Published : 09 Dec 2020, 11:34 AM
বীরেন্দ্র নাথ অধিকারী
যতকাল রবে পদ্মা যমুনা
গৌরী মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার
শেখ মুজিবুর রহমান।
যার ধ্রুপদি রং-তুলির আঁচড়ে আঁকা 'বাংলাদেশ' নামক একটি 'ভাস্কর্য', যে দেশের মানচিত্র ও পতাকা মানেই তার প্রতিচ্ছবি, তারই অমর কীর্তি সে দেশের বুকজুড়ে থাকবে তার ভাস্কর্য, এটাই তো স্বাভাবিক। তাই বাংলাদেশের সকল প্রান্তে এবং দেশের বাইরেও এ পর্যন্ত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসংখ্য ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে। তার ভাস্কর্য নির্মাণে এ বছর ১৩ নভেম্বরের আগে কোথাও কেউ কোনো বাধা দিয়েছে বলে জানা যায়নি। কিন্তু, ঐ দিন একটি ধর্মীয় মৌলবাদী দলের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা ধোলাইপাড়ে 'বঙ্গবন্ধু ভাস্কর্য' নির্মাণের বিরোধিতা করে তীর্যক ও আপত্তিজনক বক্তব্য রাখেন। তারপর থেকে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সমাবেশ, সংবাদ সম্মেলন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাগাতার জাতির পিতার উদ্দেশ্যে অশালীন ও অবমাননকর বক্তৃতা-বিবৃতিসহ তার জন্মশতবার্ষিকীতে দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে'র ঢাকা প্রান্তে সরকার কর্তৃক নির্মিতব্য 'বঙ্গবন্ধু ভাস্কর্য' স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদীরা নির্মাণ করতে দেবে না বলে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, 'বঙ্গবন্ধু ভাস্কর্য'সহ সকল প্রকার ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করে ঘোষণা দিয়েছে যেখানেই এ ধরনের ভাস্কর্য দেখা যাবে, তা তারা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবে। তারা শুধু কথায় নয়, কাজেও তা শুরু করে দিয়েছে। ইতোমধ্যে গত ৫ ডিসেম্বর কুষ্টিয়ায় নির্মাণাধীন জাতির পিতার ভাস্কর্য'র হাত ও মুখমণ্ডল ভেঙে দিয়েছে দৃষ্কৃতিকারীরা। ইতোপূর্বে ২০০৮ সালে বিমান বন্দরের গোলচক্কর থেকে লালন ভাস্কর্য অপসারণ ও ২০১৭ সালে সুপ্রীম কোর্টের সামনে থেকে লেডি জাস্টিসিয়া ভাস্কর্য সরানোসহ এবং অতিসম্প্রতি গত ২ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন চত্বরে মধুর ভাস্কর্য'র একটি অঙ্গ ভেঙে ফেলেছে তারা।
চলমান এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষে ও সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার কিছু ব্যক্তিবর্গ 'ভাস্কর্য আর মূর্তি' দুটো এক জিনিস নয়, 'ভাস্কর্য ইসলামী শিক্ষানুযায়ী নিষিদ্ধ নয়' এবং 'অনেক মুসলিম দেশেও ভাস্কর্য রয়েছে' ইত্যাদি ব্যাখ্যা দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু মৌলবাদী গোষ্ঠী সেসব ব্যাখ্যা মেনে নেবে বলে ভেবে নেয়ার কোনো কারণ নেই। তারা এদেশের স্বাধীনতাকে আজ অবধি মেনে নেয়নি, জাতির পিতাকে স্বীকার করে না, ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা বিশ্বাস করে না, বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী না, জাতীয় স্মৃতিসৌধ ও শহীদ মিনারে যাওয়াকে হারাম মনে করে এবং বাঙালির কৃষ্টি, সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্য ইত্যাদি অনুসরণ করে না। তাই বাঙালির সকল অর্জন ও গৌরবগাথাসহ ভাস্কর্য বা মূর্তি যে-নামেই অবিহিত করা বা অন্য যেকোন ব্যাখ্যা দেওয়া হোক না কেনো, সুযোগ পেলে তা তারা ধ্বংস করতে উদ্ধত হবেই। কথায় আছে- 'চোর না শুনে ধর্মের কাহিনী'!
তাছাড়া, 'ভাস্কর্য আর মূর্তি'- দুটো এক জিনিস নয়' বলার অর্থ অনেকটা এরকম দাঁড়াচ্ছে- 'মূর্তি' বলার সাথে-সাথে 'পূজা' এসে যায়, তাই 'মূর্তি'র বিষয়টি বিধর্মীদের বিধায় 'মূর্তি' নয়, 'ভাস্কর্য' নির্মাণ করা হবে। আবার ভাস্কর্য যেহেতু অনেক মুসলিম দেশে রয়েছে, তাই ওটা এ দেশেও নির্মাণে কোনো বাধা নেই। ধর্মনিরপেক্ষ এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্য এসব ব্যাখ্যা কোনভাবেই প্রযোজ্য নয়। এটি সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর নিকট ভুল বার্তা দিতে পারে। কারণ, বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী 'মূর্তি' নির্মাণ ও মূর্তিপূজা করে। আর বেসরকারি বা ব্যক্তি'র পাশাপাশি সরকারি আর্থিক সহায়তায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিভিন্ন পূজাপার্বণ আয়োজিত এবং সেসব কাজে যথারীতি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ 'মূর্তি' নির্মাণ করা হয়। এসব কর্মকাণ্ড তদারকির জন্য একাধিক সরকারি প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। ধোলাইপাড়ে 'বঙ্গবন্ধু ভাস্কর্য' নির্মাণের প্রেক্ষাপটে মৌলবাদীদের হুমকির মুখে 'ভাস্কর্য আর মূর্তি' এক জিনিস নয় বলা হলেও সরকারি সহায়তায় এ দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মূর্তি নির্মাণ ও পূজাপার্বণ এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যাবে না। পক্ষান্তরে, এ ধরনের বক্তব্য মৌলবাদীদেরকে আশকারা যোগাতে পারে এবং তাতে তারা মূর্তি ভাঙতে উৎসাহ পেতে পারে, বিশেষ করে সুযোগ পেলেই যখন তারা এই হীন কাজটি করছে।
অন্যদিকে, 'ভাস্কর্য' বিতর্কে কোন দেশে কি আছে বা নেই, তার উদাহরণ টানা অবান্তর। কারণ, যেসব দেশের উদাহরণ টানা হচ্ছে, সেসবের একটিও ধর্মনিরপেক্ষ দেশ নয়। পাক্ষান্তরে সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। বাঙালির ভাষা-শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-কৃষ্টি'তে স্বাতন্ত্রতা বিদ্যমান। শুধু বারো মাসে তেরো পার্বণই নয়, বাঙালির রয়েছে বছরজুড়ে শতপার্বণ। ঈদ, পূজা, বৌদ্ধপার্বণ, বড়দিন, পহেলা বৈশাখ ইত্যাদি ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান বিষয়ক উৎসবের দিনগুলো এখানে জাতীয়ভাবে আয়োজিত হয়, ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-নারী-পুরুষ-আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা মিলেমিশে এসব উদযাপন করে। ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্তাবিশিষ্ট বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ ও সঙ্কল্পবদ্ধ সংগ্রাম করে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছে। মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তি আমাদের সেই বিজয় মেনে নিতে পারেনি বলে তাদের প্রতিভূ মৌলবাদী শক্তি ধর্মীয় জিকির তুলে নানান ছলে বাঙালি জাতীয়তা ও আমাদের ঐক্যবদ্ধতা, তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব'র ওপর বারবার আঘাত হানায় লিপ্ত রয়েছে, মাঝেমাঝেই লম্ফঝম্প করছে এবং সুযোগ পেলেই তাদের ঘোষণা মোতাবেক তারা ভাস্কর্য বা মূর্তি সবকিছুই গুঁড়িয়ে দিতে উদ্ধত হচ্ছে।
'ভাস্কর্য' এবং 'মূর্তি'- যে নামেই বলা হোক না কেন, দুষ্কর্ম করতে মৌলবাদীদের জুড়ি নেই। প্রসঙ্গত, এখানে একটি কল্পিত উপমা দেয়া যেতে পারে। উপমাটি এরকম- ধরা যাক কোনো একটি চত্বরে পাশাপাশি 'বুদ্ধমূর্তি', 'দুর্গা প্রতিমা' এবং 'বিবেকানন্দ ভাস্কর্য' রয়েছে। মৌলবাদীরা যদি কোনোদিন কোনো কারণে সেখানে মূর্তি ও প্রতিমা ভাঙার সুযোগ পায়, তাহলে তারা পাশে থাকা ভাস্কর্যটিও অক্ষত রাখবে না, নিশ্চিত। তারা ভাস্কর্য এবং মূর্তি'র মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখে না, তাদের কাছে কোনো ব্যাখ্যাই গ্রহণীয় নয়। 'ভাস্কর্য' বা 'মূর্তি'- যা কিছু হোক না কেন, তা তারা গুঁড়িয়ে দেবে, বহুদিন ধরে সে ঘোষণা তারা বারবার দিয়ে যাচ্ছে। তাই জাতির ক্রান্তিকালে ধর্মান্ধ মৌলবাদীগোষ্ঠীর উদ্দেশ্যে 'ভাস্কর্য এবং মূর্তি'- দু'টি ভিন্ন জিনিস বলে ব্যাখ্যা দেওয়া অবান্তর। কারণ এ দু'টির মধ্যে তারা কোনো পার্থক্য দেখে না। তাই কর্তৃপক্ষ'র অবস্থান হতে হবে সুনির্দিষ্ট ও সুদৃঢ়। সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রয়োজনে এ দেশের যে কেউ ভাস্কর্য নির্মাণ করবে, আর যাদের ধর্ম পালনের জন্য মূর্তি নির্মাণের প্রয়োজন হবে, তারা তা করবে। ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশে প্রত্যেকের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করার অধিকার রয়েছে।
মুজিবের ভাস্কর্য মানে বাংলাদেশের মানচিত্র, এদেশের পতাকা। তার ওপর নাগিনীরা ছোবল মেরেছে, আমাদের স্বাধীনতা ও অস্তিত্বের ওপর আঘাত হেনেছে। তাই স্বাধীনতাবিরোধী ও ধর্মান্ধ এই অপশক্তিকে ছাড় দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। বিজয়ের মাসে তাদের সব বিষদাঁত উপড়ে ফেলতে হবে।
৩০ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগ এবং দুই লক্ষ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি স্বাধীনতা। আড়াই লক্ষাধিক মুক্তিযোদ্ধা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। এদেশের সাধারণ মানুষ যে যেভাবে পারে, মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সহায়তা করেছে। বাঙালি জাতির এতসব ত্যাগ-তিতিক্ষা বিন্দুমাত্র ধুলায় মিশিয়ে যেতে দেওয়া যায় না।
বীরের এ রক্তস্রোত, মাতার এ অশ্রুধারা
এর যত মূল্য সে কি ধরার ধুলায় হবে হারা।