Published : 19 Aug 2020, 12:56 PM
১.
আমাদের সৌভাগ্য, করোনাকালীন সময় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে দেখতে হয়নি। কবি বেঁচে থাকলে কলমের খোঁচায় বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রীর স্বাস্থ্যহানি করতেন। আগুন ধরিয়ে দিতেন তার বসার চেয়ারে। বিপ্লবী শ্লোগান এঁকে দিতেন মন্ত্রীর শরীরে। মন্ত্রীর বড় সৌভাগ্য কবি বেঁচে নেই। না হয়, কবির বিপ্লবী-বিদ্রোহী ঘোষণা শুনতে হতো। যে লোক ভগবান-খোদা কাউকে ছাড়েননি, সেই লোক জাহিদ মালেককে ছেড়ে দেবেন এইটা বিশ্বাস করা যায় না।
বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় যা শুরু করেছে, যত ধরনের অসংগতি, দুর্নীতি, সমন্বয়হীনতা ও রমরমা ঘটনা দেখিয়েছে তা এখনো পর্যন্ত সর্বোচ্চ বলে বিবেচিত। অবশ্য আর কোনো মন্ত্রণালয়ে যে দুর্নীতি, সমন্বয়হীনতা বা অসংগতি নেই তা কিন্তু নয়। কিন্তু সংকটে তা এইভাবে প্রকাশ পায়নি। সংকট বা অসহায়ত্ব কি ধরনের হতে পারে তার একটা নমুনা দেই।
'আমি যখন মন্ত্রী ছিলাম আমিও চেষ্টা করেছিলাম এই সিন্ডিকেট ভাঙতে, কিন্তু পারিনি। আমার আগে ও পরে যারা ছিলেন তারাও পারেননি।' (২৪.৭.২০২০, কালের কণ্ঠ) সাবেক স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী, বর্তমানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক বর্তমান স্বাস্থ্যখাত নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে এই কথা বলে।
আ ফ ম রুহুল হকের পরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন প্রয়াত মোহাম্মদ নাসিম। তার সময়েও আমরা একই পরিস্থিতি দেখেছি। এখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তার সময় তো হাড়ে হাড়ে দেখছি। একটি দেশের সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী যখন বলেন, তিনি মন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে সিন্ডিকেট ভাঙতে পারেননি তাহলে তিনি কেন মন্ত্রী ছিলেন? এই প্রশ্নটা স্বভাবইত চলে আসে। বা তার দায়িত্ব কী ছিল? সিন্ডিকেট চলছে, তা দেখা? এই প্রশ্নও চলে আসে।
অনেকেই মনে করতে পারেন, এই বক্তব্যে মন্ত্রীর অসহায়ত্ব প্রকাশ পেয়েছে। আসলে তা নয়। যদি মন্ত্রী অসহায়ই হয়ে থাকে তাহলে কেন সেইসময় এই কথা বলা হয়নি? কেন তিনি দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে সিন্ডিকেটের কথা প্রকাশ করেননি? আ ফ ম রুহুল হকের পরে প্রয়াত মোহাম্মদ নাসিমও পূর্ণ সময় মন্ত্রীত্ব উপভোগ করেছেন বর্তমান জাহিদ মালেকও তার সময়ে মন্ত্রীত্ব উপভোগ করছেন। বরং জাহিদ মালেকের ব্যর্থতা নিয়ে যখন তার পদত্যাগের প্রশ্ন আসে তখন যথারীতি নীরব।
আ ফ ম রুহুল হক এখন অনেক অসংগতির কথা বলছেন স্বাস্থ্যখাত নিয়ে। একই সমস্যা তার সময়েও ছিল, একই সিন্ডিকেট তার সময়েও ছিল, মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরের ভিতরের দুর্নীতি তার সময়েও ছিল তখন তিনি তা দূর না করে এখন গণমাধ্যমে বলে মহান হওয়ার ভূমিকা নিচ্ছেন। এইটাকে লজ্জা বললেও ভুল বলা হবে।
তিনি মন্ত্রী থাকা অবস্থায় তার মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতি বা সিন্ডিকেট দূর করতে পারেননি, আমরা পারব? মন্ত্রী-আমলারা নিজেদের রক্ষার জন্য 'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন'কে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। কিছু হলেই এই আইনে মামলা করে দিচ্ছে। একবার মামলা করলেই সাংবাদিকদের ধরে জেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এরপর সাংবাদিকের দায় কেউ নিতে চায় না।
এই পরিস্থিতিতে একই বিষয় নিয়ে, একই দুর্নীতি নিয়ে একাধিক প্রশ্ন করার বা অনুসন্ধান করার উপায় থাকে? একই বিষয়ের দুর্নীতি নিয়ে একাধিক বার প্রতিবেদন লেখার সুযোগ থাকে? নিশ্চয়ই নয়।
২.
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) আবুল কালাম আজাদ পদত্যাগ করেছেন। (২১.৭.২০২০, প্রথম আলো) এটা একটা সাধারণ খবর। সাধারণ কেন বলছি? কারণ কিন্তু আবুল কালাম আজাদ পদত্যাগ করেছে বিতর্কের মুখে। এই বিতর্ক কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কেউ সৃষ্টি করেননি। সরকার, প্রশাসন বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও সৃষ্টি করেনি। এই বিতর্কের জন্ম দিয়েছে গণমাধ্যম।
অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের তত্ত্বাবধানে একের পর এক দুর্নীতি, লাইসেন্সবিহীন হাসপাতালকে করোনাভাইরাস পরীক্ষার অনুমোদন দেয়া, হাসপাতালগুলোতে নিন্মমানের মাস্ক ও পিপিই সরবরাহ, কেনাকাটার দুর্নীতিসহ অসংখ্য অভিযোগের খবর প্রচার করেছে গণমাধ্যমগুলো। এখন গণমাধ্যম যদি এইসব খবর প্রচার না করত তবে কিন্তু আবুল কালাম আজাদ এখনো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি পদে বহাল থাকতেন। যেমনটি এতদিন ছিলেন।
গণমাধ্যমগুলো নিজেদের প্রতিবেদনে একাধিকবার আবুল কালাম আজাদের দুর্নীতি সংশ্লিষ্ট বিষয় প্রমাণ করেছে। এই দুর্নীতি কিন্তু আজকের নয়। অনেক আগে থেকেই চলছে। এখন সাধারণ মানুষ থেকে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকরা জেনেছেন মাত্র। তাই তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে।
মজার বিষয় হলো, আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে জাহিদ মালেক নিজেই মুখে খুলেননি। বরং গণমাধ্যমে বলেছেন, অধিদপ্তরের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের কোনো সমস্যা নেই: স্বাস্থ্যমন্ত্রী (১৪.৭.২০২০, প্রথম আলো) তাহলে আমরা কী ধরে নেব?
আবুল কালাম আজাদের পদত্যাগে সবচেয়ে বড় বিষয়টি এখনো লুকায়িত। আবুল কালাম আজাদ পদত্যাগ করেছেন, কারণ তার বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ উঠেছে। ২০১৯ সালে দুদক স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতির ১১টি খাত চিহ্নিত করে। প্রশ্নটা হলো, আবুল কালাম আজাদ নিজে কি সেই ১১ খাতের একটিও স্বীকার করেছেন? করেননি। নিজে কি বলেছেন, এইসকল অভিযোগের জন্য আমি দায়ী? বলেননি। তাহলে কেন তাকে পদত্যাগ করতে হলো? বিষয়টি দেখতে যত সরল মনে হয়, আদতে তত সরল নয়।
শুধু অভিযোগের ভিত্তিতে একটি অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে পদত্যাগ করানো যায় না। ধরুন, সাংবাদিকরা একটি নির্দিষ্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করল। তাতে কি তিনি পদত্যাগ করবেন? বা তাকে পদত্যাগ করতে বলা হবে? নিশ্চয় নয়। সেই অভিযোগ প্রমাণিত হলে তারপর তিনি পদত্যাগ করবেন এবং স্বীকার করবেন, এইসকল অভিযোগের জন্য আমি দায়ী। বাস্তবে তা হয় না।
বাস্তবে হয়, অভিযোগ আসলেই সেই অভিযোগের প্রমাণ সবাইকে না জানিয়ে পদত্যাগ করে কিন্তু কোনো দায় স্বীকার করে না। এতে করে অপরাধীর অপরাধকর্ম আড়ালেই থেকে যায় এবং তা আড়ালে রাখা হয় যাতে কেউ না জানে। এতে করে তার দেখাদেখি অনেকই অপরাধ করার জন্য উৎসাহিত হয়।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তর যে দুর্নীতির রসে ডুবে আছে তার আরেকটি নমুনা হলো, 'স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেশের কোনো সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে অভিযান চালাতে পারবে না।' (৭.৮.২০২০, বিবিসি) কারণ কী? কারণ হলো, রিজেন্ট হাসপাতাল এবং জেকেজি হেলথ-কেয়ারে অনুসন্ধান চালানোর সময় মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তরে অনেক কর্তাব্যক্তির নাম চলে এসেছে। তার মধ্যে আবুল কালাম আজাদের নাম সবার প্রথমে ছিল। এই ঘটনায় তারা সজাগ হয়ে যায়। তাই তারা এখন নিজেদের দুর্নীতি চাপা দেওয়ার জন্য এই নীতি অবলম্বন করছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, দেশে মোট ১৭ হাজার ২৪৪টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বিভিন্ন সময়ে নিবন্ধন নিয়েছে। এসব হাসপাতাল ও ক্লিনিকের অর্ধেকের বেশিরই নিবন্ধন নবায়ন করা নেই। (৭.৮.২০২০, কালের কণ্ঠ)
প্রশ্ন হলো, তারা এখনো কিভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে? কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নিশ্চয়ই তারা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরে নিশ্চিতভাবে কাউকে সন্তুষ্ট করছে। এই সন্তুষ্টির প্রক্রিয়াটা ব্যাঘাত ঘটবে অভিযান পরিচালনা করলে। যেমনটা হয়েছে রিজেন্ট হাসপাতাল এবং জেকেজি হেলথ-কেয়ারের ক্ষেত্রে।
৩.
বিগ বিজনেস ইন বাংলাদেশ: সেলিং ফেক করোনাভাইরাস সার্টিফিকেট। (১৬.৭.২০২০, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস) বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাত নিয়ে দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন। সুনামের নয়, ভয়ানক বদনামের। যারা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নিয়ে অনেক লম্বা, গুরুগম্ভীর বক্তৃতা দেন তারা এই রিপোর্ট দেখবেন না। কারণ তাদের বক্তৃতার রশদ ফুরিয়ে যাবে।
বাংলাদেশ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। টিআইএর তালিকায় ১৯৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৪৬তম। দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ, এইটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত হওয়ার খবর জানা যায়। করোনাকালীন স্বাস্থ্যখাতে প্রথম দুর্নীতি প্রতিবেদন আসে ২ এপ্রিল।
মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ার একটি প্রতিষ্ঠান রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালে 'এন–৯৫' মাস্ক সরবরাহ করে। যা আসলে 'এন–৯৫' মাস্ক নয়। চিকিৎসকদের সংশয়ের পর তদন্তে এই তথ্য জানা যায়। (২.৪.২০২০, প্রথম আলো)
এর অর্থ দুর্নীতিবাজরা সবসময় সজাগ। মৃত্যুঘাতী করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার খবরের একমাস পূর্ণ হওয়ার আগেই দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হয়ে যায়। এরপর তো স্বাস্থ্যখাতের অসংখ্য দুর্নীতির খবর আমরা জানতে পারি। এতসব দুর্নীতি, অসংগতি, সমন্বয়হীনতার ভিড়ে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যখাতের স্বাস্থ্যনীতি যে করুণভাবে চলছে তা আর নতুন করে বলতে হবে না।
লেখার শুরুতেই বলছিলাম কবি কাজী নজরুল ইসলামের কথা। কবি তার কবিতায় সর্বশক্তিমানের কাছে স্বাস্থ্য, আয়ু, আলো, বায়ু চাইছেন। আমরা কার কাছে চাইব? আমাদের স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি দেখে সর্বশক্তিমানও মুখ ঘুরিয়ে নেবেন, হবেন রাগান্বিত। এরপরও আমাদের আশা সেই সর্বশক্তিমান। আমরাও কবির মতো বলতে চাই।
'দাও স্বাস্থ্য, দাও আয়ু,
স্বচ্ছ আলো, মুক্ত বায়ু,
দাও…'