Published : 22 Dec 2020, 12:31 PM
অনেকেই বলে থাকেন যে, রাজনীতি হচ্ছে কৌশলের খেলা। এখানে স্থায়ী শত্রু বা মিত্র বলে কিছু নেই। যদিও বিষয়টি সরল নয়। কারণ রাজনৈতিক দলগুলো পরিচালিত হয় কিছু মৌলিক নীতি-আদর্শ দ্বারা। সেই নীতি-আদর্শ থেকে যদি কোনো দল সরে যায়, কিংবা নীতির সঙ্গে মিল নেই এমন কোনো দলের সঙ্গে আপস বা আঁতাত করে, তাহলে সেই দল সমালোচিত হয়। কারণ কোনো বিশেষ নীতির কারণেই একটি দলের সঙ্গে আরেকটি দলের পার্থক্য রচিত হয়। যে দল ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিতে বিশ্বাসী, তেমন দল যদি ধর্মীয় ভাবাদর্শচালিত কোনো দলের সঙ্গে সখ্য গড়ে, তাহলে সেই দলের নীতিনিষ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
আমাদের দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী দল হচ্ছে আওয়ামী লীগ (এই মন্তব্যে অনেকেই হয়তো খেঁকিয়ে উঠবেন, এর যুক্তিযুক্ত কারণও হয়তো আছে। কিন্তু তারপরও মোটাদাগে, অন্তত কাগজেকলমে আওয়ামী লীগকে এই দুই আদর্শের সমর্থক দলই বলতে হবে)। অন্যদিকে হেফাজতে ইসলামী একটি ধর্মীয় ভাবাদর্শচালিত দল। দলটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বলে কখনও শোনা যায়নি। এ দলটি ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠার কথা বলে। নারী নেতৃত্ব ও নারী শিক্ষাকেও তারা ভালো চোখে দেখে না। সেই বিবেচনায় আওয়ামী লীগ ও হেফাজত দুই মেরুর দুই রাজনৈতিক দল। কিন্তু রাজনীতির খেলা এতই বিচিত্র যে, এই দল দুটির মধ্যে গত সাত বছরে বেশ দহরম-মহরম দেখা গেছে। আবার সম্পর্ক তিক্তও হয়েছে।
হেফাজত প্রথম আলোচনায় আসে সাত বছর আগে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ২০১৩ সালে বাংলাদেশে যখন প্রগতিশীল ছাত্র-যুবরা রাজধানীর শাহবাগে আন্দোলনে নেমেছিলেন, তখন আহমদ শফীর নেতৃত্বে তাদের বিরুদ্ধে ১৩ দফা দাবি নিয়ে রাজপথে নেমেছিল কওমী মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। এক পর্যায়ে ৫ মে তারা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটানোর উদ্দেশ্যে মতিঝিলে লক্ষ লক্ষ কর্মীসমাবেশ করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। সিপিবি অফিস, বায়তুল মোকাররমের দোকানপাট ও কয়েকটি সরকারি অফিসে আগুন জ্বালিয়ে সরকারের আসন্ন পতনের লক্ষ্যে তারা চালিয়েছিল বহ্নুৎসব। সেদিন তাদের মিত্র ছিল সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ধারণা করেছিলেন, হেফাজতি অভ্যুত্থান দিয়ে সরকারের পতন ঘটানো যাবে। কিন্তু সরকারের পতন ঘটেনি। গভীর রাতে পুলিশ দিয়ে হেফাজতকর্মীদের ঢাকা থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল। তখন নিরাশ হয়েছিলেন বিএনপি ও হেফাজত উভয় নেতৃত্বই। সেই সময় হেফাজত নেতারা আওয়ামী লীগ সরকারকে মুরতাদ, নাস্তিক ইত্যাদি অভিধাও দিয়েছিল।
পরদিন ৬ মে চট্টগ্রামের হাটহাজারী, নারায়ণগঞ্জ, বাগেরহাটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হেফাজতের কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হেফাজতের ২২ কর্মীসহ ৩৯ জন নিহত হন। এসব ঘটনায় ঢাকাসহ সারা দেশে ৮৩টি মামলা হয়।
এরপর পাশার দান পাল্টে যায়। সরকার উদ্যোগ নিয়ে হেফাজতের সঙ্গে 'আপস' করে এবং সেই 'আপসে'র ধারাবাহিকতায় হেফাজতের আমীর আহমদ শফীকে রেলওয়ের ৩২ কোটি টাকার জমি উপহার দেয়া হয়। গত কয়েক বছরে ক্রমশ আওয়ামী লীগ ও হেফাজত পরষ্পরের কাছে এসেছে। হেফাজতের দাবি মেনে পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন আনা হয়েছে, কওমী মাদ্রাসাকে স্বীকৃতি দিয়েছে সরকার। ইসলামের চেতনার দোহাই দিয়ে আদালত থেকে মূর্তি অপসারণের দাবি জানিয়েছিল হেফাজত। তাও মানা হয়েছে।
এর ধারাবাহিকতাতেই নির্বাচনের প্রাক্কালে ঢাকায় সমাবেশ করে হেফাজতের 'বড় হুজুর' ৯৮ বছর বয়সী মওলানা আহমদ শফী, বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোর দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্স সমমানের স্বীকৃতি দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রীকে 'কওমি জননী' আখ্যা দিয়েছেন। এর সূত্র ধরে ২০১৩ সালে দায়ের করা ৮৩টি মামলার মধ্যে ২২টি মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করা হলেও বাকি ৬০ মামলার তদন্ত স্থবির হয়ে পড়ে। যেসব মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়, সেগুলোর বিচার কার্যক্রমও ঝুলে যায়।
আলোচনা ও কানাঘুষা রয়েছে, মওলানা আহমদ শফীর জীবদ্দশায় হেফাজত ও আওয়ামী লীগের মধ্যে একটি গোপন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। যে কারণে ২০১৩ সালের পরে জুন মাসের পরে হেফাজতের নেতাদের কখনও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কড়া কোনো মন্তব্য করতে দেখা যায়নি। বরং মওলানা শফীর বিভিন্ন বক্তব্যে আওয়ামী লীগের প্রতি এক ধরনের সমর্থনের সুর লক্ষ করা গেছে। কিন্তু গত ১৮ সেপ্টেম্বর মাওলানা শফীর মৃত্যুর তিন মাস পর এই সম্পর্কটা আবার তিক্ত হয়ে উঠেছে।
সম্প্রতি রাজধানীর ধোলাইপাড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের তীব্র বিরোধিতা করায় হেফাজতের সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি হয়। ভাস্কর্য স্থাপন নিয়ে ইতোমধ্যে সরকারি দলের নেতাকর্মী এবং হেফাজতে ইসলামের নেতাদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য ও বিষোদগার চলছে। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুযায়ী হেফাজতের দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করতে হলে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ থেকে আওয়ামী লীগকে সরে আসতে হচ্ছে। আবার ভাস্কর্য নির্মাণ করতে গেলে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সরকারের স্থায়ী দূরত্ব তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। হেফাজতে ইসলামসহ সমমনা ইসলামী দলগুলো বলছে, তারা বঙ্গবন্ধুর বিরোধী নন, কিন্তু ভাস্কর্যবিরোধী। ভাস্কর্য ও মূর্তির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশে কোনো ভাস্কর্য নির্মাণ হতে পারে না। এটি কুরআন ও সুন্নাহ বিরোধী।
হেফাজত নেতা মাওলানা মামুনুল হক কোনো রকম রাখঢাক না করে স্পষ্ট করে বলেছেন, জাতির জনকের ভাস্কর্য করতে দেয়া হবে না, প্রয়োজনে 'ভাসিয়ে বুড়িগঙ্গায় দেবেন'। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, এমন হুংকার ছেড়েও মামুনুল হক বহাল তবিয়তে রয়েছেন। অথচ আইন অনুযায়ী, জাতির জনককে নিয়ে কটূক্তি করা, ছবির অবমাননা ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। এমন অপরাধে বহু মানুষ কারাবন্দি হয়েছেন, চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছেন। গেল সপ্তাহে হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার এক ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ফেইসবুক লাইভে এমন কটূক্তির অপরাধে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই গ্রেপ্হতারয়েছেন। অথচ মামুনুল হকের বিরুদ্ধে এখনও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এর পেছনে যে রাজনৈতিক 'হিসেব-নিকেশ' আছে তা অনুমান করতে কষ্ট হচ্ছে না।
যদিও সরকার ভিন্ন পদ্ধতিতে হেফাজতকে 'ঘায়েল' করতে চাইছে। হেফাজতের সাবেক আমির মাওলানা শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর প্রায় তিন মাস পর হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। চট্টগ্রামের আদালতে দায়ের করা ওই মামলায় হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব ও বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়ার হুমকিদাতা মাওলানা মামুনুল হকসহ ৩৬ জনকে আসামি করা হয়েছে৷ মামলাটি দায়ের করেছেন মাওলানা আহমদ শফীর শ্যালক মোহাম্মদ মাঈনুদ্দিন৷ তিনি এজাহারে অভিযোগ করেছেন, "এটা একটি পরিকল্পিত হত্যা৷ আহমদ শফীর ওপর হামলা চালানো হলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রথমে তাকে হাসপাতালে নিতে বাধা দেওয়া হয়৷ অ্যাম্বুলেন্স ফিরিয়ে দেওয়া হয়৷ হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার অক্সিজেন মাস্ক খুলে এবং মানসিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়৷'' আদালত মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছে৷
ওদিকে সাত বছর আগে হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধকে কেন্দ্র করে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় দায়ের করা মামলাগুলোও পুনরুজ্জীবিত করা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে হেফাজত নেতৃত্বকে চেপে ধরার কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতাদের পাশাপাশি শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসসহ আওয়ামী লীগের নেতারাও হেফাজতবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন। 'ভাস্কর্যবিরোধী শক্তি'কে মোকাবিলা করতে পেশাজীবীদেরও মাঠে নামানো হয়েছে। যদিও এসবকে অনেকে 'দরকষাকষির কৌশল' হিসেবে দেখছেন।
যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি কার্যকর এবং আদালত কর্তৃক জামায়াত নিষিদ্ধ হওয়ার পর থেকে সরকারের মধ্যে এক ধরনের 'হেফাজত ফোবিয়া' কাজ করছে। নানা কৌশলে জামায়াত-বিএনপিকে কোণঠাসা করার পর ক্ষমতাসীনদের কাছে একমাত্র ভীতিকর শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে হেফাজতে ইসলাম।
এই হেফাজত কিন্তু জামায়াতের চেয়ে কোনো অংশে কম বিষধর নয়। নাস্তিকতার ধোঁয়া তুলে তালিকা করে মুক্তমনা ব্যক্তিদের চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যার প্ররোচনা, হত্যা-হুমকি-হামলা চালিয়ে তথাকথিত ব্লগারদের দেশ ত্যাগে বাধ্য করা, নারীদের লেখাপড়া, সম্পত্তির অধিকার বন্ধ করে দেয়ার প্রস্তাব, সর্বশেষ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেয়ার দুঃসাহস যারা দেখায় তাদের চিনতে ভুল হলে কঠিন মূল্য দিতে হবে। তখন কেবল নিহতের মূর্তি নয়, জীবিতদের কল্লাও বন্ধক দিতে হতে পারে।