Published : 01 May 2020, 04:25 PM
পরপর দু'জন বলিউড তারকা বিদায় নিলেন। এদের একজন নায়ক অন্যজন অভিনেতা। আমরা যৌবনে এই হিরোকে ডাকতাম চকোলেট হিরো। প্রথম নায়ক হিসেবে এসেই মন কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। কাপুর পরিবারের এই নায়ক ও ডিম্পল কাপাডিয়ার হাম তুম এক কামরে মে বন্দী হো অর চাবি নেহি… উপমহাদেশ জাগিয়ে তুলেছিল যৌবনের রঙে। ঋষি কাপুর যে বড় অভিনেতা তাও তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন পরের ছবিগুলোয়। অগ্নিপথ তারপর অমিতাভের সাথে পুত্রের অভিনয়ে উজ্জ্বল নায়কের তিরোধান হলো দুরারোগ্য ক্যানসারে। কঠিন করোনা কালে তিনি ও তার চব্বিশঘণ্টা আগে চলে যাওয়া আরেক অভিনেতা ইরফান খান সবাইকে কাঁদিয়েছেন।
অমিতাভ বচ্চন তার টুইটে লিখেছেন, মোস্ট ডিসাটার্বিং আর স্যাড এই খবর। এই একটি কথা আমাদের সবার মনের কথা বোঝানোর জন্য যথেষ্ট। এমনিতে মানুষের জান কয়লা। করোনাভাইরাস নিয়ে মহা বিপাকে আছে মানুষ। দুনিয়ার সবদেশে একযোগে এমন বিপর্যয় যুদ্ধের সময়ও নামেনি। এই কঠিন করোনা কালে এমন দুঃসংবাদ আসলেই হতাশার। মৃত্যুর কিছুদিন আগে ভিডিওতে ইরফান খানকে বেশ মজা করে বলতে শোনা গিয়েছে, "প্রবাদ রয়েছে যে, 'জীবন যখন আপনার হাতে লেবু ধরিয়ে দেবে ওটা দিয়ে লেমোনেড (শরবত) বানিয়ে খাওয়া উচিত'। এমন বলা কিন্তু খুবই সহজ, কিন্তু বাস্তবে যখন সত্যি আপনার হাতে জীবন একটা লেবু ধরিয়ে দেবে ওটা দিয়ে 'শিকাঞ্জি' বানানোটা বড়ই কঠিন। বাস্তবটা খুবই মুশকিল। যদিও পজিটিভ ভাবনাচিন্তা নিয়ে বেঁচে থাকাই জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত। আশা করছি, এই ছবি থেকে আপনারা অনেক কিছু শিখতে পারবেন। আপনাদের যেমন হাসাবে, তেমন কাঁদাবেও। ট্রেলারের আনন্দ নিন এবং ছবিটা দেখুন। আর হ্যাঁ আমার জন্য অপেক্ষা করবেন।''
কিন্তু কাউকে সবুর করার সময় দিলেন না তিনি। ক্যানসার একটি মরণব্যাধি আমরা জানি। কিন্তু তারপরও কত মানুষ, কত গুণীজন এর সাথে লড়াই করে বেঁচে আছেন। তিনি পারলেন না। কি সরল আর সহজ অভিব্যক্তি ছিল তার। মনকাড়া চেহারা সুরত থাকলে নায়ক হওয়া যায় অভিনেতা হতে পারা কঠিন। তিনি ছিলেন রক্ত মাংসে অভিনেতা। দরিদ্র পরিবারের সন্তান। তার ওপর রক্ষণশীল। সে জায়গা থেকে উঠে আসা মানুষ। আজীবন লালন করে গেছেন অভিনয় ও মুক্তচিন্তা। কতবার মনের কথা বলতে গিয়ে বিপদের মুখেও পড়তে হয়েছে তাকে। যেমন বলেছিলেন আমি কোনো খান না, আমি শুধু ইরফান। বুকের পাটা ছিল তার। কুরবানীতে পশু জবাই করা নিয়েও নিজের খোলামেলা মন্তব্য করে বিপদ টেনে এনেছিলেন। কিন্তু বুকের সাহস হারাননি।
কারণ বলিউডে খানদের রাজত্বে সবাই নায়ক। মাঝে মাঝে তারা অভিনয় করেন বটে অধিকাংশ সময়ে বড় পর্দায় নায়িকাদের সাথে নেচে গেয়েই পপুলার। এই খান সাহেব ছিলেন ব্যতিক্রম। বিশ্বাস করুন উপমহাদেশে হার্টথ্রব নামে পরিচিত খানদের বিদেশের অভিনয় জগত ও বুদ্ধিবৃত্তি চেনে না। কিন্তু একে চেনে। শুধু চেনে না আজ তার তিরোধানের খবরে শোকাভিভূত অস্ট্রেলিয়া থেকে হলিউড, ইউরোপ। বিশ্ব মিডিয়ায় এমন গুরুত্ব বলে দিচ্ছে কোথায় ছিল তার অবস্থান। আমার ছেলেও হলিউডের অভিনেতা। সিনেমা বানায়, পরিচালনা করে। তার একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি পূর্ণদৈঘ্য করার সুযোগ এসেছে। ছবিটি প্রশংসিত হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন শর্টফিল্ম ফেস্টিভ্যালে। করোনা কালে অনুদানের জন্য জমে থাকা সিডনির এই ফাইলটিতে পরিচালকের পছন্দের অভিনেতা অভিনেত্রীর নাম থাকতে হয়। ছেলের পছন্দ তথা উইশ লিষ্টে এক নাম্বারে ছিল তার নাম। একদিন গল্প করার সময় আমাকে বলছিল লাঞ্চ বক্সের নায়িকার সাথে যোগাযোগ আছে বলে অর্ক নিশ্চিত সেই তাকে ব্যবস্থা করে দেবে। দেখলাম মন খারাপ করে আছে খুব। বারবার বলছিল এমন অভিনেতা বলিউডে শুধু না দুনিয়াতেই বিরল।
"কেমন অভিনেতা ছিলেন তিনি? ইহুদি অভিনেতা জ্যাকব অ্যাডলারের বলা একটি কথা। জ্যাকব তার অভিনেতাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, "যদি তুমি একশ শতাংশ অনুভব কর, তবে দর্শকদের তার আশি শতাংশ দেখাও। যদি তুমি ষাট শতাংশ অনুভব করে থাকো তবে ওদের চল্লিশ শতাংশ দেখাও। কিন্তু যদি তুমি চল্লিশ শতাংশই অনুভব করতে জানো, তবে দোহাই, আর যাই হোক অভিনয় কোরো না।'' আমাদের এই চল্লিশ শতাংশেরও নীচে অনুভব করা বা উচ্চকিত বা মিনমিনে কণ্ঠসর্বস্ব, ভুল উচ্চারণ কণ্টকিত এবং ব্যক্তিগত ব্যবহারিকতাবাদকে 'অভিনয়' হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার যুগে (স্টেলা বলেছিলেন, সেই খারাপ অভিনেতা যে, অভিনীত চরিত্রটির বৃহৎ মাপকে নিজের চরিত্রের ক্ষুদ্রতর মাপে আঁটিয়ে নেয়) ইরফান খান ছিলেন সেই বিরল ব্যতিক্রম, যিনি অভিনয়ের ক্ষেত্রে চোখ ও মাংসপেশীকে সর্বাত্মক গুরুত্ব দিতেন।" এই কথাগুলো তার বেলায় শতভাগ সত্য।
সাধারণত অভিনেতারা যা যা করেন তার সাথে ইরফানের কিছুই মিলতো না। চরিত্র ধরে বুঝে নিজেকে ছড়াতেন পেঁয়াজের খোসার মতো। ছবি শেষ হয়ে গেলেও দর্শক তাকে পুরোটা ছাড়াতে পারতো না। তাই এই অধরা চরিত্র হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তী। ইরফানের বেলায় নাসিরুদ্দীন শাহ'র একটি কথা খুব সত্য মনে হয়। নাসিরুদ্দীন বলেন, তার খুব ইচ্ছে ছিল সবাই তাকে চিনুক জানুক অটোগ্রাফ নিক তাকে ঘিরে ভীড় জমে উঠুক। তিনি রাতারাতি হয়ে উঠুন তারকা। হবার পর তার মনে হতে লাগল এগুলো থেকে পালানোর পথ দরকার। তা নাহলে নাসির নাসিরকেই গিলে খাবে। ইরফান কিন্তু শুরু থেকে এটা হয়তো জানতেন বা মানতেন। ক্যামেরা লাইমলাইট সব তাকে খুঁজে ফিরেছে আর তিনি আছেন, ছিলেন থিয়েটারে।
সালাম বোম্বে থেকে Warrior, life of Pie, Jurassic World, Slumdog Millionaire বিশাল যাত্রায় বারবার ঝলসে উঠেছিলেন। লাঞ্চ বক্স, পিকু, মকবুল তার এক, একটি মাইল ফলক। কী আশ্চর্য বাংলাদেশের 'ডুব' ছবিতে অভিনয় করলেন প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদের আদলে এক চরিত্রে, এবং তার মতোই মারা গেলেন ক্যানসারে।
অভিনেতা ইরফান খানের কি মৃত্যু হয়?
কঠিন সময়ে তার এই চলে যাওয়া গভীর বেদনার। বিদায়ের আগে তার লেখা একটি শিরোনামহীন কবিতা ছিল এমন:
'সৃষ্টিকালে বিধাতা সবার সঙ্গে কথা বলেন,
পরে নিভৃতে আমাদের সঙ্গে হাঁটেন।
সেসব বাণী হালকাভাবে আমরা শুনি;
অপ্রত্যাবর্তনীয় সত্ত্বেও তোমাকে পাঠানো হল, তুমি
নিজের বাসনার ভেতর থেকে সবটুকু কর
মূর্ত কর আমাকে।
অগ্নিশিখার মতো জ্বলে ওঠ
আর আমাকে প্রতিমূর্ত হতে বিশালাকার সব ছায়া ছড়িয়ে দাও।
তোমার ক্ষেত্রে সবকিছু ঘটতে দাও; সুন্দর ও আতঙ্ক
পথচলা অব্যাহত রাখ। কোনো অনুভূতিই চূড়ান্ত না
তুমি আমাকে হারতে দিও না।'
মায়ের মৃত্যুতে যেতে পারেননি তিনি। তাও এই কঠিন করোনা কালে। তখন মনে হয়েছিল সে কারণে যাননি। এখন মনে হচ্ছে হয়তো শরীর যেতে দেয়নি। আহা কি কষ্ট আর কি অপরিসীম বেদনা।
আমি সিনেমার মানুষ না। চলচ্চিত্র ভাল করে বোঝার মেধা আমার নাই। কিন্তু আমি মন দিয়ে খুঁজি চোখ দিয়ে দেখি আর অন্তর দিয়ে অনুভব করি বলে নিশ্চিত একশ বছরেও ফুরাবেন না ইরফান খান। ফুরাবার মতো মেধা ছিলেন না তিনি।
ঋষি কাপুর ও ইরফান খানের শোকে ভক্তরা ছুটে যাবার সুযোগ পায়নি। লাখ লাখ মানুষের ভিড় হয়নি। সামান্য এক জীবাণু দেখিয়ে দিয়েছে মানুষ মূলত অসহায় ও একা।
শ্রদ্ধা জানাই তাদের।