প্রথমেই জানতে ইচ্ছা করছে, হিরো আলমকে নিয়ে অভিযোগ করা ‘বিশিষ্ট’ ব্যক্তিরা কারা?
Published : 27 Jul 2022, 10:40 PM
রাস্তার কুকুরগুলোর দিকে অনেকেরই তাকানো হয় না। যারা খেয়াল করেন বা যাদের ওদের জন্য মায়া আছে, তারা অনেকেই জানেন এই কুকুরগুলো অনেকসময়ই ‘ম্যাগট’ নামের একধরনের পোকার আক্রমণের শিকার হয়। এই পোকার কাজ হলো, ছোট একটি গর্ত করে কুকুরের শরীরের ভেতরে প্রবেশ করা। তারপর বংশবিস্তার করে কুটকুট করে মাংস খাওয়া। কেবল কুকুর নয়, অন্যান্য চতুষ্পদ জন্তুও ম্যাগটের আক্রমণের শিকার হয়।
অনেক সময়ই টের পাওয়া যায় না। একসময় যখন ক্ষত বড় হয়ে যায়, তখন দগদগে মাংসসমেত মানুষের চোখের সামনে কিলবিল করা ম্যাগটগুলো ধরা পড়ে। অথচ এর চিকিৎসা খুব সহজ। কুকুর বা চতুষ্পদের যে জায়গাটা ফুটো হয়েছে, সেখানে একটু তারপিন ঢেলে দিলেই, ম্যাগটগুলো পিলপিল করে বেরিয়ে আসে, মারা যায়। কেউ সে কাজটি না করলে আক্রান্ত প্রাণিটির মৃত্যু হয় অত্যন্ত ভয়ঙ্কর কষ্ট নিয়ে।
হিরো আলমের কার্যকলাপ হচ্ছে অনেকটা সেই গন্ধযুক্ত তারপিনের মতো, যা কুকুরের শরীরের ভেতর থেকে লুকিয়ে থাকা 'ম্যাগট' বের করে নিয়ে আসে। এই 'ম্যাগট' আমাদের চিন্তশীলতা খেয়ে ফেলছে।
সংবাদ মাধ্যমের মারফত ইতিমধ্যে অনেকেই জানেন, রবীন্দ্র সংগীত গেয়ে সমালোচনার মুখে পড়া হিরো আলমকে পুলিশের জিজ্ঞাসবাদের মুখোমুখি হয়ে ‘বিকৃত’ করে আর গান না গাওয়ার মুচলেকা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে তার সঙ্গে কথাবার্তা বলে, মুচলেকাটি নেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি তিনি রবীন্দ্র সংগীত গাইলে তা নিয়ে ওঠে সমালোচনা। তিনি গান ‘বিকৃত’ করেছেন বলে বিশিষ্টজনদের কাছ থেকে অভিযোগ পেয়ে হিরো আলমকে ডেকে নেয় ডিবির সাইবার ক্রাইম ইউনিট বলে জানিয়েছেন পুলিশের ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার হারুণ অর রশিদ।
তার বক্তব্যটি ছিল, “অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি বলেছেন, এগুলো (হিরো আলমের গান) এদেশের কৃষ্টি সংস্কৃতির সাথে মিলে না এবং বিকৃত। সাইবার ইউনিটে আসা এসব অভিযোগের বিষয়টি যাচাই করে তাকে ডেকে আনা হয়। তার সাথে প্রায় দুই ঘণ্টা কথা হয়েছে। পরে দুপুরে তিনি চলে যান।”
প্রথমেই জানতে ইচ্ছা করছে, হিরো আলমকে নিয়ে অভিযোগ করা ‘বিশিষ্ট’ ব্যক্তিরা কারা? বিশিষ্টজনদের ভাষায় ‘বিকৃত সুর’ কাকে বলে? সেই গানের যদি ‘কপি রাইট’ না থাকে তাহলে পুুলিশের কাছে অভিযোগ করা যায়? দুই বাংলায় অসংখ্য অনুষ্ঠান হচ্ছে। অসংখ্য অনুষ্ঠানে নানা ভুলভাল সুরে রবীন্দ্র সংগীত হচ্ছে। প্যারোডি হচ্ছে। কাউকে ধরা হচ্ছে না। ‘হিরো আলম’- এর দিকে পুলিশের চোখ গেল কেন?
এর একটি সহজ জবাব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেটির সারমর্ম অনেকটা এরকম- হিরো আলম যে শ্রেণি থেকে উঠে এসেছেন, সেই শ্রেণি অর্থাৎ গরীবের জন্য রবীন্দ্র সংগীত নয়। কাজেই এলিট শ্রেণির কাছে তার যেকোনও কিছু ‘অ্যালার্জি’ তৈরি করছে।
তো ভাই ‘বেগুন’ খেলে যদি কারো অ্যালার্জি হয়, তাহলে বেগুন না খাওয়াই তো উচিত। আপনি হাঁচবেন, চুলকাবেন, আবার বেগুনের দোষও দিবেন- সেটি তো হতে পারে না! হিরো আলম একজন কনটেন্ট নির্মাতা। তার কাজ কনটেন্ট তৈরি করা। আপনি দেখবেন কি দেখবেন না, সেটি আপনার ব্যাপার। আপনার ভালো লাগলো না বলে আপনি পুলিশের কাছে অভিযোগ করবেন? কেন হিরো আলম কি আপনার বাড়িতে গিয়ে জোর করে গান শুনিয়ে এসেছেন?
ছায়ানট যখন রমনার বটমূলে রবীন্দ্র সংগীতের আসর পয়লা বৈশাখে শুরু করেছিল, তখন পাকিস্তানি ‘বিশিষ্টজন’দের চোখে সেটিও ছিল একটি ‘শিষ্টাচারবহির্ভূত’ সংস্কৃতি। এখনও একদল বলার চেষ্টা করে, যে ‘পয়লা বৈশাখে ছায়ানটের ওই রবীন্দ্র সংগীতের আসর কিংবা চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা আমাদের কৃষ্টি নয়।’ সত্যিকার অর্থে বাংলা ভাষাই তো এক সময় ‘শিষ্টাচার-বহির্ভূত’ ছিল।
কেউ যদি ভুল উচ্চারণে পবিত্র কোরআনের আয়াত পড়তো, আলেমরা যদি পুলিশকে অভিযোগ দিতেন- ‘উচ্চারণ ভুল করে কোরআন পড়ছে’, সেটি কেমন হতো? নিশ্চয়ই ‘রবীন্দ্র সংগীত’ গেলো বলে যে বিশিষ্টজনরা ‘ছি’ ‘ছি’ করছেন- তখন তারা হামলে পড়তো আলেমদের সমালোচনায়।
মৌলবাদকে কেন আমরা ধর্মের দিকে ঠেলে দেই বারবার? রবীন্দ্র মৌলবাদী আছে, নজরুল মৌলবাদী আছে, বাংলা নিয়ে নাকসিঁটকানো ইংরেজি মৌলবাদী আছে। এদের অভিযোগ, সমালোচনা যাচাই করার দায়িত্ব পুলিশের?
হিরো আলমকে মানুষ ‘কমেডিয়ান’ হিসেবেই দেখেন। কনটেন্ট তৈরির জগতে প্রায় শুন্য থেকে উঠে আসা হিরো আলম বুঝে হোক কিংবা না বুঝে নিজেকে হাস্যাষ্পদ করে সমাজের অন্তত দুইটি অসঙ্গতি তুলে ধরেছেন। এর প্রথমটি নির্বাচনে দাঁড়িয়ে এবং মার খেয়ে। আর দ্বিতীয়টি হলো এইবার রবীন্দ্র সংগীত গেয়ে, আমাদের একদল 'বিশিষ্ট ব্যক্তির' চিন্তার মৌলবাদিত্ব বের করে আনতে পেরে। এসব 'বিশিষ্ট, সুধী ও সুশীল'জনেরা প্রগতিশীলতার মুখোশ পড়ে আবার বাকিদের সমালোচনা করতে থামেন না।
সোশাল মিডিয়া ফেইসবুকে সাংবাদিক গাজী নাসিরুদ্দীন খোকন লিখেছেন, “বইমেলায় বইয়ের কন্টেন্ট চেক করতো পুলিশ। মনে আছে? মানে আপনার লেখা যাচাই করবে পুলিশ। সেটা মেনে নিয়েছেন বলেই আপনি রবীন্দ্র-নজরুল সংগীত কিভাবে গাইবেন তার তালিম দিচ্ছে পুলিশ। হিরো আলমকে গালি দেবার অধিকার আপনার আছে, আমার আছে। আমি দু'বেলা করে দেই। কিন্তু তাকে ইচ্ছেমত গান করতে বাধা দেবার অধিকার কারও নেই। পুলিশ তার এখতিয়ারের বাইরে কাজ করছে। এটি রাষ্ট্রীয় শৃংখলা লঙ্ঘনের সামিল।”
আরেকজন রাজনীতিবিদ ও প্রকাশক ফিরোজ আহমেদ লিখেছেন, “গোয়েন্দা পুলিশ এখন গান গাইবার সহী পদ্ধতিও ঠিক করে দিচ্ছে। সংবিধান-টংবিধানের দরকার কী!আমি জানি অনেক সমঝদার মন্তব্য করতে থাকবেন: যাই বলেন ভাই, হিরোআলমের গান রবীন্দ্রনাথের বিকৃতি...ইত্যাদি।
হিরো আলম যদি আপনাকে শুনতে বাধ্য করেন যে কোন উন্মুক্ত স্থানে লাউড স্পিকার দিয়ে, মামলা করেন। কিন্তু সে ইউটিউবে কী দিচ্ছে, সেটা নিয়ে কথা বলবার কোন অধিকার কারও নাই। আপনি শুনবেনা না, ব্যাস। আমিও শুনি না। কিন্তু অপরের ক্ষতি না করে যে কারও নিজের মত চলবার স্বাধীনতাটা রক্ষা করাটা জরুরি। এইটুকু কাণ্ডজ্ঞানেরও যদি আপনার ঘাটতি থাকে, রবীন্দ্রনাথের গান আপনি বৃথাই শোনেন।
এটা খুব নিকৃষ্ট ধরনের পুলিশীতন্ত্র, যেখানে বিরাট বিরাট অপরাধী দিব্যি ঘুরে বেড়ায় আর পুলিশ-র্যাব হিরো আলমদের গানের ব্যাকরণ শেখায়।”
সাংবাদিক রাজীব নূর তার ফেইসবুকের প্রতিক্রিয়ায় লিখেছেন,
“গান গাওয়ার অধিকার হরণ করা হচ্ছে। সহকর্মী মেহেরুন নাহার মেঘলা বলল, 'হিরো আলম তো আর বিকৃত করে গান করেন না। তিনি গান করেন। গানটা বিকৃত হয়ে যায়।’
আরেক সহকর্মী চন্দন সাহা রায় বিষয়টাকে ইতিবাচকভাবে নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলল, ‘দাদা, তোমরা কোনোকিছুই পজেটিভলি নিতে পার না। এটা তো খুবই ভালো আমাদের পুলিশ শান্তিনিকেতনের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে।'
যদিও স্বত্বাধিকার আইনে রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে মোড়লগিরি করার অধিকার শান্তিনিকেতনেরও আর নেই। তবু কথাটা আমার ভালোই লেগেছে। যদি আমাদের পুলিশ বাহিনী এখন থেকে নিয়ম করে গান শুনে, গান শেখে, খুব ভালো হয়। বলে রাখা ভালো, আমি মাহফুজুর রহমান থেকে হিরো আলম, কারোর গান শুনি না। কাউকে নিয়ে কথাও বলি না।”
উপরের তিনটি মন্তব্য থেকে অনেককিছুই পরিষ্কার হয়ে যায়। এ বিষয়ে কিছু আর না বললেও হয়। গান গাওয়া নিয়ে আইনের কত ধারায় কী আছে, সেটার ব্যাখ্যা কী- সে প্রসঙ্গে না গিয়ে আমি বরং আমার আরেক সাংবাদিক সহকর্মীর কথা দিয়েই শেষ করি।
তিনি বিদ্রুপ করে বলেছেন, “পুলিশ বরং ভালো কাজ করেছে। তারা হিরো আলমকে ডেকে গ্রেপ্তার করেনি, ডলা দেয়নি, রিমান্ডে নেয়নি। এমনকি আদালতে তুলে হয়রানিও করেনি। কেবল একটু বুঝিয়ে বলেছে। এটাতে কেবল দোষ ধরা হচ্ছে কেন?”