Published : 30 Aug 2020, 12:06 AM
ঘুণে ধরা রেলওয়েকে সময়ে, কয়েক মাসে প্রশংসায় ভাসানো রেলের অতিরিক্ত সচিবকে পুরস্কার স্বরূপ ওএসডি করা হয়েছে। এমনও হতে পারতো তিনি রেলকে আন্তর্জাতিক মানের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারতেন। কয়দিনই আগে ঘোষণা দিয়েছিলেন, 'মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি সুযোগ দেন তাহলে তিনি ১০ জন সহকর্মী নিয়ে দেশের সব সেক্টরকে দুর্নীতিমুক্ত করবেন মাত্র তিন মাস সময়ের মধ্যে।" এই ঘোষণাই কি তার জন্য কাল হলো, নাকি আগামী কিছুদিনের মধ্যে রেলওয়েতে ১৫ হাজার কর্মীর নিয়োগে বাণিজ্যের পথের কাঁটা হয়ে উঠতে পারে এ ভয়ে তাকে সরিয়ে দেওয়া হলো? প্রশ্নটা থেকেই যায় দেশের সচেতন নাগরিকদের মাঝে।
আমরা দেখেছি রেলওয়ের কালো বিড়াল খুজে বের করার ঘোষণা দেওয়া বর্ষীয়ান পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে মাত্র ৭০ লাখ টাকার দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগে কিভাবে হেস্তনেস্ত করা হয়েছিল।
আসল কথা হলো, রেলের উন্নয়ন করা যাবে না, রেলওয়ে শৃঙ্খলা ফিরে এলে সিন্ডিকেটারদের পকেট খালি হয়ে যাবে। তাই সুরঞ্জিত থেকে মাহবুবুল কবির মিলন- বলির পাঠা হলেন দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের নীল নকশায়।
করোনাভাইরাস পরীক্ষার ভুয়া সার্টিফিকেট প্রদানকারী দেশ হিসাবে দেশ-বিদেশে সমান আলোচিত বাংলাদেশের একাধিক হাসপাতাল। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রিজেন্ট ও জেকেজি হাসপাতাল। মজার ব্যাপার হলো, এ দুইটি হাসপাতালের লাইসেন্স না থাকা অবস্থাতেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে তারা কোভিড-১৯ টেস্টের অনুমতি পায়। বিগত কয়েক বছর ধরেই স্বাস্থ্যখাতে নানান অনিয়মের খবর প্রকাশ হচ্ছিল দেশের সোস্যাল মিডিয়াসহ সংবাদমাধ্যমগুলোতে। করোনাভাইরাসের ভুয়া সার্টিফিকেট দেওয়ার আলোচনা-সমালোচনার পর গোয়েন্দা রির্পোটের ভিত্তিতে আইন শৃঙ্খলাবহিনী সাঁড়াশি অভিযান শুরু করলে বেড়িয়ে আসে রিজেন্ট, জেকেজির মত অবৈধ হাসপাতালের দুর্নীতির চিত্র।
হাসপাতাল চালানোর অনুমতি না থাকার পরেও কোন শক্তির ক্ষমতা বলে তারা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে করোনাভাইরাস টেস্টের অনুমতি পায়? দেশের আমজনতার কপালে তোলা চোখে এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী এবং দুর্নীতি দমন কমিশন যখন তৎপর হলো, ঠিক তখনই স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা জারি করা হলো- এখন থেকে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়া দেশের কোনো সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালে অভিযান চালাতে পারবে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
কোথাও কোনো হাসপাতালে অভিযান পরিচালনা করতে হলে অবশ্যই স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হবে। এটি একটি অবাক করা নির্দেশনা! যে মন্ত্রণালয় হাসপাতাল চালানোর অনুমতি না থাকার সত্ত্বেও করোনাভাইরাস টেস্টের অনুমতি দিতে পারে, সেই মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতিবাজ কর্তাদের কাছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনুমতি নিতে হবে অবৈধভাবে পরিচালিত দেশের হাসপাতাল গুলিতে অভিযান পরিচালনা করার জন্য! বিষয়টি শুধু হাস্যেকরই নয়, নীতি-নৈতিকতা পরিপন্থি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে হাতকড়া পড়ানোর সামিল।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এমন নির্দেশনার পর বিস্মিত হয়েছে দেশের জনসাধারণ। একের পর এক অনিয়ম ও কেলেঙ্কারি প্রকাশ হয়ে পড়ায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর একে অপরকে দায়ী করছে। সাইনবোর্ডসর্বস্ব হাসপাতাল ও বিভিন্ন ভুয়া প্রতিষ্ঠানকে করোনাভাইরাস চিকিৎসা ও নমুনা পরীক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হলেও এর দায় কেউ নিতে চাচ্ছে না। অথচ এ অনিয়মের শিকার হয়ে ভুগছেন সাধারণ মানুষ। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের অদক্ষতা ও ব্যর্থতা স্পষ্ট হচ্ছিল। এবং তা আড়াল করতেই এই নির্দেশনা জারি করা হয়েছে তা ধরে নিলে ভুল হবে কি?
ক্রীড়াকে হাতিয়ার বানিয়ে সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাট এবং নয়-ছয়ের মহোৎসবে মেতে উঠেছেন কতিপয় ক্রীড়া সংগঠক। এ মর্মে খবর প্রকাশিত হযেছে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে।
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে), বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) ও হকি ফেডারেশনের প্রভাবশালী কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। 'রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যাওয়া' এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাঁড়াশি অভিযানও পরিচালনা করেছেন। ইতিমধ্যে বাফুফের বিরুদ্ধে দুর্নীতির সুস্পষ্ট প্রমাণ মেলায় চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বাফুফের দুই সহসভাপতি বাদল রায় ও মহিউদ্দিন আহমেদ মহি তিন বছরের অডিট রিপোর্টে ১৭ কোটি টাকার অনিয়ম খুঁজে পেয়েছেন। প্রায় ৬০ কোটি টাকার আয় গোপন করার অভিযোগে বিসিবির পরিচালক মাহাবুব আনামকে চিঠি দিয়েছে দুদক। বিদেশে টাকা পাচারের আপরাধে র্যাবের হাতে আটক লোকমান ভূঁইয়া ইতিমধ্যে অস্ট্রেলিয়ার দুটি ব্যাংকে ৪১ কোটি টাকা জমা রাখার কথা স্বীকার করেছেন।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় শীর্ষ ক্রীড়া কর্মকর্তাদের কোটি কোটি টাকা লুটপাট, সীমাহীন দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারে কুক্ষিগত ছিল বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন।
এক সময়ের হাওয়া ভবনের বাসিন্দা মাহাফুজ আনান, লোকমান আর তাবিথ আওয়ালরা আজ সম্মিলিতভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে দেশের ক্রীড়াঙ্গনের দুর্নীতির সিন্ডিকেট। এদের সাথে যোগ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর পুত্র শেখ কামালের বন্ধু পরিচয়দানকারি কাজী সালাউদ্দিন গংরা।
প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের নাম ভাঙিয়ে চলা বাফুফের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের দুর্নীতি আর অদূরদর্শিতার কারণে এরই মধ্যে বাংলাদেশের ফুটবল আজ মৃত প্রায়। ফুটবলে বাংলাদেশের জরিমানা, বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ সরাসরি সম্প্রচারে টেলিকাস্টিংয়ের যন্ত্রপাতি ভাড়া করার নামে দুর্নীতি, ইউরো ফুটবল টুর্নামেন্টের টিকিট-দুর্নীতি, বাফুফে সভাপতি ও মাহফুজা আক্তার কিরনের যৌথ দুর্নীতি, বাফুফের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা জমা ও উত্তোলনে অনিয়ম, সিলেট বিকেএসপি ক্যাম্পাসে ফুটবল একাডেমির নামে দুর্নীতি, ফিফা প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর সংক্রান্ত আর্থিক দুর্নীতি, রাজনৈতিক আস্ফালনসহ নানাবিধ কারণে ধ্বংসের দাঁড়প্রান্তে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলার ফুটবল।
২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের অন্যতম প্রধান অঙ্গীকার ছিল দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়া। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশের বিকল্প নাই। প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরোটলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন। তার আন্তরিক চেষ্টা ও তদারকির পরেও প্রতিটি সেক্টরে দুর্নীতি যেন ক্রমাগতই বেড়ে চলেছে।
প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতি বিরুদ্ধে জিরোটলারেন্স নীতি ঘোষণাকে কেউই কানে তুলছে না। তাই জনমানুষের মনে আজ প্রশ্ন উঠছে- তাহলে দেশ পরিচালনা করছে কে? রাষ্ট্রক্ষমতার অসামঞ্জস্যতা তৈরিতে কারা কলকাঠি নাড়ছে- যেমনটা হয়েছিল খুনি খন্দাকার মুশতাক বা ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়।
সরকারের মন্ত্রী, এমপি আর সরকারি দলের নেতাদের প্রধান বক্তব্যই হচ্ছে শেখ হাসিনার সরকার উন্নয়নের সরকার। ২০০৮ সালে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর থেকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী সরকার দেশের অভাবনীয় উন্নয়ন ঘটিয়েছেন এতে কারো সন্দেহ থাকার কথা নয়। কিন্ত এ উন্নয়নকে কি টেকসই উন্নয়ন বলা যায়? দীর্ঘদিন বন্যা না হওয়াতে সরকার হয়তো ভুলেই গিয়েছিল নদীমাতৃক এই বাংলাদেশ বন্যামুক্ত নয়। তারই প্রতিফলন আমরা দেখতে পারছি এখন। বিশেষজ্ঞদের মতে এবারের বন্যা ১৯৮৮ সালের বন্যাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। ইতিমধ্যেই প্রাণহানিসহ ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়ে গেছে। দেশের দুই-তৃতীংশ মানুষ বাস করছে পানির মধ্যে।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিজস্ব চাহিদা পূরণের দক্ষতায় আপস না করে যে উন্নয়ন বর্তমানের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম তা-ই হচ্ছে টেকসই উন্নয়ন। রডের বদলে বাঁশ দিয়ে ইমারত বা রাস্তা নির্মাণ কখনোই টেকসই উন্নয়নের সংজ্ঞায় পড়ে না।
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন তিনি দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে চরম আঘাত করবেন যেমন আঘাত করেছিলেন পাকিস্থানিদের বিরুদ্ধে। এই ডিজিটাল যুগে আজকের বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকেও আজ ইস্পাত কঠিন মনোভাব নিয়ে লড়তে হবে ওই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে। আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী আর দুর্নীতি দমন কমিশনকে স্বাধীনতা দিতে হবে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত জিরোটলারেন্স নীতি বাস্তবায়ন করতে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু তার অপর এক ভাষণে আহ্বান জানিয়ে ছিলেন জনগণকে, তারা যেন মহল্লায় মহল্লায় দুর্নীতিবাজদের ধরে মিছিল করেন। তিনি অভয় দিয়েছিলেন তিনি থাকবেন জনগণের সাথে। আজ জনগণ জননেত্রীকে অভয় দিচ্ছে আপনি দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যান, বাংলার মেহনতি মানুষ থাকবে আপনার সাথে। তা না হলে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশকে রক্ষা করা যাবে না ওই হায়েনাদের কাছ থেকে।