ক্ষেত্রবিশেষ কমেছে। অন্যদিকে বইমেলার পরিধি, পরিসর বেড়েছে। প্রকারান্তরে মানুষের পাঠাভ্যাস বাড়েনি। প্রকাশক এবং প্রকাশনা সংস্থা বেড়েছে। লেখক বেড়েছে। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু বাংলা ভাষার উৎকর্ষতা সাধিত হয়নি। বরং বাংলা স্তরে স্তরে নাজেহাল আর নিগ্রহের স্বীকার হয়েছে। দেশে বিদ্যমান অন্যবিধ ৪১টি নৃগোষ্ঠীর ভাষা তো বিলুপ্তির পথে। দেশে গ্রন্থাগারের সংখ্যা কমেছে। কমেছে জনসংখ্যা অনুপাতে বই কেনার প্রবণতা বা সামর্থ্য। এ সংক্রান্ত উল্লেখযোগ্য কোনও গবেষণা বা তথ্য উপাত্ত না থাকলেও পর্যবেক্ষণ আর গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে এমনটাই মনে হয়। বইয়ের সংখ্যা বাড়লেও গুণগত মানের বই বা ধ্রুপদী সাহিত্যকর্ম কি বেড়েছে? অমর একুশে গ্রন্থমেলার মাসজুড়ে বিক্রিবাট্টা নিয়ে প্রকাশকরা মোটের উপর খুশি, এ কথা বলা যায়। তাই বছর জুড়ে প্রকাশক লেখকদের প্রস্তুতি চলে এ মেলার জন্য। তবে এ বাণিজ্য প্রায় পুরোটা স্বদেশীয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ধারে কাছেও যেতে পারেনি। এ বিষয়ে পরে আরও দুয়েকটি কথা বলব।
এবারে বইমেলার দ্বিতীয় প্রধান দিক শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞ বা অনুষ্ঠানমালা প্রসঙ্গে দুয়েকটি কথা বলতে চাই। এ কাজটি একক কোনও কর্তৃপক্ষ বা প্রতিষ্ঠানের উপর ছেড়ে দিলে হবে না। এ কর্মযজ্ঞ হবে সংশ্লিষ্ট সকলের মাঝে প্রাসঙ্গিক দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নিয়ে। এটি কেবল একা বাংলা একাডেমির এখতিয়ারে থাকলে হবে না। একটু খোলাসা করে বলি- গত প্রায় দুই যুগ ধরে অনুষ্ঠানগুলো গৎবাঁধা ছক থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি; যেমন- প্রতিদিন একটি নির্ধারিত বিষয়, একটা প্রবন্ধ, দুই বা তিনজন আলোচক আর একজন সভাপতি, খোলামাঠে এক সেমিনার, সামিয়ানার নিচে দর্শক-শ্রোতা থাক বা না থাক। এরপরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তারপর হুড়াহুড়ির মধ্যে নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন। ইদানিং আরও একটা নতুন অনুষ্ঠান যোগ হয়েছে 'লেখক বলছি'।
বেশ! এবারে আমার পর্যবেক্ষণ থেকে একটা কথা বলি। আমলা-মন্ত্রী থেকে শুরু করে বইমেলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেক কর্তা-অধিকর্তা দেশের জনগণের টাকায় পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ বইমেলাগুলোতে ঘুরে এসেছেন, ফেইসবুকে-গণমাধ্যমে সেসব ছবিও প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তার কি ছিটেফোঁটা উন্নয়ন বা সংস্কার আমাদের বইমেলার উৎকর্ষতা সাধনে করেছেন?
বইমেলার শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড কেমন হতে পারে সে বিষয়ে একটু ধারণা দিতে চাই। পৃথিবীর বড় বড় বইমেলায় বৃহৎ প্রকাশনা সংস্থাগুলো নিজস্ব মঞ্চ থেকে নিজেদের লেখকদের বই নিয়ে আলোচনা ও সংলাপের ব্যবস্থা করে থাকে। একইভাবে বড় বড় গণমাধ্যম নিজস্ব মঞ্চ নির্মাণ করে লেখক, প্রকাশক, গবেষক এবং সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ আর পেশাজীবী ব্যক্তির সঙ্গে সংলাপ আর সাক্ষাৎকারের আয়োজন করে। এসব অনুষ্ঠান একই সঙ্গে নিজ নিজ গণমাধ্যমে প্রকাশ আর প্রচার করে। অঞ্চলভিত্তিক প্যাভিলিয়ন বা চত্বর হতে পারে বইমেলায়, যেমন চট্টগ্রাম চত্বর, রাজশাহী চত্বর, ঢাকা চত্বর, খুলনা চত্বর।
বিভিন্ন ভাষাভিত্তিক বিতর্ক, প্রদর্শনী আর অনুষ্ঠানের জন্য হতে পারে ভাষা চত্বর। একইভাবে কবিতা মঞ্চ, অনুবাদ মঞ্চ, গল্পমঞ্চ বা নাটক মঞ্চ হতে পারে। আর শিশু চত্বর আমাদের আছে বটে তা অনেকটা শিশুকিশোরদের জন্য প্রকাশনাগুলোকে এক জায়গায় স্টল বরাদ্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ। শিশু চত্বরের দায়িত্বটা শিশু একাডেমিকে দেওয়া যায়, যেখানে শিশুদের জন্যে একটা মঞ্চও থাকবে। সেখানে শিশু কিশোররা শিশুদের জন্যে যারা লিখেন, আকেঁন তাদের সঙ্গে শিশু কিশোররা সংলাপে, আলোচনায় অংশ নিবেন। ওখানে একটি শিশু একজন লেখককে একজন শিল্পীকে শিশুসুলভ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে ঘায়েল করবেন- তুমি অই ছবিতে হলুদ রঙটা বেশি দিলে কেন? অথবা বলবে, তোমার এই গল্পটা মজা লাগেনি। আগের বইটা ভাল ছিল। তুমি কি ফাঁকি দিতে শুরু করেছো?…
বইমেলায় বই ঘিরে নানা আলোচনা চলবে। গ্রন্থাগার আর গ্রন্থাগারিকদের ব্যবস্থাপনায় আলাদা একটি মঞ্চ থাকবে। থাকবে জাদুঘর বিষয়ক, ধর্মবিষয়ক, দর্শন বিষয়ক, ইতিহাস বিষয়ক নানা বিতর্ক। থাকবে রাজনৈতিক বিতর্ক ও সংলাপ শিক্ষা ও সংস্কৃতি কাঠামোর মধ্যে এবং অতি অবশ্যই দলীয় কাঠামোর বাইরে। এ প্রসঙ্গে একটি বিষয়ে সতর্ক করতে চাই। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এবং চেতনা সংশ্লিষ্ট কোন প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার স্টল থাকতে পারে। তাই বলে রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনের নামে স্টল বরাদ্দ দিতে হবে কেন? এটা বন্ধ করতে হবে।একটি রাজনৈতিক দলের কোনও গবেষণা সংস্থা থাকলে সেটি বইমেলার নিয়ম মেনে স্টল বরাদ্দের জন্যে আবেদন করতেই পারে। তাই বলে একেবারে দলীয় অঙ্গসংগঠন? এ দৃষ্টিকটূ চর্চা বন্ধ হতে হবে।
এবার আন্তর্জাতিকতা প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলতে চাই। স্কটল্যান্ডে কবি জসীম উদদীনকে এক সংবর্ধনার দেওয়া হয়। সেখানে তিনি একজন লেখকের অন্যদেশের মানুষের বা পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ বা আন্তর্জাতিকতা প্রসঙ্গে বলেন, "একটি কলস ভরতে ভরতে যতটুকু জল উপচে পড়বে, সেইটুকু লেখালেখিই অন্যদেশের মানুষের নজর কাড়তে পারে।"
আর আমরা বাঙালিরা আন্তর্জাতিকতার এতই কাঙাল যে, ইংরেজিতে কোনরকমে অনুবাদ করে বই প্রকাশ করে, এমনকি সরাসরি ইংরেজিতে লিখে আন্তর্জাতিক হওয়ার জন্য ভিক্ষুকদৌড়ে দিচ্ছি। তবে আন্তর্জাতিকতা বলতে বাঙালির সামনে ইংরেজির চাইতে বাংলার চারপাশের ভাষাভাষীর জনগোষ্ঠীর আগ্রহ বেশি থাকার সঙ্গত কারণ রয়েছে; যেমন- হিন্দি, উর্দু, আরবি, ফার্সি, অহমিয়া, ককবরক, চায়নিজ, জাপানি, বার্মিজ, নেপালি, কোরিয়ানসহ প্রতীচ্যের ভাষাগুলোর জনগোষ্ঠী।
এখানে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, বছর দুই আগে লেখকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন পেন এর রেঙ্গুন কেন্দ্রের আমন্ত্রণে বার্মা যাবার সুযোগ হয়েছিল আমার। ওই সময়ে লেখকদের সঙ্গে মতবিনিময় কালে বাঙালি লেখকদের বার্মা বা রেঙ্গুন নিয়ে সাহিত্যকর্মের প্রসঙ্গ এসেছিল। তার ধারাবাহিকতায় তারা বাঙালি লেখকদের অইসব লেখালেখি বার্মিজ ভাষায় অনুবাদের একটি উদ্যোগ নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। যদিও শেষতক সামরিকজান্তা সবকিছু গুবলেটে করে দিল। এরকম আগ্রহের আভাস ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান আর ইরানেও। এসব বিবেচনায় এ বইমেলা একটি অনন্য আন্তর্জাতিক বইমেলায় রূপ নিতে পারে।
বইমেলার বর্তমান তাৎপর্য অক্ষুণ্ণ রেখে আমরা কেবল আন্তর্জাতিক অংশটা অতিরিক্ত সৌন্দর্য বা অঙ্গ হিসেবে জুড়ে দিতে পারি। আর এ দায়িত্ব সমন্বয়ের ভার দেওয়া যেতে পারে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো এবং জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রকে।
বাংলা একাডেমিকে বইমেলার মত একটা অনুষ্ঠান আয়োজন বা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের ঝোঁক থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পৃথিবীর কোনও দেশের এরকম একটি একাডেমি অপ্রাসঙ্গিক এই বাড়তি চাপ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকে না। খোঁজ নিয়ে দেখুন, ফরাসি একাডেমি, দিল্লীর সাহিত্য একাডেমি, দিনেমার একাডেমি কিংবা সুইডিশ একাডেমির। বইমেলার আয়োজনটা প্রকাশক সমিতি আর জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের হাতে ছেড়ে দিয়ে একটি স্বাধীন স্বতন্ত্র কমিটি বা কোম্পানি করে দেওয়া যায়। তাতে অনেক কিছুর সুন্দর বিকাশ এবং প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ সম্ভব।
এ বইমেলার সময়ে সরকারকে একটি বিষয় স্মরণ করিয়ে দেওয়া যায়, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে সারাদেশে উপজেলা পর্যায়ে পাঁচশ যুব কমপ্লেক্স নির্মাণের কথা বলা আছে। যার অধীনে স্বয়ংসম্পূর্ণ আধুনিক গ্রন্থাগার নির্মাণের কথাও উল্লেখ আছে।
সরকারের মেয়াদ তো প্রায় অর্ধেক চলে গেল। যুব কমপ্লেক্স নিয়ে কোথাও কি কোনও খবর আছে? গ্রন্থাগার না থাকলে, না বাড়লে, বইমেলা করে বছরের একটা মাস ভাষা সাহিত্যের জন্যে দেখানোপনা দরদ আর অনেকটা ন্যাকামো হিসেবে রয়ে যাবে। তাই যুব কমপ্লেক্সের পাশাপাশি প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছোট কলেবরে এক কক্ষ বিশিষ্ট বিদ্যালয় এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষের ব্যবহার উপযোগী গ্রন্থাগার চালুর কথা চিন্তা করা যেতে পারে। একই সঙ্গে সারাদেশে ডাকঘরগুলোকে ডিজিটাল বইঘর, ডাকঘর আর তথ্যকেন্দ্র হিসেবে সংস্কার করা যেতে পারে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ আর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এটি একটা মোক্ষম কাজ হতে পারে। এর জন্য বাড়তি অবকাঠামো নির্মাণের দরকার নেই। প্রয়োজন কেবল নীতিনির্ধারণ আর পরিকল্পনার। এসব হলে বইয়ের বিক্রি যেমন বাড়বে, তেমন বাড়বে পাঠাভ্যাস।
বইমেলা ঘিরে পাঠক প্রকাশক আর আয়োজকদের থেকে এবার লেখকদের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে চাই। স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু লেখকদের জন্যে একটা তহবিল গঠন করেছিলেন। যার নাম ছিল 'বঙ্গবন্ধু লেখক ট্রাস্ট'। ১৯৭৫ এর পর অন্য অনেক কিছুর মত এ ট্রাস্টও নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। এখনই সময় এ ট্রাস্টকে পুনরুজ্জীবিত করার। এ ট্রাস্ট সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্কের আর ফিনল্যান্ডের স্বাধীন লেখক তহবিলের আদলে পরিচালিত হতে পারে। একই সঙ্গে একটি বিষয় সতর্ক করিয়ে দিতে চাই। হাল আমলে আমলা ঠিকাদার লেখকদের দৃষ্টিকটু দৌরাত্ম্য বেড়েছে। আমলা ঠিকাদার হওয়া দোষের কিছু না, তারা লিখতেই পারেন। দেশে দেশে আমলা ধ্রুপদি লেখকের দৃষ্টান্তও বিরল নয়। আমরা পাবলো নেরুদা, জর্জ অরওয়েল থেকে আমাদের আবু ইসহাক, আবদুশ শাকুর, আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া এবং আবুল হোসেনের নাম নিতে পারি। আমাদের শিল্পসাহিত্যের দেউরিতে জাতীয় প্রতিষ্ঠানে আমলাদের অযাচিত সুযোগ নেবার দৃষ্টান্ত নিয়ে একটা অনুসন্ধানী গবেষণা হতে পারে। ছোট্ট একটা উদাহরণ দিতে চাই- একবার বাংলাদেশ শিশু একাডেমি প্রকাশিত বইয়ের তালিকায় নজর বুলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে কয়জন আমলার বই ওই তালিকায় আছে, কিভাবে আছে। একই মাজেজা কাজ করে সরকারের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের বইকেনার মধ্যে। যে কারণে আমলাদের বই প্রকাশে বড়ই আগ্রহ প্রকাশকদের। এতে লেখালেখিতে দীর্ঘ মেয়াদী অন্ধকার ছায়া পড়ার আশঙ্কা থেকে যায়। একইভাবে যুথসই বিতর্ক, আলোচনা আর অপেশাদার গণমাধ্যমের কারণে অপরিণত, অপ্রাপ্ত, অপরিপক্ক আনাড়ি অনেক লেখক নানা ফন্দিফিকির করে জনপ্রিয়তার শীর্ষে স্থান দখল করতে চায়, কখনো করেও থাকে। এটাও সাহিত্য সংস্কৃতির জন্যে একটা উটকো ঝামেলা। এই ঝামেলা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে বইমেলার ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে। এসব প্রশ্ন নিয়ে বইমেলা উপলক্ষে আমাদের ভাবার সময় এখন।
লেখাটি শেষ করবার আগে একটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যবিজ্ঞান এবং গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগ গ্রন্থাগার বিষয়ে একটা আন্তর্জাতিক সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করেছিল গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে। সিম্পোজিয়ামের প্রাক্কালে 'গ্রন্থাগার ও লেখক' শিরোনামে আমাকে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ওই সেমিনারে মালয়েশিয়া থেকে আমন্ত্রিত কয়েকজন অধ্যাপক, গবেষক, গ্রন্থগারিক এবং শিক্ষার্থীও উপস্থিত ছিলেন। তাদের মাঝ থেকে গ্রন্থাগার বিজ্ঞানের একজন অধ্যাপক জানালেন মালয়েশিয়ায় বসবাসরত অন্যান্য দেশের অভিবাসীর গ্রন্থাগারে তাদের নিজস্ব ভাষায় বইয়ের চাহিদার কথা জানায়। একমাত্র ব্যতিক্রম ওই দেশে বসবাসকারী বাঙালি অভিবাসীরা। তারা গ্রন্থাগারে খুব একটা যায়ওনা, বইয়ের কোন চাহিদাও দেয় না। এর কারণ কী?
এরকম প্রশ্ন কেবল মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। অন্যান্য দেশেও বাঙালির চিত্র কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অনেকটা কাছাকাছি। এসব প্রশ্নও উপেক্ষা করার সঙ্গত কারণ নাই। বই আর বই পড়া ঘিরে নানা ইতিবাচক আর মন খারাপ করার মত সকল প্রশ্নের অবারিত আলোচনার জন্য বইমেলা একটা বড় উপলক্ষ। গ্রাম শহর পর্যন্ত সকলের সময়টা যেহেতু মহামারীর খপ্পরে, তাই দুনিয়ার নানাপ্রান্তের মানুষকে যুক্ত করার জন্যে ডিজিটাল প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার করে হাইব্রিড মঞ্চের মোক্ষম পদ্ধতি আমরা অনলাইনে কাজে লাগাতে পারি। পারি না কি?