Published : 30 May 2020, 08:12 PM
(ধর্ম নিয়ে ষড়যন্ত্র চিরকালই হয়েছে কিন্তু এমন পাশবিক ষড়যন্ত্র বিরল)
জয় শ্রীরাম! জয় রামজি কি!
ছড়িয়ে পড়ছে দুর্দান্ত খবরটা, হুলুস্থূল পড়ে গেছে সুবিশাল ভারতের সাড়ে তিরিশ কোটি হিন্দু সমাজে। রাম দেবতা ফিরে এসেছেন! তিনি ফিরে আসবেন এই অটল বিশ্বাস হিন্দুদের প্রাচীন কাল থেকেই। মহামহিম সেই ক্রান্তি মুহূর্ত এখন সমুপস্থিত, রাম লালা (বালক রাম) এসে দাঁড়িয়েছেন অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের ভেতরে মিম্বরের ওপরে কারণ ওটাই তার জন্মস্থান। অবিশ্বাসের প্রশ্ন কোথায়- কারণ ছুটে গেছে সাংবাদিকেরা, বহু পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে সেই রাম লালার ছবি, ছাপা হচ্ছে প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকারও।
দুই বছর আগে স্বাধীনতা ও এখন রাম দেবতার আবির্ভাব, এই দুই শক্তিশালী আবেগের প্রচণ্ড মিথস্ক্রিয়ায় রামরাজ্যের স্বপ্নে টালমাটাল হিন্দু জনতার মানস। নড়েচড়ে বসল রাজনীতির নেতা ও দলগুলো, পদধ্বনি শোনা গেল ভবিষ্যতের আরএসএস, বিজেপি, বজরং, জনসঙ্ঘ …. রাজনীতির তাসের টেবিলে স্পেডের টেক্কা পাওয়া গেছে!
ধর্মের নামে কিছু মানুষ যত নির্বোধ আর হিংস্র হতে পারে ততটা আর কোনও কারণেই নয়।
অযোধ্যা। ২২শে ডিসেম্বর ১৯৪৯ বৃহস্পতিবার, রাত ১১টা।
নিঃশব্দ নিথর রাত, নিস্পন্দ নীরব। রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে আছে গ্রহ নক্ষত্রেরা, আতংকিত সরযূর লক্ষ তরঙ্গ। নিকষ অন্ধকারে ইতিউতি তাকিয়ে সন্তর্পনে হেঁটে যাচ্ছে তিন রাম-ভক্ত। দলনেতা সাধু অভিরাম দাসের চাদরের ভেতরে অষ্টধাতুর তৈরি রাম লালা-র ৭ ইঞ্চির মূর্তি। মসজিদের ভেতরে মিম্বরের ওপরে রেখে আসা হবে সেটা। এর সূত্র ধরে ৪৩ বছর পর ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর দেড় লাখ ধর্মোন্মাদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবে ৪৬৪ বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী বাবরি মসজিদ। পাশবিক উল্লাসে ফেটে পড়বে নেতা-জনতা। মাঝের বছরগুলোতে ইতিহাসের পাতা ক্রমাগত ভিজে যাবে রক্তে। রাস্তাঘাটে পড়ে থাকবে শত শত রক্তাক্ত লাশ, শত শত বাড়ির দরজায় তালা লাগিয়ে ধরিয়ে দেয়া হবে আগুন, ভেতরে পুড়ে কয়লা হয়ে যাবে হাজারো নরনারী শিশু। বাংলাদেশের গ্রামে হৈরা মুচিকে হিংস্র প্রশ্ন করা হবে- "তোরা আমাদের মসজিদ ভাঙলি কেন"? দুই ধর্মের কিছু উগ্র নেতার উস্কানিতে ঝলসে উঠবে ঘাতকের অস্ত্র, 'প্রতিপক্ষের' ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে স্রষ্টার সৈন্যরা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়।
মত্ত দরিয়া, নাও ডুবুডুবু, মৃত্যু জীবন-নদীর দুধারে,
এধারে রক্তচক্ষু পুরাণ, রক্তচক্ষু কোরান ওধারে।
"সেই তখন উত্তর ভারতের একটি শহরের মসজিদে গভীর রাত্রিতে যাহা ঘটিয়াছিল, তাহা একটি নূতন জাতিকে সংজ্ঞায়িত করিয়াছিল এবং এখনও তাহা পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশটির চরিত্র নির্ধারণ করিতেছে"- ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল।
সেই কালরাত্রির ঘটনা সবিস্তারে প্রকাশিত হয়েছে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে ছয়দিন ধরে (০৩-০৮ ডিসেম্বর ২০১২), প্রকাশিত হয়েছে বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডসহ অজস্র দেশি-বিদেশি সংবাদ-মাধ্যমে এমনকি পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটেও- "অযোধ্যা: দি ডার্ক নাইট- দি সিক্রেট হিস্ট্রি অব রাম'স অ্যাপিয়ারেন্স ইন বাবরি মসজিদ" বইয়ের (প্রকাশক হার্পার কলিন্স, ইণ্ডিয়া) লেখকদ্বয় কৃষ্ণ ঝা ও ধীরেন্দ্রকে ঝা-এর অনুমতি নিয়ে। বইটা আমাজনে কিনতে পাওয়া যায়। নিচের উদ্ধৃতিগুলো প্রধানত ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ও পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে নেয়া।
উত্তর-প্রদেশ রাজ্যের ফৈজাবাদ জেলার অযোধ্যা শহরে বাবরি মসজিদ, ১৫২৮ সালে বানিয়েছিলেন সম্রাট বাবরের সেনাপতি মীর বাকি। মসজিদের সামনে দেয়াল-ঘেরা মাঠটা মাঝখানে রেলিং দিয়ে দ্বিখণ্ডিত। ভেতরের অংশ মসজিদ সংলগ্ন, বাইরের অংশে হিন্দুরা কাঠের মঞ্চে রামমূর্তির পুজো করেন। "সেখানে সাধু ও রামভক্তরা প্রদীপ জ্বালাইতেন; রামায়ণ হইতে পড়া হইত রাম কিভাবে তাঁহার জন্মস্থানে ফিরিয়া আসিবেন"।
বিহার থেকে ১৯৩৫ সালের দিকে সেখানে এসে আস্তানা গাড়ে 'দৃপ্তকণ্ঠ ও খিটখিটে স্বভাবের' রামভক্ত সাধু অভিরাম দাস। তার দৃঢ় বিশ্বাস মসজিদের ভেতর মিনারের ঠিক নিচেই রামের জন্মস্থান। সে বারবার ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখে "মর্যাদা পুরুষোত্তম" দেবতা রাম এসে ওখানে দেখা দিয়েছেন। তাই ঠিক সেই জায়গাতেই রামকে পুনর্প্রতিষ্ঠিত করাটা তার জীবনের একমাত্র ব্রত। "আমরা দেশকে মুক্ত করেছি, আমাদেরকে লর্ড রামের জন্মভূমিও মুক্ত করতে হবে"- এই ছিল তার একমাত্র ধ্যানধারণা যা সহজেই জনসমর্থন পেয়েছিল।
জুন-জুলাই, ১৯৪৯। অভিরাম দাস আরেক রামভক্ত ম্যাজিস্ট্রেট গুরু দত্ত সিং-এর কাছে স্বপ্নটা খুলে বলতেই লাফিয়ে উঠলেন তিনি– "এ তো আমার অনেক দিনের স্বপ্ন ভাইয়া! এ স্বপ্ন তুমি এখন দেখছো, আমি তো এটা বহুদিন থেকেই দেখছি"!
অলক্ষ্যে ধ্বনিত হল ইঙ্গিত! "কিভাবে মুসলিমদের ইবাদতের স্থানে রামের মূর্তি গোপনে রাখা যায় তাহা লইয়া এই দুইজন আলোচনা করিতে লাগিলেন"।
কৌশলে অজস্র সাধু সন্ন্যাসী ও সাংবাদিকদের মাধ্যমে চতুর্দিকে ছড়িয়ে দেওয়া হল- রাম দেবতা ফিরে এসেছেন। স্বভাবতই সংখ্যাগুরুদের মধ্যে প্রবল ধর্মীয় আবেগের সাইক্লোন শুরু হল। এক অচিন্তনীয় চাপের মধ্যে পড়ে গেল ভারতের মুসলিম, চারদিক থেকে অদৃশ্য এক ধুম্রজাল ধীরে ধীরে ঘিরতে থাকল তাদেরকে। রাজনীতি ও ধর্মের অঙ্গনে একের পর এক ঘটতে থাকল অঘটন, ১৯৮৭ সালে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন দূরদর্শনে ধর্মীয় অনুষ্ঠান প্রচার না করার লিখিত নীতি ভঙ্গ করে শুরু হল প্রবল ধর্মীয় অনুভূতির "রামায়ণ সিরিয়াল"। রাম মন্দিরের পক্ষে বাবরী মসজিদের বিপক্ষে পুরো ভারতের হিন্দু-মানসকে একসূত্রে গেঁথে ফেলল সেটা।
এবারে ত্রিমূর্তির তৃতীয় মূর্তি। গুরু দত্তের পুরোন বন্ধু ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের নির্বাহী কর্মকর্তা কে কে নায়ার। দুজনই প্রচণ্ড রামভক্ত, দুজনই ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর 'হিন্দু মহাসভা' দলের সমর্থক যদিও চাকরির কারণে সেটা প্রকাশ করেন না। পরিকল্পনা মাফিক নায়ার কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করে ফৈজাবাদে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ পেলেন যার শহর অযোধ্যার সিটি ম্যাজিস্ট্রেট গুরু দত্ত সিং। এদিকে সাধু অভিরাম দাস তো অযোধ্যাতে আছেই। এই সেই ত্রিমূর্তি, ইতিহাসের মারাত্মক খলনায়ক।
"রামের মূর্তি কিভাবে বাবরি মজিদের ভিতরে স্থাপন করা যায় তাহা পরিকল্পনা করিতে তাহারা একত্রিত হইত… সূর্যাস্তের পর গোপনে সভা হইত, দরজায় এক হিন্দু চাকর রাখা হইত। তাহাকে নির্দেশ দেওয়া হইয়াছিল কোনো দর্শনার্থী আসিলে তাহাকে যেন বলা হয় যে তিনি (গুরু দত্ত) বিশ্রাম করিতেছেন"… "কে কে নায়ার, গুরু দত্ত ও উচ্চ জেলা প্রশাসকেরা অভিরাম দাসের সহিত পরিকল্পনা করিত কিভাবে বাবরি মসজিদের ভিতরে মূর্তিটি স্থাপন করা যায়, যেই মসজিদ তালাবন্ধ থাকিত ও সেখানে প্রহরী থাকিত"।
হিন্দু প্রহরী দুপুর থেকে মাঝরাত ও মুসলিম প্রহরী মাঝরাত থেকে সকাল পর্যন্ত পাহারা দিত। "আমি তাহাকে (হিন্দু প্রহরীকে) বুঝাইয়াছিলাম যে ইহা একটি এক্সট্রিম হলি ওয়ার্ক"- অভিরাম দাস। বিশ্বাসীদের মনে 'হলি ওয়ার্ক' স্বর্গের হাতছানিতে ঐশী কম্পন তোলে, হিন্দু প্রহরী রাজি হল তাদেরকে রাত্রে মসজিদে ঢুকতে দিতে। মুসলিম প্রহরীকে গুরু দত্ত ও নায়ার হুমকি দিয়েছিল সহযোগিতা না করলে তাকে খুন করা হবে। তাকেও রাজি হতে হল। সাধু অভিরাম দাস তাঁর দুই ভক্তকে নিয়ে রাত এগারোটায় মসজিদের কাছে পৌঁছতেই পরিকল্পনা অনুযায়ী আবির্ভুত হল সাধু বৃন্দাবন দাস, হাতের রাম লালা'র মূর্তি তুলে দিল অভিরাম দাসের হাতে।
পরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত, কিন্তু তার প্রবল প্রভাব আজও আছে থাকবে চিরকাল। প্রহরী তালা খুলে দিলে সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে অভিরাম দাস মসজিদে ঢুকে মিম্বরের ওপরে মূর্তিটি স্থাপন করে, তারপর ব্রহ্ম মুহূর্তের (কোন কোন মতে রাত ৩টা থেকে ৫টা) অপেক্ষা করতে থাকে। ঠিক রাত তিনটায় সে প্রদীপ জ্বালিয়ে পুজোর ঘণ্টা বাজিয়ে স্তোত্র পাঠ শুরু করে। মুসলিম প্রহরী ও বহির্প্রাঙ্গনের (যেখানে রামের পুজো হত) সাধুরা বাইরে থেকে সেটা দেখেছে বলে পরে জানিয়েছে। মুসলিম প্রহরী জানায়, প্রদীপের আলোতে রামের মূর্তি দেখা যাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল রাম নিজে আবির্ভুত হয়েছেন। সাধু বিন্দেশ্বরী প্রসাদ জানান- "আমরা রাত তিনটায় দেবতার কাছে গেলাম ও স্তোত্র পাঠ করিয়া তাঁহার পূজা করিলাম"। দুই সাইকেল আরোহী ঘটনার ক্রমাগত বিবরণ ফৈজাবাদে অবস্থানরত উৎকণ্ঠিত গুরু দত্ত ও নায়ারের কাছে পৌঁছাতে থাকে।
এর পরের ঘটনাগুলো সবার জানা।
পুনরাবৃত্তি করছি- "সেই তখন উত্তর ভারতের একটি শহরের মসজিদে গভীর রাত্রিতে যাহা ঘটিয়াছিল, তাহা একটি নুতন জাতিকে সংজ্ঞায়িত করিয়াছিল এবং এখনও তাহা পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশটির চরিত্র নির্ধারণ করিতেছে"। এ ঘটনা কখনো অতীত হবেনা, এটা বারবার ফিরে এসে ভারতের রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে কালনাগিনীর ছোবল দিতে থাকবে যার প্রভাব বাংলাদেশ পাকিস্তানেও পড়তে বাধ্য। এছাড়া আরো প্রশ্ন থেকে যায়। কোটি মানুষের বিশ্বাস ও জীবন নিয়ে এই মারাত্মক অপরাধের এতো চাক্ষুস, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দলিল প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও আদালতে সেগুলো মুসলিম পক্ষের আইনজীবী পেশ করেছেন বলে জানা যায়না। যদি তাঁরা তা পেশ করে থাকেন তাহলে আদালত সেগুলো আমলে নিলনা কেন সেটাও বৈধ প্রশ্ন। আইনজীবীরা বলতে পারবেন।
কালতামামী
অসাম্প্রদায়িক সম্রাট বাবরের এমন কি জমির অভাব পড়েছিল যে তাঁকে মন্দির ভেঙে মসজিদ বানাতে হবে? আসলে নীতি তো নয় ভোটই হল রাজনীতির ঈশ্বর। সেজন্যই সুপ্রিম কোর্টের রায়ে মসজিদটা ভেঙে সেখানে নির্মিত হবে মন্দির। সেজন্যই সেই মন্দির নির্মাণে টাকা দিলে আয়করে ছাড় দেয়া হবে (আনন্দবাজার, ০৯ মে ২০২০)। কয়েকটা বুলডজার এসে হিংস্র পশুর মতো প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় স্থাপত্যটা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে, সেই ছবি রয়ে যাবে। সে ছবির পাঁচ আঙুলের দাগ রক্তাক্ত হয়ে চিরকাল ফুটে থাকবে এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির গালে।
নিজেদেরই সরকারের হাতে এই দুঃসহ অন্যায় অপমান ভারতের মুসলিমেরা ভুলবেনা কোনোদিন।