Published : 22 Aug 2014, 12:30 PM
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর যে সরকার গঠিত হয়েছে, সে সরকার পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকবে নাকি আগাম নির্বাচন দিতে বাধ্য হবে তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং প্রভাবশালী অন্য মন্ত্রীরা বলছেন যে, বর্তমান সরকার পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করার একদিন আগেও ক্ষমতা ছাড়বে না। তাছাড়া বিএনপির সঙ্গে সংলাপ বা আলাপ-আলোচনা করার প্রশ্নেও সরকারপক্ষের অনাগ্রহের কথা জোর দিয়ে বলা হচ্ছে। বলা হয়েছে, যারা জাতীয় শোক দিবসে কেক কেটে আনন্দ-উল্লাস করে তাদের সঙ্গে কোনো সংলাপ নয়। নির্বাচিত সরকার তার পাঁচ বছরের পূর্ণ মেয়াদেই সরকার পরিচালনা করবে।
অন্যদিকে ২০ আগস্ট ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির মিট দ্য রিপোর্টার্স অনুষ্ঠানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সরকার যত কথাই বলুক না কেন, তাদের সংলাপে বসতেই হবে এবং দ্রুত নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে। তিনি আরও বলেছেন, ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। ভোটারবিহীন নির্বাচন করে সরকার যদি মনে করে ২০১৯ সাল পর্যন্ত তারা অবৈধভাবে দেশ পরিচালনা করবে তাহলে তারা ভুলের স্বর্গে বাস করছে।
দু'পক্ষ অব্যাহতভাবে বাগযুদ্ধ চালিয়ে গেলেও ৫ জানুয়ারির নির্বাচন কেন্দ্র করে দেশের রাজনীতিতে যে সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, এখন কিছুটা হলেও সে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক চিত্র দৃশ্যত স্বাভাবিক। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন 'প্রতিহত' করার জন্য বিএনপি-জামায়াত জোট যেভাবে মারমুখী ভূমিকায় নেমেছিল, এখন তারাও আর সে অবস্থায় নেই। বিএনপি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ফিরে আসার কথা বলছে।
জামায়াতও সম্ভবত কৌশলগত কারণে সাময়িকভাবে ঠাণ্ডা নীতিতেই আছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মিট দ্য রিপোর্টার্স অনুষ্ঠানেও বলেছেন, আমরা সহিংস আন্দোলনে বিশ্বাস করি না, শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাস করি। অথচ দেশের মানুষ দেখেছেন, বিএনপি-জামায়াত জোট ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করার জন্য দেশজুড়ে আন্দোলনের নামে কী ভয়ংকর সহিংসতাই না চালিয়েছে। তখন তাদের আন্দোলন শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক হলে তারা সাধারণ মানুষের ব্যাপক সমর্থন লাভ করতেন বলেই মনে করা হয়।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ না করায় নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে দেশের রাজনৈতিক সংকট গভীরতর হবে এবং পরিস্থিতি আরও বেশি উত্তপ্ত হয়ে উঠবে বলে যারা আশঙ্কা করছিলেন, তারাও হয়তো এখন কিছুটা স্বস্তি বোধ করছেন এটা দেখে যে, বিএনপির পক্ষ থেকে ৫ জানুয়ারি-পরবর্তী সরকারকে 'অবৈধ' বলা হলেও এই সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য এখনই কোমর বেঁধে মাঠে নামছেন বলে মনে হচ্ছে না। ঈদের পরে কঠোর আন্দোলনের কথা বলা হলেও বাস্তবে তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
১৭ আগস্ট গাজায় নিরীহ প্যালেস্টাইনি নাগরিকদের ওপর ইসরাইলের বর্বর হামলা এবং ১৯ আগস্ট জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার প্রতিবাদে বিএনপি শান্তিপূর্ণভাবেই মিছিল ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে। ১৯ আগস্ট সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিক্ষোভ সমাবেশে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও অসুস্থতার কারণে শেষ পর্যন্ত তিনি সভাস্থলে হাজির হতে পারেননি। তার এই অনুপস্থিতি নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানা ধরনের জল্পনা-কল্পনাও তৈরি হয়েছে।
দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ওই সমাবেশে বলেছেন, সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না, আঙুল বাঁকা করতে হবে। অবশ্য কবে এবং কীভাবে আঙুল বাঁকা করে ঘি উঠানো হবে সেটা তিনি পরিষ্কার করে বলেননি। পরবর্তী কোনো কর্মসূচির কথাও সমাবেশ থেকে ঘোষণা করা হয়নি। ফলে উপস্থিত কর্মী-সমর্থকরা কিছুটা হতাশা নিয়েই ঘরে ফিরেছেন বলে ধারণা করা যায়।
৫ জানুয়ারি নির্বাচন নিয়ে যত প্রশ্ন ও বিতর্কই থাক না কেন এটাই বাস্তব যে, এই নির্বাচনের পর দেশের রাজনীতির একটি নতুন পর্যায় শুরু হয়েছে। নির্বাচনে কতজন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন, কত শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছেন বা দিতে পেরেছেন, নির্বাচনে জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটেছে কি-না– এ সব নিয়ে একাডেমিক তর্ক-বিতর্ক নিশ্চয়ই চলবে। কিন্তু এই নির্বাচন অগ্রহণযোগ্য বলে বাতিল করে দেওয়ার সুযোগ এখন কারও আছে বলে মনে হয় না। যারা ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের শুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, তারাও এটা বলতে বাধ্য হচ্ছেন যে, দশম সংসদ নির্বাচন 'সাংবিধানিকভাবে সিদ্ধ'। এই নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণ না থাকায় প্রতিনিধিত্বমূলক না হলেও নির্বাচনকে 'অবৈধ' বলার আইনি ভিত্তি নেই।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগসহ অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলো অংশগ্রহণ না করায় ওই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ অত্যন্ত স্বল্পায়ু হয়েছিল। ওই নির্বাচনের ফলাফল এবং পরবর্তী রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া বিবেচনায় রেখে যারা এবারের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে গঠিত দশম জাতীয় সংসদও স্বল্পস্থায়ী হবে বলে আশঙ্কা করছিলেন, তারা নিশ্চয়ই এর মধ্যেই হতাশ হয়েছেন। দশম জাতীয় সংসদের মেয়াদকাল নিয়ে বিতর্ক লক্ষ্য করা গেলেও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক-বিশ্লেষকরা এটাও বলতে পারছেন না যে, এই সংসদ পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারবে না, বরং দুই-তিন বছর যে এই সংসদ অনায়াসেই টিকে যাবে, সেটাই বলা হচ্ছে।
নির্বাচনের দু'সপ্তাহ পরে, ২২ জানুয়ারি গুলশান কার্যালয়ে বিএনপি চেয়ারপরসনের সঙ্গে সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের নেতৃবৃন্দ দেখা করতে গেলে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পর্কে নিজের ব্যাখ্যা হাজির করে বেগম খালেদা জিয়া অবশ্য বলেছিলেন, ''আমি মোটেও হতাশ নই। আন্দোলনে আমাদের বিজয় হয়েছে। ভোটাররা আমাদের আহ্বানে ভোটকেন্দ্রে যায়নি। শতকরা ৫ ভাগ লোকও ভোট দেয়নি। আমি দেশের ৯৬ ভাগ মানুষের নেত্রী হয়েছি। এটাই বড় সার্থকতা।''
এরপর পেশাজীবী নেতাদের অভয় দিয়ে তিনি বলেছেন, ''আপনারা হতাশ হবেন না। আমরা আন্দোলনের মাধ্যমে এই সরকারকে বিদায় নিতে বাধ্য করব। এই সরকারের আয়ু এক বছরও হবে না, ইনশাআল্লাহ।''
যদি বেগম জিয়ার বক্তব্য অনুযায়ী সরকারের আয়ু এক বছরই হয়ে থাকে তাহলে ইতোমধ্যে ৮ মাস সময় চলে গেছে। বাকি ৪ মাসের মধ্যে সরকারের আয়ু শেষ হওয়ার কোনো আলামত কি কেউ কোথাও দেখতে পাচ্ছেন?
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার পরিবর্তনের একমাত্র পথ হচ্ছে নির্বাচন। কিন্তু আগামী ৪ মাসের মধ্যে দেশে নির্বাচন হবে এটা কি বেগম জিয়াও বলতে পারবেন? যদি নির্বাচন না হয় তাহলে আর কী উপায়ে সরকারের 'আয়ু' শেষ করা হবে সে প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠতে পারে। এ ধরনের বালখিল্য মন্তব্যের কারণেই বিএনপিকে ষড়যন্ত্রের রাজনীতির সহযাত্রী হিসেবে অনেকেই মনে করে থাকেন।
আশার কথা এটাই যে, 'এই সরকারের আয়ু এক বছরও হবে না' বলে বেগম জিয়া যে মন্তব্য করেছেন তা কোনো মহলেই গুরুত্ব পায়নি। দলের নেতা-কর্মী-সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীদের মনোবল চাঙ্গা করার জন্যই সম্ভবত অমন কথা তিনি বলেছিলেন। তার এই বক্তব্য ধর্তব্যের মধ্যে না নেওয়ার কারণ সরকারের আগের মেয়াদেও তিনি সরকারের 'আয়ু' নিয়ে অনেক কথা বলেছিলেন। একাধিকবার সরকারকে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন। সরকার মেয়াদ পূরণ করতে পারবে না, পালানোর পথ পাবে না বলে হুংকার দিয়েছিলেন। কিন্তু সবই অসার প্রমাণিত হয়েছে।
বেগম জিয়ার এই বক্তব্যে বিএনপি সমর্থকরা কতটুকু উদ্বুদ্ধ হয়েছেন এবং তারা তাদের হতাশা দূর করতে পেরেছেন কিনা সেটা জানা না গেলেও তিনি যেভাবে আন্দোলনে তাদের 'বিজয়' হয়েছে বলে দাবি করেছেন তার সঙ্গে অনেকেই একমত হতে পারছেন না। বরং সাধারণভাবে এটাই মনে করা হচ্ছে যে, আন্দোলনে বেগম জিয়া তথা বিএনপির পরাজয় হয়েছে। কারণ ৫ জানুয়ারির নির্বাচন তারা প্রতিহত করতে পারেননি। সরকার নির্বাচন সম্পন্ন করতে পেরেছে। উল্টো নির্বাচন প্রতিহত করার আন্দোলনে ব্যাপক সন্ত্রাস-সহিংসতা চালানোয় এবং অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর কারণ হওয়ায় রাজনৈতিকভাবে বিএনপির ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
শতকরা ৫ ভাগ লোকও ভোট দেয়নি বলে বেগম জিয়া যে দাবি করেছেন, সেটাও অসত্য। এটা ঠিক যে, ভোট দেওয়ার ব্যাপারে মানুষের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল না। যেভাবে জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর এবং মানুষ হত্যা করা হয়েছিল, তাতে মানুষের মধ্যে ভয়ভীতি থাকাটাই ছিল স্বাভাবিক। তারপরও অনেক আসনেই বিপুল সংখ্যক মানুষ ভোট দিয়েছে। বিএনপি যদি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করত এবং তারপরও ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি কম থাকত তাহলে হয়তো বেগম জিয়ার দাবি গ্রহণযোগ্য হত।
বেগম জিয়া নিজেকে দেশের ৯৬ ভাগ মানুষের নেত্রী বলে দাবি করেছেন। তার এই দাবি হাস্যকর এবং কল্পনাপ্রসূত। নির্বাচনে অংশ না নিয়ে এভাবে নিজেকে ৯৬ ভাগ মানুষের নেত্রী কল্পনা করে তিনি আত্মসুখ অনুভব করতে পারেন, কিন্তু বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ তার এই মনোভাবের সঙ্গে সহমত পোষণ করতে পারবেন বলে মনে হয় না। যারা ভোটকেন্দ্রে যাননি তারা সবাই বেগম জিয়াকেই 'নেত্রী' বলে মানেন এটা তো কোনোভাবেই সঠিক সিদ্ধান্ত হতে পারে না।
অবশ্য এটা ঠিক যে, বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে দেশের রাজনীতির চালচিত্র অন্যরকম হতে পারত। তারা হয়তো জয়লাভও করতে পারত। নানা জনমত জরিপে বিএনপির দিকে বেশি সমর্থন বলে তথ্য পাওয়া যাচ্ছিল। গত বছর মে-জুন মাসে দেশের পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থীদের বিপুল বিজয় থেকে অনেকেই এটা বলছিলেন যে, জাতীয় নির্বাচনেও হাওয়া বিএনপির অনুকূলে বইতে পারে। কিন্তু নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকে।
বেগম জিয়া এবং তার পরামর্শদাতারা এখন স্বীকার না করলেও বাস্তব সত্য এটাই যে, নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত বিএনপিকে কোনোভাবেই লাভবান করেনি। রাজনৈতিক কৌশলের খেলায় বিএনপি হেরে গেছে। 'আমি মোটেও হতাশ নই'– বলে প্রকাশ্যে বেগম জিয়া যতই বলুন না কেন, তিনিও এটা জানেন যে, দলকে আবার নতুন করে গুছিয়ে তোলা তার জন্য খুব সহজ কাজ হবে না। যে আন্দোলনে বেগম জিয়া তাদের 'বিজয়' হয়েছে বলে দাবি করেছেন, সেই আন্দোলনে দলের সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা যে সমানভাবে সক্রিয় ছিলেন না সেটা দলের ঢাকা মহানগর কমিটির নেতৃত্ব বদলের মধ্য দিয়ে বেগম জিয়া নিজেও কার্যত স্বীকার করে নিয়েছেন।
সমগ্র পরিস্থিতির একটি সুষ্ঠু ও সার্বিক মূল্যায়ন ও পর্যালোচনা করা উচিত। এখন বেগম জিয়ার উচিত হবে দলের শক্তি-সামর্থ্যের বিষয়টি ভালোভাবে খতিয়ে দেখে তারপর আন্দোলনের পরিকল্পনা করা। 'আন্দোলন আন্দোলন খেলা' খেলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে না– এই সত্য তাকে বুঝতে হবে। যতই গণবিচ্ছিন্ন বলা হোক না কেন, তারপরও আওয়ামী লীগই দেশের একমাত্র দল যার তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত বিরাট সংখ্যক কর্মীবাহিনী রয়েছে। শুধু প্রতিটি গ্রামে নয়, প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই আছে এই দলের সমর্থক-শুভাকাঙ্ক্ষী। তাছাড়া এই দলের রয়েছে একাধিক সফল ঐতিহাসিক গণআন্দোলনের অভিজ্ঞতা যা বিএনপির নেই।
৫ জানুয়ারির আগের এবং পরের রাজনীতি যে এক অবস্থানে নেই এটা অনুধাবনে বেগম জিয়ার কিছুটা সময় লাগবে। ৫ জানুয়ারির আগে দেশের রাজনৈতিক গতিধারার ওপর বিএনপির যে প্রভাব, নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব ছিল, ৫ জানুয়ারির পর তা অনেকাংশেই খর্ব হয়েছে। রাজনীতির ওপর বিএনপির নিয়ন্ত্রণ এখন অনেকটাই শিথিল। এরশাদ পতনের পর দেশে গণতান্ত্রিক-রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর এই প্রথমবার সংসদে বিএনপির প্রতিনিধিত্ব নেই।
বিগত সময়ে বিএনপি যেভাবে আন্দোলনের নামে শুধু শুধু উত্তেজনা ছড়িয়েছে, জামায়াতের সঙ্গে জোট বেঁধে আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস-সহিংসতা চালিয়েছে, সেটা এখন বিএনপির কাঁধে বোঝা হয়ে চেপে বসেছে। বিএনপির সঙ্গে অনেক মানুষই এসব কারণে একাত্মবোধ করতে পারছে না। সে জন্যই এখন নতুন আন্দোলনে যাওয়ার আগে যেমন বিএনপি নেতৃত্বকে দলের সবলতা ও দুর্বলতাগুলো খতিয়ে দেখতে হবে, তেমনি আন্দোলনের কৌশলেও পরিবর্তন আনতে হবে। মানুষকে দূরে ঠেলে নয়, ভয়ভীতি দেখিয়ে নয়, মানুষকে সঙ্গে নিয়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন গড়ে তুলতে পারলেই সম্ভব হবে সরকারকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করা।
সবচেয়ে বড় কথা, বিএনপি যদি জামায়াতকে নিয়ে কৌশলের খেলা অব্যাহত রাখে তাহলে তারা সুফল পাবে না। সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ না করলে বিএনপি জামায়াতের সঙ্গ ছাড়বে না– এটাই যদি হয় বিএনপির চূড়ান্ত অবস্থান, তাহলে জামায়াতবিরোধী ব্যাপক জনগোষ্ঠীর সমর্থন হারাবে বিএনপি। জামায়াত কোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল নয়, এটা একটি সন্ত্রাসী-জঙ্গিবাদী সংগঠন। জামায়াতের মাথার ওপর ছাতা ধরার কৌশল পরিত্যাগ না করলে বিএনপির পায়ের নিচে মাটিও শক্ত হবে না।
অন্যদিকে, সরকারকেও পথ চলতে হবে হিসাব-নিকাশ করে। তাদের সবসময় মনে রাখতে হবে যে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে তারা যেভাবে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন, এবার কিন্তু তা হয়নি। বর্তমান সরকার যে খুব জনপ্রিয় সরকার নয়– এটা এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না। হামবড়া ভাব দেখানোর কিছু নেই। কাজের মাধ্যমে মানুষের ভালোবাসা অর্জন করতে হবে। কম কথা বলে, কাজ বেশি করার রীতিতে অভ্যস্ত হতে হবে মন্ত্রীদের, যা এখনও দেখা যাচ্ছে না। সব ধরনের বাড়াবাড়ি বন্ধ করতে হবে।
মন্ত্রী-এমপিদের আচার-আচরণ যদি ক্রমাগত বিরূপতা তৈরি করতেই থাকে তাহলে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার সাধ পূর্ণ না-ও হতে পারে। আন্দোলনের নামে বিএনপি-জামায়াতের বাড়াবাড়ি মানুষ পছন্দ করেনি, তাদের সঙ্গে যায়নি। সরকারের কোনো বাড়াবাড়িও মানুষ সহ্য করবে না, সরকার থেকে বরং মুখ ফিরিয়ে নেবে। কিন্তু সরকার যদি ভালো শাসন উপহার দিতে পারে, মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারে, তাহলে বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলন-হুমকি নিয়ে ভয়ের কিছু নেই।
সরকার যদি পাঁচ বছরের জন্য নিজেদের শাসন নিষ্কণ্টক মনে করে যা ইচ্ছা তাই করে সাধারণ মানুষকে ক্ষিপ্ত করে তোলে এবং বিএনপি-জামায়াতের হাতে নতুন নতুন ইস্যু তুলে দেয়, তাহলে ভিন্ন রকম ঘটনা ঘটতেও পারে।