Published : 15 Feb 2021, 10:28 AM
গোপাল ভাঁড় আর মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের গল্প তো কারো অজানা নয়। আবারো বলি। কৃষ্ণচন্দ্রের সভায় নাকি একজন বিদূষক ছিলেন যিনি অনেকগুলো ভাষায় কথা বলতেন; এবং তা এতটাই শুদ্ধ ভাবে বলতেন যে আদতে তার মাতৃভাষা কী, বা কোথা থেকে এসেছেন, কেউ বুঝতে পারত না। মহারাজ তাই একদিন বললেন, যে বলতে পারবে সেই বিদূষকের মাতৃভাষা কী, তাকে তিনি পুরস্কৃত করবেন। তাই শুনে গোপাল ভাঁড় রাজসভার দরজার পাশে অন্ধকারে লুকিয়ে থাকলেন। যেই বিদূষক রাজসভায় ঢুকতে গেলেন, গোপাল অন্ধকারের মধ্যে থেকে ছুটে এসে দিলেন এক প্রচণ্ড ধাক্কা।
ব্যস! ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠে বললেন– 'সড়া অন্ধা আছিস?'
গোপাল তৎক্ষণাৎ একগাল হেসে মহারাজ কে বললেন, "মহারাজ, উনি উড়িষ্যা থেকে এসেছেন, ভাষা উড়িয়া।" মাতৃভাষা বা নিজের ভাষা, যাই বলা যাক না কেন, এমনই তার আবেদন। প্রচণ্ড আনন্দে বা চরম কষ্টের প্রকাশে অনিবার্যভাবেই উচ্চারিত হয় সেই ভাষা।
জননীর জঠর হতে মুক্তি লাভ করে শিশু কান্না করে তার আগমনী বার্তা জানান দেয়। কান্নার ভাষাই একমাত্র ভাষা যা তার মুখে ফোটে তখন। দেশ-কাল-পাত্রের ভেদে তাকে আলাদা করা যায় না। শিশুর মুখের সারল্য আর হাসির মতো তার সেই ভাষাও বড়ই মাধুর্যময়। তারপর ধীরে ধীরে সে শেখে তার নিজের ভাষা, তার মায়ের ভাষা। তার অস্তিত্ব জুড়ে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে সেই ভাষা। মায়ের কাছে শেখা ভাষা তাকে স্বাবলম্বী করে তোলে নিজেকে প্রকাশ করতে, নিজের চাওয়া-পাওয়াগুলো জানিয়ে দিতে। নিজ ভাষা অপার মমতায় এভাবে জড়িয়ে পড়ে তার জীবনের প্রাত্যহিকতায়। মা যখন চাঁদকে ডাকেন তার চাঁদপানা সন্তানের কপালে টিপ দিতে, তখন শিশুও তার আধো আধো অর্থহীন ভাষায় মায়ের কপোলে আদরের চিহ্ন এঁকে দেয়।
এই যে ভাষার প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসার কথা বলছি, এটি একটি সার্বজনীন অনুভূতি। সর্বদেশে সর্বকালে নিজ নিজ ভাষা মানব জাতির কাছে শ্রেষ্ঠ। আদিম গুহামানবও তাদের চিত্রাঙ্কিত ভাষায় ব্যক্ত করেছে মনের কথা। ভাষার প্রতি ভালোবাসার ক্ষেত্রে একমেবাদ্বিতীয়ম না হলেও, আবেগপ্রবণ জাতি হিসেবে বাঙালির ভাষাপ্রেম অনেক দৃঢ়। পৃথিবীতে একমাত্র জাতি আমরা – আমাদের মায়ের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে ১৯৫২ সালে সংগ্রাম করেছি, প্রাণ দিয়েছি। ১৯৯৯ সালে বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করার জন্য আমাদের ভাষা দিবসকেই স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
বাঙালির মাতৃভাষা বাংলা – এ আমাদের মায়ের ভাষা, প্রাণের ভাষা। আমাদের প্রজন্মের সবাই যারা স্বাধীনতার পরে জন্মেছি, তারা ভাষা আন্দোলন দেখিনি, তবে অগ্রজদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে আর কিছু না পেলেও, পেয়েছি এই অত্যাশ্চর্য অনুভূতি; বাংলার প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসার অনুভূতি।
আমরা বেড়ে উঠেছি বাবা মায়ের হাত ধরে খালি পায়ে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করে, ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় ইতিহাস জেনে। আমাদের বেড়ে ওঠার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল বাংলা ভাষা ও সাহিত্য। আমাদের অলস দুপুর কেটেছে রবি ঠাকুর, সত্যজিৎ রায় থেকে শুরু করে শাহরিয়ার কবিরের লেখনী শক্তির সাথে পরিচিত হয়ে। আমাদের শৈশবে ছন্দের মায়াজাল বিস্তৃত হয়েছে নজরুল থেকে বিপ্রদাশ বড়ুয়ার ছড়ায় ছড়ায়। না, আমি আমার প্রজন্মের হয়ে আত্মম্ভরিতা প্রকাশে আগ্রহী নই। এমনটা তো নয় যে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের সবাই এই অনুভূতি, এই ভালোবাসাকে ধারণ করে না – অবশ্যই আমাদের বয়োকনিষ্ঠ অনেকেই বাংলা ভাষার প্রেমে সিক্ত।
বাংলা তার নিজের সমৃদ্ধ ভাণ্ডার উজাড় করে দিয়ে সেই ভালোবাসা আদায় করে নেয়। ইট কাঠের পাঁজরায়, নিরেট প্রাত্যহিকতার মাঝে যেমন বাংলা মিশে থাকে নিতান্ত অভ্যাস হয়ে, তেমনি সে মাঝে মাঝে রূপকে উপমায় সালাঙ্কারা সুন্দরী হয়ে টোকা দেয় মনের গহীনে। খুব সাধারণ ভাবে বলা "কি খবর, ভালো আছো তো" তাদের যেমন আপন করে নেয়, তেমনি কবির কথায় "তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ" শুনে তাদের কারো কারো হৃদয় উথাল পাথাল হয় বৈকি! নজরুলের "আমি চাঁদ নহি, অভিশাপ" পড়ে যেমন এক অব্যক্ত আবেগে মন ভারাক্রান্ত হয়, তেমনি যখন অচিন রায় লেখেন "দাদুরী ডাকিছে সঘনে," ব্যাঙের ডাকও বুঝি মিষ্টি শোনায়। আপনি বলতেই পারেন এ তো সাহিত্যের কথা। শুদ্ধ বাংলা যা শুধু গ্রন্থমাঝেই সীমাবদ্ধ। রোজকার কূটকাচালি পূর্ণ জীবনে যে বাংলা আমরা ব্যবহার করি, সে তো সেই রবি ঠাকুরের শেষের কবিতার 'ঘড়ার জল'। এ তো আর অতল দীঘির জল তো নয় যাতে অবগাহন করা যায়।
একথা অনস্বীকার্য যে বাংলায় কথ্য ভাষার সাথে সাহিত্যের ভাষার পার্থক্য আছে। তবে সাহিত্য চর্চা কোন ভাষায় হবে, সুধীজনের ভাষায় না প্রান্তিক বা ব্রাত্য জনের ভাষায়, সে সম্পর্কে আলোচনা করার আলোচনা করার ধৃষ্টতা আমার নেই। কবি নজরুল কেন জানালার পাশে সুপারি গাছ না লিখে "জানালার পাশে গুবাক তরুর সারি" লিখলেন, তা নির্ণয়ের জন্য বাংলার অনেক দিকপাল, রথী মহারথীরা রয়েছেন। মনে পড়ছে, আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক খন্দকার আশরাফ স্যার কবি, অ-কবির পার্থক্য বোঝাতে বলেছিলেন–কবি যাকে বলবে 'নীরস তরুবর', আমরা অ-কবিরা তাকেই বলবো 'শুষ্কং কাষ্ঠং'।
আমরা যারা ছা-পোষা বাঙালি, তাদের কাছে বাংলা ভাষা প্রতিদিনের ব্যবহারে শুষ্কং কাষ্ঠং হবার পরও অমলিন থাকে। বাংলা ভাষা নিয়ে এপার-ওপারের পার্থক্যে, ঘটি-বাঙালের চিরন্তন তর্কে নাই বা গেলাম। আপনি 'কাঁচালঙ্কা' খাবেন না 'কাঁচামরিচ', 'অভ্যাস' বদলাবেন না 'অভ্যেস', সে এক অম্লমধুর তর্ক। তার জন্য বাংলা ভাষার প্রতি ঘটি আর বাঙাল উভয়েরই ভালোবাসায় কোন ঘাটতি পড়ে না।
এই যে যাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাংলা ভাষা মিশে আছে, তাদের একটা বিরাট অংশ হলেন তারা, যারা মনের দিক থেকে বাংলার কাছাকাছি থাকলেও, ভৌগোলিক ভাবে অনেক অনেক দূরে থাকেন। পরিযায়ী জীবনে দানা খুঁটে খাওয়া কবুতরের মতো তারা ডানা ঝাপটে উড়ে বেড়ান অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশের হিসেব মিলিয়ে। সে উড়ানে রঙ লাগায় কত ছবি, কত গান; পৃথিবীর হাজারো ভাষায়। তবে দিন শেষে ক্ষুদ্র খোপে ফিরে বাকবাকুম করেন ঐ সেই বাংলা ভাষাতেই।
প্রবাসের বাংলা পাড়ায় তারা শুধু ডাল ভাত খেতে বা চানাচুর কিনতে যান না, আরো দশজন অতীব সাধারণ "দ্যাশের" মানুষের মুখের বাংলা বুলি শুনতে যান। বাংলা নিয়ে তাদের চাওয়া পাওয়া খুবই সামান্য। এই যেমন আমাদের পুত্রদ্বয়ের কাছে আমাদের চাওয়া – সাহিত্যিক হতে হবে না; শুধু নিজ ভাষাটাকে বাঁচিয়ে রাখো। বাংলা ভাষা তোমার সত্ত্বার অংশ। তাকে তুমি অস্বীকার করতে পারো না। চৌকাঠ ডিঙিয়ে ঘরে ঢুকলেই কিন্তু তুমি বাঙালি। তাদের পিতামহী আরো সরস করে তার ভাষা সংক্রান্ত মতামত জানিয়ে দেন। পৌত্র তার হাউমাউ করে ইংরেজিতে কথা বলে কাঁদলে তিনি বলবেন, "এই, খবরদার, ইংরেজিতে কাঁদবে না, বাংলায় কাঁদো। এতে পুত্র মহাশয়ের কান্নার বেগ প্রশমিত না হলেও, তার মায়ের একখানা আকর্ণবিস্তৃত হাসি দেখা যায়। আদরে আহ্লাদে মা যখন তাদের নিয়ে ছড়া কাটে–
ইতুল বিতুল ইলতু পিতুল
তেঁতুল গাছের তল,
ইলতু বুড়া দাদার সাথে
খেলছে শুধু বল।
অথবা,
হুতুম হাতুম আর বাবা মা,
এক বাড়িতে থাকে
যখন ঘুমায় তখন তাদের
নাকটি সবার ডাকে।
হুতুম হাতুম দুজনেই হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে – 'নাক ডাকে' – দ্য নোজ কলস! এই নির্মল আনন্দের ষোল আনাই বাংলা ভাষার মাহাত্ম্য। এ যে মায়ের হাস্যকর কাব্য প্রতিভা নয়, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
সাপ্তাহিক ছুটির দিনটাতেও রাঙা প্রত্যুষে, যখন সূর্যটাও হাই তুলে পাশ ফিরে শোয়, আমরা তখন ছুটেছি বাংলা স্কুলে। শত অনুযোগ করেও ছেলেটা আমার বাংলা পড়া ছাড়েনি কিন্তু। বরং প্রবাস জীবনের প্রথম ভাষা দিবসে, যখন সে জীবনের ষষ্ঠ বর্ষেও পদার্পণ করেনি, স্কুল যাবার আগে আমাকে বলে যায়, "মা, এখানে তো শহীদ মিনার নেই; তুমি লেগো দিয়ে একটা শহীদ মিনার বানিয়ে রেখ। আমি স্কুল থেকে এসে ফুল দেব। " আর এর বছর দুয়েক পরেই সে মা-কে নিয়ে বাংলাতে গল্প লেখে। সাহিত্যমূল্য যাই হোক না কেন, বাংলা ভাষায়, বাংলা হরফে লেখা সেই গল্প বাবা মায়ের মনে কর্মব্যস্ত দিনের শেষে প্রশান্ত এক সন্ধ্যা নামায়।
অনেকেই অবাক হয়েছে যে আমার ছেলেটা আন্তর্জাতিক স্কুলে পড়ে বাংলা স্কুলে কেন যাচ্ছে। পরীক্ষা তো দিতে হবে না, নম্বরও যোগ হবে না, তবে কি লাভ? আসলে আমাদের প্রবাসীদের বাংলা জানা, শেখা লাভ-লোকসানের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকে না। আমাদের লাভের গুড় আমরাই খাই, পিঁপড়েতে না। বিশেষ করে যখন আত্মজ, আত্মজাকে বাংলায় শুধু কথা বলতে শুনি আমার সব লাভের খতিয়ান মিলে যায়। তারা হয়তো পরিশীলিত, ব্যাকরণ সমৃদ্ধ বাংলা বলে না। "মা, গাড়ি ডেকবে (গাড়ি ডাকবে)? অথবা "আজকে একদম ঘেমিনি, (খেলতে গিয়ে ঘেমেছ? এর উত্তরে)", "নতুন টিচার অনেক ভালো, মিসটেক বানালেও কিছু বলে না (কারণ, ইউ মেক মিসটেক ইন ইংলিশ) – মাঝে মাঝে এসব 'অদ্ভুতুড়ে' এবং 'হাঁসজারু' মার্কা বাক্য শুনতে পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে আবার 'পাগল' এর স্ত্রী লিঙ্গ 'পাগলিনী' হলে, 'ছাগল' এর স্ত্রী লিঙ্গ কেন 'ছাগলিনী' হবে না? কেন শিক্ষিকা কেটে দিয়ে 'ছাগী' লিখতে বললেন, তার সদুত্তর দিতে গলদঘর্ম হতে হয়।
তারপর আবার তারাই যখন ক্রিকেট খেলায় বাংলাদেশ জিতলে "সাবাস বাংলাদেশ" লিখে পোস্টার নিয়ে ঘোরে, আত্মতৃপ্তির পারদ আরো খানিকটা ওপরে ওঠে। অনেক বন্ধুদের তাই দেখি প্রবাস জীবনে শত ব্যস্ততার মাঝেও সন্তানের সাথে বাংলায় চর্চা করতে।
ছানাপোনাদের মুখে এহেন ভুলে ভরা বাংলা শুনে আমার বন্ধুরা অনেকেই হা-হুতাশ করে। তাদের প্রতিনিয়ত মনে হয়, এই যে সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের খোঁজে ডানা ঝাপটে উড়ে বেড়ানো, এর মাশুল দিতেই বুঝি এসব আধিভৌতিক বাংলা শুনতে হয় তাদের। আমার অবশ্য এরকম মনে হয় না; আমি মনে করি বাংলা ভাষা যদি হৃদয়ে থাকে, ভৌগলিক দূরত্ব তাকে মুছে ফেলতে পারে না। অনেক প্রবাসী বন্ধু এবং তাদের সন্তানদের কথা জানি যারা শুদ্ধ সুন্দর বাংলা ভাষা বলেন এবং লেখেন। আবার এমন অনেক অনেক বাঙালি দেশেই আছেন যারা সেই হাঁসজারু মার্কা বাংলা ভাষায় কথা বলেন।
বাংলা ভাষার বিভিন্ন আঞ্চলিক রূপ সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। নোয়াখালি, সিলেট বা বরিশাল-পটুয়াখালির ভাষা, যাতেই আপনি কথা বলুন না কেন, তার প্রত্যেকটি কিন্তু একটি সম্পূর্ণ সমৃদ্ধ ভাষা, যা সম্পূর্ণ ভাবে বক্তার মনের ভাব প্রকাশের যোগ্য। আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা তাই কখনই দোষণীয় নয় – বরং, আমি বলব এর চেয়ে স্বাভাবিক আর কিছুই হতে পারে না। আমি বাংলা ভাষার যে রূপের কথা বলছি, তার যথার্থ নাম আমি নিজেও জানি না। তবে আমার মনে হয় বাংলা ভাষার উৎপত্তি যেমন সংস্কৃত থেকে এবং মাগধী পালি ও প্রাকৃতের মাধ্যমে বিবর্তিত হয়ে আজকের এ রূপে এসেছে, তেমনি এই ভাষার মোড় ঘুরেছে ৯০' দশকে আরজে এবং ভিজেদের হাত ধরে এবং ছড়িয়ে পড়েছে আজকের ফেসবুকে এবং অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে। আপনি কি ভাবছেন যে আমি বাংলা ভাষায় পরিবর্তনের বিপক্ষে?
না, ব্যপারটা সেরকম নয় কিন্তু। ভাষার ধর্মই হল যে সে সতত বহমান। তার পরিবর্তন ঘটবে এটাই স্বাভাবিক। যদি সাহিত্যের ভাষার কথা বলি, যা বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ বা নজরুল ইসলাম লিখে গেছেন, আজকের কবি সাহিত্যিক সে বাংলা ভাষায় লেখেন না। ঠিক যেমন শেকসপিয়র যে ইংরেজিতে সাহিত্য চর্চা করেছেন, এখন আর সে ভাষা চলে না। আর সময়ের সাথে সাথে যেখানে সংস্কৃতি, ইতিহাস এমনকি একটি সমাজের চিত্র বদলে যায়, সেখানে আমদের প্রাত্যহিক জীবনের ভাষা তো বদলে যাবেই।
"সুন্দর লাগছে" হয়ে যাবে "ঝাকাস"; দারুণ হয়ে যাবে ওয়াও, "সমস্যা" হয়ে যাবে "প্যারা" এটাই স্বাভাবিক। এই আমার মতো পুরনো বাংলা ভাষা-ভাষীকে একটু বুঝে নিতে হয় আরকি! নতুন শব্দ ব্যবহার ঠিক আছে, তাই বলে বাংলা ভাষার মূল কাঠামোও কি ঠিক রাখা দুষ্কর? ইংরেজি হরফে বাংলা লেখা দেখতে দেখতে "গেবন" (পড়ুন জীবন) "ভাগা ভাগা" (অর্থাৎ ভাজা ভাজা ) হয়ে গেল। নিজেকে তাই বলি "অরা পাগলি মুরাদ টাকলা সিকা না" (পড়ুন, ওরে পাগলি, মুরোদ থাকলে শিখে নে)। এহেন ভাষাচর্চাও হয়তো স্বাভাবিক, কারণ ইংরেজি না জানলে আপনি যেমন 'ক্ষ্যাত', বাংলা না জানলে আপনি 'কুল'। কাজেই ভুল বানানে অশুদ্ধ উচ্চারণের বাংলা লিখে আপনি কোনভাবেই ভাষাদূষণ ঘটাচ্ছেন না। তবে এই ইংরেজি হরফের বাংলা লেখার ব্যাপারটা যদিও বা না দেখার ভান করা যায়, বাংলা হরফের বাংলা ভাষা লেখা এবং ক্ষেত্রবিশেষে শোনা, সত্যিই গাত্রদাহের উদ্রেক করে। "বন্দু তুমি আমারে ট্যাগাইলানা কেনো"? এ জাতীয় বাক্য দেখে তার মর্মোদ্ধারের জন্য অভিধান হাতড়াতে হয়।
মুদ্রার উল্টো পিঠে থাকা আমাদের বন্ধুদের তাই এই নব্য ভাষায় বলি, "চাপ নেবেন না বস! পোলাপানকেও প্যারা দেবেন না ঝাকানাকা ভাষা ছেড়ে আপনার মত ঝাকাস নাকি আজাইরা বাংলা বলবার জন্য"। গৌরচন্দ্রিকায় যে গল্প বলেছিলাম, সে গল্প কিন্তু ঐ বিদূষকের একার নয়, আমাদের সবার। আপনি শুধু বাংলা বলে যান আপনার শিশুটির সাথে। হোঁচট খেয়ে পড়লে সে নিশ্চিত বলে উঠবে, "উফ, মাগো! মরে গেলাম। চোখের মাথা খেয়েছি"।