Published : 19 Jul 2020, 07:21 AM
সংবাদমাধ্যমে সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে হৃদয়াহত। ক্লান্ত দেহেও অশান্ত ইন্দ্রিয়। আঁখিপাতা এক করেও নিদ্রাহীন কাটছে রজনী। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার ঘাটুরা গ্রামের বাসিন্দা স্বপ্না বেগম গত ৭ জুলাই একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। তবে নির্ধারিত সময়ের আগে ভূমিষ্ঠ শিশুটি দুদিন পরই ৯ জুলাই ভোরে মারা গেলে সেখানকার সরকারি একটি কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। তবে এর কিছুক্ষণ পরেই স্বপ্না বেগম জানতে পারেন স্থানীয় ধর্মীয় নেতারা তার সন্তানের লাশ কবর থেকে তুলে ফেলে রেখেছে! অভিযোগ, শিশুটির পরিবার আহমদিয়া সম্প্রদায়ের হয়েও সুন্নি মুসলিমদের কবরস্থানে লাশ দাফন করেছে। পরে অবশ্য পুলিশি পাহারায় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের নিজস্ব কবরস্থানে শিশুটিকে কবরস্থ করা হয়।
স্থানীয় ওসি মো. সেলিম উদ্দিন অবশ্য পুরো বিষয়টিকে দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ থেকে সৃষ্ট একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলেই মনে করছেন। আকিদাগত কারণে অবশ্য এদেশে আহমদিয়া সম্প্রদায়কে রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণার দাবি অনেকদিনের। এ নিয়ে হেফাজতে ইসলামসহ সুন্নি মতাদর্শে বিশ্বাসী বেশ কিছু সংগঠনের বিভিন্ন আন্দোলনও চলমান।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিবেদন বলছে- স্বপ্নার শিশুটিকে স্থানীয় কবরস্থানে দাফনের আগে স্থানীয় চেয়ারম্যান আজাদ হাজারী আঙ্গুরকে জানানোও হয়েছিল। কিন্তু স্থানীয় কিছু লোক ওই কবরস্থানে আহমদিয়াদের কাউকে দাফন করা যাবে না- এমনটা জানিয়ে মাইকিং করে এলাকায় লোক জমায়েত ঘটায়। পরে ওই নবজাতকের মরদেহ কবর থেকে তুলে কবরস্থানের বাইরের সড়কে ফেলে রাখে। এখন কথা হচ্ছে কারও পারিবারিক কবরস্থানে তো স্বপ্নার সন্তানকে আর দাফন করা হয়নি। সরকারি করস্থানেই তো নিষ্পাপ শিশুটিকে শেষ বিদায় জানায় পরিবার। তাহলে সমস্যাটা কোথায় ছিল? তার বাবা-মা আহমদিয়া সম্প্রদায়ের, সেটাই যদি তার অপরাধ হয়; তাহলে পবিত্র কোরানে আল্লাহ তাআলাই তো বলেছেন-
যে ব্যক্তি পথভ্রষ্ট হয়, তার পথভ্রষ্টতার ধ্বংসকারিতা তার ওপরই বর্তায়। কোনো গুনাহগার বা গুনাহের বোঝা বহনকারী অন্যের গুনাহের বোঝা বহন করবে না। (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত-১৫)
ইসলাম তো ভৌগোলিক, আঞ্চলিক, নৃতাত্ত্বিক, জাতিগত ও ধর্মীয় প্রভেদে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ সমর্থন করে না। এই ধর্মে কোনো প্রকার শ্রেণিবৈষম্য নেই, কোনো অস্পৃশ্যতাও নেই। ইমান আনা না আনার বিষয়টি মানুষের বিবেক-বুদ্ধি ও ইচ্ছার ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন- 'দ্বীন সম্পর্কে জোরজবরদস্তি নেই; সত্য ভ্রান্তি থেকে সুস্পষ্ট হয়েছে। যে তাগুতকে অস্বীকার করবে, আল্লাহে ইমান আনবে, সে এমন এক মজবুত হাতল ধরবে, যা কখনো ভাঙার নয়। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, প্রজ্ঞাময়।' (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৫৬)।
ইসলাম মানুষকে জাতি ও বর্ণ দিয়ে বিচার করে না, বরং তার বিশ্বাস ও কর্মের মূল্যায়ন করে। বিশ্বাস মানুষের অন্তরের বিষয়। সেটা গড়ে ওঠে জ্ঞানের আলোয়। বিশ্বাস চাপিয়ে দেওয়া যায় না। এ জন্যই যার যার বিশ্বাস তার তার। তাই কারও বিশ্বাস নিয়ে বিদ্রুপ, কটূক্তি বা কটাক্ষ করা ইসলামে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ; গালমন্দ ইসলামে হারাম। আল্লাহ তাআলা বলেন, 'তোমরা তাদেরকে মন্দ বলো না, যাদের তারা আরাধনা করে আল্লাহকে ছেড়ে। তাহলে তারাও শত্রুতা করে ও অজ্ঞতাবশতঃ আল্লাহকে মন্দ বলবে। এমনিভাবে আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিতে তাদের কাজকর্ম সুশোভিত করে দিয়েছি।' (সুরা আনআম, আয়াত: ১০৮)।
আর বিচার ফয়সালার ভার আল্লাহর হাতে। এ প্রসঙ্গে সুরা হজের ১৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- 'নিশ্চয় যারা মুমিন আর যারা ইহুদি, ছাবিইন, খ্রিস্টান ও মাজুস এবং মুশরিক; কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের মধ্যে ফয়সালা করবেন।'
সুরা মায়েদায় ৮২ নম্বরে আয়াতে রয়েছে- 'অবশ্যই আপনি বিশ্বাসী মুমিনদের ভালোবাসা ও সম্প্রীতিতে নিকটতম পাবেন তাদের, যারা বলে আমরা নাসারা (সাহায্যকারী) খ্রিস্টান।' তাছাড়া ইসলাম সমগ্র মানবজাতিকে একই পরিবারভুক্ত মনে করে। সব মানুষই তো এক আল্লাহ তা'আলার সৃষ্টি এবং তিনি সমগ্র বিশ্বজগতের স্রষ্টা ও প্রতিপালক। তিনি প্রত্যেক মানুষকেই মানবীয় গুণ ও বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টির সেরা করেছেন। ব্যক্তিমানুষের সম্মানকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সংরক্ষণ করে ইসলাম। কোরানে আল্লাহ বলেন- 'আমি সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতম অবয়বে।' (সুরা ত্বীন, আয়াত: ৪)। সব মানুষ ভাই ভাই, কারণ সবাই একই পিতা-মাতার সন্তান। আল্লাহ তাআলা বলেন- 'হে মানব সমাজ! তোমরা তোমাদের রবকে ভয় করো, যিনি তোমাদের এক প্রাণ থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তার থেকে তার জোড়া সৃষ্টি করেছেন; অতঃপর এতদুভয় থেকে বহু নর ও নারী সম্প্রসারণ করেছেন।' (সুরা নিসা, আয়াত: ১)
জাহিলিয়াতের যুগে মায়ের সঙ্গে নানার বাড়ি যাচ্ছিলেন হযরত যায়েদ ইবনে হারেসা (রা)। পথে বনু কায়সের লোকেরা কাফেলাকে লুণ্ঠন করে। তার মধ্যে হযরত যায়েদও ছিলেন। পরে তাকে মক্কার বাজারে নিয়ে বিক্রি করে দেওয়া হয়। হজরত খাদিজা (রা) তাকে কিনে নেন। হজরত মুহাম্মাদ (সা)-এর সঙ্গে বিয়ের পর তার খেদমতের জন্য বালক যায়েদকে উপহার দেওয়া হয়। আরবের সেই জামানায় দাসের সঙ্গে এমন ব্যবহার হতো যে, যদি তাকে তার মনিব মেরেও ফেলে কিছু বলার থাকত না। কিন্তু হজরত মুহাম্মাদ (সা) তার সঙ্গে এতোটাই উত্তম চরিত্র দেখিয়েছেন যে, সুযোগ পেয়েও বাবার কাছে ফিরে যাননি যায়েদ। বিশ্বনবীর এমন আখলাকের কারণেই তো দলে দলে মানুষ ইসলামের পতাকা তলে আশ্রয় নেয়। অথচ আমাদের দেশের আলেম সমাজ দিয়েছেন কেবলই বিভক্তি। ইসলামের মূলস্রোতের দাবিদার উপমহাদেশের আলেম ওলামারা এখনো আকিদা-প্রসঙ্গেই দাঁড়াতে পারেননি এক সুঁতোয়। ধর্মীয় ছোটখাটো বিষয়েও রয়েছে মতানৈক্য। বতর্মান ইন্টারনেটের যুগে উঠে আসা পারিপার্শ্বিক নানা ইস্যুতে তাদের ভূমিকাও হতাশাজনক। সেই সঙ্গে মতানৈক্যগত কোনো ব্যাপারে কৌশল হেকমত বা প্রজ্ঞার পরিচয় প্রশ্নবিদ্ধ।
মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ব, সাম্য ও যাবতীয় মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করে গেছেন হজরত মুহাম্মদ (সা.)। মদিনা সনদের মাধ্যমে তিনি কেবল মুসলমানদের অধিকারই প্রতিষ্ঠা করেননি, বরং সব গোত্র ও ধর্মের মানুষের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করেছেন। সেই সনদ আজও মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সবার কাছে একটি শ্রেষ্ঠ দলিল হিসেবে বিবেচিত। ইসলামী রাষ্ট্রেও তো অমুসলিমদের অধিকার মুসলমানদের মতো। যদিও ধর্ম, আকিদা ও বিশ্বাস সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইসলাম সবাইকেই স্বাধীন মত প্রকাশ ও ধর্ম পালনের অধিকার দিয়েছে। সংখ্যালঘুদের অধিকার সম্পর্কে মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, 'জেনে রাখো, যে মুসলমান কোনো চুক্তিবদ্ধ (অর্থাৎ অমুসলিম) নাগরিকের ওপর জুলুম করবে, কিংবা তার অধিকার হরণ করবে, কিংবা তার ওপর সামর্থ্যরে চেয়ে বেশি বোঝা চাপিয়ে দেবে, কিংবা তার কোনো জিনিস জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেবে, সেই মুসলমানের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত অভিযোগে আমি আল্লাহর আদালতে অমুসলিম নাগরিকের পক্ষে দাঁড়াব।' (আবু দাউদ)। আল্লাহ তাআলাও অমুসলিমদের সঙ্গে সুবিচারপূর্ণ ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন। সুরা মুমতাহিনার ৮ নম্বর আয়াতে তিনি বলেছেন- 'যারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের সঙ্গে লড়াই করেনি এবং তোমাদেরকে তোমাদের বাড়িঘর থেকে বের করে দেয়নি, তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার ও ইনসাফ করতে আল্লাহ নিষেধ করেননি। নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনসাফকারীদের পছন্দ করেন।'
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘাটুরা গ্রামের লোকদের অমানবিক কাণ্ডের খবরটি পড়ে যে কারও মনে জাহিলিয়াতের যুগের ঘটনাগুলো আবারও নাড়া দিবে। কিন্তু ইতিহাসের একটি বড় শিক্ষা হলো- কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না। ধর্ম নিয়ে ইতিহাসের শিক্ষাকে পাশ কাটিয়ে এখনো চলে ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি। ইসলামের অপব্যাখ্যা দিয়ে এদেশের ধর্মপ্রাণ সহজ-সরল মানুষগুলোকে বেপথে পরিচালিত করা হয়। মূলত নিজেদের আখের গোছাতেই বারেবার ব্যবহার করা হয় তাদের। যদিও তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হবে নেতিবাচক, আর তা আমাদের সমাজ-সভ্যতার জন্যও বয়ে আনবে মারাত্মাক কুফল। কেননা ধর্মের নামে অনাচার, ফায়দা হাসিল; ধর্মের মর্মবাণীর অপব্যাখ্যা, সহজ-সরল সাবলীল রূপকে রুক্ষ-শুষ্কভাবে উপস্থাপন, প্রকৃত বিধানকে এড়িয়ে চলা; ধর্মের নামে গোঁড়ামি, অন্ধত্ব; ধর্মের আড়ালে ধর্মব্যবসা ও ধর্মের আশ্রয়ে অমানবিকতা আর অধর্মের চর্চার মাধ্যমে বিশ্বসমাজ থেকে বহু ধর্মের বিলুপ্তি ঘটেছে। অনেক ধর্ম তার ইমেজ হারিয়েছে, আবার অনেক ধর্ম তার আপন কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে তলিয়ে গেছে মহাকালের গর্তে। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি হলে সেটি তার শাশ্বত ও চিরন্তন অবস্থানকে হারিয়ে ফেলে এবং মানব সমাজে তার গ্রহণযোগ্যতা ও উপযোগিতা হ্রাস পায়। পৃথিবীতে প্রবর্তিত সব ধর্মের একটি অভিন্ন ও অবিচ্ছেদ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মানবকল্যাণ। মানুষ ও মানবতার অকল্যাণ কোনো ধর্মেরই লক্ষ্য বা মূলনীতি হতে পারে না।