Published : 17 Sep 2020, 12:57 PM
দুইটা ঘটনা দিয়ে শুরু করি। একটু রাত করে এলাকার বেশ কয়েকটি নেড়ি খাওয়াতে নামি। আমার ছোটবেলার বন্ধু মিনটু, যে কুকুর বেশ অপছন্দ বা ভয়ই করে, মাঝে মাঝে তবু আমার টানে রাতে আসে আড্ডা দিতে। একই গলির শেষ প্রান্তে ওর বাসা। আমি কুকুরদের খাওয়াতে খাওয়াতেই ওর সাথে আড্ডা দেই।
এক রাতে এরকম কুকুর খাওয়াতে গিয়ে দুইটা বাচ্চা কুকুরের ঝগড়া লেগে গেল। মিন্টু হঠাৎই বলা নেই, কওয়া নেই- একটা কুকুরের বাচ্চার দিকে থামানোর জন্য একটু হাত তুলে তেড়ে গেল। একটা বড় কুকুর ছিল। এলাকার বাদশাহ কুকুর আরকি! মিন্টুর ওই তাড়া দেখে সে মিন্টুর পায়ের কাছে এসে নাক ছোঁয়ালো। বড় কুকুরটার ধারণা ছিল মিন্টু ছোট বাচ্চাটাকে মারতে যাচ্ছে। মিন্টুর ধারণা হলো, তাকে কুকুর কামড়েছে। সাথে সাথে ওর পা পরীক্ষা করলাম, দেখলাম কামড় তো দূরে থাক, একটা আঁচড়ও নেই!
কিন্তু পরদিন শুনলাম মিন্টু মনের ভয় থেকে মহাখালিতে গিয়েছিল এবং তাকে ইঞ্জেকশন দিয়েছে। কি অদ্ভুত! কোন কামড়ের দাগ নেই, ক্ষত নেই, ওকে ইঞ্জেকশন দিল কেন? ওরা নাকি মিন্টুকে বলেছে, ফ্রি ইঞ্জেকশন- দিয়ে রাখেন, ক্ষতি কি!
দ্বিতীয় ঘটনাটিও খুব রহস্যময়। রাতে আমি যখন ১১টা নেড়িকে খাওয়াচ্ছি তখন এক লোক পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। স্বভাবতই এ লোকটি অপরিচিত দেখে কুকুর ঘেউ ঘেউ করতে করতে এগিয়ে গেল। আমি ওদের থামালাম। কামড়ানোর প্রশ্নই ওঠে না।
পরদিন ঘুম ভাঙলো আম্মার দরজা ধাক্কায়। ওই লোক পায়ে কুকুরের কামড়ের দাগ নিয়ে হাজির হয়েছে। তিন হাজার টাকা নাকি লাগবে ইঞ্জেকশন দিতে। আমি বললাম, "মহাখালিতে ইঞ্জেকশন ফ্রি দেয়। আপনি কোথা থেকে প্রেসক্রিপশন নিয়ে এসেছেন- এটা তো সব জায়গায় দেয় না।"
সে আর কথা না বাড়িয়ে 'কুকুরগুলোকে গাড়িতে পিষে মারবে' বলতে বলতে চলে গেল।
নানাভাবে গত বছরখানেক আমার কাছে লোকজন টাকা-পয়সা নিয়েছেন কুকুরের অজুহাতে। আমিও দিয়েছি। কেবল চেয়েছি অবলাগুলো বেঁচে থাক। ওদের শত্রু বাড়িয়ে লাভ কি!
কুকুর বিতর্কে অনেকে বলছেন, কুকুর প্রচুর আওয়াজ করে। রাতে ঘুমাতে দেয় না। খুব সত্যি হয়তো! পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি শব্দদূষণের শহরগুলোর মধ্যে একটি ঢাকা। এই ঢাকায় আপনি সবচেয়ে নিরব এলাকাটাতেও গড়ে ৭০ থেকে ১০০ ডেসিবল শব্দের মধ্যে থাকেন। আবাসিক এলাকায় সহনীয় শব্দদূষণের মাত্রা হওয়ার কথা আইন অনুযায়ী এর অর্ধেক। একপাল কুকুর একসাথে আধঘণ্টা চিৎকার করলে ১০০ ডেসিবল শব্দ হয়। এবার বুঝুন কুকুর কত শব্দ দূষণ করে!
আমার বাড়ি থেকে একটু দূরে প্রতিরাতে টনকে টনকে রড ফেলে নির্মাণ কাজ হয়, সেটি অবশ্য ১০০ ডেসিবল হলে সমস্যা নেই। কারণ ক্ষমতাধর মালিক সমিতির কোনও এক মালিকের ভবন উঠছে যে! ওই বাড়ির পাশের জন যদি কুকুরের আওয়াজে ঘুমাতে না পারেন, তাহলে ব্যাপারটা আসলে কোন লেভেলের অসুস্থতা বলুন তো!
মোটরবাইক চালকরা নাকি কুকুরের কারণে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন! ঢাকার রাস্তায় কতজন মোটরবাইক চালক কুকুর বাঁচাতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন, প্রাণ হারিয়েছেন কয়জন তা পরিসংখ্যান ঘেঁটে বের করুন। এই যুক্তি যারা দেখান আর যারা বিশ্বাসের চেষ্টা করেন, তাদের অবশ্যই মানসিক চিকিৎসার প্রয়োজন।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হচ্ছে, গলিপথে ৫০ কিলোমিটারের বেশি জোরে মোটরসাইকেল চালালে কুকুর তাড়া করে। কেননা, ওদের স্মৃতি বলে দেয়- এতো জোরে গাড়ি চললে ওদের সন্তানরা মারা পড়তে পারে। আর হ্যাঁ হয়ও তো এমন প্রচুর! গলিপথে একজন সুস্থ মানুষ কেন এত জোরে বাইক চালাবেন! ঢাকার এবড়োথেবড়ো রাস্তাতেই বা এত জোরে বাইক কেন চালাবেন? আপনার এত ব্যস্ততা কিসের ভাই? ভিআইপি তকমাধারীরা যখন আপনার রাস্তা আটকায়, তখন তো গলার আওয়াজ পাওয়া যায় না।
আমি নিজে এলাকার এক মোটরবাইক চালককে বারবার কুকুরের তাড়া খাওয়া দেখেছি। আর কোনও বাইক দেখলে কুকুরগুলো তাড়া দেয় না, তাকেই কেবল তাড়া দেয়। তারপর তাকে নিয়ে পরীক্ষা করেও দেখেছি- আস্তে চালালে কুকুর বরং সরে যায়। এরপরও সেই 'মিয়াভাই' তার অভ্যাস ও যুক্তি থেকে সরেন না। বারবার বলেন, "না, ভাই কুকুরগুলো তাড়া দেয়।"
মোট চারবার পরীক্ষা করেছি। তিনি চারবার স্পিড কমিয়ে গিয়েছেন, কুকুর তাড়া দেয় নাই। তারপরও নিজের জায়গা থেকে সরেন না। কুকুর যেন নেইমার-মেসি, যেকোনও মূল্যে ট্যাকল করতে পারলেই গোলবার রক্ষা পাবে, ফাউল করে হলেও।
দুই.
নেদারল্যান্ডস বিশ্বের প্রথম নিজেদের পথ-কুকুর মানে স্ট্রে ডগ মুক্ত দেশ হিসেবে ঘোষণা করেছে। খুব বেশি কিছু করা লাগেনি। কেবল ঠিকঠাক মত কুকুরের বন্ধ্যাকরণ প্রকল্প হাতে নিয়ে এগিয়েছে দেশটি। ঢাকায় যত কুকুর আছে সেগুলোকে বন্ধ্যাকরণ ও ভ্যাকসিন দিলে আগামী দুই বছরের মধ্যেই ঢাকার কুকুর নিয়ন্ত্রণে আসবে।
ঢাকায় কুকুর নিয়ে কোনও সরকারি জরিপ হয়নি। একমাত্র জরিপটি করেছে অভয়ারণ্য। ২০১৬ সালের ওই জরিপ বলছে, ঢাকায় কুকুরের সংখ্যা ৩৭ হাজার।
প্রাণী অধিকার নিয়ে কাজ করা অভয়ারণ্যের এই আন্তর্জাতিক মানের জরিপটিতে ধরে নিলাম গলদ আছে। গত কয়েক বছরে কুকুরের সংখ্যা গাণিতিক হারে বেড়েও প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী, তা ৬০ হাজারের বেশি হওয়ার কথা নয়।
পৃথিবীর উন্নত দেশ ব্রিটেনেও ২০১৮ সালে মালিকানাহীন কুকুরের সংখ্যা ৫৬ হাজার ছিল।
ঢাকা শহরের ৬০ হাজার কুকুর বন্ধ্যা ও ভ্যাকসিনেশনে মাথাপিছু দুই হাজার টাকা করে লাগলে মাত্র ১২ কোটি টাকা লাগে (অনেক বাড়িয়ে বলা হিসেব)। অথচ দেখেন জলাতঙ্কের ভ্যাকসিন দিচ্ছেন হাজার-হাজার মানুষকে, খরচ হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। যেসব রোগী যাচ্ছে, তাদের মধ্যে কিন্তু মিন্টুর মতো রোগীও আছে!
আচ্ছা, আক্রমণের শিকারের সংখ্যাটা বাড়িয়ে বলা হচ্ছে না তো? এই ভ্যাকসিন ক্রয়-বিক্রয়ে কোনও ব্যাপার-স্যাপার নেই তো? নইলে সেধে কেন মানুষকে, যে কুকুরের দ্বারা আক্রান্তই হয়নি, তাকেও ভ্যাকসিন দেওয়া হবে!
এইতো পত্রিকায় প্রতিবেদন বের হয়েছে, তালা-বালতি-বাঁশি-পর্দা-ডাস্টবিন কিনতে গিয়ে ১৬ কোটি টাকা কেবল চুরিই করেছে রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের 'দায়িত্বশীল' কর্মকর্তারা। ঢাকার কুকুর নিয়ন্ত্রণে লাগবে তার চেয়েও কম টাকা। দেন না চুরির টাকার কিছুটা, কিছু প্রাণ বাঁচুক!
সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কুকুর সরানোর পরিকল্পনা করেছে। তাদের এ মহান পরিকল্পনার পেছনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন যুক্তি দিয়ে বলেছে, নানা কারণে কুকুর নিয়ন্ত্রণের প্রকল্প ব্যর্থ হয়েছে। তাই তারা এলাকাবাসীর অভিযোগে কুকুর সরিয়ে নিচ্ছে।
ওদিকে মজার বিষয় হলো, বাংলাদেশের প্রচলিত আইনেই কুকুর সরানো বা নিধন পুরোপুরি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
কোনও ধরনের চুরিদারি, অন্যায়, ঘুষ এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষকে মাঠে নামতে না দেখা গেলেও, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কতিপয় এলাকাবাসীর ব্যানারে কুকুর সরানোর একটি রহস্যময় মানববন্ধন হয়েছে। ব্যানার ছাপানো এবং সেই মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ইতোমধ্যে নানাজন স্ট্যাটাস দিয়েছেন যে, এরা মূলত ভাড়াটে সৈনিক।
এরই মধ্যে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে গত ২ সেপ্টেম্বর প্রকাশ হয় 'কুকুর সরানোয় সমাধান নেই, বুঝেছেন সিটি কর্মকর্তারাও' শিরোনামে একটি সংবাদ। সেই সংবাদে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান ভেটেরিনারি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মহোদয় বলেছেন, নগরবাসীর সুবিধার্থে কুকুর সরিয়ে ফেলতে হবে। কিন্তু আমি তাকে বলেছি, সরিয়ে ফেলাটা কোনো সমাধান নয়। এদের সরিয়ে ফেললে এরা আবার আগের জায়গাতেই ফিরে আসবে। আলোচনায় এতখানি চূড়ান্ত হয়েছে যে, নগর ভবন, রমনা ও ধানমণ্ডি এই তিন এলাকার কুকুর সরিয়ে ফেলা হবে। তবে এতে কোনও লাভ হবে না। এর আগে এমনটা করা হলেও কুকুরগুলো আগের জায়গাতেই ফিরে এসেছে।"
২০১৬ সালে যখন প্রাণী অধিকার নিয়ে আদালত কুকুর নিধন ও সরানো বন্ধে নির্দেশ দেয় তখন এটির পক্ষে আদালতে দাঁড়িয়েছেন খোদ দক্ষিণ সিটি মেয়র ফজলে নূর তাপস।
সে যাই হোক, সিটি করপোরেশন যখন বুঝছে কুকুর সরানোয় সমাধান নেই, তখন তারা তড়িঘড়ি করে কেন এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে? এর উত্তর লুকিয়ে আছে তাদের বলা প্রথম অংশে- নানা কারণে কুকুর নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি ব্যর্থ হয়েছে।
সেই নানা কারণগুলো কী? বরাদ্দ তো ছিল, টাকা গেল কই?
মনে হয়, বাংলাদেশেই একমাত্র দেশ যেখানে কুকুর নিধনে মানববন্ধন হলো। ছিহ, এই লজ্জা রাখি কোথায়?
বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেখানে সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ থেকে ভ্যাকসিন দেওয়া ও বন্ধ্যা করা কুকুরগুলোকে সরিয়ে নেওয়া হলো আইন ও হাইকোর্টকে কাঁচকলা দেখিয়ে। ছিহ, এ লজ্জা রাখি কোথায়!
সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেককেই দেখি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ও খুনের ব্যাপারে সোচ্চার হতে। এদের কাউকে কাউকে অত্যুৎসাহে কুকুর নিধন ও সরানোর পক্ষে পোস্ট দিতে দেখেছি। কেউ কেউ বলেছেন, মানুষেরই জীবনের দাম নাই, এরা আছে কুকুর নিয়ে।
ভাই, উল্টো করে ভাবুন। কুকুরের মত বিশ্বস্ত প্রাণীকেই আপনারা ধৈর্য্য ধরে মোকাবেলা করতে পারেন না, আবার নিজের 'বেহেড' জীবনের গ্যারান্টি চান! যখন একবার আপনার সন্তান দেখবে একটি প্রাণীকে বিনা কারণে হত্যা বা সরানো যায়, তখন সে তো ছোট থেকেই সব সমস্যা সরানোর এবং এড়ানোর পদ্ধতিতে এগোবে। এমনকি বৃদ্ধ বয়সে আপনি যখন 'সমস্যা' হবেন, আপনাকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখতে তার মোটেও কষ্ট হবে না। আর সেই সংস্কৃতিতে আপনিই তাকে বড় করছেন।
সমস্যা সরিয়ে রাখা মানে সেটি সমাধান নয়, সেটি আরও পাকানো, আরও ঘনীভূত হওয়া।
অনেকে আবার প্রাণীবাদীদের নিয়ে মস্করা করেছেন। তা তো করতেই পারেন! এই দেশে তো আমি দেখেছি- পকেটের পয়সা খরচ করে ইমারজেন্সি রোগীকে রক্ত দিতে যাওয়া ব্যক্তিকে রোগীর স্বজনরা রীতিমত ধর্মীয় পরিচয় তুলে প্রত্যাখ্যান করেছে। কারণ অবশ্য রক্তের প্রয়োজন আগেই মিটে গিয়েছিল।
অনেকে ফেইসবুকে লিখেছেন- প্রাণীবাদীদের এত দরদ থাকলে বাসায় নিয়ে যায় না কেন?
কেন? এই শহরে প্রাণীবাদীরাও থাকে, আপনিও থাকেন। দায় আপনার নেই? আপনি যদি দাবি করেন, ট্যাক্সের টাকার রাস্তা আপনার, তাহলে কুকুরও তো আপনার। প্রাণীবাদীরাও ট্যাক্স দেয়। তারা তো চাইতেই পারে কুকুর থাকবে! আপনার চেয়ে অন্তরের দিক থেকে তারা বিকশিত, পরিবেশের সহায়ক। এই দলে আছেন সেইসব তরুণরা- যারা নিজের টিফিনের পয়সা ভাগ করে কুকুরের সাথে খায়। আপনি বাধ্য হয়ে ট্যাক্স দেন, তারা ভালোবেসে দেয়। আপনার দায় বছরের পর বছর তারা মেটায়।
আপনি ময়লা ফেলার জন্য ৫০ টাকা বাড়িওয়ালা সমিতিকে চাঁদা দেন। ময়লার গাড়ি বাড়ি বাড়ি গিয়ে ময়লা নিয়ে আসে। একই টাকা আপনি সিটি করপোরেশনকে আলাদা করে দেন। কই বাড়িওয়ালা সমিতিকে তো প্রশ্ন করতে দেখিনি- ময়লার টাকা কেন নেন? এটা বাড়তি টাকা। ক্ষমতা ভয় পান?
ময়লার গাড়ির সাথে ২০ টাকা বাড়িয়ে দিন না, বাড়িওয়ালা সমিতি কুকুরগুলোকে নিউটার বা স্পে করবে, ভ্যাকসিন দেবে। কুকুরগুলোর খাওয়ার জন্য এরকম একটা গাড়ি চালু করবে। ভেবে দেখুন কত সুন্দর একটা দৃশ্য। আচ্ছা ভাবতে কষ্ট হলে তুরস্কের মসজিদগুলোর দিকে তাকান! সুন্দর সুন্দর ছবি আছে ইন্টারনেটে, কিভাবে তরুণ-তরুণীরা কুকুর-বেড়াল খাওয়াচ্ছে মসজিদে, মসজিদে। কেন 'হায়া সোফিয়া', যেটি গির্জা থেকে মসজিদ বানালো হলো- সেখানকার বিখ্যাত বেড়ালটার কথা পড়েননি। সেটাকে তো ওখানেই থাকতে দেওয়া হয়েছে। মসজিদের ভেতরে।
আপনি নিরাপত্তা চান কুকুরের কাছ থেকে। কি অদ্ভুত! প্রাণীবাদীদের বিরুদ্ধে লিখে, কুকুর হত্যা বা সরানোর পক্ষে লিখে- ফেইসবুকে যে সময়টা নষ্ট করছেন- সেই সময়ে ইউটিউবে কুকুর আক্রমণ করলে কী করবেন দেখে নিন না! লাইক-শেয়ার বা ভিন্ন কিছু করে নাম কামাতে চাইলে শিক্ষামূলক কিছু দিন না! তাতে মানুষ ও প্রাণীকূলের উপকার হয়।
নির্জন রাস্তায় কুকুর ঘিরে ধরলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলেই তো হয়! মানববন্ধনে ব্যানার ছাপিয়ে দাঁড়াতে হয় না। একমিনিট দাঁড়ান, আপনাকে পরখ করে কুকুরগুলো চলে যাবে। যদি সমস্যা না মেটে তাহলে চাবি বের করে হালকা শব্দ করুন। কামড় খাবেন না।
এরকম আরও একশ উপায় আছে। আমার নিজের অভিজ্ঞতা হলো- কোনওভাবেই না সরলে হাসতে হাসতে একটু পানি ছিটালেই কুকুরগুলো দূরে সরে যায়। আঘাতই করা লাগে না।
তিন.
লকডাউনের মধ্যে যারা প্রাণবাজি রেখে টিএসসির কুকুর খাওয়ালো- তাদের ভালোবাসার ঘনত্ব- প্রেমের গভীরতা বোঝার মতো ক্ষমতা বিবেকবর্জিত, আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিতদের নেই। যারা কুকুর খাওয়ান-পোষেন, তাদেরকে প্রায়ই শুনতে হয়, 'এটা পয়সা নষ্ট, এদের খাওয়ায়ে কি লাভ!' দুনিয়ার নিয়মটাই এরকম। এখানে যেমন মা-বাবাকে ভালোবাসার পেছনেও লাভ খোঁজা 'অমানুষ' থাকবে অনেক, তার বিপরীতে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া সত্যিকারের 'আশরাফুল মাখলুকাত' থাকবে গুটিকয়েক।
এদের ভালোবাসার শক্তি ভয়াবহ। নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দেওয়ার যোগ্যতাই বলে দেয়, এরা জয়ী হবে। সময় লাগবে। কিন্তু হিংসার পৃথিবীতে এরাই জয়ী হবে। পরিবর্তনের আওয়াজ সবাই শুনতে পায় না।
আমার সামনের বাসার ভদ্রলোক ও তার বাচ্চারা কুকুর ভয় পেত। ফলে কুকুরের সামনে সবসময় লাঠি নিয়ে বের হতো বা ইট ছুঁড়তো। কুকুরগুলোও আরও ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে যেত। একদিন উত্তেজিত হয়ে রড হাতে, লোকজন ঠিক করে কুকুর মারতে গিয়েছিলেন ওই ভদ্রলোক। আমি ঠেকিয়ে বললাম- ছিহ, ভাই। আপনার বাচ্চা দুটো এই নিষ্ঠুরতা দেখছে।
উনি থমকে গেলেন। বললাম- ভাই দুই পিস পাউরুটি দিলেই সমস্যার সমাধান হবে। ওরা খাক বা না খাক।
খুব ভালো লাগে, যখন দেখি উনার বাচ্চা দুইটা পাউরুটি দেয়, বিস্কিট দেয় এবং যে কুকুরগুলোকে তারা ভয় পেত সেগুলোই তাদের দেখে লেজ নেড়ে খেলতে যায়।
অনেককে বলতে শুনেছি, কুকুর নাপাক প্রাণী। এরজন্য তারা বিশেষ বিশেষ হাদিস টেনে নিয়ে আসেন। এটা বাংলাদেশের মানুষের সমস্যা যে, পলায়নে ধর্মই তাদের প্রধান আশ্রয়। নিজের কমতি বা ভয় ঢাকতে, ধর্মের অপব্যাখ্যা করতে তাদের অন্তর বিন্দুমাত্র কাঁপে না।
সকালে নাকি কুকুরের ভয়ে মসজিদে লোকজন যেতে পারেন না বলেও অনেকের অভিযোগ শুনেছি।
কুকুর নিয়ে যে হাদিসগুলো রয়েছে, এর কোনওটিতে কুকুরকে নাপাক বলা হয়নি। বলা হয়েছে, কুকুর ঘরে থাকলে ফেরেশতা আসে না কিংবা কুকুরের লালা গায়ে লাগলে ওজু থাকে না।
পাল্টা হাদিস রয়েছে, এক পাপিষ্ঠ ব্যক্তি তৃষ্ণার্ত কুকুরকে পানি দিল, আল্লাহ তার সব গুনাহ মাফ করে দিলেন।
আমাদের পাপের ঘরে এমনিতেই ফেরেশতা আসে না। ঘুষ, দুর্নীতিতে ছাওয়া আমরা। আমরা মেনে নিয়েছি বিচারহীনতার সংস্কৃতি, দুর্বলের উপর জুলুম। এমনকি আমাদের মসজিদগুলোকেও আমরা দুর্নীতির আখড়া বানিয়ে রেখেছি। তার চেয়ে বরং ক্ষুধার্ত একটা প্রাণীকে খাইয়ে যদি পাপমোচন হয়, ক্ষতি কি!
কুকুর অপরিচিত লোক চাটে না, তারপরও যদি লালা লাগে- ওজু করবেন, ক্ষতি কি! ধরে নেওয়া ভালো নয় কি- এটা সৃষ্টিকর্তার নিয়ামত যে আপনাকে আবার ওজু করিয়ে এই উছিলায় বাড়তি সওয়াব দিচ্ছেন।
যিনি মসজিদে যান আল্লাহকে ভালোবেসে এবং তার ভয়ে, তিনি যদি সৃষ্টিকর্তার তৈরি সবচেয়ে বিশ্বস্ত জীব কুকুর ভয় পেয়ে থমকে যান, তাহলে এ ইবাদত কোথায় দাঁড়াল- আমি ঠিক জানি না।
আরেকটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে এ লেখা শেষ করব।
বছরখানেক আগে, আমি ও আমার স্ত্রী চিকিৎসকের কাছ থেকে মুখ কালো করে আসলাম। চিকিৎসক বলে দিয়েছেন, স্ত্রীর ডিম্বাণু হচ্ছে না। ফলে আমাদের সন্তানের জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে।
বাড়ি ফেরার সময় সেরাতে নিজেদের প্রচণ্ড বিধ্বস্ত লাগছিল। এসে দেখি পাশের বাসার বড়ভাই নেড়িগুলোকে খেতে দিয়ে কোথায় যেন গেছেন! কিছুক্ষণ পর বাড়ির পেছন থেকে একটা ছোট্ট কুকুর ছানা নিয়ে হাজির হলেন। নিচে আরও আটটি কুকুর ছানা ছিল। তাদের সাথে রাখার চেষ্টা করলাম, নতুনটাকে সবাই কামড়াতে এলো।
আমার স্ত্রী ভীত কুকুর ছানাটিকে কোলে নিল। আমরা আব্বা-আম্মার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে, তাকে বাসায় রাখা শুরু করলাম এবং মাত্র দুই মাসের মাথায় খবর পেলাম আমাদের সংসারে একজন ফেরেশতা আসছে। ঘর আলো করে সে ফেরেশতা এসেছে এই পয়লা সেপ্টেম্বরেই। আমি ঠিক জানি না, এর পেছনে সৃষ্টিকর্তার ঠিক কোন ইশারা রয়েছে! যদিও কুকুর নাকি নাপাক প্রাণী, তার কারণে নাকি ঘরে ফেরেশতা আসে না!