Published : 28 Jan 2020, 12:44 PM
আমাদের এই ছোট্ট রাজধানী শহরটি আর যে আমাদের ভার বহন করে উঠতে পারছে না এ কথা নতুন করে বলার কোনো দরকার পড়ে না। সকলেই প্রতি মূহুর্তে উপলব্ধি করছি। কারোর যে খুব বেশি কিছু করার আছে তাও মনে হয় না। সরকার নিরবিচ্ছিন্নভাবে এক ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কোনোমতে শহরকে সচল রাখার জন্য। কারণ, সত্যিকার অর্থে বসবাসযোগ্য করার কোনো পথ হাতে আছে বলে কেউ মনে করেন না। বরং প্রতিদিন যে জনস্রোতের ঢল শহরে ঢোকে তা হিসেব করে চোখে অন্ধকার দেখা ছাড়া কোনো পথ নেই।
তারপরেও এটাই আমাদের নিয়তি, এটাই আমাদের প্রিয় শহর। এখানেই আমাদের বাস করতে হবে। এখানেই রুটি-রুজি, এমনকি চিকিৎসা-শিক্ষাও। তাই যার যার ক্ষেত্রে যতটা পারা যায় দায়িত্বশীল হয়ে অন্যের সুবিধা-অসুবিধাকে বিবেচনায় নিয়ে কাজ করে যতটুকু সুস্থভাবে বাস করা যায় সেটাই চেষ্টা করা ছাড়া পথ কি? কেউ ইচ্ছে করলেই আমরা সকালের একটা নির্মল বাতাস এই শহরের আকাশে প্রবেশ করাতে পারব না, ইচ্ছে করলেই কারো সন্তান একটা সবুজ মাঠ পাবে না, যেখানে সে ভোঁ একটা দৌড় দিতে পারবে। বরং এক চিলতে যে পার্ক আছে সেখানে বসলে দেখতে হয় সবুজের মৃত্যু-উৎসব। প্রতিদিন যেন সবুজগুলো প্রশান্ত মহাসাগরের একশ্রেণির তিমিদের মত হারিকিরি করছে। আমরা কেউ ভাবছি না এই সবুজগুলোর মৃত্যুর জন্য আমিও দায়ী। এক বিন্দুর জন্যে হলেও দায় আমাদের প্রত্যেকের ঘাড়ে আছে। তারপরেও স্রষ্টাকে ধন্যবাদ দিতে হয় ব্যাংক দখলের মত করে কোনো ডেভেলপার কোম্পানি এখনো যে রাজধানীর পার্কগুলো দখল করে বহুতল ভবনের ছাদে একটি পার্ক বানিয়ে দেয়নি এটাই আমাদের ভাগ্য। দুর্ভাগ্যের আরো কিছু বিষয় আছে এই পার্ক ঘিরে। ১৯৯১-এ দেশ গণতন্ত্রে ফেরার পর থেকে রাজধানীর পার্ক, উদ্যানগুলোকে যেন মরণ দশায় ধরেছে। এ পর্যন্ত অনেক মেয়র এলেন-গেলেন। রাজধানীর মূল পার্ক রমনা পার্কটি কেবল বুড়িয়েই যাচ্ছে। ব্রিটিশ আমলের গাছগুলো মারা যাচ্ছে অথচ গণতন্ত্রীদের হাত দিয়ে সবুজ চারা সেখানে পোঁতা হচ্ছে না। মেয়রদের এই উদাসীনতা সাধারণ মানুষকেও মেয়রশিপের প্রতি উদাসীন করে তুলেছে। নগরপিতা, নগরের চাবি এসব সম্মানের বিষয়গুলো কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।
গত প্রায় এক মাস ধরে মেয়র নির্বাচনের প্রচার চলছে। মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত (দলীয় কট্টর নেতাকর্মী ছাড়া) কাউকেই মেয়র নির্বাচনের প্রচারের মিছিলে দেখিনি। বেশিরভাগ মিছিলেই বস্তির লোকজন। বস্তির মানুষ বলে তাদেরকেই হেলা করার কোনো কারণ নেই–তবে এই সত্য মানতে হবে, যারা বস্তিতে বাস করেন তারা গ্রাম থেকে এসেছেন, গ্রামে ফিরে যেতে চান। আর যাই হোক তারা নগরের নাগরিক নন। তারা নগরকে ভালোবাসতে ও ভালো রাখতে এখনো শেখেননি। কথাটা কিছুটা নির্মম হলেও সত্য। আর নগর বিনির্মাণের জন্য ও নাগরিক জীবন বিনির্মাণের জন্য এ সত্যকে স্বীকার করতেই হবে। তাছাড়া এই মানুষগুলোর কিন্তু নগর পিতাদের কাছে খুব বেশি নাগরিক চাহিদাও নেই। তারা একটু পানি-বিদ্যুৎ পাওয়া আর তাদের বস্তি জ্বালিয়ে দেয়া হবে না এ নিশ্চয়তাটুকু পেলেই খুশি। এরাই এখন মেয়র নির্বাচনের মূল নিয়ামক বলে মনে হচ্ছে। খুব বড় পরিসরে আশা রেখে বলা যায়, আমাদের মেয়ররা যদি ভবিষ্যতে এদেরকে নগরের নাগরিক করে গড়ে তুলতে পারেন তাহলে এটাই প্রমাণিত হবে এসব মেয়রদের যোগ্যতার ভেতর একটা আলাদিনের প্রদীপও রয়েছে।
তবে নির্বাচনী প্রচার যদি এরকম দু'চারটি মিছিল ও কয়েকটি ছোট ছোট পথসভার ভেতর সীমাবদ্ধ থাকত তাহলে মানুষ অন্তত হাফ ছেড়ে বাঁচত। নির্বাচন তাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি কাজের ক্ষেত্রেই একটি যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়াত না। এই রাজধানী শহরের প্রায় কোনো ভবনই সাউন্ডপ্রুফ নয়। যতই নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে ততই প্রতিটি রাস্তায় রিক্সা বা ট্রাকে মাইক বেধে 'অমুক ভাইকে ভোট দিন, তমুক বোনকে ভোট দিন' এই চিৎকার সমানে চলছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো কোনো কোনো এলাকায় রাত বারোটার পরেও এই মাইক বেজে চলেছে। যে অলিতে-গলিতে এই মাইক উচ্চস্বরে শব্দ তুলছে তার দু'পাশেই ছাত্র-ছাত্রী আছে; তাদের প্রতিদিনের পড়াশুনো আছে, কারো কারো সামনে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা–আরো আছেন বয়ঃবৃদ্ধ মানুষ, শিশু, ব্লাড প্রেসারের রোগী, হার্টের রোগী, নার্ভ পেইনের রোগী ও কিছুটা মানসিক সমস্যায় ভোগা রোগী। প্রথমেই যে ছাত্র-ছাত্রীদের কথা বলেছি তাদের পড়াশুনোর ক্ষেত্রে এই শব্দ যে কতখানি ক্ষতি করে তা আর কেউ না হলেও অন্তত চার শিক্ষিত মেয়র প্রার্থী ভালোভাবেই বোঝেন। আর যে রোগীদের কথা উল্লেখ করেছি এদের জন্য ঘুম কতটা দরকার তা বোঝার জন্য কারোর চিকিৎসক হওয়ার প্রয়োজন নেই।
কিন্তু এই নির্বাচন ঘিরে এটাই চলছে। এমনিতেই যারা ঢাকায় বাস করেন শব্দ দূষণে তাদের অবস্থা নাকাল। তারপরেও নগরপিতা আসবেন বলে যদি শহর জুড়ে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত এমনি শিঙ্গা বাজানো হয় তাহলেতো নাগরিকদের প্রাণ ওষ্ঠাগতই হবে। বাস্তবে হচ্ছেও তাই। মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা না হয় জয়-পরাজয়ের মাদকতায় বুদ হয়ে আছেন কিন্তু যে সমস্ত রাজনৈতিক দল থেকে এই নির্বাচন করা হচ্ছে সেখানে কি কারোরই কানকে এই শব্দ বোমা আঘাত করছে না? কারো কি একবারের জন্যও মনে হচ্ছে না, এরা আসবে বলেই যদি নগরের নাগরিকদেরকে এতটা যন্ত্রণা দেয় তাহলে এরা নগরপিতা হলে নাগরিকদের অবস্থা কি হবে? তবে এ নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কারণ, এ যাবৎকাল যত মেয়রই এসেছেন এবং গেছেন তাদের ভেতর দুই-একজন ছাড়া নাগরিকদের কথা ভেবেছেন খুব কমই। তাই নির্বাচনের প্রচারকে এত যন্ত্রণাকর করে তোলার পরও নাগরিকদের খুব কোনো অভিযোগ নেই। যাদের কাছে প্রত্যাশা কম তাদের কাজে মানুষ বিরক্ত হয় খুবই কম। মানুষ বিরক্ত হয় যদি আপনজন তার ক্ষতির কারণ হয় তখনই।
এই শব্দ দূষণের পর মানুষের চোখে পড়ছে পোস্টার জঙ্গল। এর এক অংশ নিয়ে (পলিথিনের পোস্টার) কোর্ট ইতিমধ্যেই নির্দেশনা দিয়েছে। তাই এ নিয়ে খুব বেশি কিছু বলার নেই। শুধু এটুকুই বলা যায় এই পোস্টারের জঙ্গল তৈরি করে নগরকে অপরিচ্ছন্ন করা আর অর্থের অপচয় করা কি একান্তই দরকার ছিল?
মেয়র নির্বাচনের প্রচারে এই যা ঘটে গেল নির্বাচন কমিশন নিশ্চয়ই তা উপলব্ধি করতে পেরেছে। ভবিষ্যতে নির্বাচনী আচরণবিধি তৈরির ক্ষেত্রে এগুলো গুরুত্বে নিয়ে মানুষকে এর হাত থেকে মুক্তি দেবেন এটাও কিন্তু এখন নির্বাচনের থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। নির্বাচন কমিশনকে সে কাজটি করতে হবে। পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতাদেরও বালিতে মুখ গুজে উটপাখি হবার সময় আর নেই। মানুষের যন্ত্রনা, সুখ-দুঃখ তাদেরকে উপলব্দি করতে হবে। নির্বাচনী পদ্ধতি গোটা পৃথিবী জুড়ে বদলে গেছে ঠিকই। কতদিন এ অবস্থা থাকবে কেউ জানে না। তবে মানুষের স্বস্তি নিশ্চিত করতে হবে, তা নাহলে রাজনীতি টিকবে না। নগর পিতাদের মত রাজনীতিও মানুষের আগ্রহের বাইরে চলে যাবে।