Published : 29 Aug 2019, 07:56 PM
প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে পৌরাণিক ভারতবর্ষে বিভিন্ন সময়ে নৃতাত্ত্বিক বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণ-জাতিসত্তার উদ্ভব ঘটে। তবে জাতিগতভাবে এ ভূঅঞ্চলের প্রথম জনগোষ্ঠী 'হিন্দু' বলে পরিচিত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৫২৮ সালে বৌদ্ধ ধর্মের আর্বিভাবের ফলে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এবং ৭১২ খ্রিস্টাব্দে মুসলমানদের আগমনের পর ভারতবর্ষের ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে সংখ্যায় কম হলেও ভারতবর্ষে শিখ, জৈন, পার্সি প্রভৃতি ধর্মের জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব দেখা যায়। বিংশ শতাব্দীতে এসে ভারতবর্ষে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, শিখ, জৈন, পার্সি প্রভৃতি সব ধর্মের কমবেশি জনগোষ্ঠীর সহাবস্থান থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন সময় ধর্মেধর্মে সংঘাতও দেখা যায়।
১৮৩৫ সালে ভারতবর্ষে ইংরেজিসহ আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলন হলে ইতিহাস, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাষ্ট্রনীতি, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে ভারতীয়দের জ্ঞানের দুয়ার খুলে যায়। ফলে ক্রমান্বয়ে তাদের মধ্যে স্বাধীনতার বাসনা জাগ্রত হতে থাকে। এ লক্ষ্যে ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিপ্লব সংঘটনোত্তর ১৮৮৫ সালে 'ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস' ও ১৯০৬ সালে 'সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ' প্রতিষ্ঠা লাভের মধ্য দিয়ে ভিন্ন ধারার দু'টি রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড শুরু হয়।
তৎকালীন ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চল ব্রিটিশদের জন্য রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে সবচেয়ে বিপদসংকুল ছিল। তাই তারা 'ডিভাইড অ্যান্ড রুল' কূটবুদ্ধিতে ১৯০৫ 'পূর্ববঙ্গ ও আসাম' প্রদেশ গঠনের মধ্য দিয়ে বঙ্গভঙ্গ করলে ওই সময় এখানে মোট জনসংখ্যায় ৫৯ দশমিক ৫ শতাংশ মুসলমান এবং ৩৯ দশমিক ৫শতাংশ হিন্দু অধিবাসী বিদ্যমান দেখা যায়। মূলত বঙ্গভঙ্গের কারণেই জনসংখ্যার হিসাবে এখানে হিন্দুরা সংখ্যাঘলুতে পরিণত হয়ে যায় বটে, কিন্তু অবিভক্ত বঙ্গে বরাবরই হিন্দুসংখ্যাধিক্য বিরাজমান ছিল।
হিন্দুরামূলত বঙ্গভঙ্গ প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই এর বিরোধিতা করে আসছিল। বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হওয়ারদিন থেকে তৎকালীন সমগ্র পূর্ব ভারতজুড়ে প্রচণ্ড রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। ফলশ্রুতিতে১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর বৃটিশরা পুনরায় দুই বঙ্গ একত্রিত করতে বাধ্য হয়। এভাবে বঙ্গভঙ্গরদের কারণে হিন্দুদের আত্মতৃপ্তি ঘটলেও, মসুলমানরা হতাশ এবং ক্ষোভ প্রকাশ করে। বঙ্গভঙ্গ,বঙ্গভঙ্গ রদ, আলাদা নির্বাচন ব্যবস্থা প্রচলন ইত্যাদি কারণে এ অঞ্চলের হিন্দু ও মুসলমানদেরমধ্যে ভেদরেখা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে থাকে।
বঙ্গভঙ্গরদের কারণে সে সময়ে অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া মুসলমান জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলেতাদের মধ্যে সৃষ্ট ক্ষোভ প্রশমনে ইংরেজ শাসকরা ১৯২১ সালের ২১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়স্থাপন করে। এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবাসগুলোরধর্মীয় সম্প্রদায়ভিত্তিক আবাসিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারিত হয়।
কেবলমাত্র বঙ্গ প্রদেশেই নয়, হিন্দু এবং মুসলমানদের ভেদাভেদের বিষয়গুলো কমবেশি সারা ভারতবর্ষজুড়েই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে থাকার মধ্য দিয়েই উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন চলতে থাকে। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে দেশে প্রত্যাবর্তন করে কংগ্রেস দলীয় নেতৃত্বে আসীন হয়ে অহিংস পন্থায় বর্ণবিদ্বেষ বিরোধী ও অসম্প্রায়িক ধারার রাজনীতি প্রবর্তনের মাধ্যমে অখণ্ড ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু করেন। প্রায় সমসাময়িককালে বিলেত থেকে ফিরে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ও হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের মাধ্যমে অখণ্ড ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে কংগ্রেসের পতাকাতলেই রাজনীতি শুরু করেন। এরই এক পর্যায়ে ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের সম্মেলনে 'দ্বি-জাতি তত্ত্বের' ভিত্তিতে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক মুসলমানদের জন্য একাধিক স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব উত্থাপন করেন। আশ্চর্য হলেও সত্য, উক্ত প্রস্তাব উত্থাপনকালে অসাম্প্রদায়িক এবং অখণ্ড ভারতবর্ষের অন্যতম প্রবক্তা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ সভাপতিত্ব করেন।
উল্লেখ্য, হিন্দু এবং মুসলমানদের ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে তাদেরকে 'হিন্দু জাতি'এবং'মুসলমান জাতি' আখ্যায়িত করে এক অদ্ভুত দ্বি-জাতি তত্ত্ব আবিষ্কার করা হয়। ফলে হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে বিদ্বেষ নতুন মাত্রা পাওয়ার জের ধরে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়। সেসবের মধ্যে জিন্নাহ-র ডাকে পাকিস্তান বাস্তবায়নের দাবিতে তথাকথিত প্রত্যক্ষ সংগ্রাম-এর নামে ১৯৪৬ সালের অগাস্ট মাসে 'গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং' এবং একই বছর অক্টোবর মাসে 'নোয়াখালির রায়ট' সবচেয়ে ভয়াবহ ও বিভৎস রূপ ধারণ করে। এসব সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হাজার-হাজার মানুষ নিহত এবং লাখ-লাখ মানুষ সর্বস্ব হারান।
এভাবে দাঙ্গা-হাঙ্গামার মধ্য দিয়ে ১৯৪৭ সালের ১৪ এবং ১৫ অগাস্ট ভারতবর্ষ বিভাজিত স্বাধীনতালাভ করে। ভারত ভাগ করে মূল 'ভারত' নামে একটি এবং নতুন 'পাকিস্তান' নামের আরেকটি অদ্ভুত রাষ্ট্র বানিয়ে স্বাধীনতা দেয়া হয়। এই অপরিপক্ক রাষ্ট্র জন্মদানের প্রসব বেদনায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ভারতবর্ষে, বিশেষত বাংলা এবং পাঞ্জাব ভাগ হয়ে যাবার ফলে এ দু'টি অঞ্চলজুড়ে হিন্দু-মুসলমান-শিখ দাঙ্গায় প্রায় ৫ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে এবং সব মিলিয়ে প্রায় সোয়া কোটি মানুষের দেশান্তর ঘটে- যা বিশ্বের সমসাময়িক ইতিহাসে বিরল নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি ও নৃশংসতার দৃষ্টান্ত হিসেবে চিহ্ণিত হয়ে রয়েছে।
অদ্ভুত 'দ্বি-জাতি'তত্ত্বের কুফসলে সৃষ্ট আস্বাভাবিক রাষ্ট্র পাকিস্তানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা, যাদের মধ্যে প্রায় ৯৯ শতাংশই হিন্দু, সবাই রাতারাতি আপনাআপনি নিজ আবাসভূমে অবাঞ্ছিত বনে যায়। কারণ ধর্মভিত্তিক ওই তত্ত্বের একমাত্র ব্যাখ্যা হচ্ছে- পাকিস্তান কেবলমাত্র মুসলমানদের জন্য সৃষ্ট একটি রাষ্ট্র। ফলে ১৯৪৭ সালের ১৪ অগাস্ট থেকে নিমিষেই অন্যান্য জাতি-ধর্মের বিশাল জনগোষ্ঠী নিজভূমে পরবাসী হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে লক্ষ-লক্ষ সংখ্যালঘু দেশান্তরিত হতে শুরু করে। আর যারা চৌদ্দ পুরুষের ভিটেমাটির মায়া কাটিয়ে দেশান্তরিত হতে চায়নি, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তাদেরকে জোরপূর্রক বিতারণের পর্ব শুরু হয়।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর শুধু হামলা করেই নয়, তাদেরকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করার মহাপরিকল্পনা নিয়ে পাকিস্তান সরকার ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ চলাকালীন Enemy Property (Custody and Regulation) Order II of 1965 এবং ওই আদেশকে পাকাপোক্ত করতে ১৯৬৬ সালে East Pakistan Enemy Property (Lands and Building) Administration and Disposal Order of 1966 জারি করে। পাকিস্তান আমলে 'শত্রু সম্পত্তি আইন' এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী 'অর্পিত সম্পত্তি আইন' বলে পরিচিত কুখ্যাত এই আইনের যাতাকলে পড়ে হাবুডাবু খায় বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি হিন্দু পরিবার, অনেকে সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসে যায়, দেশান্তরিত হয়।
সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীসমূহের অপকর্মকাণ্ডের বিপরীতে '৫২, '৬২, '৬৬, '৬৭, '৬৯ ও '৭০-এর বিভিন্ন পর্যায়ে আন্দোলন-সংগ্রাম ও নির্বাচন এবং সর্বোপরি বাঙালি জাতির অবিসম্বাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রগতিশীল শক্তিসমূহের সকল আন্দোলন-সংগ্রাম ছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং আদর্শপুষ্ট। এই ভূখণ্ডের অধিবাসীরা সবকিছু ছাপিয়ে 'বাঙালি- এই অমোঘ সত্য প্রকাশের সুযোগ তারা নিখুঁতভাবে একবারই পেয়েছে, ১৯৭১ সালে। 'বাঙালি' জাতিসত্তা এবং জাতীয়তাবোধই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এ ভূখণ্ডের মানবগোষ্ঠীকে মুক্তির নেশায় অকুতোভয় করে তোলে। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও ধর্মভিত্তিক একক সম্প্রদায় হিসেবে হিন্দুরাই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসরদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।
মুক্তিযুদ্ধে আত্মাহুতিদানকারী, নারীর সম্ভ্রম ও সহায়-সম্পদ হারানো এবং শরণার্থীদের মধ্যে সংখ্যানুপাতিক হারে এ দেশের হিন্দু জনগোষ্ঠীই একক সম্প্রদায় হিসেবে সবচেয়ে বেশি। অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ফলে শরণার্থী প্রতিটি হিন্দু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে। জন্মগত বৈশিষ্ট্যের কারণে এ ভূখণ্ডে আর কোনদিনও তাদের ওপর সাম্প্রদায়িক কালো থাবা পড়বে না বলে তাদের আশা থাকলেও বছর না ঘুরতেই ১৯৭২ সালের দুর্গাপূজার সময় সাম্প্রদায়িক অপশক্তি দেশের বিভিন্ন স্থানে একযোগে পূজামণ্ডপ এবং মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুর করে। তারপরও অন্তত তিন বছর পর্যন্ত এ দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা হতাশ হননি। কারণ অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল আদর্শের স্রষ্টা, ধারক ও বাহক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার সহকর্মীরা স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য একটি অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল সংবিধান প্রণয়ন করেন। এতে করে ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী এদেশে তাদের নিরাপত্তার ভরসা এবং আস্থার স্থলটি খুঁজে পেয়েছিলেন বটে, কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু'র নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তাদের সেই আস্থাস্থলের যবনিকা ঘটে।
মূলত জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি ভাবধারায় বাংলাদেশকে পরিচালনা করা শুরু হয়। সামরিকচক্রের সহায়তায় রাষ্ট্রপতির নামে একাধিক অধ্যাদেশ জারি, সামরিক ফরমান এবং ১৯৭৯ সালে পঞ্চম ও ১৯৮৮ সালে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশে পাকিস্তানের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পুনর্বহাল করা হয়। অসাম্প্রদায়িক এবং ধর্মনিরপেক্ষ এই দেশটিকে সাংবিধানিকভাবে একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়। ফলে নতুন করে প্রজাতন্ত্রের ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে।
১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনের পর ভোলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক হামলার ফলে তখন থেকে নব পর্যায়ে হিন্দুদের দেশত্যাগ শুরু হয়। বিগত নব্বই দশকের প্রথম দিকে ভারতের বাবরি মসজিদে হামলা এবং তা ধ্বংসের জের ধরে বাংলাদেশের হিন্দুদের উপর সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী কর্তৃক হামলা, অত্যাচার ও নির্যাতন হয়। ফলে পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা দেশত্যাগ করে। এরপর ১৯৯৬ সালের জুন মাস থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত র্সংখ্যালঘুদের তেমন দেশত্যাগ ঘটেনি। তবে ২০০১ সালের ১ অক্টোবর নির্বাচনে বিজয়ী বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের নেতা-কর্মীরা সংখ্যালঘুদের উপর সর্বৈব অত্যাচার, নির্যাতন ও নিপীড়ণ পরিচালনা করে। এসব নারকীয় ঘটনাবলী বন্ধে কোনো প্রকার পদক্ষেপ না নেওয়ার ফলে আস্কারা পেয়ে তৎকালীন চারদলীয় জোটের নেতা-কর্মীরা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর টানা পাঁচ বছর অত্যাচার, নির্যাতন ও হালমা অব্যাহত রাখে। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা ঘোষিত হলে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের মাত্রা কিছুটা হ্রাস পায়। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠন করলে তাদের উপর নির্যাতন সাময়িকভাবে বন্ধ হলেও তা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। দল-বেদলের ধর্মীয় মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তি অল্প কিছুদিনের মধ্যেই নানা অজুহাত ও কৌশলে সংখ্যালঘুদের উপর হামলা শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দলের নেৃতত্বে সরকার পরিচালিত হলেও সংখ্যালঘুরা হামলা থেকে রেহাই পায়নি। দেশের সকল প্রান্তে রয়ে-রয়ে সকল ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীই কমবেশি হামলার শিকার হয়েছে। ২০১১ ও ২০১২ সালের বিভিন্ন সময়ে চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হিন্দুদের উপর নানা প্রকার হামলা হয়। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরাও হামলা থেকে রেহাই পায়নি। ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি অন্যতম যুদ্ধাপরাধী দুর্ধর্ষ ও কুখ্যাত দেইল্যা রাজাকারের ফাঁসির রায় ঘোষিত হওয়ার পর সংখ্যালঘুদের উপর দেশব্যাপী একযোগে সবচেয়ে বড় হামলা হয়। এ সময় প্রায় প্রতিদিন দেশের কোনো না কোনো স্থানে তাদের উপর হামলা চলে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনরত বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন জোট বিভিন্ন কর্মসূচি পালনকালে তাদের উগ্র এবং সন্ত্রাসী কর্মীবাহিনী সংখ্যালঘুদের উপর হামলে পড়ে।
পাবনার সাঁথিয়াসহ দেশের কোথাও-কোথাও আবার সরকার সমর্থক সন্ত্রাসীরাও এ ধরনের হামলা পরিচালনা করে। ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের আন্দোলনের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে-সাথে তাদের জঙ্গি কর্মীবাহিনী কর্তৃক সংখ্যালঘুদের উপর হামলার মাত্রাও বৃদ্ধি পায়। ১২ ডিসেম্বর অন্যতম যুদ্ধাপরাধী মিরপুরের কসাই নামে কুখ্যাত কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর হলে জঙ্গিদের হামলার মাত্রা তীব্রতর হয়। দেশের বিভিন্নস্থানে যৌথবাহিনী অভিযান চালিয়ে এবং নির্বাচনকালীন স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে সেনাবাহিনী মাঠে থাকা সত্ত্বেও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনের সময় এবং আগে ও পরে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর হামলা বন্ধ করা যায়নি। সকল পক্ষেরই সাধারণ লক্ষ্যবস্তু ছিল সংখ্যালঘুরা। নির্বাচনের আগে থেকেই যে আশঙ্কা করা হয়েছিল- দিনাজপুর ও যশোরসহ সারা দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর ব্যাপক হামলার মাধ্যমে সেই আশঙ্কাই সত্য বলে প্রতীয়মান হয়। এরপর ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসির নগরে ব্যাপকভাবে হিন্দুদের মন্দির ও ঘরবাড়িতে ব্যাপক হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। তাছাড়া প্রায়ই সোস্যাল মিডিয়াতে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা ও বানোয়াট প্রচারণার শিকার হচ্ছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেকেই। অন্যদিকে, পত্রপত্রিকার এবং ইন্টারনেটে বিভিন্ন সময় দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংখ্যাঘলুদের জমিজমা দখল এবং ঘরবাড়ি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগসহ নানা ধরনের অত্যাচার ও নির্যাতনের খবর প্রকাশ হতে দেখা যায়। যদিও বর্তমান সরকার, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সার্বিক তত্ত্বাবধানে অতীতের চেয়ে বর্তমানে দেশে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির অনুকূল পরিবেশ বিরাজ করছে।
অতীত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বৃটিশ আমল থেকে এ ভূখণ্ডের কোথাও না কোথাও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা নানাভাবে নির্যাতিত হয়ে আসছে, তাদের ঘরবাড়ি, ব্যবসা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, নারীদেরকে ধর্ষণ ও জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত ও বিয়ে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা বৈষম্যেরও শিকার হচ্ছে। ফলে তাদের অনেকেই দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছে বিধায় বর্তমানে যে-ভূখণ্ড নিয়ে বাংলাদেশ গঠিত সে-অঞ্চলের মোট জনসংখ্যায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের হার ১৯০১ সালে ৩৩ দশমিক ৯ শতাংশ এবং ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় কমবেশি ২৯ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে নেমে ২০১৯ সালে ১১ দশমিক ৬ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো কর্তৃক প্রকাশিত দলিলাদিসূত্রে জনসংখ্যার হিসাব নিচের সরণিতে দেয়া হলো।
সরণিতে পরিসংখ্যান ব্যুরো কর্তৃক প্রকাশিত ১৯০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত আমদশুমারী এবং ২০১৫ ও ২০১৮ সালের স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইয়ারবুকের উপাত্ত নেয়া হয়েছে।
১৯৪৭ সালে কোনো আদমশুমারি না হওয়ার কারণে তার পূর্বে কাছাকাছি সময়ে পরিচালিত ১৯৪১ সালের আদমশুমারীর জনসংখ্যাকে ভারত বিভক্তির সময়ে প্রমিত জনসংখ্যা বলে ধরে নেয়া যেতে পারে। এতে দেখা যাচ্ছে সংখ্যার বিচারে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা ১৯৪৭ সালের তুলনায় বর্তমানে প্রায় ৬৮ লাখ বেশি হলেও শতকরা হারে প্রায় এক-তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে। তাই বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য যে, সংখ্যালঘুদের মোট জনসংখ্যা কত বৃদ্ধি পেয়েছে তার চেয়ে মুখ্য বিষয় হচ্ছে তাদের শতকরা হার অতিমাত্রায় কমে গেছে। এখানে আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যে, সময়ের পরিক্রমায় পরিবর্তিত ভূ-অঞ্চলগত রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিতে আদমশুমারি, জনমিতি, সংখ্যাতত্ত্ব ও পরিসংখ্যান সম্পর্কে কারো সম্যক ধারণা না থাকলে কোনো জনগোষ্ঠীর মোট জনসংখ্যা ও শতকরা হার নিয়ে বিভ্রাট সৃ্ষ্টি হতে পারে। বিশেষ করে এমন যদি বলা হয়- জনসংখ্যার হার ১৯৪৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত অপরিবর্তিত থাকলে বাংলাদেশে বর্তমানে যত সংখ্যক সংখ্যালঘু রয়েছে তার চেয়ে তাদের সংখ্যা দ্বিগুণ বা তিনগুণ বেশি বা নির্দিষ্টভাবে কোনো সংখ্যা হতো, তাহলে বিষয়টি 'অনুমান' নির্ভর (Hypothetical) হবে।
তাই কোথাও অনুমাননির্ভর হয়ে নির্দিষ্ট করে সংখ্যালঘু হ্রাসের কোনো সংখ্যা উল্লেখ করা মানে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা। বাস্তব অবস্থা হচ্ছে- ১৯৪৭ সালের অগাস্ট মাসের পর হতে এ ভূ-অঞ্চলে সংখ্যালঘু জনসংখ্যার হার হ্রাস পেতে থাকলে সংখ্যাগতভাবে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধির পরিবর্তনও (Variation) নিম্নগামী হতে থাকে। তাই এ বিষয়টি মস্তিষ্কে ধারণ করতে হবে যে, 'অনুমান' ও 'বাস্তব' এক ব্যাপার নয় এবং জনসংখ্যা ও জনসংখ্যার শতকরা হার ভিন্ন জিনিস, বিশেষ করে যেখানে স্বাভাবিক নিয়মে সংখ্যালঘু জনসংখ্যার হার হ্রাস পায়নি বা তাদের বৃদ্ধির পরিবর্তন হয়নি, মূলত তা ঘটেছে রাজনৈতিকি সিদ্ধান্তের কারণে।
বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের শতকরা হার হ্রাস পাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে তাদের দেশত্যাগ করা, যা একদিনে ঘটেনি, বিগত ৭২ বছর ধরে ঘটে চলেছে। এতদ্সত্ত্বেও সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যচ্ছে এ দেশে বর্তমানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সংখ্যা ১ কোটি ৯২ লাখেরও বেশি, যা খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। কারণ, জাতিসংঘের পপুলেশন ডেটাবেইজে দেখা যাচ্ছে বর্তমানে বিশ্বের ১৯৫টি দেশের মধ্যে ১৩৩টি দেশের প্রত্যেকটির জনসংখ্যার চেয়ে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা অধিক।
উপমহাদেশের রাজনৈতিক উথাল-পাথালে ঐতিহাসিকভাবে এবং উত্তরাধিকারসূত্রে বাংলাদেশের বিশাল ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে অনেক সমস্যা বয়ে বেড়াতে হচ্ছে, এটি অস্বীকার করা যাবে না। তাই বাস্তবতার নিরিখে সংখ্যালঘুদের সমস্যাগুলো যথাযথ গুরুত্বসহকারে সমাধানে সরকার, রাজনৈতিক দলসমূহ এবং সুশীল সমাজসহ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।