Published : 23 Apr 2008, 12:44 PM
'ইভটিজিং' বলছি না। বলছি যৌন নিপীড়ন। শিশু বয়স থেকে বুড়ি বয়স পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে ধাপে নারী যে রকম যৌনতার ইঙ্গিতবাহী, সরাসরি নিপীড়নের শিকার হন, তা শুধু ইভটিজিং শব্দ দিয়ে এর ভয়াবহতা বোঝানো সম্ভব না। যে কিশোরী মেয়েটি বাড়ি ফেরার পথে অথবা স্কুলে যাওয়ার রাস্তায় মেয়েকে যৌন-বস্তু ভাবা পুরুষের নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে ঘরের দরজা লাগিয়ে ঢক ঢক করে কীটনাশক বা ঘুমের ওষুধ খেয়ে বা ফ্যানে ঝুলে পড়ে নিজেকেই হত্যা করে –তা কি শুধু 'টিজিং' শব্দ, যার ইংরেজি প্রতিশব্দ উইট, চিটচ্যাট -যন্ত্রণা আর অপমানের ভার কি এই ইংরেজী শব্দে বোঝানো যায়? আমার এক বন্ধুর মা, আশালতা চক্রবর্তী একবার বলছিলেন, 'তুমি এত রাতে রাতে বাড়ি ফের, আমার এই ষাট বছর বয়সে এখনও রাত বেশি হলে ধর্ষণের আতঙ্ক কাজ করে।' কোন বয়সের নারীরই ঘর থেকে বের হলে ঘরে ফেরার আগ পর্যন্ত স্তনে, পাছায়, কোমরে অযাচিত শক্ত স্পর্শ অথবা মাথা ঝাঁঝাঁ করা যৌন উদ্দেশ্যমূলক বাক্য না শুনে ঘরে ফেরা হয়? এমনকি ট্রান্সজেন্ডার যাদের বলা হয়, প্রচলিত ভাষায় হিজড়া নারী; স্টপেজে বাস থামার পর বাস ড্রাইভারের কাছে টাকা চাইতে গেলে বাস ড্রাইভার সিটে বসে থেকে তার অপুষ্ট স্তনে সরাসরি হাত চালিয়ে দেয়।
সিগন্যাল ছেড়ে দিলে চম্পট। এমন দৃশ্যও ঢাকার রাস্তায় খুব অচেনা না। রাস্তায় যৌন নিপীড়নকারী পুরুষের সংখ্যা এবং আচরণের ধরণ অনেক বাড়ছে, দিন দিন। এই কথাটা খুব শোনা আর জানা, কিন্তু যে খবরটি কম জানা তুলনামূলকভাবে, সেটি হলো দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পুরুষদেরই একটা অংশ যৌন নিপীড়নকারী খারাপ পুরুষদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন। স্থান, কাল, পাত্র বিচারে ভালো পুরুষের আইডেন্টিটি তৈরি করতে চাওয়া এই পুরুষরা, খুব আশ্চর্য্যের বিষয়, নিজেরা দৃষ্টান্ত হচ্ছেন মার খেয়ে অথবা জীবন দিয়ে।
২১ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের একটি প্রধান দৈনিক ফ্রন্ট পেইজে একটা খবর ছেপেছে, তিন কলামে, দুটো ফটোগ্রাফ ব্যবহার করে। খবরটির শিরোনাম হোল: জীবন-মৃত্যুর মাঝে এক শিক্ষক/নাটোরে কলেজছাত্রীদের উত্যক্ত করায় বখাটেদের হামলা/ এলাকাবাসীর ক্ষুব্দ প্রতিক্রিয়ার পর এক আসামী গ্রেফতার। খবরটি থেকে তথ্য হলো: নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার লোকমানপুর কলেজের একাদশ শ্রেণীর কিছু নারী শিক্ষার্থীর সঙ্গে স্থানীয় বখাটে তরুণ আসিফ আলী ও রাজন দীর্ঘদিন ধরে অশালীন আচরণ করে উত্যক্ত করে আসছিল। রসায়ন বিভাগের শিক্ষক মিজানুর রহমানকে তারা তাদের এ দৈনন্দিন অপমানিত হওয়ার ঘটনা জানাতেন । মিজানুর রহমান ঘটনাটি কলেজের অধ্যক্ষ ও ব্যবস্থাপনা কমিটিকে জানান। তিনি অভিযুক্ত বখাটে পুরুষদের সতর্কও করেন। এর প্রতিক্রিয়া হিসাবে বখাটে পুরুষরা ১২ অক্টোবর দুপুরে স্থানীয় কৃষ্ণা কৃষি খামারের সামনে প্রভাষক মিজানুর রহমানের ওপর মোটর সাইকেল তুলে দেয়। মাথা, বুক ও চোখের ওপর আঘাত করে। এরপর শিক্ষক মিজানুর রহমানকে স্থানীয় হাসপাতাল থেকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, তারপর বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। মিজানুর রহমানের ভাতিজা আবু হেনা মোস্তফা কামাল ঢাকায় সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, মিজানুর রহমান চার দিন ধরে অচেতন। চিকিৎসকেরা তাদের জানিয়েছেন, তিনি ক্লিনিক্যালি ডেড। তবে এখনও মৃত ঘোষণা করা হয় নি।
খবরের এটুকু তথ্য জানবার পর স্বাভাবিক কৌতুহল তৈরি হতে পারে, থানা পুলিশ কি করছে? ওই খবরটিই জানায়, মিজানুর রহমানের ভাই মামুনুর রশীদ এ ঘটনায় বাদী হয়ে ১৫ অক্টোবর বাগাতিপাড়া থানায় মামলা করেছেন। কিন্তু পুলিশ আসামীদের গ্রেপ্তার করে নি। কিন্তু ২০ অক্টোবর শিক্ষক মিজানুর রহমান মারা গেছেন গুজব ছড়িয়ে পড়লে এলাকাবাসীর ক্ষুব্দ প্রতিক্রিয়ায় আসিফ নামের এক আসামীকে স্থানীয় এক আইনজীবীর বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
নারী ও পুরুষ পাঠক খেয়াল করুন, জনগণের বিক্ষোভের চাপে বাগাতি থানার পুলিশ যৌন উৎপীড়ক আসিফকে গ্রেপ্তার করে স্থানীয় এক আইনজীবীর বাসা থেকে। একটা মফস্বল শহরে একজন আইনজীবীর বাসায় ঢোকার অধিকার রাস্তার সাদাসিদা হকার টাইপের কেউ পায় না। সেই-ই পায়, যে ক্ষমতার চর্চা করে- যে ক্ষমতা সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করে। আমাদের সমাজ ব্যবস্থাপনা নিপাট সোজা সাপ্টার জন্য কোন উঁচু স্তরেই প্রবেশ দ্বার খোলা রাখে না। 'যৌন নিপীড়ক' আসিফের জন্য আইনজীবীর বাসার দরজা খোলা থাকে। ধরেই নেয়া যায় মিজানুরের জন্য কখনোই এসব উচ্চ পেশাদারদের দরজা খোলা ছিল না। থাকলে ১৫ অক্টোবর তার ভাইয়ের করা মামলায় কেন তৎপর হয় নি পুলিশ? যৌন নিপীড়নে আত্মহত্যা করা অথবা উল্টা ফতোয়ার মাধ্যমে দোররা খাওয়া ঘটনা নিয়ে প্রকাশিত রিপোর্টগুলোতে আমরা খেয়াল করি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উত্যক্তকারী পুরুষের সামাজিক স্ট্যাটাস উত্যক্তের শিকার মেয়েটির তুলনায় অধস্তন থাকে। অভিভাবকরা ওদের রাস্তার ছেলে বলে থাকেন। কিন্তু এই রাস্তার ছেলেগুলাই পাড়ার বা এলাকার অর্থ এবং অস্ত্রে ক্ষমতাবান অথবা অর্থ, অস্ত্র এবং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বড় ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকে। এবং সে পুরুষ –এটাই যথেষ্ঠ। অর্থাৎ, একজন মেধাবী, আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন, ক্ষমতার ইঙ্গিতবাহী স্ট্যাটাসের একজন নারী রাস্তায় হাঁটার সময় তাকে ছাড় দেয় না রাস্তার মোটর পার্টসের দোকানের শ্রমিকও; কানের কাছে এসে পাশাপাশি হেঁটে দ্রুত বলে যায় অশালীন কোন মন্তব্য। অর্থাৎ, যৌন উৎপীড়ক পুরুষের কাছে সব নারীই, তা সে যেই-ই হোক স্কুলগামী, অফিসগামী, বাড়িগামী, বড় অফিসারের মেয়ে, যেই স্ট্যাটাসেরই হোক না কেন; সব নারীই কেবল যৌনতা সম্পন্ন প্রাণী, এর বেশি কিছু নয়।
মিজানুর পুরুষ। তার ক্ষেত্রে ক্ষমতাধর আর ক্ষমতাহীনের সরাসরি প্রতিযোগিতা ছিল। এ প্রতিযোগিতায় মিজানুরকে আহত হতে হয়েছে। এর আগে কুমিল্লায়ও এক শিক্ষক এভাবে যৌন উৎপীড়ক পুরুষদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছিলেন। অথচ, আশ্চর্য্য! সত্যিই আশ্চর্য্যের বিষয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট থেকে একটি নির্দেশনা এসেছে, যেখানে 'ইভটিজিং'কে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, এর বিরুদ্ধে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সব প্রতিষ্ঠানে প্রাতিষ্ঠানিক অভিযোগ সেল গঠনসহ নানান নির্দেশনা দেয়া আছে। এ বছরের মে মাসে শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং নারী ও শিশু মন্ত্রণালয়ের সম্মিলিত আয়োজন 'ইভটিজিং'র বিরুদ্ধে জনসচেতনতা তৈরিতে বিশেষ প্রচারণা কর্মসূচি পালন করে, মুক্তাঙ্গনে। ১৪ মে বিবিসি বাংলার খবরে বলা হয়, স্কুল-কলেজগামী মেয়েদের উত্যক্ত করার ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে যাওয়ার পর সরকার এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে সাদা পোষাকে পুলিশ মোতায়েনের কথা ভাবছে। মোবাইল ফোনগুলো তাদের কর্পোরেট সংস্কৃতির সোস্যাল রেসপন্সিবিলিটির দায় থেকে জনে জনে বখাটেদের বিরুদ্ধে জনসচেতনা বাড়ানোর অঙ্গীকারসম্পন্ন এসএমএস পাঠাতে থাকে। টেলিভিশনগুলা জনস্বার্থে ট্যাগনেইমে বিজ্ঞাপন দিতে শুরু করে। হয়তো এমনও হতে পারে, মিজানুরের ভেতরকার ভালো মানুষটা এসব আয়োজন দেখে উজ্জীবিতই হয়েছেন। যেখানে সরকারের মন্ত্রণালয়গুলো উদযোগ নিয়ে উৎপীড়কদের বিপক্ষে দাঁড়ানোতে উৎসাহিত করেছে, সেখানে মিজানুর কেন উজ্জীবিত হবেন না? কিন্তু মিজানুরের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা একটা বড় প্রশ্ন তৈরি করেছে। ওয়েলফেয়ার রাষ্ট্রের চেহারা দেখানোর জন্য সরকার অসম সমাজ কাঠামো আর ব্যবস্থাপনার মধ্যেও যৌন নিপীড়ন বন্ধে একটা বিশেষ উদযোগ নিয়েছে। সংসদের বাজেট অধিবেশনে শিক্ষামন্ত্রী একে সরকারের বিশেষ উদযোগ বলেই দাবি করেছিলেন। এত উদযোগ, আয়োজনে প্রতিবাদী মিজানুরের মৃত্যুর আশঙ্কা ঠেকানোর কোন চেষ্টা কি লক্ষ্য করা গেছে? দীর্ঘদিন ধরে যে কলেজ ছাত্রীগুলা আসিফ আলী আর রাজনের যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে আসছিলো, তাদের জন্য হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ি একটা অভিযোগ সেল কেন গঠন করা হলো না? মিজানুর অধ্যক্ষ এবং ব্যবস্থাপনা কমিটিকে জানানোর পরও কেন স্থানীয় সাংসদ কোন উদযোগ গ্রহণ করেন নাই? পদাধিকার বলে স্থানীয় সাংসদ স্কুল কমিটির সভাপতি হয়ে থাকেন। ১৫ অক্টোবর মিজানুরের ভাই যখন থানায় মামলা করেন, তখনো ঘটনার বিবরণে যৌন উৎপীড়কদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের বিষয়টি এসেছিল, তাহলে থানা-পুলিশ কেন সরকারের বিশেষ পদক্ষেপের সাথে বিশেষভাবে তৎপর হয় নাই?
কারণ, সরকার শুরু থেকেই যৌন নিপীড়নের এই ভয়ঙ্কর ঘটনাকে 'ইভটিজিং'য়ের মতো একটা হালকা শব্দ দ্বারা সীমাবদ্ধ এবং সংজ্ঞায়িত করে আসছেন। সরকারের অফিসিয়াল চিঠি, নথিপত্র সবখানে। এটা হচ্ছে সরকারের যৌন নিপীড়ন সম্পর্কে লেবেল অব আন্ডার্স্টান্ডিং অর্থাৎ বোঝাবুঝির স্তর। এই বোঝাবুঝিটা সেই বাস্তবতার যেখানে দলে দলে মেয়েরা আত্মহত্যা করেই যাচ্ছে, প্রতিবাদকারী পুরুষেরা পিটুনি খাচ্ছেন, আহত হচ্ছেন, -শুধুমাত্র যৌন নিপীড়ন জাতীয় অপরাধের জন্য। আর এই ভয়াবহ ঘটনাটিকে 'ইভটিজিং' শব্দ দ্বারা সংজ্ঞায়িত করে যাচ্ছেন সরকারের জোটবদ্ধ রাজনৈতিক দলগুলার সবচে বড় দলটি, যারা যে কোন বক্তৃতায় মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষনের শিকার নারীদের কথা বলতে গর্বিত বোধ করেন, সঙ্গে আছে কার্ল মার্কস আর ভ.ই. লেলিনের কাস্তে দিয়ে নিজেদের শানিয়ে নেয়া প্রচারিত দুটি রাজনৈতিক দল। এদের নিজেদের মেয়ে-বউদের শরীরে কি যৌন উৎপীড়ক পুরুষের হাত যায় নি? অথবা উত্যক্ত বাক্য কানে ঢুকে মাথা থেকে শরীরের শিরায় শিরায় পৌঁছে নি? পৌঁছেছে। কিন্তু এরা বরাবরই সমঝোতা করে গেছে। এদের কোন আদর্শ নাই, সমঝোতা ছাড়া। এরা যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধের উদযোগে শাসন ব্যবস্থার তৃণমূল পর্যন্ত নির্দেশনা কঠোরভাবে বাস্তবায়নে বাজেট বরাদ্দ না রেখে 'ইভটিজিং বিরোধী সমাবেশ, ক্যাম্পেইন, বিজ্ঞাপনের সঙ্গে সমঝোতা করে। এই রাষ্ট্রীয় সমঝোতাগুলোর পরিবেশন এমন যে, উজ্জীবনের মোড়কে এক বিশাল ফাঁদ তৈরি হয়ে আছে। সেই ফাঁদেই পরেছেন শিক্ষক মিজানুর রহমান।
নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার লোকমানপুর কলেজের রসায়ন বিভাগের ৩৬ বছর বয়সী শিক্ষক মিজানুর রহমানের ঘটনা কেবল যৌন উৎপীড়ক, পুরুষালি মানসিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের দৃষ্টান্তই নয়, ইভটিজিংকে হাল্কাভাবে নেয়ার সরকারী সিদ্ধান্তের অসারতা উন্মোচনেরও দৃষ্টান্ত।