Published : 10 Oct 2013, 08:24 PM
এ বছরের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কারের কথা সবাই জেনে গেছেন এরই মধ্যে। নোবেল পেয়েছেন পিটার হিগস এবং ফ্রাঁসোয়া অ্যাঙ্গলার্ট। পারমাণবিক এবং উপ-পারমাণবিক কণার ভরের উৎস খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা যে 'হিগস-বোসন' কণার ধারণা করেছিলেন, গত বছর সার্নের পরীক্ষায় তা সফলভাবে প্রমাণিত হয়। এর স্বীকৃতি হিসেবে চলতি বছরের নোবেল পুরষ্কারের জন্য এই দুজনের নাম বিবেচনা করেছে নোবেল কমিটি।
ফ্রাঁসোয়া অ্যাঙ্গলার্ট জন্মেছিলেন ১৯৩২ সালে, অধ্যাপনা করছেন ব্রাসেলস বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি একটি যুগান্তকারী গবেষণা প্রবন্ধ লিখেছিলেন তার সহকর্মী রবার্ট ব্রাউটের (অধুনা পরলোকগত) সঙ্গে মিলে যা হিগস-কণার কাজ বুঝতে সহায়ক হয়েছিল।
আর ১৯২৯ সালে জন্মগ্রহণকারী পিটার হিগস এমনিতেই পাদপ্রদীপের আলোতে সবসময়ই ছিলেন, বিখ্যাত কণাটির সঙ্গে নিজের নাম যুক্ত থাকায়। তিনি তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যার এমিরেটাস অধ্যাপক হিসেবে এখনও কাজ করছেন এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
পেছনের ইতিহাস
সেই ষাটের দশক থেকে কণা পদার্থবিজ্ঞানের প্রমিত মডেলের একটা জোরালো অনুমিতি ছিল যে আমাদের এই চিরচেনা মহাবিশ্ব হিগস-কণাদের সমন্বয়ে গঠিত হিগস-ক্ষেত্রের (Higgs field) এক অথই সমুদ্রে ভাসছে। এই অথই সমুদ্রে চলতে গিয়েই নাকি উপ-পারমাণবিক বস্তুকণারা সব ভর অর্জন করে। যদি হিগস-ক্ষেত্র বলে কিছু না থাকত, তাহলে কোনো বস্তুকণারই ভর বলে কিছু থাকত না– তা সে রোগাপটকা ইলেকট্রনই হোক, আর হোঁৎকামুখো হিপোপটেমাস, মানে টপ-কোয়ার্কই হোক।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, কেবলমাত্র হিগস-ফিল্ড বলে কিছু একটা আছে বলেই এসব কণা ভর অর্জন করতে পারছে, যা আবার ফলশ্রুতিতে তৈরি করতে পারছে আমাদের গ্রহ, নক্ষত্র, ছায়াপথসহ সবকিছুই।
চিন্তা করে দেখুন, আমরা ফোটনের মতো ভরহীন কণার কথা জানি যারা ছোটে আলোর বেগে। আলোর বেগে ছুটতে পারে, কারণ এরা হিগস-ফিল্ডের সঙ্গে কোনো ধরনের মিথস্ক্রিয়ায় জড়ায় না। হিগস-ক্ষেত্রের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় না জড়ানোর কারণে তারা থেকে যায় ভরহীন। আর ভর-টরের ঝামেলা নেই বলেই তারা অমনি বেগে হু হু করে ছুটতে পারে।
কিন্তু ওভাবে ছুটলে কী হবে, তারা জোট বাঁধতে পারে না কারও সঙ্গেই। জোট বাঁধতে হলে ভর থাকা চাই। এই যে আমাদের চারপাশে এত বস্তুকণার সমারোহ দেখি, দেখি পাহাড় পর্বত, নদীনালা, গাছপালা আর মানুষ-– সবারই অল্পবিস্তর ভর রয়েছে। ভর জিনিসটা তাই আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গেই অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত বলে আমরা মনে করি।
তাই কোনো কণা যদি পাওয়া যায় যেটা মহাবিশ্বের ব্রাহ্মমুহূর্তে সবাইকে ভর প্রদান করছে, করছে অস্তিত্বহীনকে অস্তিমান, তার গুরুত্ব হয়ে দাঁড়ায় অপরিসীম। বহু বছর আগে ১৯৬৪ সালের দিকে পিটার হিগস নামে এক বিজ্ঞানী ধারণা করেছিলেন এই ধরনের এক 'হাইপোথিটিক্যাল কণা'র।
যদিও ধারণাটির পিছনে কেবল পিটার হিগসের একার অবদানই ছিল তা নয়, এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন রবার্ট ব্রাউট এবং ফ্রাঁসোয়া অ্যাঙ্গলার্টের মত বিজ্ঞানীরাও; তারপরেও এক ধরনের কণা দিয়ে তৈরি ফিল্ডের ব্যাপারটা হিগসের মাথা থেকেই প্রথম বেরিয়েছিল বলে অনেকে ভেবেছিলেন। তাই তার নামানুসারেই এই অনুকল্প-কণাটির নাম দেওয়া হয় হিগস-কণা।
যদি এ নামকরণ থেকে কেউ ধরে নেন যে, হিগস-কণার অনুকল্প যাদের মাথা থেকে এসেছে সেসব তাত্ত্বিকদের মধ্যে পিটার হিগসের অবদানই ছিল সর্বাধিক, তাই তার নামে কণাটির নামকরণ করা হয়েছে– তাহলে কিন্তু ভুল উপসংহারে পৌঁছে যাওয়া হবে।
আসলে ১৯৬৪ সালে হিগসের ধারণাসূচক যে তিনটি মহামূল্যবান পেপার প্রকাশের কথা বলা হয়, তার মধ্যে হিগসের পেপারটি ছিল দ্বিতীয়। হিগসের আগে বেলজীয় পদার্থবিদ রবার্ট ব্রাউট এবং ফ্রাঁসোয়া অ্যাঙ্গলার্টের একটি পেপার প্রকাশিত হয়। আর হিগসের পেপারটির পরে জেরাল্ড গৌরালিঙ্ক, রিচার্ড হ্যাগেন এবং টমকিব্বল-এর আরও একটি পেপার প্রকাশিত হয়।
প্রতিসাম্যতার ভাঙনের জন্য দায়ী 'হিগস-প্রক্রিয়া' হিসেবে যে প্রক্রিয়াটিকে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, সেটার পেছনে এদের সবারই কমবেশি অবদান আছে। এমনকি তাদের কাজের আগে জাপানি-আমেরিকান পদার্থবিদ ইয়োইচিরো নামবু এবং ভূতপূর্ব বেল ল্যাবের ফিলিপ অ্যান্ডারসনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ তাদের উত্তরসূরীদের জন্য ভিত্তিপ্রস্তর গড়ে দেয়।
এদের সকলের অবদানই উল্লেখযোগ্য। তারপরেও কেবল পিটার হিগসের নামেই কেন হিগস-কণা, হিগস-ক্ষেত্র, হিগস-প্রক্রিয়া সবকিছুর নামকরণ হল এটা একটা মূর্তিমান রহস্য। পিটার হিগস নিজেই নিজের নামে কণাটির নামকরণ করেননি এটা নিশ্চিত।
অনেকেই এই নামের জন্য আঙুল তুলেন মেধাবী কোরিয়ান-আমেরিকান পদার্থবিদ বেঞ্জামিন লীর প্রতি, যিনি ১৯৭৭ সালে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় দুর্ভাগ্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগে, হিগসের সঙ্গে তার আলাপ হয় এবং এই আলাপ থেকে তিনি প্রতিসাম্যতার ভাঙনের মাধ্যমে কীভাবে কণারা ভরপ্রাপ্ত হয়, সে সম্বন্ধে সম্যক ধারণা লাভ করেন।
এই সূত্র ধরে উৎসাহী লী বেশ কিছু সেমিনারে সেটাকে 'হিগস-মেকানিজম' বলে উল্লেখ করেছিলেন। এছাড়াও নোবেলবিজয়ী বিজ্ঞানী স্টিভেন ওয়েইনবার্গের ১৯৬৭ সালের গুরুত্বপূর্ণ একটি পেপারে ভুলক্রমে রেফারেন্সে পিটার হিগসের নাম অন্যদের আগে চলে যায়। এটাও একটা কারণ হতে পারে।
এগুলোর বাইরে 'হিগস-বোসন' শব্দটির দ্যোতনা শ্রুতিমধুর, উচ্চারণও সহজ। এসব কিছুই এই নামের পক্ষে গেছে।
কিন্তু নাম দিলে কী হবে, সে কণার কোনো পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ বিজ্ঞানীরা কখনওই দিতে পারেননি, অন্তত ২০১২ সালের আগ পর্যন্ত।
২০১২ সালে এই হারানো টুকরা খুঁজে পাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন সার্নের বিজ্ঞানীরা তাদের বিশাল ব্যয়বহুল কণা ত্বরক লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার থেকে পাওয়া প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে। লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার এক বিশাল যন্ত্রদানব।
আমাদের কোনো ধারণাতেও আসবে না কতটা বিশাল। গত বছর সুইজারল্যান্ড ভ্রমণের সময় এই যন্ত্রদানবকে চাক্ষুষ দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল এই অধমের। জেনেভার সীমান্তে জুরা পাহাড় বলে একটা জায়গা আছে, সেখানে নানা কায়দা-কসরত করে মাটির পঞ্চাশ থেকে একশ পঞ্চাশ মিটার (মানে প্রায় ১৬৫ ফুট থেকে পাঁচশ ফুট) নিচে ২৭ কিলোমিটার (মানে প্রায় সাড়ে সতের মাইল) পরিধির ধাতব এক টিউব বসানো হয়েছে। সেখানেই এই ঐতিহাসিক পরীক্ষাগুলো সম্পন্ন করেছেন বিজ্ঞানীরা।
বলাবাহুল্য, এই লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার নামের দানবটা শুধু সুইজারল্যান্ডেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, সুইজারল্যান্ডের লেক জেনেভার নিচ দিয়ে চলে গেছে একেবারে ফ্রান্স অব্দি। সেখানেই বিজ্ঞানীরা পেলেন হিগস কণার অস্তিত্বের সুস্পষ্ট প্রমাণ।
কীভাবে তারা এই পরীক্ষাটি সম্পন্ন করলেন, এ নিয়ে সাদামাটা ভাষায় কিছু বলা যাক।
আমাদের মহাবিশ্ব যদি হিগসের অথই সমুদ্রে ভাসমান থাকে আর সেই সমুদ্র যদি হিগস-কণাদের দিয়ে তৈরি হয়, তাহলে প্রচণ্ড বেগে ধাক্কা দিলে সেখান থেকে কিছু কণা বেরিয়ে আসতে পারে। আটলান্টিক মহাসাগরের নিচে প্রচণ্ড গতিতে দুটো সাবমেরিনের সংঘর্ষ হলে যেমন কিছু পানি ছিটকে চলে আসে উপরে, আর তা দেখে আমরা বুঝি নিশ্চয়ই পানির নিচে কিছু একটা ঘটেছে।
ঠিক তেমনি ব্যাপার হবে হিগস-মহাসাগরের ক্ষেত্রেও। হিগস-কণা পেতে হলে প্রচণ্ড গতিতে হিগসের-সমুদ্রকে ধাক্কা দিতে হবে। এমন জোরে ধাক্কা দেওয়ার ক্ষমতা এই পৃথিবীতে লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার ছাড়া আর কারও নেই। সেখানে প্রোটনকে আলোর গতির ৯৯.৯৯৯৯৯৯ শতাংশ গতিতে ত্বরান্বিত করা হয়। আর এভাবে দুদিক থেকে প্রোটনের সঙ্গে প্রোটনের মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটানোর মাধ্যমে মৌলিক কণা তৈরি করা হয়।
সেই পদ্ধতিই অনুসরণ করলেন বিজ্ঞানীরা। লার্জ হ্যাড্রন কলাইডারে সংঘর্ষের মাধ্যমে ১৪ ট্রিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্টের শক্তি উৎপন্ন হয়, আর সেই শক্তির ধাক্কায় উপ-পারমাণবিক কণিকারা (subatomic particles) দিগ্বিদিক হারিয়ে ছুটতে থাকে যত্রতত্র। সেগুলো আবার ধরা পরে যন্ত্রদানবের ডিটেক্টরগুলোতে। এভাবেই আটলাস আর সিএমএস ডিটেক্টরে ধরা পড়ল মহামান্যবর হিগসের অস্তিত্ব।
হিগসের শক্তি অবশ্য তাত্ত্বিকভাবে হিসেব করা হয়েছিল অনেক আগেই। বিজ্ঞানীরা জানতেন হিগস-কণা যদি থেকে থাকে তবে সেটার ভর থাকবে ১১৪ থেকে ১৩১ বিলিয়ন ইলেকট্রন-ভোল্ট (যেটাকে নতুন এককে গিগা-ভোল্ট বলা হয়) এর মাঝামাঝি জায়গায়।
বিজ্ঞানীদের অনুমান মিথ্যে হয়নি। প্রোটন নিয়ে গুঁতোগুঁতির ফলাফল শনাক্ত করতে গিয়ে এমন একটা কণা পাওয়া গেল যার শক্তি ১২৫ গিগা ইলেকট্রন ভোল্টের কাছাকাছি। হিগস-কণার যা যা বৈশিষ্ট্য থাকার কথা তা এই ফলাফলের সঙ্গে মিলে যায়। আজ বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত যে, নিচের ছবিতে ১২৫ জিইভি-র কাছাকাছি যে ঢিপি চোখে পড়ছে সেটা হিগস-কণার জন্যই হয়েছে।
এটাই ছিল হিগসের প্রথম পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ। ফ্যাবিওলা জায়ানোত্তির নেতৃত্বে এক দল (আটলাস) এবং জো ইনকানডেলার নেতৃত্ব আরেক দল (সিএমএস) পৃথক পৃথকভাবে এই কণার খোঁজ পেয়ে তাদের উপর মহলে সার্ন গবেষণাগারের সার্নের মহাপরিচালক রলফ হয়ারের কাছে রিপোর্ট করেন। পৃথক দুই দলের পৃথক গবেষণা থেকে যখন একই ফলাফল বেরিয়ে এল তখনই রলফ হয়ার বুঝতে পারলেন সত্য সত্যই হিগসের সন্ধান পাওয়া গেছে। তারপরেও নিঃসন্দেহ হবার জন্য তারা বেশ কিছুদিন সময় নিয়ে ফলাফলগুলো পুনঃপরীক্ষা করলেন।
অবশেষে সবাই হলেন নিঃসন্দেহ। শেষমেশ ২০১২ সালের জুলাই মাসের চার তারিখে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে অনুষ্ঠিত হাই এনার্জি ফিজিক্সের একটি দ্বিবার্ষিক কনফারেন্সে হিগসের প্রাপ্তির খবর জানানো হয়। জেনেভার সার্ন থেকে সরাসরি রিলে করা হয় তাদের ঘোষণাটি। গবেষণাগারের মহাপরিচালক রলফ হয়ার যখন এই আবিষ্কারের ঘোষণা দিলেন, তখন উল্লাস আর করতালিতে ফেটে পড়লেন সমবেত শতাধিক বিজ্ঞানী।
বিজ্ঞানীদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পিটার হিগস স্বয়ং। ৮৩ বছর বয়স্ক এ বিজ্ঞানী ঘোষণার সময় হয়ে উঠলেন আবেগে অশ্রুসজল। বললেন, ''আমি ভাবতেই পারিনি ব্যাপারটা আমার জীবদ্দশাতেই ঘটবে।''
স্ত্রীকে তখনই ফোনে বলে দিলেন সেলিব্রেশনের জন্য শ্যাম্পেইনের বোতল ফ্রিজে রেখে দিতে। তখই বোধহয় তিনি বুঝে গিয়েছিলেন গুরুত্বপূর্ণ এ আবিষ্কার নিয়ে যেভাবে মিডিয়ায় হৈ চৈ হচ্ছে, হয়তো অচিরেই নোবেল পুরষ্কারের তালিকায় নাম দেখা যাবে তার।
আরেকটি পুরস্কারপ্রাপ্ত অ্যানালজি
১৯৯৩ সালের কথা। লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার তখনও এই দানবীয় রূপ নেয়নি, বিজ্ঞানীদের কল্পনা আর ড্রইং বোর্ডের নকশাতেই ঘুরছে কেবল। সার্নের একদল বিজ্ঞানী যুক্তরাজ্যের রক্ষণশীল সরকারের বিজ্ঞান মন্ত্রী উইলিয়াম ওয়াল্ডে গ্রেভের কাছে ধর্না দিলেন তাদের কল্পনা আর নকশাকে বাস্তবায়ন করার জন্য কোনো আর্থিক অনুদান পাওয়া যায় কিনা বুঝতে। ওয়াল্ডে গ্রেভ হিগস নিয়ে বিজ্ঞানীদের অভিমত আর সেটাকে ধরার কসরতের কথা মন দিয়ে শুনলেন বটে কিন্তু একবর্ণ বুঝলেন বলে বোধ হল না।
এটা স্বাভাবিকই। হিগস-বোসন আসলে কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্বের খুব গূঢ় এক বিষয়। অনেকেই বলেন এটা সন্তোষজনকভাবে বোঝার ন্যূনতম শর্ত হল কোনো মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের গ্র্যাজুয়েট (মাস্টার্স বা পিএইচ-ডি) প্রোগ্রামের কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্বের তিন সিকোয়েন্সের কোর্স সফলভাবে সম্পন্ন করা!
কেবল তাত্ত্বিক কণা পদার্থবিজ্ঞনী কিংবা এ ধরনের গবেষণার সঙ্গে জড়িতরাই হয়তো এর সবটুকু বোঝেন। কারণ তাদের জন্য এই তিন সিকোয়েন্সের পাঠ আবশ্যিক। এর সঙ্গে জড়িত থাকে খুব উঁচুস্তরের গাণিতিক বিমূর্ততা। এ ধরনের জটিল বিষয়কে জনবোধ্য ভাষায় প্রকাশ করা অনেক সময়ই দুরূহ হয়ে দাঁড়ায়।
কিন্তু ওয়াল্ডে গ্রেভ হাল ছেড়ে দেবার পাত্র নন। তিনি সবার উদ্দেশে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন– মাত্র এক পাতার একটা সাদা কাগজে খুব সহজ ভাষায় হিগসের সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা হাজির করে তার কাছে নিয়ে আসতে হবে। যিনি পারবেন তিনি মন্ত্রী মহোদয়ের কাছ থেকে পুরষ্কার হিসেবে পাবেন একটা ভিন্টেজ শ্যাম্পেইনের বোতল!
লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ডেভিড মিলার তার চারজন সহকর্মীর সঙ্গে মিলে জিতে নেন চ্যালেঞ্জ। তারা হিগস-কণার মাধ্যমে অন্যান্য কণাদের ভরপ্রাপ্তির ব্যাপারটা যেভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন সেটা এখন হিগসের অন্যতম সহজ সরল, মজাদার আর জনবোধ্য ব্যাখ্যা হিসেবে স্বীকৃত।
ডেভিড মিলারের দলবলের অ্যানালজিটা ছিল এ রকম–
ধরুন মার্গারেট থ্যাচারের মতো কোনো বিখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আমার বা আপনার মতো ছাপোষা কারও সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে ব্রিটেনের কোনো এক জনসভার দিকে যাচ্ছেন। দেখা যাবে মার্গারেট থ্যাচার যেহেতু একজন চেনাজানা বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব, তাকে ঘিরে তৈরি হবে জনগণের মধ্যে নিদারুণ উৎসাহ। তার সমর্থকরা তার চারদিকে জটলা পাকিয়ে এক দুর্দমনীয় বাধার সৃষ্টি করবে; যার ফলে থ্যাচারের এগিয়ে যেতে বেশ বেগ পেতে হবে।
অন্যদিকে আমার মতো ছাপোষা লোককে কেউ পুছেও দেখবে না। ফলে আমি জনসমুদ্রের মধ্যে দিয়ে সুড়সুড় করে এগিয়ে যাব। দেখলে মনে হবে থ্যাচারের ওজন যেন তার চারপাশে দলাপাকানো ভক্তদের কারণে বহুগুণ বেড়ে গেছে; আর আমার মতো অচেনা লোকেরা রয়ে গেছে হালকা-পটকা।
হিগস-ফিল্ডও কাজ করে ঠিক অমনিভাবে, অনেকটা জনসমুদ্রের মতোই। এর সঙ্গে একেক কণা একেক রকম ভাবে মিথষ্ক্রিয়া করে ভরপ্রাপ্ত হয়। যেমন টপ-কোয়ার্ক অনেকটা মার্গারেট থ্যাচারের মতো খুব সহজেই হিগস-ক্ষেত্রের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়ে। আর অন্যদিকে আপ-কোয়ার্ক কিংবা ইলেকট্রনের মতো গোবেচারা ঘরকুনোরা থেকে যায় হালকা-পটকা। এই অ্যানালজি দিয়েই মিলার এবং তার চারজন সঙ্গী প্রত্যেকে একটা করে শ্যাম্পেনের বোতল বগলদাবা করে নিয়েছিলেন।
মার্গারেট থেচারের মতো কোনো বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব কোনো ককটেল পার্টিতে প্রবেশ করলে তাকে ঘিরে স্বাভাবিকভাবেই তৈরি হয় গণমানুষের জটলা। আর অন্যদিকে আমার মতো অখ্যাত জন থেকে যায় অন্যদের আগ্রহের বাইরে।
বিজ্ঞানীরা দেখেছেন কিছু কণা যেমন, টপ-কোয়ার্ক মার্গারেট থ্যাচারের মতোই খুব সহজে হিগস-ক্ষেত্রের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়ে আর 'ভারী' হয়ে উঠে; আর অন্যদিকে আপ-কোয়ার্ক কিংবা ইলেকট্রনের মতো কণারা থেকে যায় তুলনামূলকভাবে হালকা।
এটা হয়তো স্থূল উপমা সঠিক বিচারে, কিন্তু সাধারণ মানুষকে বোঝানোর ব্যাপারে এ ধরনের উপমার জুড়ি নেই। ডেভিড মিলারের এই উপমার সাফল্যের পথ ধরে আরও অনেক পদার্থবিজ্ঞানী এ রকম কিংবা এর চেয়েও উন্নততর উপমামূলক ব্যাখ্যা নিয়ে হাজির হয়েছেন জনগণের দরবারে।
যেমন, কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফিলিপ্পি ডি স্টেফানো থেচারের বদলে কানাডিয়ান পপতারকা জাস্টিন বিবারকে ব্যবহার করেছেন; আয়ান স্যাম্পলের মতো কেউ-বা গুড়ের কিংবা আলকাতরার মধ্যে পিংপং বলের চলন দিয়ে বুঝিয়েছেন; ফার্মি ল্যাবের ডন লিঙ্কন পানির মধ্যে ব্যাড়াকুডা মাছের বিচরণের উপমা ব্যবহার করেছেন হিগসের কাজকর্ম বোঝাতে। পদার্থবিদ শন ক্যারল তার সাম্প্রতিক 'দ্য পার্টিকেল অ্যাট দ্য এন্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড' বইয়ে হিগস বোঝাতে নিয়ে এসেছেন লাস্যময়ী অভিনেত্রী অ্যাঞ্জেলিনা জোলিকে।
তারপরেও জাস্টিন বিবার বলুন আর অ্যাঞ্জেলিনা জোলিই বলুন, কিংবা হোক না সে ব্যাড়াকুডা অথবা পিংপং– সবই শেষ পর্যন্ত উপমাই। উপমারা উপমার জায়গায় থাকুক, আমরা এখানে কেবল এ ধরনের চটকদার উদাহরণ দিয়ে আবছাভাবে হিগসের ব্যাখ্যা শেষ করতে চাই না। যেতে চাই আরেকটু গভীরে।
সিরিয়াসলি, কীভাবে অন্যান্য কণারা হিগসের মাধ্যমে ভর অর্জন করে? এটা জানতে হলে হিগসের একটা ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যের কথা জানতে হবে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, শূন্য স্থানেও হিগসের একটা সাংখ্যিক মান থাকে (এটা নিয়ে আমরা একটু পরেই আলোচনা করব)। একে বলে হিগসের 'প্রত্যাশিত মান' (Expectation value)।
যেহেতু হিগসের এই প্রত্যাশিত মান এমনকি শূন্যস্থানেও প্রকাশমান; এর সঙ্গে অন্যান্য কণারা মিথস্ক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়ে, আর ভর অর্জন করে। ব্যাপারটা বুঝতে পারলে কণাদের ভরপ্রাপ্তির ব্যাপারটাও বোঝা যাবে খুব সহজেই। বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় বলা যায়, একটি কণার ভর=শূণ্যস্থানে হিগস-ক্ষেত্রের মান x হিগসের সঙ্গে কণাটির মিথষ্ক্রিয়াগত প্রাবল্য।
অর্থাৎ, যখন কোনো কণার সঙ্গে হিগসের মিথষ্ক্রিয়ার প্রাবল্য যত বেশি থাকে, অর্থাৎ কণাটি যত বেশি করে মিথস্ক্রিয়ায় জড়ায়, তত বেশি ভরপ্রাপ্ত হয়। একটা টপ-কোয়ার্ক হিগস-ক্ষেত্রের সঙ্গে অনেক বেশি মিথস্ক্রিয়ায় জড়ায় আপ-কোয়ার্ক কিংবা ইলেকট্রন থেকে। তাই এর ভরও তুলনামূলকভাবে বেশি।
তবে একটি কথা এখানে পরিষ্কার করে নেওয়া ভালো। হিগসকে মিডিয়ায় যথেচ্ছভাবে সব বস্তুকণাদের 'ভর সৃষ্টির পেছনে মুখ্য কণা' হিসেবে তুলে ধরা হলেও, বাস্তবতা হল– মহাবিশ্বের বস্তুকণার তাবৎ ভর কিন্তু হিগস থেকে আসেনি। বরং সত্যি বলতে কি তাবৎ ভরের খুব নগণ্য ছোট্ট একটা অংশই কেবল হিগস থেকে এসেছে।
তারপরেও হিগস-কণার গুরুত্ব যে ম্লান হয়নি। হিগস না থাকলে কণা পদার্থবিদদের সাধের 'প্রমিত মডেল'-এর বোধহয় সলিল সমাধি ঘটত। কণাদের আলাদা বৈশিষ্ট্য বলে কিছু থাকত না, সবার চেহারাই হত হুবহু অনুরূপ। ফার্মিয়নেরা সব থাকত ভরহীন হয়ে। আমরা কণাদের যে রসায়নের সঙ্গে পরিচিত, সেই রসায়ন বলেই কিছু থাকত না। কণাদের রসায়ন না থাকলে জীবনের রসায়নও থাকত অনুপস্থিত।
সে হিসেবে আমরা বলতে পারি, হিগস-বোসন হচ্ছে এমন এক মূল্যবান কণা যা কিনা মহাবিশ্বে প্রাণের স্পন্দন জাগিয়েছে। কাজেই কণাদের মধ্যে কাউকে 'সৈয়দ বংশের খেতাব' দিতে গেলে হিগসের কথাই হয়তো আগে চলে আসবে। মিডিয়ায় যে 'ঈশ্বর কণা' হিসেবে হিগসকে আখ্যায়িত করা হয়েছে, সেটা হয়তো এসব গুরুত্ব উপলব্ধি করেই।
হিগস না থাকলে মহাবিশ্বের প্রকৃতি কেমন হত, প্রাণের উদ্ভবের সম্ভাবনাই বা কতটুকু থাকত তা নিয়ে নানা ধরনের দার্শনিক আলোচনায় জড়ানো যায়; কিন্তু বাস্তবতা হল, মহাবিশ্বে উদ্ভবের পর থেকেই এই কণার একটা বড়সড় ভূমিকা ছিল। হিগসের অথই সমুদ্রের কথা যে আমরা বলছি, যেটাকে বলা হয় হিগসের ক্ষেত্র বা হিগস-ফিল্ড; বিগ ব্যাং-এর পর হিগস-ক্ষেত্র তৈরি হবার আগ পর্যন্ত কণাদের ভর বলে কিছু ছিল না।
মহা-উত্তপ্ত অবস্থা থেকে মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে যখন মহাবিশ্বের উদ্ভব ঘটেছিল, তারপর সেটা কিছুটা কমে যখন মিলিয়ন বিলিয়ন ডিগ্রিতে (দশের পিঠে পনেরটা শূন্য চাপালে যে তাপমাত্রা পাব সেটা) পৌঁছেছিল, তখন হিগস বেচারাদের এতই ঠাণ্ডা লাগা শুরু করল যে তারা সব ঠাণ্ডায় জমে গিয়ে এক ধরনের করুণ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল, যাকে জ্যোতির্পদার্থবিদেরা বলেন 'কসমোলজিক্যাল ফেজ ট্রান্সিশন'।
এর আগ পর্যন্ত মহাবিশ্বে কণারা লাল ঝাণ্ডা তুলে সাম্যবাদের গান গাইত। কোনো কণারই ভর বলে কিছু ছিল না, পদার্থ-প্রতিপদার্থের সংখ্যা ছিল সমান ইত্যাদি। কিন্তু যে মুহূর্তে হিগস বাবাজির ঠাণ্ডা লাগা শুরু হল, অমনি সাম্য-টাম্য সব ভেঙে পড়তে শুরু করল। রাতারাতি কণাদের ভর গজাতে শুরু করল; কারও কম কারও বেশি।
কেউ চিকনা পটকা হালকা হয়ে রইল, আর কেউ-বা হিগস-ক্ষেত্রের সঙ্গে বেশি করে মিথস্ক্রিয়ায় গিয়ে আর রসদ খেয়ে হয়ে উঠল হোঁদল কুতকুত। যেমন ইলেকট্রন বাবাজি কিংবা লেপ্টন গ্রুপের সদস্যরা হালকা-পাতলা থেকে গেলেও আপ-কোয়ার্ক কিংবা W বা Z কণারা হয়ে উঠল গায়েগতরে হাতির মতন (যেমন আপ-কোয়ার্ক কণাটা আয়তনে ইলেকট্রনের সমান হলেও ওজনে ইলেকট্রনের চেয়ে ৩৫০ হাজার গুণ ভারী)।
সাম্যাবস্থা ভেঙে এই যে বিশৃঙ্খল অবস্থায় যাওয়ার ব্যাপারটাকেই কেতাবি ভাষায় বিজ্ঞানীরা বলেন 'সিমেট্রি ব্রেকিং', বাংলা করলে আমরা বলতে পারি 'প্রতিসাম্যের ভাঙন'। তবে এই অসাম্য আর বৈষম্য নিয়ে আমরা যতই অসন্তুষ্ট হই না কেন, হিগস-কণার কল্যাণে প্রতিসাম্যের ভাঙন ব্যাপারটা না ঘটলে পরবর্তীতে তৈরি হত না কোনো অণু কিংবা পদার্থ কিংবা সৌরজগত, নীহারিকা, সূর্য আর পৃথিবীর মতো গ্রহ।
এই প্রতিসাম্যের ভাঙন কীভাবে ঘটতে পারে সেটাই ১৯৬৪ সালে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পেপারের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছিলেন ছজন জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী– পিটার হিগস, জেরাল্ড গৌরালিঙ্ক, রিচার্ড হ্যাগেন, টম কিব্বল, রবার্ট ব্রাউট এবং ফ্রাঁসোয়া অ্যাঙ্গলার্ট– যাদের কথা আমরা এই প্রবন্ধের শুরুতেই জেনেছি।
এদের মধ্যে রবার্ট ব্রাউট মারা গিয়েছেন ২০১১ সালে। নোবেল পুরষ্কার মরণোত্তর হিসেবে দেওয়ার কোনো রেওয়াজ নেই; তাই রবার্ট ব্রাউট মনোনীত হতে পারেননি। বাকি তিনজন– গৌরালিঙ্ক, রিচার্ড হ্যাগেন, টম কিব্বলের গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয় সবার শেষে।
কাজেই গুরুত্ব বিচারে তারাও ছাকুনির জাল ভেদ করে উপর উঠতে পারেননি। জয়মাল্য গিয়েছে ফ্রাঁসোয়া অ্যাঙ্গলার্ট এবং পিটার হিগসের গলাতে।
নোবেল কমিটির ঘোষণা থেকে জানা গিয়েছে, তারা এ দুজনকে পুরস্কৃত করেছেন ''একটি প্রক্রিয়ার তাত্ত্বিক আবিস্কারের জন্য, যে প্রক্রিয়া উপ-পারমাণবিক কণাদের ভরের উদ্ভব বুঝতে সহায়তা করে এবং যেটি সার্নের লার্জ হ্যাড্রন কলাইডারের আটলাস এবং সিএমস-এর পরীক্ষায় নিশ্চিত করা গেছে।''
ড. অভিজিৎ রায় : মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক।