Published : 12 Feb 2020, 01:01 PM
ভারতীয় জাতীয় রাজনীতিতে বিজেপির জনজোয়ারকে আটকে দিয়ে তৃতীয়বারের জন্য দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে বসতে চলেছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। আসন কিছুটা কমলেও বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে (৬২টি আসন) ক্ষমতায় বসার ম্যান্ডেট পেয়েছে আম আদমি পার্টি (আপ)। বিজেপির আসন বাড়লেও (৮টি আসন) ধর্মীয় মেরুকরণ, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি), জাতীয় জনসংখ্যা রেজিস্টার (এনপিআর)-এর ধাক্কায় এ বারও দিল্লির মসনদ অধরাই থেকে গেল বিজেপির কাছে। অন্য দিকে কংগ্রেসসহ অন্য দলগুলোর অস্তিত্ব কার্যত ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল।
কিন্তু কী এমন ম্যাজিক দেখিয়েছেন কেজরিওয়াল? ম্যাজিক একটাই কেজরিওয়ালের সততা ও উন্নয়নের রাজনীতি। গত পাঁচ বছরে কেজরিওয়াল দিল্লিবাসীর জন্য ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুতের বিল মওকুফ করে দেওয়া, নারীদের জন্য বিনামূল্য সরকারি বাসযাত্রা, বিনা পয়সায় ৭০০ লিটার পর্যন্ত পানির ব্যবস্থা করা, মহল্লা ক্লিনিকে বিনামূল্য ওষুধ দেওয়ার মতো জনমুখী প্রকল্পের উপর আস্থা রেখেছেন দিল্লিবাসী। তার সঙ্গে ছিল প্রায় দুর্নীতিহীন সরকার উপহার দেওয়া।
অথচ কয়েক মাস আগের লোকসভা ভোটেও ভরাডুবি হয়েছিল আপের। দিল্লির সাতটি আসনের একটিতেও জিততে পারেনি আপ। সব কটি আসন ঝুলিতে পুরেছিল বিজেপি। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বিধানসভা নির্বাচনে যেভাবে আপ ফের ক্ষমতায় ফিরল, তার কৃতিত্ব অবশ্যই কেজরিওয়ালের।
দিল্লিতে প্রচার শুরু হতেই দেখা যায়, লোকসভা ভোটের আগের কেজরিওয়াল আর বিধানসভা ভোটের আগের কেজরিওয়ালে আকাশ-পাতাল ফারাক। জাতীয় রাজনীতি নিয়ে যেন মাথাব্যথাই নেই এই নতুন কেজরিওয়ালের। তার এবং তার দলের অন্য নেতাদের ভাষণ এবং আপের যাবতীয় প্রচার শুধু দিল্লি-কেন্দ্রিক। গত পাঁচ বছরে আপ কী কী করেছে দিল্লির জন্য, শুধু তার ফিরিস্তি। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নয়, যেন দিল্লির মেয়র হিসেবে ভোটে লড়তে নামা। আর বিজেপির মতো দোর্দণ্ডপ্রতাপ দল কী ভাবে সব বিজেপিশাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে এবং শ'দুয়েক সাংসদকে দিল্লির ময়দানে নামিয়ে দিয়েছে, তার মতো এক জন 'ছোটা আদমি'কে হারানোর জন্য, তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করা। দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের গোটা প্রচার পর্বটাতেই কেজরিওয়াল নিজেকে এবং দলকে সীমাবদ্ধ রাখলেন শুধু এইটুকুর মধ্যে। ফলে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার চেয়ে অনেক বেশি আসন নিয়েই আবার ফিরছেন কেজরিওয়াল।
সঙ্গত কারণেই অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। হওয়াটাই অবশ্য স্বাভাবিক। তিনি ভারতের জাতীয় রাজনীতির পরিসরে অন্যান্য বিরোধী দল থেকে অনেকটা দূর দিয়া চলেছেন। তিনি বিজেপি-বিরোধী হিসাবে বিতর্কোর্ধ্ব থেকেছেন, একইসঙ্গে কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস কিংবা বাম দলগুলির সঙ্গে দূরত্ব রক্ষা করে চলেছেন। তার এই অবস্থান ঘটনাচক্র কিংবা আকিস্মক নয়, বরং রীতিমতো সুচিন্তিত ও সতর্ক। কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা বিলোপ বা সিএএ প্রবর্তন, কোনওটিতেই কেজরিওয়ালকে এগিয়ে এসে বিরোধিতায় নিমজ্জিত হতে দেখা যায়নি, আবার তিনি বিজেপির লেজ-রূপেও নিজেকে পরিচিত হতে দেননি। শাহিনবাগের অবস্থানরতদের তিনি ভর্ৎসনা করেছেন রাস্তা জুড়ে বসবার জন্য, কিন্তু আবার বিরোধিতার কারণটিকেও সমর্থন করেছেন। স্পষ্টতই, তার হিসাবটি রাজনীতির, বলা ভালো, ভোটের রাজনীতির। আদর্শ কিংবা নীতির স্থান তাতে সামান্য–নিছক ব্যবহারিক অর্থেই রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির অঙ্ক কষেছেন কেজরিওয়াল। এর সঙ্গে দুর্নীতিবিরোধী আদর্শিক অবস্থান যোগ হয়েছে। আর কে না জানে, রাজনীতির মধ্যে আদর্শ যুক্ত হলে তা মহৎ বা বৃহৎ হয়, কিন্তু শেষ বিচারে রাজনীতি সম্ভাবনার শিল্পই। আদর্শ বা নৈতিকতার শিল্প নয়।
গত পাঁচ বৎসরে নিরন্তর কতকগুলি মৌলিক বিষয়ে কেজরিওয়াল কাজ করে গেছেন। বাধাবিপত্তি কম ছিল না, তবু পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। বিদ্যুৎ জোগান, পানি সরবরাহ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা ফেরানো এবং স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদান— এই কয়েকটি কাজে আপ প্রশাসন উন্নতির যে ধারা তৈরি করেছে, তা অতুলনীয়। গোটা ভারত যখন সত্তা-পরিচিতি ও স্বার্থ-গোষ্ঠীর রাজনীতির পুরাতন পথগুলি নূতন উদ্যমে পরিক্রমায় ব্যস্ত, কেজরিওয়ালের নেতৃত্বে দিল্লিতে তখন নাগরিক জীবনের মৌলিক প্রশ্নগুলিতে ধারাবাহিক প্রশাসনিক সক্রিয়তা। এটা অনন্য শুধু নয়, অনুকরণ ও অনুসরণের যোগ্য।
দিল্লির রাজনীতিতে 'আপ'-এর উত্থান আমাদের দেশেও একটা ধারণাকে খুব জনপ্রিয় করেছে। সেটা এই যে, রাজনীতিতে অরাজনৈতিক মানুষের অনেক বেশি করে যোগ দেওয়া উচিত। বিশেষ করে বিভিন্ন ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত ও বিভিন্ন বিষয়ে খ্যাতিমান মানুষের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি বলে মনে করা হচ্ছে। এই ধারণা অহেতুক নয়। এটা হতেই পারে যে, আমাদের দেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতিতে বীতশ্রদ্ধ মানুষ প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের বাইরে একটা বিকল্প চাইছেন। দিল্লিতে আপ সেই চাহিদা মিটিয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে কি তা সম্ভব? আমাদের দেশে কী তেমন কেজরিওয়াল খুঁজে পাওয়া যাবে?
হ্যাঁ, আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী ভূমিকা পালন করতে পারছে না। কিন্তু তার ফলে যদি এ কথা বলা হয় যে, অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের হাতেই রাজনীতিকে ছেড়ে দেওয়া ভালো, তা হলে হয়তো ভুল হবে।
রাজনীতি কিন্তু একটা আলাদা শিক্ষা দাবি করে। সেটা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়, যথার্থ রাজনৈতিক শিক্ষা। আমরা সেই শিক্ষাকে তার প্রাপ্য মর্যাদা বা স্বীকৃতি দিই না। আমাদের পরিবার, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সর্বত্র মানুষ নানা উপায়ে ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত ভাবে নিজের প্রয়োজনে নানা রাজনীতি করে যাচ্ছেন, কিন্তু সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণে তাদের তীব্র অনীহা ও বিরোধ। ব্যক্তিগত সুখের আশ্রয় ছেড়ে এসে খুব কম লোকই চায় রাজনীতি করতে, অথচ রাজনীতির সুফল ভোগ করতে সবাই লালায়িত। আমরা কারণে অকারণে রাজনীতিকদের প্রতি কটু মন্তব্য করেই থাকি। প্রশ্ন তোলা হয় রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে। সমাজ আমাদের ছোটবেলা থেকেই রাজনীতিবিমুখ করে তোলে। রাজনীতির সঙ্গে অশিক্ষাকে জুড়ে দেওয়ার একটা প্রবণতা আমাদের আছে। আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার এই স্বভাব, রাজনৈতিক শিক্ষার অভাবকে আমরা অহংকারের বিষয় করে তুলি। এটা এক বারও ভাবা হয় না যে রাজনীতি নিজেই একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। রাজনীতি করার জন্য একটা শিক্ষার প্রয়োজন, যে শিক্ষা আমাদের স্কুল-কলেজের পাঠক্রম দেয় না। সমান্তরাল ভাবে নানা কাজের সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে সেই শিক্ষা অর্জন করতে হয়। রাজনীতির লোকজন ভুল-ত্রুটি করেন অজস্র, কিন্তু সেই ভুল-ত্রুটির মধ্য দিয়ে গিয়েই তারা শিক্ষিত হতে থাকেন, নিজেকে প্রস্তুত করে চলেন।
গায়ক হয়ে উঠতে সংগীত শিক্ষার প্রয়োজন, খেলোয়াড় হয়ে উঠতে সেই খেলার শিক্ষা ও দক্ষতার প্রয়োজন, অভিনেত্রী হয়ে উঠতে অভিনয় দক্ষতা ও শিক্ষার প্রয়োজন। তা হলে কেন ধরে নিই যে, যেকোনও একটা বিষয়ে কারও পারদর্শিতা থাকলেই সে রাজনীতি করার যোগ্য? যদি কোনো ধরনের ট্রেনিং-অভিজ্ঞতা ছাড়া কেউ রাজনীতির ময়দানে নামেন, এত দিন যারা রাজনৈতিক শিক্ষা নিল ও পরিশ্রম করে গেল তাদের বঞ্চিত করে, তা হলে আমি সুযোগসন্ধানী ছাড়া কি আর অন্য কিছু?
রাজনীতির শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়ে কেবল নিজস্ব জগতে অর্জিত খ্যাতির জোরে যিনি রাজনীতির দুনিয়ায় ছাড়পত্র পেয়ে যান, ধরে নেওয়া হয় তিনি সেই জগতের বিখ্যাত মানুষ বলেই, তার সেই খ্যাতিতে মজে গিয়েই তাকে আমরা ভোট দেব। অথচ তার সেই 'ফেস ভ্যালু'র ফসল ওঠাবে রাজনৈতিক দল। এর মধ্যে নিজেদের প্রতিনিধিত্ব কোথায়, সেটা আমরা ভাবব না! আর সেই মুহূর্তেই করব সব থেকে বড় আত্মপ্রবঞ্চনা।
এই প্রবঞ্চনার ফলে সমাজের দুই ধরনের মানুষ বিশেষ ভাবে বঞ্চিত হন। এক, যারা আজীবন রাজনীতি করছেন; আর দুই, হাজার শ্রেণিতে বিভক্ত সমাজের একাধিক স্তর। সংসদে বা স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় এমন মানুষের দরকার, যারা বৈচিত্রে বিভক্ত দেশের নানা স্তর থেকে আসছেন, নানা স্তরের কথা বলার সম্ভাবনা রাখেন। কিন্তু রাজনীতির পরিচালন কাঠামোয় আমলা-সেনা-ব্যবসায়ী বা তথাকথিত এলিটদের প্রবেশ যত বেশি হবে, তত বেশি কেবল একটা শ্রেণিরই প্রতিনিধিত্ব হতে থাকবে। তখন এলিট গোষ্ঠী শাসন করবে 'জনগণমন'। এই উচ্চ শ্রেণির শাসন অন্য নানা ভাবেই দেশ জুড়ে আছে। আমাদের তো উচিত সংসদ সদস্য বা রাজনীতিবিদদের রাজনৈতিক অজ্ঞানতার সুযোগ যাতে কেউ না নিতে পারে, সে দিকটা দেখা। আর সব শ্রেণির মানুষের প্রতিনিধিত্ব যেন থাকে, সে দিকে লক্ষ রাখা। দেশ গঠনের কাজ এতেই শেষ হবে, এমন কথা কেউ বলবে না। কিন্তু এটা না হলে সে সম্ভাবনাও মারা যাবে। অরাজনৈতিক নাগরিক সমাজ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রেশার গ্রুপ রূপে কাজ করেন। তাদের গুরুত্ব সেখানে।
সবচেয়ে বড় কথা, ভীরুতা-স্বার্থপরতা, সুবিধাবাদিতায় আচ্ছন্ন আমাদের নাগরিক সমাজে তেমন কেজরিওয়ালকে আমরা কোথায় খুঁজে পাব?