Published : 12 Jan 2020, 06:07 PM
১০ জানুয়ারি ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ দিবাগত রাত (২৬ শে মার্চ) বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার খবরটুকু ছাড়া বাঙালি বা গোটা দুনিয়ার কাছে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কোন খবরই ছিল না। এই অন্ধকারাচ্ছন্ন সময় ছিল ১৯৭১ সালের অগাস্ট অবধি।
দুনিয়ার কূটনীতি, গণমাধ্যম, রাষ্ট্রযন্ত্র কারো কাছেই কোন খবর ছিল না- বঙ্গবন্ধু কোথায়? তিনি কি বেঁচে আছেন? তিনি কি কারাগারে? কোথায় সে কারাগার? তাঁকে কি মেরে ফেলা হয়েছে? না! এরকমটা কেউ ভাবতে চায়নি, কল্পনাও করতে চায়নি।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সময় জাতিসংঘের মহাসচিব ছিলেন বার্মার কূটনীতিক উ থান্ট। এই নামটি প্রথম শুনেছিলাম মধুপুর শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ে আমাদের সকলের প্রিয় ইতিহাসের শিক্ষক আনোয়ার হোসেন স্যারের কাছে। এই স্মৃতি আজও মনের মাঝে রয়ে গেছে।
গত বছর জুলাই মাসে উ থান্টের দেশ বার্মা ভ্রমণের সুযোগ হল লেখকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন পেন এর মায়ানমার কেন্দ্রের আমন্ত্রণে। আমার মনের মধ্যে রয়ে গেছেন অন্য অনেক গল্পের সঙ্গে উ থান্ট মহোদয়। রেঙ্গুনে অবস্থানকালে একদিন বের হলাম দুইজন সহকর্মী কবিকে সঙ্গে নিয়ে উ থান্ট জাদুঘর পরিদর্শনে।
এই জাদুঘর পরিদর্শনে ব্যক্তি উ থান্ট এর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে জানব। একই সঙ্গে আমার মনের মাঝে খানিকটা চাপা উত্তেজনা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তার ভূমিকা সম্পর্কে বিশদ করে জানার সুযোগ পাব।
এই পর্যায়ে উ থান্ট এর ভাগ্য আর উ থান্ট জাদুঘর সম্পর্কে দুই একটা কথা বলে নিতে চাই। উ থান্ট ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘের দুই মেয়াদের মহাসচিব থাকার পর তৃতীয় মেয়াদে মহাসচিব হতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তার শরীর স্বাস্থ্য ভাল যাচ্ছিল না। শেষতক তিনি ১৯৭৪ সালে ফুসফুসে কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে নিউ ইয়র্কে মারা যান। তার ইচ্ছা অনুযায়ী তার মৃতদেহ রেঙ্গুনে ফেরত আনা হয়। ওই সময় সামরিক জান্তা নিয়ন্ত্রিত সরকার উ থান্ট এর সম্মানে রাষ্ট্রীয় কোন আনুষ্ঠানিকতা দেখায়নি। তবে রেঙ্গুনের হাজার হাজার জনতা উ থান্টের শেষ যাত্রায় শ্রদ্ধা নিবেদন করে। তারপর ২০১২ সাল পর্যন্ত উ থান্ট বিষয়ে রেঙ্গুনে তেমন কোন উচ্চবাচ্য হয়নি। ২০১০ এবং ২০১৫ সালে নির্বাচন হয় বটে। সামরিক জান্তার শাসনব্যবস্থার কিছুটা লেবাসী সংস্করণ হয়। সুচি সামরিক নিয়ন্ত্রিত সরকারের বেসামরিক প্রধান হন।
২০১৬ সালে উ থান্ট জাদুঘরের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ নেন উ থান্টের দৌহিত্র ইতিহাসের অধ্যাপক থান্ট মিন্ট-উ। এই জাদুঘরে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সরকারের পক্ষ থেকে কোন প্রতিনিধি আসেনি। সুচি এই জাদুঘর পরিদর্শন করতে আসতে চেয়ে শেষ মুহুর্তে বাতিল করেছেন। অথচ সুচির বাবা অং সান ছিলেন উ থান্টের বন্ধু। সুচি তার তারুণ্যে উ থান্টের সঙ্গে জাতিসংঘে শিক্ষানবীশী হিসেবে কাজ করেছেন।
উ থান্টের ভাগ্যের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ভাগ্যের কিছুটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ১৯৭৫ এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে সামরিক জান্তার আমলে ইতিহাসের নায়ক মহানায়কদের তুলে ধরার পরিবর্তে আড়ালে রাখার একটা প্রবণতা ছিল। এই প্রবণতার কবলে আমাদের বঙ্গবন্ধু যেমন পড়েছেন, তেমনি উ থান্টও; এমনকি আজও।
উ থান্ট ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চেই জাতিসংঘের কলকাতা দপ্তর মারফত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার খবর পেয়ে যান। একই সঙ্গে বাংলাদেশে হতাহতের খবরও পান। তিনি তার অবস্থান থেকে জাতিসংঘে বাংলাদেশ বিষয়ে একটা আলোচনার তৎপরতা শুরু করেন। পাকিস্তান ও ভারতের বিরোধিতার কারণে পেরে উঠেন না। কারণ বিবদমান দুটি পক্ষের কোন একটি পক্ষের যদি সায় না থাকে উ থান্টের অবস্থান থেকে কোন আলোচনার উদ্যোগ নেবার এখতিয়ার থাকে না। তিনি দৃশ্যত আনুষ্ঠানিক উদ্যোগে একটু ভাটা দিলেন ঠিকই, তবে তিনি তার ব্যক্তিগত যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে অনানুষ্ঠানিক নানা তৎপরতা শুরু করলেন। তার উদ্বেগ ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবন নিয়ে। তিনি মনে করতেন বঙ্গবন্ধুকে বাঁচিয়ে রাখাটা জরুরি। কেননা বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া বিবদমান এই যুদ্ধের শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব না।
মুক্তিযুদ্ধের এই নয় মাসে তার নেয়া উল্লেখযোগ্য উদ্যোগের একটি ছিল তিনি মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী টুংকু আবদুর রহমানকে অনুরোধ করলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে যোগাযোগ করে বাংলাদেশের বিষয়ে একটা ইতিবাচক সমাধানে পৌঁছাতে। এখানে উল্লেখ্য যে, ইয়াহিয়া খান এবং এমনকি ইন্দিরা গান্ধীর বাবা জওহরলাল নেহেরুর সঙ্গে টুংকুর আন্তরিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ যোগাযোগ ছিল। টুংকু তার যথাসাধ্য চেষ্টা করলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদশে সফরের উদ্যোগও নিলেন। শেষতক ভারতের অনাগ্রহে তা আর হয়ে উঠল না। পরে তিনি উ থান্টকে বিস্তারিত জানালেন। টুংকু রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়ার বরাবরে বঙ্গবন্ধুর জীবনের নিরাপত্তার অনুরোধ জানিয়ে পত্রও লিখেছিলেন। উ থান্টও রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া মারফত বঙ্গবন্ধুর জীবনের ব্যাপারে উদ্বেগ জানিয়ে কয়েকবার পত্র লিখেন।
ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুর ব্যাপারে মোটামুটি মুখে কুলুপ এঁটে থাকতেন। কোন খবরই সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছিল না। এরকম অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর খবর জানার জন্যে উ থান্ট দুনিয়ার নানা ভাষার সংবাদমাধ্যমও ঘাঁটাঘাঁটি করতেন। এমন অবস্থায় লা ফিগুরা পত্রিকার সাংবাদিক পিয়েরে বরিস জেনারেল ইয়াহিয়ার একটি সাক্ষাৎকার নেন। এটি ১৯৭১ সালের ২সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্ক টাইমসে ছাপা হয়। এই সাক্ষাৎকারের একটা জায়গায় বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন আর উত্তর রয়েছে। এই অংশটুকু উ থান্ট তার স্মৃতিকথা 'জাতিসংঘের ভাবনা' (View from the UN) গ্রন্থে 'বাংলাদেশের জন্ম' (The Birth of Bangladesh) শীর্ষক প্রবন্ধে তুলে ধরেছেন:
প্রশ্ন: কিন্তু অতীতে আপনি শেখ মুজিব বিষয়ে কথা বলেছেন? তাঁর কি হয়েছে?
উত্তর: তিনি জেলে।
প্রশ্ন: কোথায়?
উত্তর: আমার ধারণা নাই। আপনাদের রাষ্ট্রপতি কী জানেন কোথায় দেশের সকল অপরাধীরা?
প্রশ্ন: কিন্তু তিনি সর্বতো আপনার প্রধান শত্রু।
উত্তর: তিনি আমার ব্যক্তিগত শত্রু নন। তিনি পাকিস্তানি জনগণের শত্রু। চিন্তা করবেন না পাকিস্তানের সকলেই জানে তিনি কোথায়। কিন্তু এটা তাদেরকে জিজ্ঞেস করা অবান্তর। তারা কেউ জবাব দেবে না।
প্রশ্ন: কিন্তু আন্তর্জাতিক জনমত?
উত্তর: আমার নিজের যথেষ্ঠ ন্যায়বোধ আছে। আমি বলেছিলাম যে তিনি জীবিত, আমার কথাটাই বিবেচনায় নিতে হবে।
হ্যা, বঙ্গবন্ধু জীবিত ছিলেন। তিনি ফিরে এলেন ১৯৭২ সালের এই দিনে বাঙালি জাতির মহাকাব্যিক নায়ক হয়ে কেবল নয়, সাম্রাজ্য-উত্তর আন্তর্জাতিক ইতিহাসের একজন মুক্তির দূত হিসেবে।
উ থান্ট এর উদ্বেগ আর উদ্যোগ দুটোই যথার্থ ছিল বঙ্গবন্ধুর মত একজন নেতার ভাগ্য নিয়ে। আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক ইতিহাসে উ থান্ট আর বঙ্গবন্ধু দুজনেই আজ স্মরণীয়। ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের এই দিনে তাই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে উ থান্টকেও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। বাস্তবে ওনাদের দুজনের দেখা হয়নি।